কুমিল্লায় নৌকাডুবি

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 1 April 2017, 04:18 AM
Updated : 1 April 2017, 04:18 AM

বাংলাদেশের ভোটের রাজনীতি আর উন্নয়নের রাজনীতি এক বিষয় না। এটা আওয়ামী লীগ জানলেও মানতে চায় না। এমনকি মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতার চেতনা আর দেশে ভোটে জেতাও এক না। সেটা যে কত নির্মম হতে পারে তা আমরা দেশমুক্ত হওয়ার পরপরই টের পেয়েছিলাম। শ্রুত যে তিয়াত্তরের নির্বাচনে ঢাকার সূত্রাপুর-কোতায়ালী নিবার্চনী এলাকায় বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ভোটে দাঁড়িয়ে তখন অখ্যাত মেজর জলিল ৭০ হাজারের মতো ভোট পাওয়ার পর জাতির জনক স্বয়ং বিস্ময় প্রকাশ করে নাকি বলেছিলেন:

"এমনটা আমাকে আগে বুঝতে দেওয়া হয়নি কেন?"

এখনও সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। শীর্ষ নেতৃত্বকে স্তুতি আর বন্দনায় ব্যস্ত রেখে যে যার মতো আখের গোছানোর রাজনীতি অতীতে অনেক দলের নেতানেত্রীদের প্রায় শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসলেও দলীয় নেতা ও স্তাবকদের হুঁশ ফেরেনি। কারণ তারা আছে আখের গোছানোর ধান্দায় ব্যস্ত।

শেখ হাসিনা নিজের ক্যারিশমা ও ইমেজে যত উজ্জ্বল হচ্ছেন এরা ততই তাঁকে বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছেন। আপনি দেখবেন আওয়ামী লীগের নেতা, মন্ত্রী বা যে কেউ কোনো ভাষণে বা বক্তৃতায় নিজেদের কথা বলেন না। তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব কিংবা কাজের কথা বলার চেয়ে পুরো সময় প্রধানমন্ত্রীর বন্দনায় মত্ত থাকেন। মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় এরা কি আসলে প্রশংসা করছেন নাকি কৌশলে শেখ হাসিনার ইমেজের ১২টা বাজাতে নেমেছেন? এ জাতীয় মোসাহেবী এবং দল ও দলের কাজ বাদ দিয়ে প্রশংসার নামে কথা বলার ভেতর দিয়ে তারা যে অন্যায় করছেন তার একটা বড় প্রমাণ কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের (কুসিক) নির্বাচনী ফলাফল।

কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি তথা ধানের শীষের বিজয় হয়েছে। এ নিয়ে কথা বলা বা লেখার লোকের অভাব নেই দেশে। আমরা যারা দূরে থাকি এবং নিয়মিত দেশের ঘটনার আঁচ টের পাই আমাদের জন্য এটি কোনো বড় খবর না। কারণ এ কথা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, যাবতীয় উন্নয়ন বা দেশের অগ্রগতির পর ও বদলে যাওয়া মন-মানসিকতায় এরাই মানুষের মনে জায়গা নিয়ে বসে আছে। শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত ইমেজ আর তাঁর একক নেতৃত্বের বাইরে আওয়ামী লীগের নেতাদের কর্মকাণ্ড কিংবা ভূমিকা মানুষকে নানাভাবে বিরক্ত করলেও তারা তা টের পায় না।

একশ্রেণির সুশীল ও বুদ্ধিজীবী এখন যত কাঁদুন আর যতই বলুন দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠা মানে আওয়ামী লীগ– এটা কেউ মানে না। না-মানার কারণ তাদের খাই খাই মনোভাব। একদিকে যেমন আয়-উন্নতি, আরেকদিকে আছে এদের স্বেচ্ছাচারিতা।

সাধারণ মানুষ খুব ভালোভাবে জানে চাঁদা ছাড়া কাজ মেলে না। অফিস-আদালতে, ব্যবসা-বাণিজ্যে মাসোহারা ও নজরানা দেওয়া এখন খুব স্বাভাবিক ঘটনা। নিজেদের প্রভু ভাবার এ বিশেষ ব্যবস্থাকে অন্যায় মনে না করার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের নেতাদের চাইতে পটু কেউ নেই। আর বড় দল বলে তাদের মনোভাবে ছায়া দেওয়ার পরিবর্তে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা ও দলীয় ষড়যন্ত্র খুব সাধারণ ঘটনা।

কুমিল্লাতে বিএনপির বিজয়ে বা প্রাপ্ত ভোটে খালি সংখ্যাগুরু মুসলমানদের অবদান আছে– এটা ভাবা ভুল। সামাজিক মিডিয়ায় এ যাবৎ দেখা বিভিন্ন মন্তব্য আর মতামতে আমি দেখেছি, সংখ্যালঘু নামে পরিচিত জনেরাও মহাখুশি। কারণ আদর্শের নামে বা চেতনার নামে আপনি যেমন জোব্বা পরিয়ে রাখতে পারেন না, তেমনি কাউকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিতও করতে পারেন না।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার যে দিকটা হারিয়ে দেশ ও সমাজ আজ নিঃস্ব সে দিকটা আওয়ামী লীগের মাথায় নেই। তারা মনে করে প্রশাসন আর বাহিনী সঙ্গে থাকলেই চলবে। এই একই খেলা খেলতে গিয়ে বিএনপি আজ দেউলিয়া প্রায়। জনগণের 'পালস' বা মনোভাব বুঝতে না-পারার বড় কারণ জনবিচ্ছিন্নতা। সেটা যে কত প্রকট তা এই দলের সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যেই স্পষ্ট। তিনি যে বললেন 'দলে কাউয়া ঢুকেছে।' এই কাক বা কাউয়া কিন্তু সকাল বেলায় ঘুম ভাঙানোর কা কা কাউয়া না। এটা ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্ট কিংবা যেখানে খাবার সেখানে জমায়েত লোভী কাকদের কা কা আওয়াজ। খেতে খেতে আজ এমন এক জায়গায় যাতে মানুষ সুযোগ পেলেই তাদের বিরূপ মনোভাবের জানান দিচ্ছে।

