যুদ্ধাহতের ভাষ্য: ৬৫– “বিএনপি-জামায়াতের বিধ্বংসী রাজনীতিই উসকে দিয়েছে জঙ্গিবাদ”

সালেক খোকনসালেক খোকন
Published : 24 March 2017, 02:45 PM
Updated : 24 March 2017, 02:45 PM

তাঁর নাম ওসমান গণি তালুকদার। দাদা আব্দুল আলীম তালুকদারের ছিল অগাধ জমিজমা। আর বাবা আব্দুল মজিদ তালুকদার ছিলেন মাতব্বর প্রকৃতির লোক। দান-খয়রাতও করতেন খুব। গরীব মানুষের পাশে দাঁড়াতেন। এলাকার মানুষ তাই মান্য করতেন। জোরদার ফ্যামেলি তাঁদের। চৌদ্দ পুরুষের ছিল তালুক সম্পত্তি। তাই নামের শেষে বসেছে 'তালুকদার'।

ওসমান গণি তখন নেত্রকোণা কলেজে। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা আন্দোলন তুঙ্গে। কলেজ থেকে শহীদ মিনার ও বড় বাজার ঘুরে মিছিল শেষ হত আবার কলেজে এসে। মুসলিম লীগাররা আর পুলিশ তখন বাধা দিত। ওই আন্দোলনেই বিভক্তিটা পুরোপুরি প্রকাশ পায়। কী কী ভিত্তিতে বৈষম্যের স্বীকার হচ্ছে বাঙালিরা, কেন নির্বাচনের প্রয়োজন– সেটা ছয় দফায় স্পষ্ট ছিল। ভাসানী সাহেবের সঙ্গে শেখ সাহেবের দ্বিমত ছিল খুবই সামান্য। উনি বলতেন: "ভোটের বাক্সে লাথি মার, পূর্ব বাংলা স্বাধীন কর।"

আর শেখ সাহেব বলতেন: "না, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াতে নির্বাচনের মাধ্যমেই আমরা ওদের হটাব।"

ক্রমেই নানা আন্দোলন সংগ্রামে যুক্ত হয়ে যান ওসমান গণি। পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তান– একই দেশ। দুটোরই সমান অধিকার থাকা উচিত। সংখ্যায় লঘু ছিল পশ্চিম পাকিস্তান। তবু বিভিন্ন ফ্যাসালিটি পশ্চিমারাই পেত। বড় বড় পদ ওদের দখলে। শিক্ষিত হলেও পূর্ব পাকিস্তানের লোকেরা পোস্টমাস্টার আর স্কুল মাস্টার হত। সিএসপি ছিল খুব কম। ডিফেন্সে সিপাই থেকে পরীক্ষা দিয়ে অফিসার হতে হত; সরাসরি সুযোগ ছিল কম।

কাগজের মিলগুলো ছিল পূর্ব পাকিস্তানে। অথচ সে কাগজেরই দাম ছিল বেশি। এসব বৈষম্য নিয়ে সোচ্চার ছিলেন ওসমান গণিরা। লিফলেট করে বৈষম্যের বিষয়গুলো তাঁরা ছড়িয়ে দিতেন সবখানে।

কিন্তু তখনও কিছু লোক ছিল পাকিস্তানের পক্ষে। তারা ধর্মীয় বিভ্রান্তি ছড়াত। নেত্রকোণায় এদের সংখ্যা ছিল যথেষ্ট। নেতা ছিল মওলানা মঞ্জুরুল হক। তার ছেলে আবু তাহের এবং আত্মীয় আতাউর রহমান ননী আর্ন্তজাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি এখন। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কথা বললেই এরা 'মালাউন' বলে গালি দিত। 'ইসলামবিরোধী' বলে রিউমার ছড়াত। কমিউনিস্ট বলত। তখন কমিউনিস্ট বলা মানেই ধর্মবিরোধী ব্যক্তি। ধর্ম নিয়ে রিউমার ছড়ানোর এ কাজটা এখনও বন্ধ হয়নি।

