আহ, বিশ্ববিদ্যালয়!

সৌমিত জয়দ্বীপসৌমিত জয়দ্বীপ
Published : 17 March 2017, 04:30 PM
Updated : 17 March 2017, 04:30 PM

ঘটনাটা সামান্য। এ বিষয়ে অনেক বিজ্ঞ ব্যক্তিই নিজেদের মতামত না-ও দিতে পারেন উচ্চমার্গ অবস্থানের কারণে। কিন্তু ঘটনাটা আমার কাছে সামান্য নয়, অনেক বড়। এত বড় যে, 'সামান্য' বাস ভাঙচুরের মতো বিষয় আমলে আনলে আমরা হালের বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি একটু হলেও বুঝতে পারব।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় তাদের অন্তত কেন্দ্রস্থিত অবস্থানের কারণে, অতীতের অবদানের কারণে, সন্দেহাতীতভাবেই দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা, প্রধানত ছাত্ররা, বাস ভাঙচুরের মতো একটা খেলো প্রতিযোগিতায় নেমেছে দেখে বিস্ময় প্রকাশ না করে পারা যাচ্ছে না।

পত্রপত্রিকা পড়ে মোটা দাগে যা বোঝা যাচ্ছে সেটা হল, সম্প্রতি রাজধানী ঢাকার সাতটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় বিশ্বিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত করায় ঢাকা বিম্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বড় গোসসা হয়েছে। সেই গোসসা ক্ষোভে রূপান্তরিত হয়েছে বাস ভাঙচুরের মাধ্যমে। কার বাস ভাঙা হয়েছে এখানে সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়। প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে বাস ভাঙচুর কিংবা যে কোনো সম্পদ নষ্ট করা তো একটি 'মনস্তাত্ত্বিক রোগ' ও আধিপত্যবাদী মানসিকতার বৈকল্যের পরিচয় বহন করে।

আহ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়! আমাদের গৌরবান্বিত ইতিহাসের বটবৃক্ষ, প্রতিবাদের ভাষাধিরাজ। তার অতিআধুনিক ছাত্রদের প্রতিবাদের ভাষা কী কুৎসিত!

এরপর এল প্রতিশোধপর্ব। যে বাসটি ঢাবির টিএসসির সড়কদ্বীপে ভাঙা হয়েছিল, সেটি ছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা নিজেদের আবার ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের 'যুবরাজ' মনে করে। যখনই নিজেদের স্বার্থে আঘাত লাগে, তখনই ক্ষমতাসীনদের ছত্রচ্ছায়ায় সংখ্যায় নগণ্য কিন্তু প্রতাপে অগগ্রণ্য কিছু ছাত্র বাস ভাঙচুর থেকে শুরু করে বাস আটকে রাখা, জিম্মি করা, চাঁদাবাজি ইত্যাদি নানা ঘটনা ঘটায়।

এটা নব্বই-পরবর্তী তথাকথিত 'গণতান্ত্রিক' রাজনৈতিক পরিবেশে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সাধারণ চিত্র। এই চিত্রের রাহুগ্রাসে কত গণপরিবহন যে ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে ওই রুটে বাস উঠিয়ে নিয়েছে তা নিয়ে ভালো 'বিশেষ প্রতিবেদন' হতে পারে। কতিপয় 'যুবরাজ' পূর্বতনদের উত্তরাধিকারের ধারাবাহিকতায় নিজেদের শক্তি প্রদর্শন করল ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে। এবার ঢাবির ওপর প্রতিশোধ নিতে 'প্রতিবাদস্বরূপ'বিশ্ববিদ্যালয়টির নামাঙ্কিত বাস ভেঙে দিল।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার সমান বয়সী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়– নব্বই-পরবর্তী দিশাহীন ছাত্ররাজনীতিতে বাংলাদেশকে নতুনমুখী ছাত্রআন্দোলনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা– কখনও ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন, কখনও সূর্যাস্ত আইনবিরোধী আন্দোলন, কখনও মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ কুশক্তি শিবিরবিরোধী আন্দোলন (যে আন্দোলনের কারণে বাংলাদেশের একমাত্র ক্যাম্পাস হিসেবে প্রকাশ্যে শিবিরের রাজনীতি সাংস্কৃতিকভাবে নিষিদ্ধ), কখনও ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে গর্জে ওঠা সন্ত্রাসবিরোধী আন্দোলন– সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এ কোন মানসিক দীনতা!

