বিজেপির উত্তরপ্রদেশ জয় এবং হিন্দু রাষ্ট্রের স্বপ্ন

সুখরঞ্জন দাশগুপ্তসুখরঞ্জন দাশগুপ্ত
Published : 30 March 2017, 04:36 AM
Updated : 30 March 2017, 04:36 AM

২৫ বছর আগে আযোধ্যার বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মামলা আবার নতুন করে উঠে এসেছে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে। ফলে লালকৃষ্ণ আদবানি, মূরলী মনোহর যোশী, কালরাজ মিশ্র, উমা ভারতীর মতো শীর্ষ বিজেপি নেতাদের জেরার মুখে পড়তে হতে পারে। সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, মন্দির-মসিজদ বিতর্কের মামলা ২৫ বছরে কেন, ৫০ বছরেও সমাধা হবে না। যুযুধান পক্ষরা নিজেরাই এই সমস্যা নিজেদের মতো করে আলোচনার মাধ্যমে মিটিয়ে নিক।

সুপ্রিম কোর্টের এই মন্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করেছে রাজনৈতিক দলগুলি। এরই মধ্যে অযোধ্যায় রাম মন্দিরের প্রস্তাবিত নির্মাণস্থল দেখতে সোমবারই অযোধ্যা যাচ্ছেন উত্তর প্রদেশের সদ্য-নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। আর তা নিয়েই শুরু হয়েছে নতুন জল্পনা। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগেই অবশ্য আদিত্যনাথ বলেছিলেন: "মামলা মামলার মতো চলবে, এদিকে রাম মন্দির তৈরির কাজও চলবে।"

এবার দেখা যাক একজন সন্ত থেকে কিভাবে পুরোদস্তুর মুখ্যমন্ত্রী হয়ে উঠলেন যোগী আদিত্যনাথ।

হিন্দুত্বের জাদুতে উত্তরপ্রদেশের তখন দখলে মোদি তথা বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবারের ছক ১৬ আনার জায়গায় ৩২ আনা সফল। এই ফলিত সাফল্যের অনুপ্রেরণায় ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনেও লক্ষ্মৌ বিজয়ের মতো খেল দেখাতে চায় তারা। হাতে সময় বাাকি আর দুবছর। এর মধ্যে প্রত্যেকটা দিনই চড়চড় করে চড়তে থাকবে হিন্দুত্ব ঢাকের বাদ্যি। আর এই বাদ্যিতে নরেন্দ্র মোদির পাশে আরও এক যুৎসই বাজনদার হিসেবেই খাড়া করা হল যোগী আদিত্যনাথকে। গোটা উত্তরপ্রদেশ মুখারিত 'জয় শ্রীরাম' ধ্বনির মধ্যে ৪৭ জন মন্ত্রীকে ও সেই সঙ্গে দুজন উপমুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে শপথ নিয়েছেন তিনি।

ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য সঙ্ঘ পরিবারের আজন্ম স্বপ্ন। কিন্তু তাকে সফল করতে বিজেপিসহ তাদের যাবতীয় রাজনৈতিক শাখা-প্রশাখার সর্বত্রই এতদিন বহিরঙ্গে ছিল ভারতীয় সংবিধান ও গণতান্ত্রিক বাতাবরণের খোলাস। কিন্তু গত শুক্রবার সেই খোলস সম্পূর্ণ খসিয়ে দিয়ে গোটা সঙ্ঘ পরিবার এবার যে নিজেদের আসল চেহারায় অবতীর্ণ হল তার চাক্ষুষ প্রমাণ উত্তরপ্রদেশ নামক ভারতের সবথেকে গুরত্বপূর্ণ এবং বৃহত্তম রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে এমন একজনকে বেছে নিল যাঁর চলন-বলন-আচরণ ও আবরণ সবটারই রং গেরুয়া।

