ইংরেজি ভাষায় বিসিএস: বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতির জন্যে অশনি সংকেত!

শিশির ভট্টাচার্য্যশিশির ভট্টাচার্য্য
Published : 4 March 2017, 03:22 PM
Updated : 4 March 2017, 03:22 PM

সরকারি কর্ম কমিশন ৩৮তম বিসিএস পরীক্ষা ইংরেজিতেও নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পৃথিবীর যে কয়েকটি দেশে (কানাডা বা সুইজারল্যান্ড) একাধিক রাষ্ট্রভাষা আছে সেখানে একাধিক ভাষায় সরকারি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা নেবার ব্যবস্থা আছে বটে, কিন্তু একভাষী দেশ, যেমন জাপান, জার্মানি বা ফ্রান্সে রাষ্ট্রভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় প্রতিযোগিতমূলক পরীক্ষা নেবার কথা চিন্তাও করা যায় না। বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকেরা কি ধীরে ধীরে ইংরেজি রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার দিকে এগিয়ে চলেছেন?

উপরিউক্ত সিদ্ধান্তের সঙ্গে বাংলাদেশের শিক্ষানীতির সম্পর্ক আছে। বাংলাদেশ যারা চালান তারা শিক্ষাসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে এমনভাবে নীতিনির্ধারণ করেন যাতে শুধু তাদের 'সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে!' জনগণের কোটি কোটি সন্তানকে দুধভাত খাওয়ানো, অর্থাৎ ইংরেজি শেখাবার উপযুক্ত আর্থসামাজিক কাঠামো কি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আছে, যেখানে কিনা বিলিয়ন বিলিয়ন ইউয়ান খরচ করে চীন তার জনগণকে ইংরেজিতে সরগড় করতে তুলতে পারছে না? সবাইকে যদি ইংরেজি শেখানো না যায়, তবে 'কেউ খাবে তো কেউ খাবে না, তা হবে না, তা হবে না!'

মুজতবা আলীর কথায়, 'শব্দের প্রাগদেশে জোর দিয়ে' ফটাফট ইংরেজি যে বলতে পারে সে স্মার্ট, চাকরির বাজারে তার কদর বেশি। বুদ্ধিমান এবং সামর্থ্যবান বাবা-মা মাত্রই সন্তানকে ইংলিশ মিডিয়ামে পাঠাতে চান। ইংরেজি জানলে উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশ গিয়ে খোকাবাবু বিদেশেই থেকে গেলেন; অথবা নেহায়েত কপালদোষে প্রত্যাবর্তন যদি করতেই হয়, সে ক্ষেত্রেও বিদেশি ডিগ্রির একটা দাম পাওয়া যাবে। কিন্তু পৃথিবীতে ইংরেজিই উচ্চশিক্ষার একমাত্র ভাষা নয়। অনেক বাঙালি সন্তানই সাক্ষ্য দেবেন যে, বছর দুয়েক ফরাসি, রুশ বা ডেনিশ ভাষা শিখেই ঐসব ভাষায় অংক, ইতিহাস বা বিজ্ঞানচর্চা করা সম্ভব।

কয়েক দশক আগে ইংলিশ মিডিয়ামের অনুমতি যারা দিয়েছিলেন তাঁরা মূলত অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে চেয়েছিলেন, পরবর্তী প্রজন্ম ভালো ইংরেজি বলুক। কিন্তু ইংরেজি শেখার জন্যে ইংলিশ মিডিয়াম যেমন অপরিহার্য নয়, তেমনি অংক, ইতিহাস বা সাহিত্যও ইংরেজিতেই পড়তে হবে এমন কোনো কথা নেই। বস্তুত ইংরেজি, ফরাসি যে কোনো ভাষা শেখার জন্যে জীবনের শ পাঁচেক ঘণ্টা সময় ব্যয় করলেই যথেষ্ট। বাংলাদেশে উচ্চ মাধ্যমিক পাস তরুণ-তরুণীরা প্রায় পনেরশ ঘণ্টা ইংরেজি শেখার পরেও কী কারণে ইংরেজি বলতে বা লিখতে পারে না সেটা খুঁজে বের না করে একের পর এক সরকার জাতির উপর ইংলিশ মিডিয়ামের জগদ্দল পাথর চাপিয়ে দিয়েছে।