এরপর আবার মঞ্চে আবির্ভূত হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বাস ভাঙচুরের বদলে বাস ভাঙচুর। দুটি প্রথম সারির পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ রকম কদর্য প্রতিযোগিতাই কি তবে আজকের বিশ্ববিদ্যালয়ের 'বেঞ্চমার্ক স্টান্ডার্ড'? এই একটি ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞান উৎপাদন, বিতরণের সংস্কৃতি প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সে সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় তার শিক্ষার্থীদের কোন কাণ্ডজ্ঞানের আধার হিসেবে গড়ে তুলছে, সেটাও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। তাহলে কি ধরে নিতে হবে, এটাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাণ্ডজ্ঞানের মানদণ্ড?

এসব ভাবতে যে বড়ই বেদনা জাগে মনে। আগে মানুষ দূর থেকেও বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষার্থীকে দেখিয়ে দিয়ে গর্বে বুক ফুলিয়ে কথা বলত। আর আজকে আমাদের সেই কবিতার চরণ উচ্চারণ করতেই সময় চলে যায়:

"আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে…!"

২.

ধরে নিলাম, কোনো বাস ভাঙচুর হয়নি, কোনো রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিনষ্ট হয়নি। তবু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের 'প্রতিবাদ'এর ইস্যুটি একটু ভেঙে দেখা উচিত। মূলত এই বিক্ষোভের মাধ্যমে তারা যে তাদের অজ্ঞতা প্রকাশ করেছে এতে বোধহয় কারও কোনো সন্দেহ নেই। তারা কি জানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার ইতিহাস? তারা কি জানে সারা দুনিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কীভাবে চলে তার রূপরেখা? নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় যে, এর শিক্ষার্থীরা অযৌক্তিক চিন্তাভাবনা করলে সেটাও মানদণ্ড হিসেবে মেনে নিতে হবে?

১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ যখন ১৯১১ সালে রদ হল, তখন পূর্ব বাংলাকে ক্ষতিপূরণ প্রদান হিসেবে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেন তৎকালীন ভারতের ভাইসরয় ও গভর্নর জেনারেল লর্ড চার্লস হার্ডিঞ্জ। যে অভিব্যক্তি ১৯২৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের প্রথম সমাবর্তন বক্তা হিসেবে প্রকাশ করে দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন চ্যান্সেলর লর্ড বালওয়ের-লিটন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বলেছিলেন: "a splendid imperial compensation."

এই 'এক চমৎকার রাজকীয় ক্ষতিপূরণ' হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া বিদ্যাপীঠ ঔপনিবেশিক শাসকদের কেমন চপেটাঘাত করেছিল, তা তো আমাদের অজানা নয়। এর সব কথাই তো অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিমের বহুল আলোচিত 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ: অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকএর আলাপচারিতা' গ্রন্থটিতে অত্যন্ত নিটোলভাবে বর্ণিত আছে।