স্বাধীনতার আগের নানা ঘটনা নিয়ে কথা হচ্ছিল যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. ওসমান গণি তালুকদারের সঙ্গে। তাঁর বাড়ি নেত্রকোণার বারহাট্টা উপজেলার গাভারকান্দা গ্রামে। আব্দুল মজিদ তালুকদার ও আয়শা মজিদ তালুকদারের পঞ্চম সন্তান ওসমান গণি। লেখাপড়ায় হাতেখড়ি দেওপুর প্রাইমারি স্কুলে। অতঃপর ভর্তি হন বারহাট্টা সিকেপি (কোরেন্যাশন কৃষ্ণ প্রসাদ) উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখান থেকেই ১৯৬৬ সালে এসএসসি পাস করেন। এরপর নেত্রকোণা কলেজ থেকে এইচএসসি পাসের পর তিনি ওই কলেজেই ডিগ্রিতে ভর্তি হন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ডিগ্রি পরীক্ষার্থী।

নেত্রকোণায় সে সময়কার রাজনৈতিক অবস্থার কথা জানালেন এই যোদ্ধা। তাঁর ভাষায়:

"নেত্রকোণায় তখন মুসলিম লীগবিরোধী একটা রাজনীতি চলত, বিশেষ করে ছাত্র
ইউনিয়ন, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ছিল শক্তিশালী। তৃণমূল পর্যায়ে স্কুলগুলোতে গিয়ে ওরা ছাত্রদের সচেতন করত। কমিউনিস্ট পার্টির বড় নেতা ছিলেন কমরেড মনি সিংহ। ন্যাপের ছিলেন আজিজুর রহমান ও ওয়াজেদ আলী। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ করতেন ফজলুল কাদের, ফজলুর রহমান খান, আব্দুল খালেক, মমিন সাহেব প্রমুখ। সত্তরের নির্বাচনে আমাদের ওখানে আব্দুল মমিন সাহেব এমএনএ এবং এমপিএ হন আব্বাস আলী খান। কিন্তু তবু ক্ষমতা দিতে টালবাহানা করে পাকিস্তানের শাসকরা।"

বিএ ফাইনালের প্রস্তুতি চলছে তখন। ওসমান গণি নেত্রকোণা কলেজ হোস্টেলে। সারা দেশ উত্তপ্ত। আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা না দিলে যেন যুদ্ধ শুরু হবে। সে ঘোষণারই অপেক্ষায় আছে সবাই। ওসমানরা হোস্টেলের রেডিওতে শোনেন বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণটি। বঙ্গবন্ধু বললেন: "এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম…।"

ওসমান গণির কাছে ওটাই ছিল স্বাধীনতার ডাইরেক্ট ঘোষণা।

২৫ মার্চ ১৯৭১। পাকিস্তানি সেনারা গণহত্যা শুরু করে। ঢাকায় আর্মি নামার খবর ছড়িয়ে পরে সারা দেশে। ফলে মানুষ জীবন বাঁচাতে মানুষ চলে যেতে থাকে সীমান্তের ওপারে, ভারতে। নেত্রকোণায় পাকিস্তানি সেনারা প্রবেশ করে এপ্রিলের শেষে। এর আগেই ওসমান গণিরা শহর ছেড়ে চলে যায় গ্রামে।

ধনী পরিবারের সন্তান ছিলেন, তবু কেন মুক্তিযুদ্ধে গেলেন?

"ছাত্র ছিলাম। বাঙালি চেতনাবোধটাও প্রবল ছিল। পশ্চিমা অনেকেই তখন নেত্রকোণায় কাজ করত। তারা বাঙালিদের মানুষই মনে করত না। এসব অবহেলা দেখেছি নিজ চোখে। শহরের এসেই পাকিস্তানি সেনারা হিন্দু ও আওয়ামী লীগের লোকদের বাড়িগুলো জ্বালিয়ে দিচ্ছিল। পাকিস্তানি সেনাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে শান্তি কমিটির লোকেরা। ফজলুল হক ছিলেন শান্তি কমিটির নেতা। আমাদের পেলেই তো ওরা মেরে ফেলবে। তাই বাঁচলে হলে লড়াই করেই বাঁচব। দেশের স্বাধীনতার জন্য তাই একদিন ঘর ছাড়ি।"

ট্রেনিং নিলেন কোথায়?

