মার্চের বিরুদ্ধে মার্চ

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 11 March 2017, 05:14 AM
Updated : 11 March 2017, 05:14 AM

আবেগ আমাদের সম্পদ আবার আমাদের ভয়ের জায়গাও বটে। এই মার্চে আমাদের মিডিয়া যখন 'স্বাধীনতার মাস' বা 'অগ্নিঝরা মার্চ' বলে তাকে চিহ্নিত করছে তখন আমাদের অজান্তেই চলছে ষড়যন্ত্র। দেশের সামাজিক চেহারা আর জাতির উন্নয়ন একসঙ্গে পা ফেলতে পারছে না। উন্নয়ন যে হচ্ছে সেটা সবাই স্বীকার করেন, কিন্তু এর কোনো ক্রেডিট সরকারকে দিতে নারাজ। বলা বাহুল্য, এ জন্য সরকারের কর্মকাণ্ডও কম দায়ী নয়। বিশেষত সরকারের উচ্চপদে থাকা মানুষ মাঝেমধ্যে সব গুবলেট করে ফেলেন। কো-অর্ডিনেশন বা পারস্পরিক সংযোগের অভাব বড় প্রকট।

সরকারের বড় পদে থাকা মানুষ যখন পরস্পরবিরোধী কথা বলেন জাতি বিভ্রান্ত হবে, এটাই স্বাভাবিক। অনেকদিন থেকে ড. ইউনূস আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। নোবেলবিজয়ী এই মানুষটিকে নিয়ে টানাহ্যাঁচড়ার অন্ত নেই। এখন এমন এক পরিবেশ, এমন এক বাস্তবতা তাঁকে নিয়ে কিছু বলা যেমন মুশকিল, তেমনি তাঁকে সমর্থন বা তাঁর বিরোধিতা করাও বিপজ্জনক।

এটা তো মানতে হবে, এ দেশে ড. ইউনূসই প্রথম নোবেলবিজয়ী। সে উজ্জ্বলতা আমাদের জাতির অহংকার। তিনি যেমন তাঁর ভূমিকা ঠিকভাবে পালন করতে পারেননি তেমনি সরকারি দলও তাঁকে ইচ্ছেমতো টানাটানি করে আজ সবটাই লেজেগোবরে করে ফেলেছে।

ধরে নিলাম সরকারি দলের সঙ্গে ড. ইউনূসের বিরোধিতা যৌক্তিক, তাঁর দোষ ত্রুটিও ফেলনা কিছু না। তারপরও এই জাতীয় টানাটানি না হলেই কি চলত না? তিনিও পারতেন লবিং বা বিদেশি প্রভাবমুক্ত থেকে নিজের সম্মানে অটল ও অবিচল থাকতে। দুর্ভাগ্য আমাদের তাঁকে জানালা করে সে জানালায় দুনিয়া দেখার পরিবর্তে তাঁকে বলা হচ্ছে 'সুদখোর'। সেটাই যদি সরকারি দলের নীতি হয় তো সিনিয়র মন্ত্রী, প্রভাবশালী অর্থমন্ত্রী কীভাবে তাঁর বন্দনা করেন? আবার সে বন্দনার নিন্দায় মুখ খোলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী?

মার্চ মাসে আমরা দেখলাম অনেকদিন না হওয়া সেই হরতাল বা ধর্মঘটের অপঘটনা। সেখানেও সরকারের মন্ত্রীর যোগসাজশের কথা উঠেছে। গণপরিবহন ধর্মঘটের নামে দেশজুড়ে যে অসভ্যতা যে বেপরোয়া মনোভাব তার সঙ্গে এতদিনে গড়ে ওঠা মনমানসিকতা মেলেনি। তার মানে এখনও শর্ষেতে ভূত আছে। মানুষ কি আসলেই বোকা? তারা কি বুঝতে পারছে না কোনো বিশেষ মহলের ইশারা ছাড়া এমন ঘটনা ঘটা অসম্ভব। বাংলাদেশের মেধাবী মানুষের জান কেড়ে নেওয়া যানচালকেরা কি আইনের ঊর্ধ্বে?

এই দুর্ঘটনায় আমি আমার যৌবনের অন্যতম প্রিয় বন্ধু আঁকিয়ে ঢালী আল মামুনকে হারাতে বসেছিলাম। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া তাঁকে দেখতে গিয়ে হকচকিয়ে গেছিলাম। তখনও শরীরে সেই দুর্ঘটনার দাগ, কথা বলছিলেন কষ্ট করে।

অনেকটা ইচ্ছাকৃত ঘটানো এসব দুর্ঘটনার বিচার না চাওয়ার কোনো কারণ আছে আসলে? অথচ এ নিয়ে জলঘোলা হল দেশে। এখন যে কোনো কারণে তা চাপা পড়ে আছে বটে, কিন্তু কেউ জানে না তলে তলে কোন আপস বা ষড়যন্ত্র চলছে। যা-ই চলুক মার্চের শুরুতে এই ঘটনা আরেক 'বিপদ সংকেত'।

