সৌদি বাদশার বালি সফর: কট্টরপন্থী আকলমন্দের জন্যে চমৎকার এক ইশারা

শিশির ভট্টাচার্য্যশিশির ভট্টাচার্য্য
Published : 12 March 2017, 03:44 PM
Updated : 12 March 2017, 03:44 PM

ইহলৌকিক ও পারলৌকিক ফায়দার জন্যে সৃষ্টিকর্তার উপাসনা করার দুই রকম কায়দা আছে: সাকার ও নিরাকার। সৃষ্টিকর্তার কল্পিত মূর্তি ব্যবহার করে যে প্রার্থনা তার নাম সাকার উপাসনা। হিন্দু ধর্মে নিরাকার ঈশ্বরের কল্পিত প্রতিকৃতিগুলোর মূর্ত রূপের নাম 'মূর্তি' বা 'প্রতিমা'। বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টান ধর্মেও যথাক্রমে বুদ্ধ ও যিশুর মূর্তি তৈরির রেওয়াজ আছে। এককালে গ্রিক ও রোমানরাও পূজার উদ্দেশ্যে থেমিস, আফ্রোদিতি ইত্যাদি দেবীর মূর্তি নির্মাণ করত। ইসলামপূর্ব যুগে আরব দেশেও লাত, উজ্জা, মানাত ইত্যাদি দেবীর মূর্তি ছিল। পাশ্চাত্যে রাস্তার ধারে বা পার্কে আফ্রোদিতি, এথেনা ইত্যাদি দেবীর মূর্তি স্থাপন করা হয়।

এই সব মূর্তি স্থাপনের উদ্দেশ্য দুটি: ১. দেশ ও সমাজের অতীত সম্পর্কে জনসাধারণকে অবহিত করা; ২. শহরের অলঙ্করণ।

ঢাকার সায়েন্স ল্যাবরেটরির মোড়ে হাতির বিশ্রি মূর্তি অথবা ক্রিকেট টুর্নামেন্টের সময় বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে বাঘের কিম্ভূত মূর্তিগুলো নির্মাণের উদ্দেশ্য শহরের অলঙ্করণ। এই হাতি বা বাঘের মূর্তির পূজা করতে কখনও কাউকে দেখা যায়নি। উপাসনার উদ্দেশ্যে নির্মিত মূর্তির সঙ্গে অলঙ্করণের উদ্দেশ্যে নির্মিত মূর্তিকে গুলিয়ে ফেললে চলবে না।

ইন্দোনেশিয়া বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিমপ্রধান দেশ, কিন্তু তার একটি হিন্দু অতীত রয়েছে। দেশটির বেশিরভাগ জায়গায় হিন্দু ধর্ম প্রায় মুছে গেলেও কীভাবে যেন বালি দ্বীপে ধর্মটি এখনও টিকে রয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার কোনো সরকারই অবশ্য তার হিন্দু অতীত মুছে ফেলতে আগ্রহী ছিল না। এর অন্যতম প্রমাণ, হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর বাহন গরুড় পক্ষীর নামানুসারে ইন্দোনেশিয়ার এয়ারলাইন্সের নাম রাখা হয়েছিল 'গারোরা'। এছাড়া মুসলিমপ্রধান জাকার্তা শহরে (এবং হয়তো অন্য অনেক শহরেও) হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি স্থাপন থেকে বোঝা যায়, সেদেশের সরকার ও জনগণের বৃহদাংশ দেশটির হিন্দু অতীত সম্পর্কে কমবেশি শ্রদ্ধাশীল।

সম্প্রতি সৌদি আরবের বাদশা সালমান বিন আবদুল আজিজ ইন্দোনেশিয়া সফরে গেলে জাকার্তা শহরের মূর্তিগুলো কাপড় বা অন্য কিছু দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় বা গাছের ডালপালা দিয়ে আড়াল করে দেওয়া হয়, যদিও বাদশা ইন্দোনেশিয়া সরকারের উপর অনুরূপ কোনো শর্ত চাপিয়ে দিয়েছিলেন বলে জানা যায়নি।

