অভিভাবকতুল্য রাজনীতিক জিল্লুর রহমান

প্রণব সাহা
Published : 20 March 2017, 04:28 AM
Updated : 20 March 2017, 04:28 AM

একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় রাজনীতিক। দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের চার-চারবারের সাধারণ সম্পাদক। একজন সজ্জন জনপ্রতিনিধির নাম জিল্লুর রহমান। দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে– এমন সৌভাগ্যবান রাজনীতিক তিনি।

সাংবাদিকতার সুবাদে এমন একজন উদার মনের রাজনীতিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়াটাও ভাগ্যের ব্যাপার। বয়সের বিস্তর পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও আমরা সতীর্থ সাংবাদিকরা যে তাঁকে অবলীলায় 'জিল্লুর ভাই' বলতে পারতাম, এর অন্যতম কারণ ছিল রাজনীতিক হিসেবে সর্বস্তরের নেতা-কর্মী ও জনমানুষ সম্পর্কে তাঁর মমত্ববোধ। হয়তো সে কারণেই ১৯৭৫ সালের ভয়াবহ আগস্টের পর যেমন, তেমনি ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের (যাকে অনেকেই "সুগারকোটেড মার্শাল" বলে অভিহিত করে) সময় যোগ্য রাজনীতিকের পরিচয় দিতে পেরেছিলেন জিল্লুর রহমান। হয়তো সে কারণেই ২০১৩ সালে যখন চিরবিদায় নিয়েছিলেন এই অভিজ্ঞ রাজনীতিক তখন পত্রিকার শিরোনাম হয়েছিল "অভিভাবকের বিদায়"।

প্রিয়তমা স্ত্রী এবং দেশের আরেক কীর্তিময়ী রাজনীতিক আইভি রহমানকে ২০০৪ সালের গ্রেনেড হামলায় হারানোর পর শোকাহত বুকেই বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির শপথ নিয়েছিলেন জিল্লুর রহমান। আর সেই দায়িত্ব পালন করতে করতেই তাঁর বিদায়। দুই যুগের রাজনৈতিক সাংবাদিকতার সুযোগে ঘনিষ্ঠভাবেই মেশার সুযোগ হয়েছিল তাঁর সঙ্গে।

খুব মনে আছে ১৯৯৫ সালে যখন আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে তুমুল আন্দোলন করছিল, তখন ঢাকা থেকে ট্রেন-মার্চ করে চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন সভানেত্রী শেখ হাসিনা। সেই ট্রেনে অনেকটা সময় আমাদের কম্পার্টমেন্টে এসে সাংবাদিকদের সঙ্গে সময় কাটিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। অতীতের অনেক স্মৃতিচারণ শুনেছিলাম সেবার।

আর ২০০০ সালে যখন চতুর্থবারের মতো আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর টুঙ্গিপাড়া যাচ্ছিলেন তিনি, তখনও ফেরিতে লম্বা সময় একান্তে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। সেদিনই জিল্লুর রহমান জানিয়েছিলেন ১৯৪৬ সালে সিলেটে বঙ্গবন্ধু, তখন যিনি তরুণ রাজনীতিক শেখ মুজিব, তাঁর সঙ্গে জিল্লুর রহমানের প্রথম পরিচয়ের কথা। খুব আত্মতৃপ্তি নিয়ে বলেছিলেন: "বঙ্গবন্ধু দুবার আমাকে দলের সাধারণ সম্পাদক করেছিলেন, নেত্রীও আমাকে দু-দুবার সেই দায়িত্ব দিয়েছেন।"

১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদে প্রাণবন্ত সব অধিবেশন, সেই সংসদ থেকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সব বিরোধী দলীয় (জাতীয় পার্টি ও জামায়াতসহ) সাংসদদের পদত্যাগ এবং তারপর ১৯৯৪-৯৬ জুড়ে তত্বাবধায়ক সরকারের সফল আন্দোলন কাভার করতে গিয়ে বেশ ঘনিষ্ঠাতা হয়েছিল জিল্লুর রহমানের সঙ্গে। গুলশানের আইভি কনকর্ডের অট্টালিকা তখন ছিল না, বরং সবুজ ঘাসের লন পেরিয়ে ছিমছাম দোতালা বাড়িতেই হয়তো বেশি মানানসই ছিলেন সহজ-সরল, বড় মনের রাজনীতিক জিল্লুর রহমান। সেই বাড়ির খোলা বারান্দায় অসংখ্যবার নানা কারণে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল তাঁর সঙ্গে।

