বাড়িভাড়া, ড্রাগন ও দুঃস্বপ্ন

গোলাম কিবরিয়া পিনুগোলাম কিবরিয়া পিনু
Published : 16 March 2017, 04:23 AM
Updated : 16 March 2017, 04:23 AM

ঢাকা মহানগরের মাত্র ১৩ শতাংশ লোক বাড়ির মালিক, এই মালিকেরা নানা অজুহাতে অযৌক্তিকভাবে বাড়িভাড়া বাড়িয়ে চলেছে। এদের লাগাম ধরবে কে? বহুদিনের এই সমস্যা সমাধানে সরকার এগিয়ে আসছে না! এগিয়ে আসছে না রাজনৈতিক দলগুলো– না আওয়ামী লীগ, না বিএনপি, না বামপন্থী দলগুলো। এসব দলের প্রধান নেতাদের অনেকে বাড়িওয়ালা কিংবা ফ্লাটের মালিক। তাই তাদের মাথাব্যাথা নেই। দু-একটি বামদল কদাচিৎ দু-একটি মানববন্ধন করে ক্লান্ত ও অবসন্ন।

মানুষের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখার জীবন-মরণ এই সমস্যা নিয়ে ধারাবাহিক কোনো আন্দোলন বামপন্থীদের তরফ থেকেও দেখা যায়নি, অথচ ইস্যুটি নিয়ে জোরালো আন্দোলন গড়ে তুলে জনগণের সমর্থন অর্জন শুধু নয়, জনগণের প্রতি তাদের যে অঙ্গীকার আছে, তা প্রমাণ করতে তারা পারত। এমনকি 'সোস্যাল ইন্টারঅ্যাকশন'এর মাধ্যমে রাজনৈতিক চিন্তার সংযোগ ঘটিয়ে তা একটি বিজয়ী রাজনৈতিক আন্দোলনেও পরিণত করতে পারত। তবে এ বিষয়ে 'জাতীয় ভাড়াটিয়া পরিষদ' ও অন্যান্য দু-একটি এমন ধরনের সংগঠন বিচ্ছিন্নভাবে সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধনসহ কিছু কার্যক্রম করে আসছে, কিন্তু সেই তুলনায় রাজনৈতিক দল বা সংগঠন সোচ্চার নয়।

'বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯১'এর সংস্কার ও বাস্তবায়নের দাবি করে আসছে ভাড়াটিয়া পরিষদ, কিন্তু তা কি সংশ্লিষ্ট মহলের বিবেক নাড়া দিতে পারছে? পারছে না। বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হলেও সেই তুলনায় জোরালোভাবে মিডিয়াসহ জাতীয় সংসদে এ বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে না।

'বাংলাদেশ ভাড়াটিয়া ফেডারেশন' হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী বাড়িভাড়া নির্ধারণে কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছে বহুবার। ২০১০ সালে একটি মানবাধিকার সংগঠনের রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ১৭ মে বাড়িভাড়া-সংক্রান্ত আইন ও বিধিবিধান কার্যকর করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে রুল জারি করা হয়। রুলের চূড়ান্ত শুনানি ২০১৩ সালে মে মাসে শেষ হয়। হাইকোর্ট ২০১৫ সালের ১ জুলাই সরকারকে ছয় মাসের মধ্যে বাড়িভাড়া নির্ধারণে কমিশন গঠনে দিকনির্দেশনা দেন। কিন্তু বাড়িভাড়া বিষয়টি নিয়ে আইনি কাঠামো যেমন গড়ে তোলা হয়নি এখন পর্যন্ত, তেমনি বাড়িভাড়া বিষয়ে যেসব সমস্যা প্রকটভাবে দেখা দিচ্ছে, তা সমাধানে সংশ্লিষ্ট মহল এগিয়ে আসছে না। এমনকি 'বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯১'এর ৩ ধারা অনুযায়ী ভাড়া-সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে অবকাঠামো গঠন বা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না!

সরকারি বেতন বাড়লেই একটা বড় সুযোগ পেয়ে যায় বাড়িওয়ালারা বাড়িভাড়া বাড়ানোর। কিছুদিন আগে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন বাড়ল, তাদের সংখ্যা সারা দেশে মাত্র ২১ লাখ। আর এই ঢাকায় প্রায় দুই কোটি লোকের বসবাস, তাদের সবার তো বেতন বাড়েনি।

দেশে মোট শ্রমশক্তির সংখ্যা ছয় কোটি ১০ লাখ। এই বেতন বাড়ানোর অজুহাতে বিশেষত ঢাকায় বাড়িভাড়া বাড়ানোর জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়েছে বাড়িওয়ালারা। যাদের বেতন বাড়ল, তারা হয়তো কিছুটা সামাল দিতে পারছে বা পেরেছে, যাদের বেতন বাড়ল না, তারা কিভাবে সামাল দিল বা দিচ্ছে? কেউ হয়তো ভাড়া বাড়ানোর কারণে যেখানে কম ভাড়া সেখানে স্থানান্তরিত হচ্ছে, কেউবা বড় বাসা ছেড়ে ছোট বাসা নিচ্ছে, কেউবা অন্যান্য খরচ কমিয়ে বাসা ভাড়ার দিকটাকে সামাল দিচ্ছে।

অনেকের আয়ের বেশিরভাগ অংশ ব্যয় করতে হয় বাড়িভাড়ার পেছনে, কারো কারো অর্ধেক। কেউ একটু বেশি আয় করল একটু স্বছন্দে চলবে, তা হয়তো হয় না, বাড়তি বাড়িভাড়া মেটাতে গিয়ে সেই স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যায়। বাড়িভাড়া কোথাও কোথাও ছয় মাসে বাড়ে, কোথাও কোথাও এক বছরে বাড়ে। নগরের কিছু মানুষ সরকার থেকে বাড়িয়ে দেওয়া বেতন-ভাতার মাধ্যমে যদি আয় বাড়ানোর সুযোগ পায় কিংবা শ্রম বাড়িয়ে বা বিভিন্নভাবে মানুষ তাদের নিজের আয় বাড়াতে সক্ষমও হয়, তারপরও তারা দুঃস্বপ্ন নিয়ে বসবাস করতে থাকে, কখন বাড়িওয়ালা 'ড্রাগন' হয়ে বাড়িভাড়ার নামে তাদের বাড়তি আয় সমূলে ছিনিয়ে নেয়!

হায়! এই দুঃস্বপ্ন নিয়ে এই নগরের বেশিরভাগ মানুষ প্রতিনিয়ত কাতরাচ্ছে, তা কি কেউ শুনবে না?