যেটি লক্ষ্য করার মতো সেটা হচ্ছে, বালি দ্বীপের কর্তৃপক্ষ শহরের হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি ঢেকে দেবার সরকারি নির্দেশ মান্য করেনি। কিন্তু সৌদি বাদশা এতে আপত্তি করা তো দূরের কথা, বরং হাজারের উপর সফরসঙ্গী নিয়ে তিনি বালি দ্বীপে তাঁর সফরের সময়সীমা তিন দিন বাড়িয়ে দিয়েছেন। বালির হিন্দু মন্দিরের কাঁসর ও ঘণ্টাধ্বনি অবশ্যই বাদশার কর্ণকুহরে প্রবেশ করেছে, কিন্তু এতে তাঁর নিজের ধর্মপালনে নিশ্চয়ই অসুবিধা হয়নি, যেমন অসুবিধা হয় না বালি দ্বীপে বসবাসরত অন্য মুসলমানদেরও।

গত বছর রোমে ইরানি প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির সফরের সময় তাঁর সম্মানে একটি যাদুঘরে প্রাচীন যুগের একটি নগ্ন মূর্তি কাঠের আবরণে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল। এককালের মহান রোমান এবং পারস্য সাম্রাজ্যের মানুষের রূচির কী নিদারুণ অধঃপতন! সুস্থ মানসিকতার কোনো লোক যাদুঘরে যায় মানবসভ্যতার অতীত দেখতে, সেই অতীত তার পছন্দ হোক বা না হোক। কিন্তু সেই অতীতই যদি ঢেকে দেওয়া হয়, যেমন ধরা যাক, কাউকে প্যারিসের লুভর মিউজিয়মে ভেনাস দেখাতে গিয়ে যদি ভেনাসের নগ্ন বুক ওড়না দিয়ে ঢেকে দিতে হয়, তবে (সে যে ধর্মের বা যে পদের লোকই হোক না কেন) তার ভেনাস দেখার এত শখ কেন?

বাংলাদেশে হাইকোর্টের সামনে নির্মিত ন্যায়বিচারের রোমান দেবী থেমিসের শাড়িপরা মূর্তি সরানোর দাবি করেছে একাধিক গোষ্ঠী। কয়েক দশক আগেও বিভিন্ন ভাষ্কর্য ভাঙার হুমকি দেওয়া হয়েছিল বাংলাদেশে; কয়েকটি ব্যর্থ চেষ্টাও হয়েছিল। সে সময় বিমান অফিসের সামনের বকগুলিও ভাস্কর্য-বিরোধীদের হাতুড়ির আঘাত থেকে রক্ষা পায়নি। বলাবাহুল্য, বক ভাস্কর্য নির্মাণের উদ্দেশ্য উপাসনা নয়, নিছকই অলঙ্করণ। থেমিস দেবীর ভাস্কর্যটি উপাসনার উদ্দেশে ব্যবহারের প্রশ্নই উঠে না, কারণ শেষ রোমান মূর্তিপূজকটিও মরে ভূত হয়ে গেছেন হাজার দেড়েক বছর আগে।

মূর্তি সরানো না হলে একটি গোষ্ঠী বাংলাদেশ থেকে হিন্দু বিতাড়নের হুমকি দিয়েছে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর এখানে-ওখানে বছরে কয়েকবার অত্যাচার-নির্যাতন হয় বটে, কিন্তু সেই অন্যায়ের সঙ্গে ন্যায়বিচারের রোমান দেবীর কী সম্পর্ক তা পরিষ্কার করে বলা হয়নি।

বিচার বিভাগের কাছ থেকেও যে প্রশ্নগুলোর উত্তর মেলেনি সেগুলো হচ্ছে: 'ধর্ম' নামে ন্যায়বিচারের এক হিন্দু দেবতা থাকতে হঠাৎ রোমান দেবীর মূর্তিই-বা কেন স্থাপন করতে হল? রোমান দেবী যদি তিনি হবেন, তবে মূর্তির পরনে শাড়ি কেন? বাংলাদেশের মতো একটি মুসলিমপ্রধান দেশের প্রধান বিচারালয়ের সামনে একটি দেবীমূর্তি স্থাপন কি অপরিহার্য ছিল? বিমূর্ত কোনো শিল্পকর্মের কথা কি ভাবা যেত না?