যাহোক, ১৯৪৭ সালের ভারতভাগের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠল পূর্ব বাংলার মানুষের স্বর ও সুরের প্রতীক। সঙ্গত কারণেই তার একাডেমিক চরিত্রেও এল বড় পরিবর্তন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তখন আর শুধু শিক্ষাপ্রদানের (একাডেমিক) প্রতিষ্ঠান রইল না, একইসঙ্গে হয়ে উঠল অধিভুক্ত বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা গ্রহণকারী ও সনদপ্রদানকারী কর্তৃপক্ষও।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ভূমিকা হুট করেই হয়েছে, তা অবশ্য নয়। ব্রিটিশ আমলে ভারতবর্ষে 'উড ডিসপ্যাচ ১৮৫৪'এর সুপারিশক্রমে সর্বপ্রথম ১৮৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কলকাতা, মুম্বাই ও মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়। যেগুলো লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুরূপ শুধু পরীক্ষা গ্রহণকারী ও ডিগ্রি প্রদানকারী সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ হিসেবে গড়ে উঠেছিল। ১৯০৪ সালে ভাইসরয় লর্ড জর্জ কার্জন 'ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট'এর সূচনা করলে ওই অ্যাক্টের অধীনেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একাডেমিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবেও যাত্রা শুরু করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই দ্বৈত ভূমিকা আসলে ভারতবর্ষের আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় ধারণারই পরম্পরা। যে পরম্পরা ১৯৯২ সালে 'জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়' প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত বজায় রেখে দায়িত্ব পালন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

এখন প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ঢাকার স্নাতক-স্নাতকোত্তর পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ সাতটি কলেজ পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার। এই কলেজগুলোর মধ্যে ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি তিতুমীর কলেজ ও মিরপুর বাঙলা কলেজের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সময় বিশ্ববিদ্যালয়করণের দাবি নিয়ে রাজপথে নেমেছে। অবশেষে সরকার আলাদা আলাদা করে নয়, বরং সবগুলো একটি 'বৃহত্তর ছাতা'র নিচে নিয়ে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ প্রদানের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সিদ্ধান্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কী এমন ক্ষতি করবে, তা বোধগম্য নয়।

আবার এটাও বোধগম্য নয়, গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের শিক্ষার্থীরা যখন তাদের প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত ইনস্টিটিউট করার আন্দোলন করছেন, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সেই আন্দোলন নিয়ে আশ্চর্যজনকভাবে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করা ও আন্দোলনস্থলে গিয়ে দলবেঁধে বিরুদ্ধাচারণের কী অর্থ থাকতে পারে! আন্দোলনের দাবি মেনে নেওয়া হবে কি হবে না সে সিদ্ধান্ত নেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। শিক্ষার্থীদের এখানে নাক গলানোর কী আছে?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নিশ্চয়ই জানেন, চারুকলা কিংবা লেদার টেকনোলোজিও একদা কলেজ ছিল এবং পরে আইবিএর মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধা-স্বায়ত্তশাসিত ইনস্টিটিউটে রূপান্তরিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার আগে টেক্সটাইল কলেজও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ছিল।

ঢাকা বিভাগসহ বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থিত বাংলাদেশের সিংহভাগ সরকারি ও বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত। কোনো দিন শুনিনি, এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অন্তর্ভুক্তি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাসে বিকাশমান শিক্ষার্থীদের জন্য হীনমন্যতা বা ক্ষতির কারণ হয়েছে। বরং সবাই একইসঙ্গে সমাবর্তনে সনদ নিয়েছেন। এখনকার শিক্ষার্থীদের এসব মেনে নিতে সমস্যা কোথায়?

সমস্যাটা খুব ভালোই বোঝা যাচ্ছে। মেডিক্যাল বা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে সমাবর্তনে সনদ নিলে, কোনো আপত্তি নেই তাদের, কারণ এ ডিগ্রিগুলো বাজারের হীরক বস্তু। কিন্তু এখনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশ গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ইনস্টিটিউট এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ঢাকাস্থ সাত কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করলে তথাকথিত প্রাচ্যের অক্সফোর্ডের শিক্ষার্থীদের মান-ইজ্জত-জাত ধূলোয় মিশে যাবে। কারণ বাজার বলেছে এদের মার্কেট-ভ্যালু নেই!

আহারে, সর্বজনের বিশ্ববিদ্যালয়, কী নিদারুণ করুণ তার শিক্ষার্থীদের হীন্মন্য বৈষম্য, ব্যবহার! কী ভয়ঙ্কর বৈষয়িক ব্যবহারিক কাণ্ডজ্ঞান!