এর ফল ভালো হয়নি। কারণ (আমার অভিজ্ঞতায়) ইংলিশ মিডিয়াম তার বেশিরভাগ ছাত্রকে ভালো ইংরেজি শেখাতে ব্যর্থ হয়েছে, অথচ বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির উপর তাদের দখলটা ঠিকই দুর্বল করে দিয়েছে। টবের মধ্যে বনসাই হয়, বিশাল বটগাছ হয় না। ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্ররা দ্বিভাষী বা বাইলিঙ্গুয়াল হবার পরিবর্তে অর্ধভাষী বা সেমি-লিঙ্গুয়াল হয়ে বসেছে যার প্রমাণ হচ্ছে বাংরেজি, যা নিয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত সম্প্রতি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কৃষক-শ্রমিকের সন্তান নয়, সমাজের নীতিনির্ধারকদের ছেলেমেয়েরাই বাংরেজি বলে। কারণ ভাষাশিক্ষার কাম্য বয়সে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে, বাংলা মিডিয়াম স্কুলের ইংলিশ ভার্সনে এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের বাংলার পরিবর্তে ইংরেজি শেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে।

লাখখানেক বাংলাদেশি ছাত্র যদি বিদেশে লেখাপড়া করে তবে প্রত্যেকের জন্যে ন্যূনতম দুই হাজার ডলার করে প্রতি মাসে প্রায় দুই মিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ আইনসঙ্গত বা বেআইনিভাবে বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার একটা উদ্দেশ্য ছিল, দেশের এই টাকা দেশে রাখা। জনগণ ভেবেছিল, এই 'নর্থসাউথ', 'ইস্টওয়েস্ট', 'আপ-ডাউন' বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হবে এক একটি রপ্তানি-প্রক্রিয়াজাত-অঞ্চল বা ইপিজেড। প্রাইভেট গ্র্যাজুয়েটরা বিদেশে গিয়ে চাকুরি খুঁজে নিতে বাধ্য হবে। কারণ দেশের বাজারের চাকুরির স্বল্প বেতন থেকে তাদের পেছনে বিনিয়োগকৃত মূলধন উঠে আসবে না। কিন্তু ইতোমধ্যে প্রাইভেট সেক্টরে বেতন আশাতীত বেড়েছে এবং সরকারও গত বছর বেতন দ্বিগুণ করেছে। এছাড়া সরকারি কাজে উপরি আয়ের সুযোগ একেবারেই নেই বললে সত্যের অপলাপ হবে।

সরকারি কর্ম কমিশন থেকে বলা হয়েছে, ইংলিশ মিডিয়াম গ্র্যাজুয়েটদের সরকারি চাকুরির সুযোগ দিতেই বিসিএস পরীক্ষা ইংরেজিতে নেবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত স্পষ্টত বাংলাদেশের সংবিধান এবং ১৯৮৭ সালের বাংলা প্রচলন আইনের পরিপন্থী। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে এক সময় পররাষ্ট্র বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলোতে এবং প্রশাসনের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদেও শুধু ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্রদেরই নেওয়া হবে। কারণ ইংরেজিতে অপটু নিয়োগকর্তাদের কাছে বাংরেজ প্রজন্মকেই বেশি চৌকশ বলে মনে হবে। কালক্রমে আমলাতন্ত্রে 'আধা ইংরেজি জানা' এবং 'ইংরেজি না জানা'– এই দুটি গোষ্ঠী সৃষ্টি হবে এবং দুই গোষ্ঠীর মধ্যে সুযোগ-সুবিধার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে রেশারেশি শুরু হবে।