স্বভাবতই আজ থেকে ২৫ বছর আগে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের দিন ভারতের ভাগ্যাকাশে যদি প্রথম ধূমকেতুর আবির্ভাব হয়, তবে গত শুক্রবার তার পাশে উদয় হল সাম্প্রদায়িকতার আরেক ধূমকেতু। বলা বাহুল্য, অচিরেই দেশজুড়ে এক আতঙ্কের শীতল বাতাস বয়ে যেতে শুরু করেছে, দেশের সর্বত্র রাজনৈতিক অঙ্গনে। যার প্রতিফলন হিসেবে সিপিআই (এম)-এর সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরির সাবধানবাণী: "হিন্দু রাষ্ট্র গড়ার লক্ষ্যেই যোগীকে মুখ্যমন্ত্রী করা হয়েছে।"

এক্কেবারে ছক বাঁধা নিখুঁত অংক। উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনী পর্বের একেবারে গোড়া থেকেই ছিল রগরগে হিন্দুত্বের আবেগ। তার প্রথম প্রমাণ ৪০৩ আসনবিশিষ্ট রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে একটি কেন্দ্রেও দাঁড় করানো হল না একজনও মুসলিম প্রার্থীকে। এই একটি ঘটনাতেই সঞ্চারিত হযেছিল এক জোড়া বার্তা। তার একটি হল, হিন্দু আবেগকে নতুন করে চাগিয়ে তোলা, চাগিয়ে তোলা মুসলিম-বিদ্বেষ।

বেশ কয়েকমাস আগে থেকেই সুপরিকল্পনায় বীজ বপণ করা হচ্ছিল সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের– গোমাংস ভক্ষণের বিরুদ্ধে হিংস্র আচরণের মাধ্যমে। একই সঙ্গে রটিযে দেওয়া হযেছিল দ্বিতীয় বার্তা মুসলিমদের প্রতি– 'হয় বশ্যতা মানো, নয় বিপদ জানো'।

যার পরিণতিতে আতঙ্কে, বলা ভালো, ধনে-প্রাণে বেঁচে থাকার তাগিদে মুসলিম ভোটারদের একটা বৃহৎ অংশ ভোট দিতে বাধ্য হয়েছিল বিজেপিকে। বিজেপিকে ভোট দেওয়া ওই মুসলিম ভোটাররাও জানতেন, রাজ্যে এই ভোটে বিজেপির জেতা মানে এ দেশে মুসলিমদের বিপদ আরও ঘনিয়ে আসা। কিন্তু তারা এ-ও বুঝেছিল, এই ভোটে বিজেপিকে ভোট না দেওয়ার মানে বিপদ এখনই ডেকে আনা।

এরপর নির্বাচনী প্রচারে কী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, কী বিজেপি দলপতি অমিত শাহ উন্নয়নের হরেক রকম মধু-মাখা বুলির পাশাপাশি প্রকাশ্যেই ছড়াতে থাকেন সাম্প্রদায়িকতা ও উদগ্র হিন্দুত্বের বিষ ও বাষ্প।

হয়তো এত বিশাল নির্বাচনী জয়ের পর, যে নির্বাচনে সুমলিমরাও ব্যাপক সংখ্যায় ভোট দিল বিজেপিকে ঠিক এখনই কোনো মুসলিম-বিদ্বেষী প্রত্যক্ষ জেহাদে নেমে পড়ছে না হিন্দুত্বের ভৈরব বাহিনী। তাই নির্বাচনে একজনও মুসলিম প্রার্থী দাঁড় না করানো সত্ত্বেও নামকাওয়াস্তে মন্ত্রিসভায় একজন মন্ত্রী রাখা হয়েছে ওই সম্প্রদায় থেকে। তিনি হলেন প্রাক্তন ক্রিকেটার মহসিন রাজা। তাঁকে করা হযেছে সংখ্যালঘু দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী।

তবে এটা নেহাতই একটি নির্লজ্জ পরিহাস ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ মুসলিম ছাপ মারা যে ব্যক্তিকে মন্ত্রী হিসেবে নিয়ে সংখ্যালঘু বিদ্বেষের উগ্র চেহারাকে আড়াল করার প্রচেষ্টা হল, তিনি আসলে রাজ্য বিধানসভার সদস্যই নন। তাকে জিতে আসতে হবে নতুন করে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে। সেটা সম্ভব কোনো একজন হিন্দু বিধায়কের স্বেচ্ছা ও দয়াপরবশ হয়ে পদত্যাগের মাধ্যমে শূন্য করে দেওয়া আসন থেকে।