অথচ গত কয়েক বছর হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশকাঁপানো ছাত্রআন্দোলন নেই। নেই ডাকসু নির্বাচনের প্রাণপণ দাবি। শিক্ষা-বাণিজ্য, হলদখল, সন্ত্রাস, যৌননিপীড়ন, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কিংবা শিক্ষা-গবেষণা খাতে রাষ্ট্রীয় বাজেট বৃদ্ধির দাবিতে দুর্বার বুদ্ধিবৃত্তিক ছাত্রআন্দোলন, যা দেশে নতুন দিশা দিবে। এত সব 'নেই'–এর কারণগুলোও মোটাদাগে পরিষ্কার।

যাদের ১৯৭৩এর অধ্যাদেশ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন বিষয়ে ধারণা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বজনীন ভূমিকা বিষয়ক বোঝাপড়া নেই, ইন্টারডিসিপ্লিনারি ও মাল্টিডিসিপ্লিনারি অ্যাপ্রোচ নেই, পরীক্ষার নম্বর বাগানোও বিসিএস উত্তীর্ণের 'অদ্বিতীয়' স্বপ্ন ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার অর্থবহ কারণ নেই। সেই প্রজন্মের কাছে এমন অবিবেচনাপ্রসূত, কাণ্ডজ্ঞানহীন ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় আচরণ ছাড়া আর কী-ই-বা আশা করতে পারে বাংলাদেশ।

বলাবাহুল্য, পৃথিবীসেরা যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নাম আমরা জানি সেগুলোর সেরা হওয়ার পেছনে তাদের অধিভুক্ত কলেজগুলোরও অনেক বড় অবদান রয়েছে। অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, ভারতের প্রাদেশিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একাডেমিক দায়িত্বের পাশাপাশি এখনও শুরুর মতোই বিভিন্ন কলেজের পরীক্ষা-গ্রহণকারী ও ডিগ্রি-প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করে এবং কলেজগুলো বিনা প্রশ্নে বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো, পতাকা ইত্যাদি ব্যবহার করে।

এদের সামগ্রিক বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থা নিয়ে অবশ্য আমার দ্বিমত নিয়ে একটি পাঠ আছে। সেটা এই আলোচনায় প্রাসঙ্গিক নয় বলে উহ্য রাখা হল।

৩.

বিক্ষুব্ধ এই শিক্ষার্থীরা কি জানে, যারা সেই সময় স্নাতক-স্নাতকোত্তর পাস করেছে, তাদের ফেসবুকে আইডিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ও লোগো শোভা পায় এবং সেটাও সঙ্গত কারণেই। তাদের প্রাক্তনদের এ ধরনের কোনো অহমবোধজনিত সমস্যা দেখা যায় না। বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাসে স্নাতক-স্নাতকোত্তর জীবন কাটানো বহুজনকেই দেখেছি, কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপত্র পাওয়া শিক্ষার্থীদের সহপাঠী জ্ঞান করেছেন। সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের নামিদামি পণ্ডিতদের ক্লাস করতে অধিভুক্ত কলেজের শিক্ষার্থীদেরও উপচেপড়া ভিড় ছিল এবং সেটা স্বাভাবিক জ্ঞান করা হত।

আজকের শিক্ষার্থীরা কোন ভিনগ্রহ থেকে এসেছে যে, তারা এই সিদ্ধান্ত এমন ঘৃণা, বিদ্বেষের চোখে দেখা শুরু করেছে। এ রকম দীন-হীন মানসিকতা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো মহাসমুদ্রে 'বিশ্ববিদ্যা' অর্জিত হয় নাকি! শেষ পর্যন্ত হয়তো একটি সনদ জোটে কপালে, কিন্তু তা দিয়ে দেশ-দশ-সমাজের তেমন উপকার হয় না। জনগণের টাকা দিয়ে পড়ে শেষ পর্যন্ত জনগণের সঙ্গে প্রতারণাই করা হয়।