জাকার্তা ও রোমে নগ্ন বা অর্ধনগ্ন ভাস্কর্য ঢেকে দেওয়া এবং ঢাকায় রোমান দেবীর মূর্তি অপসারণের দাবি একটি বিশেষ মানসিকতার প্রতিফলন। বালিতে মূর্তি না ঢাকার সিদ্ধান্ত এবং সৌদী বাদশার পক্ষ থেকে সেই সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান দেখানো অন্য একটি মানসিকতার প্রতিফলন। প্রশ্ন হতে পারে: কোন মানসিকতাটি বেশি ইসলামসম্মত ও যুক্তিসঙ্গত?

ইসলাম ধর্মে সাকার প্রার্থনা 'শিরক' বা প্রায় মহাপাপের পর্যায়ে পড়ে। দ্বিতীয়ত, ইসলাম অংশীবাদী ধর্ম নয়, অর্থাৎ এক সৃষ্টিকর্তা ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর উপর দেবত্ব বা ঈশ্বরত্ব আরোপ করা ইসলাম ধর্মে নিষিদ্ধ। সুতরাং কোনো নবী, ফেরেস্তা, মানুষ বা প্রাণির মূর্তি নির্মাণ বা চিত্রাঙ্কন হারাম বলে বিবেচিত হবে যদি: ১. যদি তা উপাসনার উদ্দেশ্যে করা হয়; অথবা ২. যদি সেই ভাস্কর্যের উপর ঈশ্বরত্ব আরোপ করা হয় বা করার সম্ভাবনা থাকে।

ইসলাম কোনোক্রমেই অনুমোদন করে না এমন প্রায় প্রত্যেকটি বিষয়, যেমন মদ্যপান, সুদগ্রহণ, ব্যভিচার, মূর্তিপূজা ইত্যাদি নিষিদ্ধ করে কোরানের একাধিক সুরায় একাধিক আয়াত আছে। কিন্তু কোরানের কোনো সুরার একটি আয়াতেও অলঙ্করণের উদ্দেশে ভাস্কর্য বা মূর্তি নির্মাণ নিষিদ্ধ করে সুস্পষ্ট নির্দেশ থাকার কথা কেউ কখনও বলেনি। সুরা আল ইমরানের ৪৯ নং আয়াতে বরং মূর্তি নির্মাণের উল্লেখ আছে: "আমি যদি কাদা দিয়ে একটি পাখির মূর্র্তি তৈরি করি এবং তাতে ফুঁ দিই, তবে সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় মূর্তিটি পাখিতে পরিণত হয়।"

বস্তুত, উপাসনা ছাড়া অন্য উদ্দেশ্যেও যে মূর্তি নির্মিত হতে পারে আরব অঞ্চলে তা অজানা ছিল না। এর প্রমাণ আছে সুরা সাবার ১৩ নং আয়াতে:

"(সৃষ্টিকর্তার নির্দেশে) তারা (অর্থাৎ জ্বিনেরা) তাঁর (অর্থাৎ ইহুদি বাদশা সোলেমানের) জন্যে মূর্তি প্রতিষ্ঠার 'গর্ভগৃহ' (ভাস্কর্যের পেছনে ফাঁপা খোপ, আফগানিস্তানের বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তির পেছনে যেমন ছিল) ও মূর্তি, পুকুর-প্রমাণ থালা-বাটি ও স্থানান্তর-অযোগ্য (রান্নার সুবৃহৎ) হাঁড়ি নির্মাণ করল।"