বাংলায় বিসিএস পরীক্ষা দেবার যোগ্যতাই যার নেই সে কীভাবে প্রশাসনে বাংলা ব্যবহার করবে? বাংলা প্রচলন আইন অনুসারে প্রশাসনে বাংলা ব্যবহার না করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ, কিন্তু যেহেতু প্রশাসন তার ভাষাজ্ঞান সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েই তাকে নিয়োগ দিয়েছে, সেহেতু বাংলা ব্যবহারে তাকে বাধ্য করার নৈতিক অধিকার প্রশাসনের থাকবে না। এর ফলে ইতিমধ্যে প্রশাসনে বাংলা প্রচলনে যেটুকু অগ্রগতি হয়েছে সেটুকুও হারিয়ে যাবে।

প্রশাসনে যদি চোস্ত ইংরেজি জানা লোকের অভাব হয়, তবে ভবিষ্যতে ইংরেজি ভালো জানে এমন প্রার্থীদের নিয়োগ দিলেই হয়। নিয়োগকৃত আমলাদের জন্যে বাধ্যতামূলক ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান ইত্যাদি ভাষা কোর্সেরও ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকেরা কোনো সমস্যার সহজ সমাধানে আগ্রহী নন। পেশাদার ভাষাবিজ্ঞানীদের পরামর্শও তাঁরা নিতে চান না। কোনো গোপন এজেন্ডাও হয়তো তাদের থাকতে পারে। ইংরেজি শেখানোর উদ্দেশ্যে ইংলিশ মিডিয়াম এবং ইংলিশ ভার্সন চালু করে তাঁরা অতীতে একটি ভুল করেছিলেন। ইংরেজি জানা আমলার সরবরাহ নিশ্চিত করতে ইংরেজিতে বিসিএস চালু করে তারা আরও একটি ভুল করতে চলেছেন।

নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, ইংরেজিতে বিসিএস চালু হবার সমান্তরালে বাংলা মিডিয়ামের গুরুত্ব ধাপে ধাপে কমে আসবে। এক সময় বাংলাদেশের জনগণের ক্ষুদ্র একটি অংশ খারাপ ইংরেজি বলবে এবং তারা রাজত্ব করবে বাকি নিরানব্বই ভাগ মানুষের উপর যারা চলনসই ইংরেজিও শিখে উঠতে পারবে না। এক ধরনের ভাষা-বর্ণবাদের চর্চা শুরু হবে সমাজে। বাংলা হবে তুচ্ছ, ছোটলোকের ভাষা। অভিভাবকেরা ছেলেমেয়েদের বাংলা মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করতে চাইবেন না, এমনকি বাংলা শেখাতেই চাইবেন না, ঠিক যেভাবে চট্টগ্রামের অনেক বাবা-মা তাদের ছেলেমেয়েদের চট্টগ্রামি বলতে নিরুৎসাহিত করেন। পৃথিবীর বহু অঞ্চলে অতীতে অনুরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, আফ্রিকার বহু দেশে এই পরিস্থিতি এখনও বিদ্যমান। বলাবাহুল্য, 'কত রূপ স্নেহ করি বিদেশি কুকুর ধরি স্বদেশের ঠাকুর ফেলিয়া' মানসিকতায় দেশের সত্যিকার উন্নতি সম্ভব নয়।

ভবিষ্যতের সেই দ্বিধাবিভক্ত বাঙালি সমাজ অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে না, হবে বহিষ্কারমূলক। ইংরেজি ভালো বলতে-লিখতে না পারলেই বহিষ্কার। অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি সমাজের জন্য অপরিহার্য। কারণ ধর্ম-বর্ণ-স্বাস্থ্য নির্বিশেষে সমাজের প্রত্যেক সদস্য বিচিত্র শক্তির অধিকারী হয়ে থাকে। স্টিফেন হকিংএর মতো মানুষের সেবাও কি সমাজের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ নয়? সর্বসাধারণকে অন্তর্ভুক্ত করতে না পারলে অনেক নাগরিকের শক্তি অব্যবহৃত থেকে যায় এবং এর ফলে সমাজের সার্বিক উন্নয়ন ব্যহত হয়। সবার অর্ন্তভুক্তিতে বাধা দেয় বলেই সাম্প্রদায়িকতা ও বর্ণবাদের মতো আচরণ ও মানসিকতাকে ব্যক্তিগতভাবে ঘৃণা করা উচিত এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিহত করা উচিত।

