‘তোমরা ভুলেই গেছ মল্লিকাদির নাম’

Published : 20 March 2017, 02:06 PM
Updated : 20 March 2017, 02:06 PM

একটি মেয়ে। বুদ্ধিদীপ্ত দৃষ্টি। ঠোঁটের কোণে সরল হাসির ঝিলিক। মেয়েটি লেখাপড়া করত। খুব সচ্ছল পরিবারের নয়। লেখাপড়ার খরচ চালাত টিউশনি করে। সেই সঙ্গে গান গাইত চমৎকার। সংস্কৃতিককর্মী ছিল। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিত। নতুন পোশাক বানাতে দিয়েছিল দোকানে। বাড়ি থেকে যাবার আগে মাকে বলে গিয়েছিল নতুন পোশাকটি দোকান থেকে এনে রাখতে। কিন্তু সেই নতুন জামা আর পরার সুযোগ পায়নি সে। বরং তাকে জড়ানো হয়েছে সাদা কাফনে।

মেয়েটির নাম ছিল সোহাগী জাহান তনু। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের এই ছাত্রীকে হত্যা করা হয় গত বছরের আজকের দিনে। রাত ৮টা থেকে ১০টার ভিতর মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়েছে তনু নামের মেয়েটি। তবে ও পারেনি। ও হেরে গেছে। মৃত্যু ওকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে এক অন্ধকার জগতে। যারা ওকে মৃত্যুর পথে ঠেলে দিয়েছে তাদের পরিচয় আজও জানা যায়নি।

ওকে হত্যা করা হয়েছে এমন এক জায়গায় যেটি দারুণ সুরক্ষিত বলে পরিচিত। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের সংরক্ষিত এলাকার ভিতরে হত্যা করা হয়েছে তনুকে। শুধু হত্যা নয়, ধর্ষণের শিকারও হয়েছে সে। তনুকে যখন খুঁজে পাওয়া যায় তখনও সে বেঁচে ছিল। তার দেহের সুরতহাল এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে তাৎক্ষণিকভাবেই বলা হয় সে ধর্ষণের শিকার হয়েছিল। সে পালাতে চেয়েছিল, বাঁচতে চেয়েছিল, লড়াই করেছিল তার ধর্ষণকারীদের বিরুদ্ধে।

হ্যাঁ, এটিও বোঝা গিয়েছিল যে, তার ধর্ষণকারী ছিল একাধিক। তার হতভাগ্য বাবা তাকে খুঁজে পায় অন্ধকার এক জায়গায়। বাবার কোলে মাথা রেখেই মৃত্যুর দেশে চলে যায় মেয়েটি।

এই পর্যন্ত শুনে মনে হয়েছিল তার ধর্ষক ও হত্যাকারীদের ধরা পড়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। কারণ এমন সুরক্ষিত জায়গায় তো শত শত মানুষের আনাগোনা নেই। কিন্তু তারপরেই শুরু হয় টালবাহানা। তার ময়না তদন্তের রিপোর্টেই আভাস মেলে যে ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। প্রথম ময়না তদন্তের রিপোর্টে ধর্ষণের কোনো উল্লেখ থাকে না। গণমানুষের ব্যাপক প্রতিবাদের কারণে তনুর দ্বিতীয়বার ময়না তদন্ত হয়। তখন বলা হয় মৃত্যুর আগে মেয়েটির 'সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স' হয়েছিল!

কথাটি আপত্তিকর। ধর্ষণ আর সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্সের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। একটি মারাত্মক অপরাধ আর অন্যটি স্বেচ্ছায়ও হতে পারে। একটি মেয়ে যে টিউশনি করতে বাসা থেকে বেরিয়েছিল তাকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হল, অথচ বলা হচ্ছে সে 'সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স' করেছে! যেন যৌন সম্পর্ক করে বেড়ানোই ছিল তার কাজ! ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমেই ধরা যেত তার খুনিদের। সেখানে তিন ব্যক্তির ডিএনএ পাওয়া যায়। অথচ তনু হত্যার তদন্ত রিপোর্ট আর আলোর মুখ দেখল না কোনোদিন। আসামিদেরও খুঁজে পাওয়া গেল না।