উল্লিখিত মূর্তিগুলো যে ইহুদিদের উপাসনার উদ্দেশ্যে নয়, বরং অলঙ্করণের উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছিল, এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়।

সুরা মায়দার ৯০ নং আয়াতে 'মদ, জুয়া, আল আনসাআব এবং ভাগ্যনির্ধারক শরসমূহ থেকে মুসলমানদের দূরে থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ন-স-ব ধাতু দিয়ে গঠিত 'আনসাআব' শব্দটির ব্যুৎপত্তি নিম্নরূপ: উপসর্গ {আ}+ ধাতুকণা {ন+স} মধ্যসর্গ{আআ}+ধাতুকণা{ব}। মধ্যসর্গ যদি দীর্ঘ {আআ}-এর পরিবর্তে হ্রস্ব {আ} হয়, তবে শব্দটির অর্থ দাঁড়ায় 'উত্তম', 'উপযুক্ততর' ইত্যাদি।

'আনসাব' শব্দটি ইসলাম-পরবর্তী যুগে আরব অঞ্চলে ব্যক্তিনাম হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কিন্তু ছেলে বা মেয়ের নাম 'আনসাআব' রাখা হয় না। কারণ শব্দটির অর্থ হচ্ছে 'প্রাগ-ইসলামি যুগে ব্যবহৃত পূজার বেদি', 'দেবতার বেদি', 'পশুউৎসর্গের জন্যে ব্যবহৃত বেদি' ইত্যাদি। সুতরাং কোনো কোনো আরবিভাষীর ভাষাবোধে 'আনসাআব' শব্দের অর্থ 'পূজার উদ্দেশ্যে নির্মিত প্রতিমা বা মূর্তি' হলেও হতে পারে, কিন্তু শব্দটির অর্থ কোনো মতেই 'অলঙ্করণের উদ্দেশ্যে নির্মিত ভাষ্কর্য' নয়।

বিদায় হজ্বের ভাষণ, যাকে ইসলামি জীবনাচরণের সারসংক্ষেপ বলা যেতে পারে, তাতে কোরান ও সুন্নাহ উভয়ের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। 'সুন্নাহ' কথাটির মানে হচ্ছে 'মহানবীর জীবনাচরণ' বা অন্য মতে 'মহানবীর সময়কালে আরবদেশের প্রচলিত রীতিনীতি'। চিত্রাঙ্কন হজরত মুহম্মদ (সা:) খুব একটা প্রশংসার চোখে দেখতেন না, এ রকম ধারণা সমর্থন করে একাধিক হাদিস রয়েছে। একটি হাদিসে বলা হয়েছে, হজরত আয়েশার (রা:) কক্ষে প্রাণির ছবিযুক্ত একটি পর্দা ঝুলছে দেখে হজরত মুহম্মদ (সা:) অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন। তিনি বলেন, শেষ বিচারের দিন সৃষ্টিকর্তা ঐসব ছবির চিত্রকরকে ছবিগুলোতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে বলবেন এবং তিনি যখন তা করতে অক্ষম হবেন তখন তাকে তার কৃতকর্মের জন্যে (অর্থাৎ ছবি আঁকার জন্যে) কঠিনতম শাস্তি দেওয়া হবে।

এই হাদিসের ভিত্তিতে দাবি করা হয় যে, সুন্নাহ চিত্রকলা অনুমোদন করে না। আমরা জানি, কুমির, বিড়াল, শিয়াল ইত্যাদি অনেক প্রাণিকেই মিশর ও আরব অঞ্চলে দেবতা হিসেবে পূজা করা হত। আয়েশার কক্ষে যে ছবিগুলো মহানবীর ক্ষোভের কারণ হয়েছিল সেগুলো যদি জাহিলিয়া যুগের কোনো আরাধ্য প্রাণির ছবি হয়ে থাকে তবে তাঁর রাগ করার সঙ্গত কারণ ছিল বৈকি।