এ লেখা যখন লিখছি, আদালত প্রাঙ্গণ থেকে বিচার ও ন্যায়ের প্রতীক ভাস্কর্যটি নিয়েও ঝামেলা চলছে। হেফাজতের নামে সংঘবদ্ধ জামায়াত-বিএনপি ও সব অপশক্তি আসলে যা চায় তা আমাদের অজানা নয়। ইতোমধ্যে শাহবাগ নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। তার ভেতরে যত চেতনা আর শক্তি থাকুক না কেন এখন সে বলহীন। যারা একসময় এর জন্য সময় দিয়েছেন যেসব মিডিয়া খেয়ে না-খেয়ে শাহবাগকে তুলে ধরত তারা এখন দায়সারা গোছের কিছু একটা করেই খালাস। এই সুযোগে হেফাজত যদি তাদের দাবিদাওয়া একেক করে আদায়ের নামে আবার তাণ্ডব শুরু করে তবে ছাড় দেওয়ার রাজনীতি কি আবারও আমাদের নিচে নামাবে না? আদালত প্রাঙ্গণ থেকে ভাস্কর্য সরানোর এই উদ্ভট চাওয়ার পেছনে আছে দূরগামী ষড়যন্ত্র। সেই পুরনো সাম্প্রদায়িকতা সেই পুরনো বিদ্বেষ দেশকে আবার পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরিয়ে নেওয়ার চক্রান্ত ছাড়া আর কিছুই না। এরা থেমে নেই। ছলে-বলে-কৌশলে তারা মার্চের আগুনে দেশ জ্বালাতে চাইছে।

এই মার্চে আমরা আরও একটা বিষয়ে উদ্বিগ্ন হচ্ছি। দেশে এত আওয়ামী লীগ আগে কেউ দেখেনি। হেন কোনো জায়গা নেই, হেন কোনো পেশা নেই যাতে লীগের নাম ঢোকেনি। সেদিন সামাজিক মিডিয়ায় দেখি একুশের শ্রদ্বাঞ্জলি জানাতে ফুল দিয়েছে 'তরকারী লীগ'। এমনও হয়, না হতে পারে? আওয়ামী লীগ দেশ শাসনে তাদের সঙ্গে লড়ার মতো কোনো দল নেই, কোনো রাজনীতি নেই। এই একমাত্র শক্তি হওয়ার পরও তাদের নামে এত দল এত শাখা-প্রশাখা গজায় কী করে?

সভানেত্রী শেখ হাসিনার হাতে সময় নেই, থাকার কথাও না। তিনি এখন দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও আলোচিত এক নাম। তাঁর সৌরভ, তাঁর গুণ, তাঁর বলিষ্ঠতা যখন ঘরে-বাইরে দেশ ও জাতিকে বড় করে তুলছে তখন অন্যরা কি করছেন? দলের সাধারণ সম্পাদক বা অন্যান্য নেতারা কি জানেন না দেশের চারদিকে লীগের নামে কি চলছে? এভাবে চলতে থাকলে মানুষের মনে যে রাগ ও বেদনা জমবে, তা কি ছেড়ে কথা বলবে?

আরও একটা ভয়ের ব্যাপার: দেশের সংস্কৃতি প্রায় নিবীর্য ও গতিহীন। তার নৈমিত্তিক কাজগুলো চললেও যেভাবে একসময় সংস্কৃতি দ্রোহের আগুন জ্বালাত, সামাল দিত তার ছিঁটেফোটাও নেই আর। মার্চের সাহস ও শক্তি টিভি কিংবা কাগজনির্ভর হতে পারে না; তার চাই মানুষের সমর্থন। একদা যেমন সে পথ দেখিয়েছিল এরশাদের পতন অব্দি তার যে শৌর্য, তার ভেতরের যে আগুন তাকে আবারও জ্বালাতে হলে সংস্কৃতিকে সামনে আনতেই হবে। সে কাজটা থেমে আছে। সবকিছুতে মোশতাকদের আগমন ও দখলের লড়াই চলছে দেশে।

চারদিকে এত লীগ, এত নেতা, এত মুজিব অনুসারী দেখে অামার ভয় হয়। তিনি তো বঙ্গবন্ধু, যারা তাঁকে সে পরিচয়ে মানে না, যারা পিতাকে মানে না, যারা মুক্তিযুদ্ধ মানে না, বোঝে না তারা এখন সরব। এমন ভাব, এমন ঝামেলা পঁচাত্তরেও দেখেছিলাম। এক নেতা এক দেশ বলে শ্লোগান দেওয়া লোকরাই ১৫ অাগস্টে মিষ্টি বিতরণ করেছিল। অাজ যারা লীগের নামে লুটপাট ও অরাকজকতা চালাচ্ছে, তারা চোখ উল্টাতে বেশি সময় নেবে না।

মার্চ একটি ঐতিহাসিক ভাষণেরও মাস। সেই জনসমুদ্রে জনক তাঁর ভাষণে বলেছিলেন:

"এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।"

সে মুক্তি শুধু জমিন বা পতাকার না, এই মুক্তি বাঙালি ও বাংলার। যা অাজও পাইনি অামরা। এই ভাষণটি দুনিয়ার সেরা ভাষণের নামকরা সংকলনে নেই। নেই দুনিয়ার জরুরি ভাণ্ডারে। করবে করবে বলে যারা টাকা নিয়েছে তারা সুযোগের অপেক্ষায়।

দিনে দিনে মোশতাকের ভিড়ে তরী কানায় কানায় ভরে উঠছে। লীগ ভুলে গেছে অাগে মোশতাক এসেছিল তারপর জিয়াউর রহমাান বা এরশাদ। নয়া মোশতাকরা খাল কাটছে নতুন কুমির অানবে বলে। অাদর্শহীন এমন রাজনীতি ও দল দেখে বঙ্গবন্ধু হয়তো মনে মনে বলছেন:

"অামি যদি হুকুম দেবার না-ও পারি… যার যা অাছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো।"

সেটাই হয়তো শেষ ভরসা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি কি সব জানছেন বা শুনতে পাচ্ছেন?