একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালনার মূল দলিল এর সংবিধান। সংবিধানের বাইরে গিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ নেই। কাজেই সংবিধানবহির্ভূত পন্থায় বাংলাদেশ কেন, পৃথিবীর কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র চলতে পারে না। আনন্দের বিষয়: আমাদের বাংলাদেশের একটি সংবিধান রয়েছে।
রাষ্ট্র পরিচালনা করে সরকার। সরকার গঠিত হয় জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির দ্বারা, জনপ্রতিনিধিরা হলেন সংসদ সদস্য বা সাংসদ। স্বতন্ত্র বা দলীয়ভাবে নির্বাচিত সংসদসদস্যগণ সংসদ নেতা নির্বাচন করেন। রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণে সংসদ নেতা সরকার প্রধান (প্রধানমন্ত্রী) হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। তিনিই সরকার পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক মন্ত্রী নিয়োগ করে থাকেন, যাদের রাষ্ট্রপতির কাছে অনুরূপ শপথ নিতে হয়।
বাংলাদেশে একটি নির্বাচন কমিশন আছে। জনপ্রতিনিধি নির্বাচন পরিচালনা করা এ কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব। বাংলাদেশের যে কোনো নাগরিক কিছু ব্যতিক্রম বাদে জনপ্রতিনিধি তথা সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন। তবে দলীয়ভাবে নির্বাচন করতে হলে সংশ্লিষ্ট দলকে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত হতে হয়। স্বতন্ত্র হলে নিবন্ধনের প্রয়োজন নেই, কিন্তু নিবন্ধন ব্যতীত কোনো দল নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন না।
বাংলাদেশে বর্তমানে ৪০টি রাজনৈতিক দল নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন লাভ করেছে। উল্লেখযোগ্য একটি দল জামায়াতে ইসলামী এ হিসাবে নেই। নিবন্ধন ছাড়া আরও যে কত দল আছে তার হিসাব নেই। পৃথিবীতে কোনো উন্নত ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এত অধিক সংখ্যক রাজনৈতিক দল নেই। দেশের উন্নয়ন, গণতন্ত্রের বিকাশ এবং সমাজে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ লালন-পালনে মূলত প্রধান ভূমিকা রয়েছে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের তথা রাজনৈতি দলগুলোর। আমার কাছে তা খনার বচনের মতো মনে হয়:
"যত মত/তত পথ;
কত নেতা কত দলে
দেশ যাবে কি রসাতলে!"
এর মানে দাঁড়াচ্ছে এত অধিক সংখ্যক রাজনৈতিক দল, মত ও বিভক্তি আমাদের দেশের উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে কি না, তা গভীরভাবে দেখা দরকার। এটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠারও প্রবল অন্তরায়। এ বিভাজন ও বিভক্তি যত দ্রুত দূর করা যায় দেশ ও জাতির জন্য তত মঙ্গল।
বাংলাদেশে যদি ১০০টি রাজনৈতিক দল থাকে এবং সে দলগুলো কমিশনের নিবন্ধন নিয়ে সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে চায় তাহলে কমিশন কী করবে? কিছুই করার নেই, যতই অসুবিধা হোক না কেন তাদের 'না' করতে পারবে না। বিভাজন ও বিভক্তি কমানোর জন্য দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও দলগুলো গঠনমূলক ভূমিকা নিতে পারে। সুশীল মহাজনেরা এ বিষয়ে কী বলেন?
দেশের মালিক জনগণ। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির দ্বারা সরকার গঠন করে মূলত জনগণই। জনপ্রতিনিধি নির্বাচন প্রক্রিয়া পরিচালনা করা কশিনের প্রধান কাজ। নির্বাচন কমিশন স্বাধীন, একমাত্র জনগণ ও সংবিধানের কাছে দায়বদ্ধ। জনগণের কাছে দায়দ্ধতার মানে হচ্ছে সবার প্রতি সমান আচরণ করা।
রাষ্ট্র, জনগণ, জনপ্রতিনিধি, সরকার কিংবা কমিশন যা-ই বলি না কেন, কেউ বা কিছু সংবিধানের বাইরে নয়। সবাই, সবকিছু সংবিধানের অধীন। কাজেই এ সংবিধানের আওতায় প্রজাতন্ত্রের সব আইন-কানুন, বিধি-বিধান ইত্যাদি প্রণীত হয় এবং রাষ্ট্রের সব নাগরিকের উপর তা সমানভাবে প্রযোজ্য।
বাংলাদেশের সংবিধান ও বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের রাজনৈতিক দলসমূহের নিবন্ধন-সংক্রান্ত বিধিমালা নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, রাজনৈতিক দলসমূহের নিবন্ধনের ক্ষেত্রে নির্বচন কমিশন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মুক্তিযুদ্ধ ও সংবিধানের মূলনীতির উপর নিবন্ধিত অনেকগুলো দলের আস্থা ও বিশ্বাস না থাকা সত্ত্বেও তাদের নিবন্ধন সনদ দিয়েছে; এক কথায় যাকে সংবিধানের লঙ্ঘন বলা যায়।
সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিকভাবে তাদের কাছে অর্পিত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সংবিধানের বিধানাবলী রক্ষা ও সংরক্ষণের জন্য তারা শপথ নিয়েছে। জাতির পিতা ও মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ বাদ দিয়ে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের সংবিধান হতে পারে না। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ সরিয়ে রেখে বাংলাদেশে আইনত রাজনৈতিক দল করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়।
কাজেই প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্রে বা মেনিফেস্টোতে জাতির পিতা ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আবেদনকারী দলের সুষ্পস্ট অঙ্গীকার বা ঘোষণা রয়েছে কি না, ওই দলের গঠনতন্ত্র/নির্বাচনী মেনিফেস্ট রাষ্ট্রীয় মূলনীতিসমূহের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি না ইত্যাদি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এ বিষয়ে কমিশন নিশ্চিত হলেই কেবল তখনই একটি দলকে কমিশন কর্তৃক সনদ প্রদান করা যাবে। এর কোনোরকম ব্যত্যয় ঘটানোর সুযোগ নেই। সংবিধানের মূলনীতিসমূহ লঙ্ঘিত হয়– এমন কিছু করবে না মর্মে প্রত্যেক দলকে অঙ্গীকার দিতে হবে।
সরকার আসবে, সরকার যাবে। তিরিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতার মূল্যবোধ ও সংবিধানের মূলনীতিসমূহ যাতে কেউ গণতন্ত্রের নামে, নির্বাচনের নামে নস্যাৎ করতে না পারে তা নিশ্চিত করাও কমিশনের একটা সাংবিধানিক দায়িত্ব। কাজেই বিষয়টি নব নিয়োগকৃত কমিশন বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে পুনর্বিবেচনা করবে– এটাই জাতির প্রত্যাশা।