মূর্তিপূজার ব্যাপারে মধ্যপ্রাচ্যের নবীদের হাজার বছরের তিক্ত অভিজ্ঞতা ছিল। সেমিটিক জাতিসমূহের ধর্মাচরণের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, তারা একাধিকবার এক সৃষ্টিকর্তার নিরাকার উপাসনা ভুলে গিয়ে বহু দেবদেবীর সাকার উপাসনায় অভ্যস্ত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, মুসা নবী (সা:) নিরাকার য়াহবের কথা নিশ্চিতভাবে বলার পরেও ঈহুদিরা গোবৎসের পূজা শুরু করেছিল (সুরা বাকারা দ্রষ্টব্য)।

আইয়ামে জাহিলিয়া যুগে আরবেরা হযরত ইব্রাহিমের একেশ্বরবাদী ধর্ম ভুলে গিয়ে কাবা শরীফে এবং আরবের অন্যত্র বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি পূজা করত। আরব দেশে দেবদেবীর মূর্তিপূজা বা ঈশ্বরের সাকার উপাসনার অবসান হয় মক্কা বিজয়ের অব্যবহিত পরে, যখন নবী হযরত মুহম্মদ (সা:) কাবা শরীফের ৩৬০টি দেবদেবীর মূর্তি চূর্ণ-বিচূর্ণ করেন (মতান্তরে অন্য একটি উপাসনালয়ে অপসারণের নির্দেশ দেন)।

ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে উপাসনার উদ্দেশ্যে ভাস্কর্য নির্মাণ হারাম, এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু উপাসনা ছাড়াও ভাস্কর্য নির্মাণের আরও দুটি উদ্দেশ্য থাকতে পারে: ১. শিল্পসৃষ্টি; ২. জাগতিক প্রয়োজন। প্রাচীন যুগে মূর্তি বা ভাস্কর্য নির্মাণের দুটি প্রধান কারণ ছিল: ১. দেবতার পূজা; ২. উপাসনাগৃহের অলঙ্করণ। তক্ষশীলা-অজন্তা-ইলোরা-পাহাড়পুর-এথেন্সে এই দুই ধরনের ভাস্কর্যই রয়েছে। আশ্বিন-কার্তিক মাসে বাংলা অঞ্চলে লক্ষ লক্ষ দুর্গামূর্তি নির্মাণের মুখ্য উদ্দেশ্য উপাসনা, গৌণ উদ্দেশ্য শিল্পসৃষ্টি।

পক্ষান্তরে রোঁদার 'চিন্তামগ্ন', মিলোর 'ভেনাস' বা আবদুল্লাহ খালিদের 'অপরাজেয় বাংলা' ইত্যাদি ভাস্কর্য স্রেফ শিল্পসৃষ্টির উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছে। এই সব ভাস্কর্যের সঙ্গে সৃষ্টিকর্তার উপাসনার কোনো সম্পর্ক নেই।

জাগতিক প্রয়োজনেও মানুষকে মূর্তি নির্মাণ করতে হয়। উদাহরণস্বরূপ, অন্য সব জাতির শিশুদের মতো মুসলমান শিশুরাও পুতুল নিয়ে খেলে। মহানবীর অনুমোদনক্রমে পুতুল নিয়ে খেলতেন তাঁর স্ত্রী হজরত আয়েশা (রাঃ)। অন্য সব দেশের কৃষকদের মতো মুসলমান কৃষকেরাও পাখির উপদ্রব থেকে ফসল রক্ষার জন্যে কাকতাড়ুয়া তৈরি করে থাকে। এই পুতুল বা কাকতাড়ুয়াগুলো এক একটি (অতিসাধারণ) মূর্তি নয় কি?