যে কলেজগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তাদের শিক্ষার্থীদের মোটেও 'ছাগলের তৃতীয় বাচ্চা' হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। তারা এই রাষ্ট্রেরই সন্তান এবং তাদের অচ্ছুত ভাবার কারণ নেই। তাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ দেওয়া হলে খুব বেশি ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কাও নেই। কেননা কে কতটা পারঙ্গম সেটার প্রমাণ শেষ পর্যন্ত সনদ দিয়ে হবে না, মেধা দিয়ে হবে। কলেজপড়ুয়া কোনো শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল মাটিতে পড়ুয়া কোনো শিক্ষার্থীকে মেধায়-মননে-প্রতিভায় পরাজিত করে দিতে পারলে, যে জয়ী হল হয়তো সে-ই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি হয়ে উঠবে দেশে কিংবা বিশ্বমঞ্চে। এটাই বাস্তবতা।

ক্যারিয়ারকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা ও স্বার্থপরতা আজ এমন এক জায়গায় চলে গেছে যে, জ্ঞানার্জনের চেয়ে সনদের চাকচিক্যের পেছনেই শিক্ষার্থীদের ছোটাছুটি বেশি। সেই স্বার্থপরতার বীজ থেকে এমন এক 'বৃষবৃক্ষ' জন্ম নিয়েছে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ওই সনদের গরমে মাটিতেই পা ফেলতে চায় না। অথচ কথা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশ্বিক জ্ঞান শিক্ষার্থীদের বিনয়ী করবে। করেনি। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে, যে শিক্ষকদের শিক্ষায় আজ শিক্ষার্থীরা বড় হচ্ছে, তারাই মোটা দাগে শিক্ষার্থীদের এই অধঃপতনের জন্য দায়ী।

বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর অন্দরে ঢুকুন, দেখতে পাবেন এর সত্যতা। হলপ্রশাসন কী নাজুক মেরুদণ্ডহীন হয়ে ক্ষমতাসীন ছাত্রদের চাটুকারিতায় মত্ত! সেই শিক্ষকদের কাছে বিশ্ববিদ্যার বীক্ষণ ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীর জন্ম দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা করা একটু অবাস্তব দাবি হয়ে যায় বৈকি।

৪.

কদিন আগে, গবেষণার অংশ হিসেবে আমাকে একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করতে হয়েছিল। সেই উপস্থাপনায় আমি দেখিয়েছিলাম, ঔপনিবেশক আমলে উপমহাদেশে প্রতিষ্ঠিত হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিশাল অবদান আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয় রাখতে পারেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পৃথিবীর সেই বিরলতম বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অন্যতম যে একটি জাতির জন্ম দিতে ভূমিকা পালন করেছে– একটি ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় অকাতরে রক্ত বিসর্জন দিয়েছে– শিক্ষার অধিকার আদায়ে, ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছে– আর গণমানুষের মধ্যে মুক্তির চৈতন্য সৃষ্টি করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই তো দায়িত্ব। এই তার সামাজিক দায়বোধ। এই আমাদের স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়, যে আমাদের মাথা নত না করতে শিখিয়েছে।

অথচ আজ কাদের হাতে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়। যাদের সামাজিক দায়বোধ নেই, আত্মমর্যাদা নেই। হিংসা, দ্বেষ, অহম, ঘৃণা, নাকউঁচু, ছোঁয়াচে রোগে ভারাক্রান্ত যাদের মানসিকতা। যার হওয়ার কথা ছিল সবচেয়ে উদার, গণতান্ত্রিক ও মানবিক প্রতিষ্ঠান– তার শিক্ষার্থীদের মধ্যে এত বড় রক্ষণশীলতা!

এই 'অদ্ভুত উটের পিঠে' সওয়ার হয়েছে বাংলাদেশ। যে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটি এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন 'শিক্ষিত' শিক্ষার্থীতে ভরে উঠতে পারে, সে দেশের তলানিতে যাওয়াই যেন নিয়তি।