ইংরেজি বা বাংরেজির দাপটে বাংলা ভাষা হারিয়ে যাবে না ঠিকই, তবে বাংলা শব্দগুলো ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে, ঠিক যেমন করে একদিন দাপ্তরিক ভাষা ফার্সি ও ধর্মীয় ভাষা আরবি থেকে আসা শব্দের কারণে হারিয়ে গিয়েছিল বহু দেশি, তৎসম ও তদ্ভব শব্দ। শিক্ষা, প্রশাসন, ব্যবসায়, বিচার-ব্যবস্থা এমনকি সংস্কৃতিতে বাংলার ব্যবহার কমার ফলে ভাষাটির প্রকাশশক্তি এতটাই হ্রাস পাবে যে এক সময় বাঙালিরাই বিশ্বাসই করবে না, বাংলা সর্বস্তরে ব্যবহারের উপযুক্ত কোনো ভাষা। আফ্রিকার বহু জাতির কাঁধে ফরাসি ভাষার ঔপনিবেশিক জোয়াল এমনভাবে চেপে বসে আছে যে, তারা ভাবতেও পারে না, তাদের মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চা কিংবা আদালতে বিচারকার্য পরিচালনা করা আদৌ সম্ভব।

ভাষার প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জনগণের উন্নয়ন অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। বাংলা ভাষার অবমূল্যায়নের সমান্তরালে বাংলাভাষী মানুষেরও অবমূল্যায়ন হবে। ইংরেজি না জানার কারণে নীতিনির্ধারণে বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর কোনো ভূমিকা থাকবে না। বাংলাভাষীদের উত্তরপুরুষরা এক সময় ইংরেজি শিখে আবার ক্ষমতাসীন হবে ঠিকই, কিন্তু ততদিনে অনেকগুলো প্রজন্ম হারিয়ে যাবে, নষ্ট হয়ে যাবে অনেকখানি সময়। অন্যান্য জাতি ইত্যোবসরে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাবে এবং বাঙালিরা আজকের মতোই বিভিন্ন জাতির দেশে গিয়ে কামলা খাটতে বাধ্য হবে।

সালাম-রফিক-বরকতেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তান প্রশাসনের ভয়ঙ্কর কারফিউ ভেঙেছিলেন শুধু উত্তরপুরুষদের অর্থনৈতিক সৌভাগ্যের আশায়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ভাষাশহীদদের যাবতীয় অর্জন অচিরেই ব্যর্থতায় পর্যবশিত হয়ে একদিন স্মৃতির বিষয়ে পরিণত হবে। ফরাসি রাষ্ট্রপতি জর্জ পম্পিদ্যু একবার বলেছিলেন, ফরাসি ভাষার প্রশ্নে আমরা যদি ছাড় দিই তবে আমরা একেবারে ভেসে যাব। বাঙালিও যদি রক্তের দামে কেনা রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে বিন্দুমাত্র ছাড় দেয় তবে তার পায়ের তলার মাটি সরে যাবে। বিশেষ করে শিক্ষা ও ভাষার ক্ষেত্রে এমনসব ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, যেগুলো নিঃসন্দেহে বর্তমান ও ভবিষৎ প্রজন্মের জন্যে হানিকারক।

স্বাধীনতার পর থেকে বঙ্গবন্ধু হত্যার মতো ঔপনিবেশিক/পাকিস্তানি এমন অনেক এজেন্ডা ধীরে ধীরে বাস্তবায়িত হচ্ছে বাংলাদেশে এবং এমন ব্যক্তিদের হাতে, যারা অন্তত প্রকাশ্যে (কী বলব, শরমের কথা!) জামায়াতও নয়, হেফাজতও নয়।