ইসলাম যখন নাজেল হয় তখন ক্যামেরা ছিল না বলে আলোকচিত্র হারাম নাকি হালাল সে প্রশ্ন ওঠেনি। তবে ছবি আঁকা যদি নিষিদ্ধ হয়, আলোকচিত্রও নিষিদ্ধ হওয়া উচিত বৈকি। কিন্তু এমন কোনো মুসলিমপ্রধান দেশ কি আছে যেখানে লোকে ছবি তুলতে বাধ্য হয় না, অন্তত পাসপোর্ট করার জন্যে? চিত্রাঙ্কন যদি নিষিদ্ধ হয়ে থাকে তবে নিষিদ্ধ হওয়া উচিত টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র। কারণ এগুলো (প্রতি সেকেন্ডে ২৫/২৫টি) চলমান চিত্র বৈ তো নয়।

এ ধরনের জাগতিক প্রয়োজন বা শিল্পসৃষ্টির উদ্দেশ্যে নির্মিত ভাস্কর্য, ছবি বা সঙ্গীত ইসলামে নিষিদ্ধ হবার যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে কিনা তা ভেবে দেখা যেতে পারে। সর্বজ্ঞ সৃষ্টিকর্তা মানুষের কর্মের উদ্দেশ্য (অর্থাৎ কী উদ্দেশ্যে তারা মূর্তি নির্মাণ বা চিত্রাঙ্কন করছে) আমলে নিয়েই তাদের ব্যাপারে বিধেয় স্থির করবেন, এ রকম ধারণা অমূলক নয়।

ধর্ম ও সমাজ আদৌ মূর্তিমুক্ত করা যাবে কিনা সে প্রশ্নও উঠতে পারে। গ্রিক ভাস্করেরা দেবী আফ্রোদিতি বা ভেনাসের যেসব মূর্তি তৈরি করেছিলেন সেগুলোর চেহারা ঠিক একই রকম ছিল না, যদিও গ্রিকদের কাছে একই আফ্রোদিতি বা ভেনাসের মূর্তি ছিল সেগুলো। দেবী সরস্বতীর এক একটি মূর্তির চেহারা এক এক রকম, কিন্তু এই সব মূর্তি দেখে হিন্দুদের মনে একই সরস্বতীর ভাবনা জাগে। ঈশ্বর, ভগবান, খোদা, গড– এই শব্দগুলোও একই সৃষ্টিকর্তার ভাবনা জাগায় আমাদের মনে, যদিও শব্দগুলো ধ্বনিগতভাবে আলাদা। এই শব্দগুলোও মূর্তি, তবে 'কথামূর্তি'।

মূর্তি অনেক রকম আছে, প্রতিমা, কথামূর্তি, লিপিমূর্তি, ভাবমূর্তি। একজন মানুষ যখন কাউকে বলতে শোনে বা কোথাও পড়ে যে, সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছেন (হিন্দু ধর্মের ক্ষেত্রে), কোনো নবীর কাছে দেবদূত/ফেরেশতা পাঠাচ্ছেন, কোনো নবীর সঙ্গে কথা বলছেন বা নবী নিজেই সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন (সেমিটিক ধর্মগুলোর ক্ষেত্রে), তখন তার মনে কি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সৃষ্টিকর্তার কোনো 'ভাবমূর্তি' বা 'কথামূর্তি' সৃষ্টি হতে পারে না?

