বিশ্ববিদ্যালয়ে কলেজ অধিভুক্তির সিদ্ধান্ত কেন যুক্তিসঙ্গত?

শিশির ভট্টাচার্য্যশিশির ভট্টাচার্য্য
Published : 8 April 2017, 04:10 AM
Updated : 8 April 2017, 04:10 AM

দক্ষিণ এশিয়ার অন্য সব দেশের মতো বাংলাদেশের কলেজগুলোও ১৯৯২ সাল পর্যন্ত কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত ছিল। সে সময় কলেজ থেকে তিন বৎসরের অনার্স পাস করে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বছর মাস্টার্স পড়ত। যারা কলেজ থেকে দুই বৎসরের পাসকোর্সে স্নাতক পাস করত তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই বছরে মাস্টার্স করত। কলেজ থেকে অনার্স করে আসা শিক্ষার্থীদের অবজ্ঞাভরে 'পিলু' এবং দুই বৎসরের স্নাতক পাস করে আসা শিক্ষার্থীদের 'কলু' বলে ডাকত বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত ছাত্ররা, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষকেরাও। কলু এবং পিলুরা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে হীনম্মন্যতায় ভুগত, অনেক ক্ষেত্রে শারীরিক-মানসিক অত্যাচারেরও শিকার হত।

এই অপসংস্কৃতির কারণ মূলত অর্থনৈতিক। বিসিএসসহ যে কোনো চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে ন্যূনতম যোগ্যতা স্নাতক ডিগ্রি। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ই স্নাতক বা মাস্টার্স ডিগ্রি প্রদান করত, সেহেতু কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় নির্বিশেষে প্রাপ্ত ডিগ্রির মান সমান ছিল। চাকরির বাজারে বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় নিম্নশ্রেণির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কলেজের ডিগ্রিধারী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী একই সুবিধা পাবে– বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত শিক্ষার্থীরা এ ব্যাপারটা মেনে নিতে পারত না। কলেজের শিক্ষার্থীদের অবজ্ঞাসূচক 'কলু' ও 'পিলু' ডাকার উদ্দেশ্য ছিল সমাজে, বিশেষ করে বিসিএসসহ সম্ভাব্য নিয়োগকর্তাদের মনে এমন একটা কুসংস্কার সৃষ্টি করা যে বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলে তো কথাই নেই!) থেকে অনার্স পাস করা শিক্ষার্থীরা তুলনামূলকভাবে বেশি স্মার্ট, জ্ঞানও তাদের অনেক বেশি।

কূটাভাষ হচ্ছে, রাষ্ট্রপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, দেশের প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ বাংলাদেশের প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নন, কলেজের ছাত্র ছিলেন।

১৯৯২ সালে বিএনপি সরকার 'জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়' নামে নতুন একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে সরকারি/বেসরকারি কলেজগুলো পরিচালনার দায়িত্ব সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর অর্পণ করে। এই সিদ্ধান্ত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আহ্লাদের কারণ হয়, কারণ এতে করে কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিকে গুলিয়ে ফেলার সম্ভাবনা আর থাকে না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্ব কখনও সমান নয় বাংলাদেশে, জনগণের চোখে তো বটেই, সরকারের চোখেও। উপাচার্য নিয়োগে সরকারের পছন্দের অনুক্রমের দিকে তাকালেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে।

আড়াই দশক পর ২০১৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কলেজগুলোকে আবার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত করা হবে। নিন্দুকেরা বলবেন, এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের মূল কারণ বাংলাদেশের রাজনীতির বিশেষ ধরন। যেহেতু এরশাদ উপজেলা ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিলেন, সেহেতু সে ব্যবস্থার যত ভালো দিকই থাক না কেন, বিএনপি সেটা বাতিল করেছিল। যেহেতু বিএনপি সরকার কলেজগুলোকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতামুক্ত করেছিল, সেহেতু আওয়ামী লীগ সরকারকে অবশ্যই কলেজগুলোকে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করতে হবে।

ঢাকার সাতটি কলেজ ইতিমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) অধিভুক্ত হয়েছে। ঢাবি শিক্ষার্থীরা সরকারের এই সিদ্ধান্তে খুশি হতে পারেনি। ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজ, মিরপুর কলেজ বা তিতুমীর কলেজের মতো প্রতিষ্ঠান ঢাবির 'পবিত্র লোগো' ব্যবহার করবে, ঢাবির ছাত্র হিসেবে খেলাধুলায় অংশ নেবে, ভাবা যায়? এদিকে ঢাবিতে অধিভূক্ত গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ চাইছে ঢাবির ইনস্টিটিউট হিসেবে স্বীকৃতি পেতে। এই অধিভুক্তি এবং অধিভুক্ত হওয়ার খায়েশ উভয়েরই প্রতিবাদ করেছে ঢাবির ছাত্ররা। স্বতঃস্ফূর্ত এই প্রতিবাদে বিরোধী দলের ন্যূনতম হস্তক্ষেপ নেই– এ কথা যিনি বলবেন, তাকে শুধু স্মরণ করিয়ে দেব, বিনা ইন্ধনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বিরল।