তখন মোবাইল ফোন এত সহজলভ্য ছিল না, তাই নেতাদের বাড়িতে গিয়েই খবরাখবর জানার চেষ্টা করতাম 'ভোরের কাগজ' পত্রিকার রিপোর্টার হিসেবে। অনেক প্রশ্ন করতাম, ধৈর্য্য নিয়ে শুনে অল্প কথায় জবাব দিতেন জিল্লুর রহমান। অনেক সময় কাঙ্ক্ষিত প্রশ্নের জবাব মিলত না, কিন্তু এমন স্নেহ দেখাতেন যে, রাগ করতে পারতাম না।

অনেক সময় এখনকার রাজনিতীকদের সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করি। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনের পর ২৩ জুন শপথ নিয়েছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা। নিজ দলের বাইরে জাতীয় পার্টি থেকে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু আর জাসদের আ স ম রব মন্ত্রী হয়েছিলেন। ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরেছিল, কিন্তু জিল্লুর রহমানসহ তখনকার মন্ত্রীদের (প্রয়াত আব্দুস সামাদ আজাদ, আব্দুর রাজ্জাক ও আব্দুল জলিলকে স্মরণ করছি) কোনো অহংকার দেখিনি। বর্তমান অনেক মন্ত্রীর 'কৃত্রিম ব্যস্ততা ও অহমিকা' তাই হাসির খোরাক যোগায় অনেক সময়।

১৯৪৬ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির গণভোটের প্রচারে সিলেট গিয়ে তখনকার ইসলামিয়া কলেজের ছাত্রনেতা শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা হয়েছিল ঢাকা কলেজের ছাত্রনেতা জিল্লুর রহমানের। তারপর দু-দুবার তিনি বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন ১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালে। ১৯৭৫ সালে গঠিত বাকশালেও তিনি ১ নং সম্পাদক ছিলেন।

১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ঢাকায় ফিরে সভানেত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর দুবার সাধারণ সম্পাদক হন জিল্লুর রহমান। ১৯৯৬ সালে দল ক্ষমতায় গেলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী ও সংসদের উপনেতার দায়িত্ব পালন করেছেন ভাষাসৈনিক জিল্লুর রহমান। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহীদ বরকতকে আহত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন জিল্লুর রহমান ও গাজীউল হক। অতীতের এসব অনেক কথাই শুনেছি জিল্লুর রহমানের কাছেই।

আওয়ামী লীগ অন্তপ্রাণ ছিলেন জিল্লুর রহমান। বারবার কারাবরণ করেছেন। আবার জনভোটে ১৯৭৩, ১৯৮৬, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮ সালে সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হয়েছিলেন জিল্লুর রহমান। শেষ ক্ষণে তিনি রাষ্ট্রপতির পদে আসীন ছিলেন। চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন সিঙ্গাপুরে, ফিরে এসেছিলেন নিথর দেহে। ২০১৩ সালের এই ২০ মার্চে তাঁর মৃত্যুর পর লিখেছিলাম: "সাংবাদিক পেলেই অহরহ রাজনৈতিক বক্তৃতা দিতেন না জিল্লুর রহমান, কিন্তু হাসি মুখে সবাইকে স্বাগত জানাতেন। আর খুব ধীরে ধীরে বুঝিয়ে বলতেন রাজনীতিবিদদের কখন কথা বলতে হবে আর কখন চুপ থাকতে হবে।"

পুরনো লেখা থেকে বাক্য দুটি এ জন্য উদ্ধৃত করলাম যে প্রায়ই অতি উৎসাহী আর হরবোলা রাজনীতিকদের অধিক বাক্যবাণে শুধু প্রতিপক্ষ রাজনীতিকরাই নন, কখনও আহত হয় দেশের মানুষও। সাংবাদিকদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার রাজনীতিকের সংখ্যাও কম নন। তাই স্মরণ করি জিল্লুর রহমান বা আব্দুল জলিলের (মাত্র কয়েকদিন আগেই গেল তাঁর প্রয়াণদিবস) মতো রাজনীতিকদের, যাঁরা আক্ষরিক অর্থেই ছিলেন জননেতা।

বিনম্র শ্রদ্ধা প্রিয় জিল্লুর ভাইয়ের স্মৃতির প্রতি।