তনুর ধর্ষক ও খুনি কারা? তারা কি ভিনগ্রহ থেকে এসে, মেয়েটিকে হত্যা করে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে? কেন তাদের ধরা হচ্ছে না? এই না ধরার পিছনে কী রহস্য লুকিয়ে আছে তা দেশবাসী জানতে চায়। তনু হত্যার প্রতিবাদে অনেক মানববন্ধন হয়েছে, প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছে দেশ জুড়ে। তবু ধরা পড়েনি তার খুনিরা। বলা ভালো, ধরা হয়নি তাদের। কারা সেই প্রভাবশালী খুনি যাদের আড়াল করার জন্য ময়না তদন্তের রিপোর্টেও কারচুপির গন্ধ?

তনু শুধু একটি নাম নয়। তনু এমন এক নারীর প্রতীক যে নারী জঘন্যতম অপরাধের শিকার হওয়ার পরও পায়নি বিচার। তনু আমাদের দেশের বিচারহীনতার সংস্কৃতির প্রতীক।

তনু হত্যার পর আরও কয়েকটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। ধীরে ধীরে বিস্মৃতির অতলে চলে যাচ্ছে তনু। এমন একটি অপরাধ করে অপরাধীরা এখনও মুক্ত ঘুরে বেড়াচ্ছে। এর ফলে জন্ম হচ্ছে আরও অনেক অপরাধীর। একজন সম্ভাব্য অপরাধী যখন দেখে অন্য একজন অপরাধ করেও শাস্তি এড়াতে পারছে তখন সে মনে করে 'কৈ কিছুই তো হল না'। সে অপরাধ করার দুষ্ট প্রেরণা পায়। সেও অপরাধ ঘটায়। এভাবে বিচারহীনতার সংস্কৃতি আরও নতুন অপরাধীর জন্ম দেয়।

সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির খুনিদের আজও ধরা হয়নি। ধরা হয়নি গৃহবধূ মিতুর হত্যাকারীদের। তেমনই ধরা পড়েনি তনুর হত্যাকারীরাও।

মার্চ মাসটি আমাদের স্বাধীনতার মাস। এই মাসে অনেকগুলো স্মরণীয় ঘটনা ঘটেছে আমাদের জাতীয় জীবনে। ৭ মার্চে (১৯৭১) বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ, ১৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন (১৯২০), ২৫ মার্চে (১৯৭১) ভয়ালতম গণহত্যার শিকার হয় বাঙালি জাতি আর ২৬ মার্চে ঘোষিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালের এই মাসে পাকিস্তানি বাহিনীর ভয়ালতম ধর্ষণ, নিপীড়ন ও হত্যার শিকার হন অগণিত বাঙালি নারী।

৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের দিয়েছে স্বাধীন পতাকা, স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। এই স্বাধীন দেশেও যদি তনুর মতো নারীরা হত্যা ও ধর্ষণের শিকার হয় তাহলে কীভাবে অর্থবহ হবে আমাদের স্বাধীনতা? যদি তার খুনিরা বিচারের কাঠগড়া এড়িয়ে যেতে পারে তাহলে তনুদের কাছে কতখানি মূল্য বহন করবে স্বাধীনতা? স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে যখন এদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেছিল তখন কি একথাই ছিল না যে, স্বাধীন দেশে আর কোনো নাগরিক নিপীড়ন নির্যাতনের মুখোমুখি হবে না? বিচার পাওয়ার অধিকার প্রতিষ্ঠার কথাই কি ছিল না প্রতিটি নাগরিকের?

যতদিন পর্যন্ত তনুদের মতো নারীর হত্যাকারীরা মুক্ত থাকবে ততদিন আমাদের স্বাধীনতা পূর্ণ অর্থ বহন করবে না।

তনুসহ সকল হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই। বিচার চাই সকল প্রকার মানবাধিকার লঙ্ঘনের। যেদিন আমরা এদেশকে নারী, শিশুসহ সকলের জন্য নিরাপদ করতে পারব সেদিন আমাদের ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মা শান্তি পাবে। তার আগে কিছুতেই আমরা স্বাধীনতা পুরোপুরি অর্থবহ করতে পারব না।