দাবি আদায়ের লক্ষে গার্হস্থ্য অর্থনীতির ছাত্রীরা নীলক্ষেত মোড় অবরোধ করলে তাদের বাধা দিতে এগিয়ে আসে ঢাবির সোনার ছেলেরা। দুই যুধ্যমান শিক্ষার্থীদলের হট্টগোলে ব্যবসার ক্ষতি হওয়ার অজুহাতে প্রতিবাদ মিছিল বের করে নীলক্ষেতের হকাররা, কার ইন্ধনে কে জানে। সম্প্রতি এই তিন দলের আন্দোলনে স্থবির হয়ে পড়েছিল নীলক্ষেত এলাকা। এদিকে কলেজ অধিভুক্তির প্রতিবাদে টিএসসি এলাকায় যখন ছাত্রদের সমাবেশ হচ্ছিল তখন সেখানে নাকি ঢুকে পড়েছিল জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) একটি বাস। মূহূর্তে বাস ভেঙে চুরমার। কলেজ অধিভুক্তির সঙ্গে জাবির কোনো সম্পর্ক না থাকতে পারে, কিন্তু চাকরি বা প্রেস্টিজের বাজারে জাবির সঙ্গে ঢাবির একটা রেশারেশি তো আছেই। এই সুযোগে জাবিকে এক হাত নেওয়া গেলে মন্দ কী!

জাবির ছাত্ররাও কিছু কম যায় না। বিপদের আশঙ্কায় ঢাবি তাদের বাসগুলোকে পই পই করে জাবির ত্রিসীমানায় যেতে বারণ করেছিল। কিন্তু মাথা খারাপ এক ড্রাইভার পথ ভুলে ঢুকে গিয়েছিল জাবির চৌহদ্দীতে। ব্যস, আর যায় কোথা! জাবির সোনার ছেলেদের হাতে ঢাবির বাস চুরমার হতে দেরি হয়নি। বাংলাদেশ একটি মজার দেশ। শুধু তাকিয়ে থাকতে জানলে এ দেশে বিনোদনের জন্যে নাটক-সিনেমা-টেলিভিশন কিছুরই দরকার পড়ে না।

ঢাবি উপাচার্য অবশ্য ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন, অধিভুক্ত হওয়া মানেই ঢাবির অংশ হওয়া নয়। অধিভুক্ত কলেজগুলো নিজ নিজ লোগোই ব্যবহার করবে এবং এসব কলেজের শিক্ষার্থীরা ঢাবি শিক্ষার্থী হিসেবে খেলাধুলায় অংশ নিতে পারবে না। কলেজগুলোর ডিগ্রি ঢাবিই দেবে বটে, কিন্তু সার্টিফিকেটে নিজ নিজ কলেজের নাম লেখা থাকবে। আসল ঢাবি ছাত্রদের সার্টিফিকেটে লেখা থাকবে নিজ নিজ হল এবং বিভাগের নাম।

মুড়ি আর মুড়কির এক দাম হবে না, দুই ঢাবির মধ্যে পার্থক্য থাকবে। শুনে ভবী ভুলেছে কিনা কে জানে।

ঢাবিতে স্থানীয় কলেজের অধিভুক্তির বিরোধিতা যারা করছে, তাদের জ্ঞাতার্থে জানাই, বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন কলেজের অধিভুক্ত হওয়াটা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনা ও বিকাশের ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। 'কলেজ' নামক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির সূচনা প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্যারিস থেকেই এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি অক্সফোর্ড-কেমব্রিজে এবং পৃথিবীর অন্যত্র ছড়িয়ে গিয়েছিল। যে অক্সফোর্ড বা কেমব্রিজের আদলে ঢাবি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেই দুই বিশ্ববিদ্যালয় এখনও নেহায়েতই কতগুলো কলেজের সমষ্টি মাত্র।