যোগী আদিত্যনাথ আদতে কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বই নন। বিভিন্ন সময় তিনি বিধাযক-সাংসদ পদ অলঙ্কৃত করলেও আপাদমস্তক তিনি হিন্দুধর্মীয় নেতা। পূর্ব উত্তরপ্রদেশের গোরখপুরের গোরখনাথ মঠের বর্তমান মহন্ত তিনি। তাঁর গুরু এবং সেই গুরুর গুরুও ওই মঠেরই অধ্যক্ষ ছিলেন। সঙ্ঘ পরিবারের রাম মন্দির তৈরি বা হিন্দু মহাসভা কর্মসূচির সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রযেছে এই মঠটির। তাঁর গুরু অবৈদ্যনাথই হাতে ধরে আদিত্যনাথকে ১৯৯৮ সালে লোকসভায় প্রার্থী করেন। সেই মঠে আশ্রয়প্রার্থীদের নিয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন হিন্দু যুববাহিনী। দাঙ্গা বাঁধানো এবং গোলমাল পাকানোর কাচে তারা সিদ্ধহস্ত। ঘোর নারীবিদ্বেষী বলে চিহ্নিত এই যোগী আদিত্যনাথই বিজেপির হুইপ উপেক্ষা করেই সংসদে মহিলা সংরক্ষণ বিলের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিলেন। উত্তরপ্রদেশের নতুন এই মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অন্তত এক ডজন ফৌজদারি মামলা রয়েছে।

৯৬ একর জমির ওপর তৈরি কাঁসিরাম উপবনে ৪৬ সদস্যের মন্ত্রিসভাকে নিয়ে শপথ নিয়েছেন যোগী আদিত্যনাথ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী থেকে শুরু করে বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ, আশেপাশের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী থেকে হেভিওয়েট কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, এমনকি প্রবীণ লালকৃষ্ণ আদবানি, মূরলী মনোহর যোশী, বাদ যাননি কেউ-ই। আমন্ত্রণ গিয়েছিল বিরোধী শিবিরেও। ছেলে অখিলেশ যাদবকে নিযে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন মুলায়ম সিং যাদবও।

শপথ গ্রহণের পর বরাবর বতির্কিত মন্তব্যের জন্য শিরোনামে আসা যোগী আদিত্যনাথ বলেছেন: "আমাদের সরকার কোনোরকম বিভেদ ছাড়াই সমাজের সব অংশের মানুষের জন্য কাজ করবে। এই সরকার সব কাজের জন্য দায়বদ্ধ থাকবে। প্রধানমন্ত্রীর 'সবকা সাথ, সবকা বিকাশ'-এর লক্ষ্যেই উত্তরপ্রদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাব আমরা। এই রাজ্য ১৫ বছর পিছিয়ে আছে। তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই এখন একমাত্র লক্ষ্য।"

নরেন্দ্র মোদী অবশ্য মন্ত্রিসভা শপথ নেওয়ার আগেই তাঁর ট্যুইট-বার্তায় স্পষ্ট করে দিয়েছেন: "উত্তরপ্রদশকে উত্তমপ্রদেশ বানানোর লক্ষ্যে নতুন সরকার সবরকম চেষ্টা চালাবে। এই রাজ্যে রেকর্ড উন্নয়ন হবে। উন্নয়নই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য। উত্তরপ্রদেশের উন্নয়ন হলে গোটা দেশের উন্নয়ন হবে।"