শুধু তাই নয়, এই ভাবমূর্তি নির্মাণে ব্যাকরণেরও ভূমিকা আছে। আরবি ভাষায় বিশেষ্যগুলো পুং ও স্ত্রী এই দুই ভাগে বিভক্ত। আরবিভাষী মুসলমান, খ্রিস্টান, ইহুদিদের দ্বারা ব্যবহৃত সৃষ্টিকর্তাবাচক 'আল্লাহ' শব্দটি পুংলিঙ্গ। এই শব্দের সঙ্গে ব্যবহৃত বিশেষণ ও ক্রিয়াপদে পুংলিঙ্গ বিভক্তি যুক্ত হয়। হিন্দি-উর্দু, ইংরেজি বা ফরাসিতেও সৃষ্টিকর্তা পুংলিঙ্গ। এভাবে মানুষের ভাবনায় পুরুষ সৃষ্টিকর্তার ভাবমূর্তি, বাচনে কথামূর্তি এবং লিখনে লিপিমূর্তি সৃষ্টি হয়ে চলে।

মানবভাষার শব্দকোষে প্রতিটি শব্দই এক একটি মূর্তি যার একদিকে আছে দ্যোতক/রূপ (সিগনিফাইয়ার) আর অন্যদিকে আছে দ্যোতিত/অর্থ (সিগনিফাইড)। ভাষা মানেই মূর্তির খেলা। যে কোনো মানবভাষা ব্যবহার করতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে আপনার মস্তিষ্কে অবিরাম ছবি বা মূর্তি সৃষ্টি হয়ে চলবে। মানুষের জীবন এত বেশি মূর্তিময় যে, তা সম্পূর্ণ মূর্তিহীন করা অসম্ভব।

ধরা যাক, ভারতের কোনো এক বিমানবন্দরের সামনে স্বামী বিবেকানন্দের একটি মূর্তি ছিল। কোনো কারণে সেই মূর্তি সরিয়ে সেখানে যদি দেবনাগরী অক্ষরে 'ঈশ্বর' কথাটা লিখে দেওয়া হয় স্টেইনলেস স্টিল দিয়ে, তবে তার মানে দাঁড়াবে এই যে, ইট-কাঠ-মাটি-ধাতুর একটি প্রতিমার জায়গায় স্টেইনলেস স্টিল দিয়ে তৈরি সৃষ্টিকর্তার একটি 'লিপিমূর্তি' বসিয়ে দেওয়া হল। কোনো না কোনো ফর্মে মূর্তি তো থেকেই গেল। ঢাকা বিমানবন্দরের সামনে বাউল-ভাস্কর্য অপসারণ করে সে জায়গায় স্টেইনলেস স্টিলে লেখা 'আল্লাহ' শব্দ স্থাপন করার অর্থও তাই দাঁড়ায়।

এই লিপিমূর্তি যদি কারও মনে সৃষ্টিকর্তার ভাবনা জাগায়, তবে তাকে দোষ দেবেন কী করে? আর দোষ দেবেনই-বা কেন?

পূজার উদ্দেশ্যে তৈরি মূর্তি আর সুকুমার ভাস্কর্য যে এক করে দেখা চলে না, এই ব্যাপার ঠিকঠাকমতো না বোঝার ফলে ইতিহাসের একাধিক সন্ধিক্ষণে বিভিন্ন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে কট্টর মনোভাবাপন্ন একাধিক গোষ্ঠী ভাস্কর্যের ঘোর বিরোধিতা করেছে। আফগান সমাজ মূর্তিমুক্ত করার জন্যে বামিয়ানের পাহাড়প্রমাণ বুদ্ধমূর্তিকে ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, যদিও হাজার বছর ধরে আরব-তুর্কি-পাঠান-মোঘল সৈন্যদল সে মূর্তির সামনে দিয়ে কুচকাওয়াজ করে চলে গেছে।

কম্বোডিয়ার একটি মৌলবাদী গোষ্ঠী বরোবুদুর মন্দিরে হামলা চালিয়েছে নিজেদের পূর্বপুরুষের অমুসলিম অতীত মুছে ফেলতে। মিশরেও এমন একটি মূর্তিবিরোধী ফতোয়া জারি হয়েছিল যার প্রেক্ষিতে ফারাওঁ আমলের ভাষ্কর্য (যেমন স্ফিংস) ভাঙায় উৎসাহ বোধ করেছিলেন কট্টরপন্থীরা। ইসলামিক স্টেটের সদস্যরা অতিসম্প্রতি সিরিয়ার পালমিরার ভাষ্কর্য ধ্বংস করেছে। অথচ ইসলাম নাজেল হওয়ার পর চৌদ্দশত বৎসর ধরে এই ভাষ্কর্যগুলো অটুট ছিল।