সাক্কু সাহেবকে অভিনন্দন জানিয়েই বলি, আমরা ভয় পাই অন্য কারণে। দেশে একটা সমান্তরাল পরস্পরবিরোধী রাজনীতি চলছে। জঙ্গির মতো ভয়াবহ বাস্তবতাকে একদল যেমন ফাঁদে না-পড়া পর্যন্ত আইএসের কাজ মনে করে না, আরেকদল বলে এটাই চলার কথা। বিএনপি দ্বিতীয় ধারার দল। তাদের আমলে জঙ্গিবাদের হাতে খড়ি। তারা যদি মনে করে থাকে তাদের দেশশাসনে দেখলেই জঙ্গিরা নিজেরা 'সাইজ' হয়ে যাবে, বা বলবে আপনারা আছেন বলে আমরা এসব বাদ দিয়ে ভালো হয়ে গেলাম, তবে মারাত্মক ভুল হবে।

একটা কথা মনে করিয়ে দিই আওয়ামী লীগের নেতাদের তুলনায় বিএনপির নেতারা গেট-আপে, পোশাকে, আচরণে অনেক মডার্ন। তারা লেবাসের জন্য দাড়ি-টুপি পরেন না। তাদের এই আধুনিকতা জঙ্গিদের পছন্দ হওয়ার কথা নয়। তারা এদের ছাড় দেবে এমন ভাবারও কোনো কারণ নেই।

কুমিল্লার এই ফলাফল আমাকে একটা কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে– আওয়ামী লীগে মোশতাকদের জায়গা ও ভূমিকা এখনও অটুট। মনে রাখা দরকার, জিয়াউর রহমানকে আপনারা যত গালাগাল করেন আর দোষারোপ করেন, তাঁর আগমনের দুয়ার খুলে দিয়েছিল খন্দকার মোশতাক। সে ইতিহাস থেকে আপনারা যদি কিছু শিখতেন কুমিল্লায় হয়তো হারতেন না।

আর একটা বিষয়, দুনিয়ার সব খেলায় সমানে সমান না হলে যেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় না, তেমনি না খেলতে খেলতে নিজেদের শক্তিও টের পাওয়া যায় না। যেমন: মোহামেডান বনাম আবাহনী। যেমন: আর্জেন্টিনা বনাম ব্রাজিল, বা ভারত বনাম পাকিস্তান অথবা ইংল্যান্ড বনাম অস্ট্রেলিয়া। এদের খেলায় যেমন মানুষ হামলে পড়ে তেমনি এরা পরস্পর খেলে বলেই টেকনিক জানে, কৌশল বোঝে এবং একজন আরেকজনকে টপকে যায়। আপনি যদি তা না করে ভুটান আর মালদ্বীপের সঙ্গে খেলতে থাকেন, নিজেকে এরশাদের সঙ্গে খেলে বা ওয়াক ওভার নিয়ে জয়ী ভাবেন, তখন যে কোনো শক্ত মোকাবেলায় আপনিই হারবেন।

এখন অনেকে বলবেন, সরকার লোকাল প্রশাসন বা স্থানীয় নির্বাচনে ছাড় দিয়ে বিএনপিকে আসলে জাতীয় নির্বাচনে আনতে চাইছে। এতে প্রলুব্ধ হয়ে তারা আসবে এবং গো হারা হারবে। কিন্তু কিভাবে? যে মানুষগুলো এসব নির্বাচনে ধানের শীষে ভোট দিয়েছে তারা জাতীয় নির্বাচনে মত বদলাবে কোন দুঃখে? তাহলে আপনারাই স্বীকার করে নিচ্ছেন তখন ফলাফলে তারতম্য করা হবে!

আর বিএনপিকেও বলি, কথা বলার সুর বদলান। দুই প্রান্তে দুই জনকে রেখেছেন। সুবেশী ভদ্র বাংলায় কথা বলার ফখরুল সাহেব জিতলে বলবেন, এই তো বলেছিলাম না দেশের মানুষ আসলে নৌকাকে চায় না। এটাই তার প্রমাণ। কারচুপি না হলে আমরা আরও বেশি ভোটে জিততাম। আর হারলে রাগীমুখো রিজভী সাহেব বলবেন, সব নীল নকশা। আগেই আমাদের হারিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই বৈপরীত্য বন্ধ করে লাইনে আসুন। জনগণকে শ্রদ্ধা করুন।

কোনো ধরনের বাড়াবাড়ি বা অতি দানব এ দেশের মানুষ পছন্দ করে না। তারা খুব ভালো করে জানে, কাকে কখন কোন ট্রিটমেন্ট দিতে হয়। সেটা যদি তারা না করতো এ দেশ যেমন স্বাধীন হত না, তেমনি ইতিহাসে রাজাকরদের ফাঁসিও দেখতে হত না। তারপরও আজ যখন নৌকার এই পরাজয় দেখি তখন মেনে নিই বদলে যাওয়া মানসিকতার জন্য আমরা সবাই কমবেশি দায়ী। কুমিল্লা সেটাই আবার প্রমাণ করে দিয়ে গেছে।

নৌকাডুবির এই সংকেত ধানের শীষে হাওয়া দিলেও জনগণের মনে কী বাতাস বইয়ে দিল– সেটা জানাই এখন জরুরি।