এদিকে রাজনৈতিক মহল মনে করছে, মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে যোাগীর নির্বাচন ২০১৯-এর প্রস্তুতিরই অঙ্গ। সমীক্ষা বলছে, এবার উত্তরপ্রদেশের পুরো হিন্দু ভোটই হস্তগত করতে পেরেছে মোদী শিবির। বিরোধীদের ভোট ভাগাভাগিতেই বিজেপির সাফল্য এসেছে। তবে উচ্চবর্ণের ভোট দখলে যোগীর মতো হিন্দুত্ববাদী নেতার প্রভাব অনস্বীকার্য। সেই জাদুকেই ২০১৯-এ কাজে লাগাতে চায় মোদী বাহিনী।

উত্তরপ্রদেশের সদ্য নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের কসাইখানা বন্ধের সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে দ্রুত উত্তপ্ত হচ্ছে দেশের বৃহত্তম রাজ্যটির রাজনৈতিক পরিস্থিতি। পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের তো বটেই, রাজ্যের অন্যান্য প্রান্তে মুসলিম মহল্লাগুলিতে ক্রমশ বাড়ছে জনরোষ। ব্যাপক গ্রেপ্তারি ও মামলার প্রতিবাদে পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে দোকান বন্ধ করে দিয়ে ধর্মঘট করেছেন মাংস-বিক্রেতারা। শুক্রবার থেকেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে উত্তর প্রদেশের জনপ্রিয় কাবাবের দোকান 'তুন্ডে কাবাবি'।

আরএসএসের অত্যন্ত কাছের মানুষ এই আদিত্যনাথ মুখ্যমন্ত্রী শুরু করেছিলেন বেআইনি কসাইখানা বন্ধ করা। কিন্তু সেই প্রক্রিয়া 'বেআইনি কসাইখানা' ছাড়িয়ে গিয়েছে। গত ৪৮ ঘণ্টায় রাজ্যের ৩৬টি কসাইখানা এবং কয়েকশ মাংসের দোকান বন্ধ করে দিয়েছে আদিত্যনাথের সরকার। পুলিশ সূত্রেই খবর, পশুপাচারের সঙ্গে যুক্ত থাকার দায়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৪৩ জনকে। ২৭টি এফআইআর দায়ের করা হয়েছে ৬০ জনের বিরুদ্ধে। রাজ্য পুলিশের ডিজি রাহুল শ্রীবাস্তব বলেছেন মিরাট, বারাণসী, বেরিলিতে আটটি এফআইআর করা হয়েছে। এই ঘটনাগুলির পরেই আরও তপ্ত হতে শুরু করেছে উত্তরপ্রদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি।

আকস্মিক এই ধর্মঘটে চাঞ্চল্য চড়িয়ে পড়ে গোটা উত্তরপ্রদেশে। রাজ্যর মানুষ দ্রুত মাংস কিনতে শুরু করেন। অচিরেই শেষ হয়ে যায় পাঁঠার মাংস, আকাশে চড়ে যায় মুরগির মাংসের দাম। মিরাটের প্রাক্তন মেয়র, তথা মাংস রপ্তানিকারক শাহিদ একলাখ বলেছেন, বিজেপি সরকারের নির্দেশে অতি-তৎপরতা শুরু করেছে প্রশাসন। রাজ্যের সব কসাইকানাই বন্ধ করে দিতে উদ্যত হয়েছে সরকার। বাদ পড়ছে না বৈধ কসাইখানা ও দোকানগুলিও।

বহুজন সমাজ পার্টির এই নেতা বলেছেন, রাজ্য সরকারের কসাইখানাও দোকান বন্ধের অতি-সক্রিয়তার পর বৈঠকে বসেছিলেন উত্তরপ্রদেশের মাংস-ব্যবসায়ীরা। আদিত্যনাথ সরকার যদি মাংসবিক্রেতাদের বিরুদ্ধে অভিযান বন্ধ না করে, তাহলে পুরোপুরি ধর্মঘটের রাস্তায় যাওয়া হবে। সরকার মুখে বলছে, 'সবকা সাথ, সবকা বিকাশ', আর বাস্তবে গোমাংস বিক্রি বন্ধের যাবতীয় পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে।

কলকাতা, ২৫ মার্চ ২০১৭