"মে মাসের কথা। মা জানত ফুপুর বাড়িতে গিয়েছি। আমার সঙ্গে ছিল আব্দুল হাকিম। বিজয়পুরের বর্ডার পাড় হয়েই নাম লেখাই ভারতের মোহাদেও ইয়ুথ ক্যাম্পে। ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন হাবিবুর রহমান খান। সেখানে এক মাস চলে লেফট-রাইট। পরে এক মাসের হায়ার ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠানো হয় তুরাতে।

"সকালে সোনার বাংলা গেয়েই শুরু হত ট্রেনিং। রাইফেল, স্টেনগান, গ্রেনেড থ্রোই ছিল প্রধান। পাহাড়ের ওপরে ছিল আমাদের ক্যাম্প। ট্রেনিং ছিল খুবই কষ্টের। কিন্তু দেশের কথা মনে হলেই সব কষ্ট ভুলে যেতাম। আমার এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার) নং ছিল ১৩৭৩১।"

ট্রেনিং শেষে ওসমান গণিদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় রণক্ষেত্রে। তাদের ১২০ জনের কোম্পানির কমান্ডার ছিলেন ইসলাম উদ্দিন খান আর টোয়াইছি আবুল হোসেন। শেষে কোম্পানি ভেঙে তাঁরা দু-তিনটি গ্রুপে অপারেশন চালায়। এভাবে তিনি গেরিলা অপারেশন করেন ১১ নং সেক্টরের ধর্মপাশা, কলমাকান্দা, দুর্গাপুর, বিজয়পুর প্রভৃতি এলাকায়।

দেশের স্বাধীনতার জন্য এক অপারেশনে মারাত্মকভাবে আহত হন এই সূর্যসন্তান। পাকিস্তানি সেনাদের পুতে রাখা মাইনের আঘাতে তাঁর ডান পা উড়ে যায়। স্প্লিনটারে বিদ্ধ হয় তাঁর বাঁ পা ও ডান হাতের আঙুলও। সেদিনের দুঃখ-স্মৃতি আজও তাঁকে আনমনা করে দেয়। রক্তাক্ত ওইদিনের যুদ্ধ-স্মৃতি শুনি মুক্তিযোদ্ধা ওসমান গণির জবানিতে–

"তখন আমরা বাগমারায়, হাইট আউটে। সঙ্গে ছিল ৬০-৭০ জন মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকে অপারেশন করে আবার বাগমারা ক্যাম্পে ফিরে আসতাম। ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১। ভারতীয় সেনারাও যোগ দেন আমাদের সঙ্গে। গঠিত হয় যৌথ বাহিনী। আমাদের ওখানে যৌথ বাহিনীর কমান্ডে ছিলেন মেজর মুরারি।

"উনি আমাকে বিজয়পুর অ্যাটাকের নির্দেশ দেন। সেখানে ছিল পাকিস্তানি সেনাদের শক্তিশালী ঘাঁটি। গ্রুপ নিয়ে বিজয়পুরের কাছাকাছি থেকে ক্যাম্পের দিকে গুলি শুরু করি ৩ ডিসেম্বর। গোলাগুলি চলে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত। ওইদিন রাত ১২টার পর আমরা পাহাড়ি পথ বেয়ে নিচে নেমে আসি। উদ্দেশ্য বিজয়পুর ক্যাম্প দখলে নেওয়া।

"৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। ভোর বেলা। ওদের ফাস্ট ক্যাম্পের পূর্বদিকে প্রথম অ্যাটাক করি। ওরা ধীরে ধীরে পালাতে শুরু করে। খানিক পরেই কোনো প্রত্যুত্তর পাই না। ক্রলিং করে সামনে এগিয়ে একটা বাংকার দখলে নিই। এর আগেই ওরা ক্যাম্প ছেড়ে পিছু হটে, আশ্রয় নেয় দুর্গাপুরে।

"বাংকারগুলো আমরা সার্চ করছি। সামনে কয়েকজন। পেছনে আমি। সবাইকে সর্তক থাকতে বলি। একটি বাংকার থেকে অন্য একটি বাংকারের যাওয়ার ছোট্ট একটি রাস্তা। অন্যদিক দিয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। এটাই ছিল ওদের কৌশল। চলে যাওয়ার আগে ওরা সেখানে মাইন পুতে যায়। সর্তক হয়েও আমরা তা বুঝতে পারি না। হঠাৎ একটি মাইনে পা পড়তেই বিকট শব্দ হয়। চারদিকে কুণ্ডুলি পাকানো ধোঁয়া। উড়ে গিয়ে একটি গাছের ডালের সঙ্গে বাড়ি খেয়ে আমি মাটিকে আছড়ে পড়ি।

"প্রথম ভেবেছি ওরা অ্যাটাক করেছে। ডান পায়ের দিকে চোখ পড়তেই স্থির হয়ে যাই। পাটি হাঁটুর ওপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। চামড়ার সঙ্গে তা লেগেছিল কোনোরকমে। স্প্লিনটারে বিদ্ধ হয় বাঁ পা ও ডান হাতের আঙুল। আমি নড়তে পারি না। গোঙ্গাচ্ছিলাম। সহযোদ্ধারা একটা দরজার পাল্লায় আমাকে তুলে নিয়ে যায় বাগমারা ক্যাম্প হাসপাতালে। সেখানেই ডান পা হাঁটুর ওপর থেকে কেটে বিচ্ছিন্ন করা হয়। বালতির মধ্যে চোখ পড়তেই দেখলাম শরীরের রক্তে অর্ধেকটাই ভরে গেছে।

"জ্ঞান তখনও ছিল। সহযোদ্ধাদের ডেকে হাতে হাত রেখে শপথ করিয়েছিলাম: 'হয়তো মরে যাব, কিন্তু তোমরা কথা দাও– দেশটা স্বাধীন করবে।'"

"মুক্তিযোদ্ধারা সে কথা রেখেছিল। আর তাইতো আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি।"

মুক্তিযোদ্ধা ওসমান গণির পায়ের চিকিৎসা চলে তুরা, গোহাটি ও খিরকী হাসপাতালে। পরে তাঁকে পাঠানো হয় পুনা সম্মিলিত সামরিক হাসাপাতালে। সেখানেই তাঁদের দেখতে আসেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী।

ওসমান গণি বলেন:

"ওখানকার একটি পাবলিক মিটিংয়ে বক্তব্য দেওয়ার আগে হাসপাতালে আসবেন ইন্দিরা গান্ধী। কমান্ডিং অফিসার জানালেন খবরটি। সবাইকে দেখে উনি আমার কেবিনে আসেন। জানতে চান আহত হওয়ার পুরো ঘটনাটি। মনোযোগ দিয়ে সব শুনে তিনি শুধু মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। হাসপাতালের পাশেই ছিল তাঁর মিটিং। বিকেলে সেখানে বক্তব্য দেওয়ার সময় আমার নাম উচ্চারণ করে বললেন:'যে দেশে ওসমানের মতো হাজার হাজার সাহসী বীরের জন্ম, সে দেশকে তো দমানো যায় না।'"

"শুনে মনটা ভরে গিয়েছিল। তাঁর সঙ্গে এসেছিলেন পুুনা ফিল্ম স্টুডিওর চেয়ারম্যান। উনিই পরে ইন্দিরার সঙ্গে আমার ছবি পাঠিয়ে দেন। ছবিটার দিকে তাকালেই ইতিহাসটা জীবন্ত হয়ে ওঠে।"

যে দেশের জন্য রক্ত দিলেন, স্বপ্নের সে দেশ পেয়েছেন কি?