স্বদেশের ঐতিহ্যধ্বংসী এই সব অপকর্মের পেছনে পাশ্চাত্য ইন্ধন অবশ্যই রয়েছে, তবে মূর্তিধ্বংসে কট্টরপন্থীদের নিজেদের উৎসাহও কম নয়। তার উপর জনগণের একাংশের নিরব সমর্থনও রয়েছে এদের প্রতি।

বৈচিত্র্য জীবনের অন্যতম ধর্ম। হাতের পাঁচ আঙুল সমান হয় না। ইসলাম নাজেল হওয়ার পূর্বেও পৃথিবীতে ধর্ম ছিল এবং সেই সব ধর্মের আচার ও ঐতিহ্য ইসলামসম্মত না হওয়ারই কথা। পৃথিবীতে ইসলাম ছাড়াও ধর্ম আছে এবং এসব ধর্মের সব আচার ও ঐতিহ্য ইসলামসম্মত হবেই, এমন কথা নেই। মুসলমানদের যেমন অন্যদের আচার-ঐতিহ্য মেনে নিতে হবে, তেমনি মুসলমানদের আচার-ঐতিহ্যের প্রতিও সম্মান দেখাতে হবে অন্যদের।

বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে পার্থক্যের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে বিদায় হজ্বের ভাষণে ও কোরান শরীফের সুরা আল হুজুরাতের ১৩ নং আয়াতে:

"তোমাদের আমি সমাজ ও গোত্রে বিভক্ত করেছি যাতে তোমরা পরস্পরের পরিচয় জানতে পার।"

এই দৃষ্টিকোণ থেকে বালিতে সৌদি বাদশাহের আচরণ ইসলামসম্মত ও যুক্তিসঙ্গত ছিল বলে মনে হয়। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং বিশ্বশান্তির লক্ষ্যে বাদশাহের এই আচরণ অনুকরণীয় বিবেচিত হওয়া উচিত।

ভাস্কর্য সম্পর্কে সব মুসলমান যে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেন না, তার প্রমাণ মুসলমানপ্রধান অনেক দেশে ভাস্কর্য রয়েছে। খোদ সৌদি আরবের রাস্তায় থাকা ভাস্কর্যের বেশ কয়েকটি ভাষ্কর্য মরুভূমির জাহাজ উটের। এছাড়া আরব দেশগুলোতে বাদশাহের বড় বড় ছবিও রাখা হয় বিমানবন্দরসহ সর্বত্র। ছবি ও ভাস্কর্য যদি একান্তই ইসলামবিরোধী হত, অথবা শিল্পকলা সম্পর্কে ওয়াহাবিপন্থী সৌদি সরকার বা জনগণ যদি নেতিবাচক ধারণা পোষণ করত, তবে নিশ্চয়ই এতদিনে সে দেশের কট্টরপন্থীরা এই ভাষ্কর্য ও ছবিগুলো অপসারণের দাবি তুলত।

পোপের চেয়ে বেশি ক্যাথলিক হতে চাওয়াটা যদি কেউ মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ বলে মনে করে, তবে তাকে দোষ দেওয়া যায় না। উর্দু প্রবাদ আছে: 'আকলমন্দ কি লিয়ে ইশারা হি কাফি হ্যায়'। বাংলাদেশের কট্টরপন্থী সব আকলমন্দ এবং সরকার ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা তাদের নিরব সমর্থকেরা কি সৌদি বাদশার উদারনৈতিক ইশারা আদৌ আমলে নেবেন?

[লেখকের 'ঈশ্বর-ধর্ম-বিশ্বাস' পুস্তক অবলম্বনে]