ত্রয়োদশ শতকে যখন বিশ্ববিদ্যালয় নামক প্রতিষ্ঠানটির সূচনা হয়, তখন কলেজগুলো ছিল নিছক দরিদ্র শিক্ষার্থীদের ছাত্রবাস। ধীরে ধীরে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক কার্যক্রমই কলেজের অঙ্গীভূত হতে থাকে। ডিগ্রি পাওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট সংখ্যক বক্তৃতায় উপস্থিত থাকার বাধ্যবাধকতা ছিল। দিনের বেলা শিক্ষার্থীরা অধ্যাপকদের যেসব বক্তৃতা শুনত রাতের বেলা কলেজের হাউজ টিউটর সেগুলো শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে দিতেন, অথবা টিউটরের সামনে আবাসিক ছাত্রদের সকালে শোনা বক্তৃতার বিষয়গুলো পুনরাবৃত্তি করতে হত।

কলেজগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ার আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বাইরে ঘরভাড়া করে ছাত্রদের পড়াতেন। একসময় তারা কলেজে এসেই বক্তৃতা করতে শুরু করলেন। পঞ্চদশ শতক থেকে কলেজের অধ্যাপকদের বক্তৃতার গুরুত্ব বেড়ে গেল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের বক্তৃতা শোনাটা নিছক আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবশিত হল।

ষোড়শ শতকের শুরুতে শুধুমাত্র কলেজের বক্তৃতায় উপস্থিত থেকেই ডিগ্রি পাওয়া সম্ভব ছিল। কালক্রমে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে ১৪৪৫ সালে ফ্রান্সের রাজার কাছে লেখা এক আবেদনপত্রে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় জানিয়েছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব শিক্ষার্থীই কলেজে আবাসিক। কলেজে যারা থাকতো না তাদের 'ননকলেজিয়েট' বা অনাবাসিক বলে গণ্য করা হত এবং তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি দেওয়া হত না। 'ননকলেজিয়েট'-এর ধারণাটা বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় এখনও ব্যবহৃত হয়।

কলেজের অভ্যন্তরীণ প্রশাসন কিভাবে কাজ করবে সেটা নির্ধারণ করত প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়। কলেজগুলো তাদের অধ্যক্ষ নির্বাচন করত বটে, কিন্তু তাদের নিয়োগ অথবা অব্যাহতি দিত বিশ্ববিদ্যালয়। কলেজের উপর প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ অনেক সময় ক্লাসরুম পর্যন্ত গড়াত, অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের সদস্যরা গিয়ে দেখতেন, কলেজের অধ্যাপক ঠিকমতো পড়াচ্ছেন কি না। অক্সফোর্ড-কেমব্রিজের কলেজগুলো তুলনামূলকভাবে স্বাধীন ছিল।

বর্তমান পৃথিবীর সব বিশ্ববিদ্যালয় কমবেশি মধ্যযুগের প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে গঠিত হয়েছে। প্যারিসের প্রায় সব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কলেজ ও ইনস্টিটিউট প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত ছিল। এখনও পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ডিগ্রি প্রদানের জন্য কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত হতে হয়।

স্রেফ কলেজগুলো চালানোর জন্যে একটি বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টি করার যে সিদ্ধান্তটি বিএনপি সরকার নিয়েছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবর্তনের ইতিহাসে সেটা অভূতপূর্বই শুধু নয়, অস্বাভাবিকও বটে। কলেজগুলোকে এক একটি প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার যে সিদ্ধান্ত বর্তমান সরকার নিয়েছে, অন্ততপক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনা ও বিকাশের দৃষ্টিকোণ থেকে সেই সিদ্ধান্তটিকে অস্বাভাবিক বলার সুযোগ নেই।

যে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঢাবির অধিভুক্ত করা হচ্ছে, সেগুলোকেও একসময় সমন্বিত ভর্তিপরীক্ষার আওতায় আনা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে কোনো কোনো ঢাবি ছাত্র এখন যেমন বলছে, 'ভর্তি পরীক্ষায় পাস করে আমরা ঢাবির ছাত্র হওয়ার গৌরব অর্জন করেছি', কলেজের ছাত্ররাও সে গৌরবের অংশীদার হতে পারবে। যেখানে জনগণের পয়সাতেই অন্তর্ভুক্ত এবং অধিভুক্ত সব ধরনের পাবলিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চলছে, সেখানে জনগণের কষ্টের পয়সায় কেনা বাস (সে ঢাবির হোক বা জাবির হোক) ভাঙার অধিকার জনগণের সুপুত্রদের (অন্যমতে, বহিরাগত সমাজবিরোধীদের) কে দিয়েছে? যদি কোনোদিন অন্তর্ভুক্ত এবং অধিভুক্ত উভয় প্রকার প্রতিষ্ঠানে উচিত শিক্ষার ব্যবস্থা করে শিক্ষার্থীদের মনে যুক্তিবোধ জাগ্রত করা সম্ভব হয়, তবেই হয়তো বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আত্মধ্বংসী রাজনীতির করাল থাবা ধীরে ধীরে শিথিল হতে শুরু করবে।