"হুবহু সে দেশ পাই নাই। তবে পাব বলে বিশ্বাস আছে। চেয়েছিলাম শোষণমুক্ত সমাজব্যবস্থা থাকবে দেশে। যেখানে দুর্নীতি, মাসলসম্যানদের দৌরাত্ম্য থাকবে না। ধর্ম নিয়ে সাম্প্রদায়িকতা নয়, বরং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন ছিল আমাদের। কিন্তু এখনও অনেক মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হয়নি। উন্নতি তো হচ্ছে। শেখ হাসিনা সরকার আপ্রাণ চেষ্টাও করছে। কিন্তু দলের লোকদের সিলেকশনের বিষয়ে খুবই সর্তক থাকতে হবে। দেশের স্বার্থে সত্যিকারভাবে সবাই এক হয়ে কাজ না করলে তো দেশ এগোবে না।"

মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রসঙ্গে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা অকপটে তুলে ধরেন নিজের মতামত:

"জাস্ট আফটার লিবারেশন ছিল তালিকার উপযুক্ত সময়। মুক্তিযোদ্ধারা তখন চিহ্নিত ছিলেন। বেঁচে ছিলেন প্রত্যেক সেক্টর কমান্ডার ও কোম্পানি কমান্ডাররাও। ফলে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা কম ছিল। ৪৬ বছর পর আমাদের জন্য এটা এখন টাফ হয়ে গেছে। নেত্রকোণায় যাচাই-বাছাই কমিটির আমিও মেম্বার। এমনভাবে প্রেসার আসে বলার মতো না। মুক্তিযুদ্ধের সময় সংগঠক ও সহযোগী ছিলেন তারাও আবেদন করেছে। কিন্তু নীতিমালায় তো তোদের নেওয়ার সুযোগ নেই। যখনই বাদ দিই তখনই কমিটির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আর প্রপাগান্ডা ছড়ানো হয়। নেত্রকোণায় আমরা ফেয়ারলি চেষ্টা করছি। এখানকার কমান্ডার নুরুল আমিনও ভালো লোক। কমিটিতে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা থাকাটাও জরুরি। কমিটি সঠিক না হলে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইও সঠিক হবে না।'

মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বৃদ্ধিতে শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ওসমান গণি বলেন:

"দেশের জন্য মৃত্যু আগ পর্যন্ত কিন্তু আমাদের কষ্ট করে যেতে হবে। সময়ের প্রয়োজনে যুদ্ধ করেছি, সুবিধা পাওয়ার আশায় নয়। তবু মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য শেখের মেয়ে অনেক করছেন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তো রাষ্ট্রীয় কোনো প্রটোকল নাই। এটা খারাপ লাগে।'

স্বাধীনতার পরের প্রেক্ষাপট নিয়ে নিজের মতামত তুলে ধরেন এ মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর ভাষায়:

"রাজনীতিতে জাসদ যেমন ক্ষতি করেছে তেমনি সিরাজ সিকদারের কার্যক্রমও শেখ সাহেবকে বিপাকে ফেলেছিল। বঙ্গবন্ধু যখন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশেকে টেনে তোলার কাজ করছিলেন, তখন জাসদই ছিল মুজিবের বিরুদ্ধে। এমনকি বঙ্গবন্ধুর হত্যার জন্য জাসদ সৃষ্টির পেক্ষাপটও দায়ী। তাই আমি মনে করি, সরকারের সঙ্গে থাকলেও তাদের বিষয়ে সব সময় সর্তক থাকা প্রয়োজন। আদর্শের জায়গায় তো তারা কখনও ঠিক থাকেনি!"

মুক্তিযোদ্ধা ওসমান গণিও মনে করেন দেশে কোনো আইএস নেই। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও ফাঁসি কার্যকর করা, বিএনপি-জামায়াতের বিধ্বংসী রাজনীতিই উসকে দিয়েছে জঙ্গিবাদ। দেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্থ করা ও সরকারকে বিপাকে ফেলাই এর মূল উদ্দেশ্য।

জঙ্গিবাদ নির্মূলে কী করা উচিত?

"রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মান্ধতা প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। জঙ্গিবাদ ইস্যুতে 'জিরো টলারেনস' দেখাতে হবে। পারিবারিক ও সামাজিকভাবেও উদ্যোগ নিতে হবে সচেতনতার। আমরা শুধু সরকারের ব্যর্থতা খুঁজি। এটা তো সহজ কাজ। কিন্তু যে পরিবার থেকে ছেলে বা মেয়েরা জঙ্গিতে যাচ্ছে সেই পরিবারের কি কোন দায় নেই? সবাই এগিয়ে না এলে শুধু প্রশাসন দিয়েই জঙ্গিবাদ নির্মূল করা সম্ভব নয়।"

স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভালোলাগার অনুভূতি জানতে চাই আমরা। উত্তরে এই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা বলেন:

"মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নতুন প্রজন্মের জেগে ওঠা দেখলে ভালো লাগে। আমার দেশের সন্তানেরা যখন সারা পৃথিবীতে লাল-সবুজের পতাকাকে সমুন্নত রাখে তখন মন ভরে যায়।"

খারাপ লাগে কখন?

"যখন দেখি ধর্মের নামে হেফাজতে ইসলামের লোকেরা মাদ্রাসার কোমলমতি ছাত্রদের নিয়ে মতিঝিলে আষ্ফালন করে, হাইকোর্টের ভাস্কর্য ভাঙতে চায়, দেশকে অচল করে দেওয়ার হুমকি দেয়, তখন ঠিক থাকতে পারি না। একাত্তরে শান্তি কমিটির লোকদের কথা মনে পড়ে যায়। হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচিগুলোও জঙ্গিবাদ উৎসাহিত করে।'

কী করলে দেশ আরও এগিয়ে যাবে?

মুক্তিযোদ্ধা ওসমান গণির উত্তর: "আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে এগোতে হবে। দরকার মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম গড়া। নেতাকর্মীদের খাই খাই স্বভাবটাও বাদ দিতে হবে। ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে পারলে দেশটা অবশ্যই সোনার বাংলা হবে। একইসঙ্গে রাজনীতিতে যুদ্ধাপরাধী ও তাদের পোষ্যদের নিষিদ্ধ করতে হবে। তা না হলে শেখ হাসিনার সব অর্জনই ম্লান হয়ে যাবে।"

বঙ্গবন্ধুর সোনার দেশে সোনার ছেলেরাই একদিন দেশটাকে উন্নত বাংলাদেশে রূপ দেবে–এমনটাই আশা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. ওসমান গণি তালুকদারের।

নতুন প্রজন্মের উদ্দেশে তিনি শুধু বললেন:

"ধর্ম যেমন মানুষের মাঝে ঐক্য আনে তেমনি একশ্রেণি এ নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি করে মানুষে মানুষে বিভেদ টানে। ধর্মের নামে সেই বিভ্রান্তি থেকে তোমরা সর্তক থেক। তোমাদের জন্যই আমরা স্বাধীনতা এনেছি। তোমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাতেই অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়।"

সংক্ষিপ্ত তথ্য:

নাম: যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. ওসমান গণি তালুকদার

ট্রেনিং: এক মাস ট্রেনিং করেন ভারতের তুরাতে। এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার) নং-১৩৭৩১

যুদ্ধ করেন: ১১ নং সেক্টরের ধর্মপাশা, কলমাকান্দা, দুর্গাপুর, বিজয়পুর প্রভৃতি এলাকায়

যুদ্ধাহত: ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। বিজয়পুর ক্যাম্প অপারেশনের সময় পাকিস্তানি সেনাদের পুঁতে রাখা মাইনের আঘাতে তাঁর ডান পা হাঁটুর ওপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

ছবি ও ভিডিও: লেখক।