মেয়েদের ‘সর্বোত্তম স্বার্থ’ রক্ষার এ কেমন আইন!

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 4 March 2017, 03:24 AM
Updated : 4 March 2017, 03:24 AM

আমাদের দেশে বাল্যবিবাহ একটি বড় সামাজিক সমস্যা। সরকার ও বিভিন্ন এনজিওর সচেতনতামূলক কার্যক্রম ব্যাপকভাবে প্রচারিত হলেও কোনোক্রমেই বাল্যবিবাহ রোধ করা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় দৃঢ় ও কার্যকর নীতি গ্রহণসহ কর্মসূচি বাস্তবায়ন সবার কাছে প্রত্যাশিত।

সম্প্রতি জাতীয় সংসদে 'বাল্যবিবাহ নিরোধ বিল ২০১৭' পাস করা হয়েছে। এই বিলে মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ বছর রাখা হয়েছে বটে, তবে তা 'লঙ্ঘনেরও সুযোগ' রাখা হয়েছে যথেষ্ট! বিলে বলা হয়েছে:

"এই আইনের অন্যান্য বিধানে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, কোনো বিশেষ প্রেক্ষাপটে অপ্রাপ্ত বয়স্কদের সর্বোত্তম স্বার্থে, আদালতের নির্দেশনাক্রমে এবং মাতা-পিতা ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অভিভাবকের সম্মতিক্রমে বিধি দ্বারা নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুসরণক্রমে বিবাহ সম্পাদিত হইলে উহা এই আইনের অধীন অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে না।"

তার মানে, 'আদালতের নির্দেশে এবং মা-বাবা ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অভিভাবকের সম্মতিতে' কোনো শিশুরও যদি বিবাহ হয়, তবে সেটাও জায়েজ হয়ে যাবে। অর্থাৎ ক্ষেত্রবিশেষে শিশুবিবাহও অনুমোদন পাবে। আইনটিকে বলা হচ্ছে 'বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন', আর কিনা রাখা হল শিশুবিবাহের সুযোগ!

'অপ্রাপ্তবয়স্কদের সর্বোত্তম স্বার্থ' রক্ষার বিষয়টি অত্যন্ত ধোঁয়াশাপূর্ণ একটি কথা। কমবয়সী কোনো ছেলে বা মেয়ের 'সর্বোত্তম স্বার্থ' কীভাবে নির্ধারণ করা হবে? সেটা করবেই-বা কে? একজন নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার ভোগই তো তার সর্বোত্তম স্বার্থ, যেখানে সব বয়সী নাগরিকই অন্তর্ভুক্ত। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, সম্পদ-সুযোগ-সুবিধা ভোগ, ন্যায্য মজুরি ইত্যাদি অধিকার সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত। তাহলে আলাদাভাবে আবার কীসের 'সর্বোত্তম স্বার্থ'? ১৮ বছর না হলে একজন ভোটও দিতে পারছে না। তাহলে কেন সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিল?

এ কথা বহুবার বলা হয়েছে যে, বাল্যবিবাহ একজন মেয়েশিশুর জীবনের ঝুঁকি বাড়ায়, অপরিণত সন্তান প্রসবের কারণ হয়, জীবনের সুষ্ঠু বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে, শিক্ষার অধিকার হরণ করে, সমাজ তাকে সামাজিক সম্পর্ক ধারণ ও পরিচর্যায় সামর্থ্যের অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করে, সামাজিক অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

এই বিলে ২১ বছরের কমবয়সী ছেলেে এবং ১৮ বছরের কমবয়সী মেয়েদের 'অপ্রাপ্তবয়স্ক' বলা হলেও আইন শিথিলের সেই বিশেষ প্রেক্ষাপটের ক্ষেত্রে ন্যূনতম কোনো বয়সের কথা বলা হয়নি। এটা কী হবে– পাঁচ, দশ, পনের? নাকি আকিকা ও বিয়ে একই সঙ্গে ঘটবে? বিশেষ প্রেক্ষাপটের সুযোগ নিয়ে কেউ এমন কাণ্ড করলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই!

বিশেষ বিধানের ধারা সম্প্রসারিত করে বিবাহের ন্যূনতম বয়সের ক্ষেত্রে মেয়েশিশুদের সঙ্গে ছেলেশিশুকেও যুক্ত করা হয়েছে। ফলে এটি উভয়ের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলা হয়েছে। আইনটিতে অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেশিশুর বিয়ের বয়স সম্পর্কে কোনো ধরনের দাবি না থাকার পরও আইন করে তাদের অকাল বিয়ের বৈধতা দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে অপ্রাপ্তবয়সে পরিবার গঠনের দায়িত্বের বোঝা তার বিকাশ বাধাগ্রস্ত করবে বলে আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।

বিলটিতে এই বিশেষ বিধান যুক্ত করার পক্ষে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা বলেছেন, আমাদের দেশে তো অনেক অল্পবয়সী ছেলেমেয়ে পালিয়ে গিয়ে বিবাহ করে প্রেগন্যান্ট হয়ে যায়। এ সমস্যাগুলো যেহেতু আছে, এটার জন্য একটা ব্যবস্থা হিসেবে এই বিধান।

উল্লিখিত যুক্তিটি খুবই নেতিবাচক। এ থেকে মনে হচ্ছে, আমাদের দেশে কমবয়সী মেয়েদের 'পোয়াতি' হওয়া ছাড়া অন্য কোনো সমস্যা নেই! আর এই সমস্যা সমাধানে বিয়ে ছাড়া পথ নেই। কথা আরও আছে। ধর্ষণের কারণে কোনো মেয়ে গর্ভবতী হলে তাকেও ওই আইন দেখিয়ে ধর্ষকের সঙ্গে বিয়েতে বাধ্য করা হতে পারে। বর্তমান সামাজিক বাস্তবতায় এই 'বিশেষ বিধান' ধর্ষক ও প্রভাবশালীদের সুবিধা দেবে।

আমাদের গ্রামাঞ্চলের কিছু অংশে প্রভাবশালীরা অল্পবয়সী সুন্দরী মেয়েদের জোর করে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। তারা একটি মেয়েকে আটকে রেখে তাকে গর্ভধারণে বাধ্য করতে পারে। কদিন চুপচাপ থাকার পর তারা আইনের মাধ্যমে এই অপরাধেরও বৈধতা নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে। একটি অবৈধ ব্যবস্থা আইনের মাধ্যমে এভাবে বৈধ করা কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত হতে পারে না। আর এভাবে কোনো মেয়েকে 'সুরক্ষা'ও দেওয়া যায় না। তাছাড়া এটা প্রচলিত আইনেরও বরখেলাপ।

'নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন (সংশোধিত) ২০০৩' অনুযায়ী, ১৬ বছরের নিচে কোনো নারীর সম্মতিতে বা অসম্মতিতে যৌনসঙ্গম করলে তা ধর্ষণতুল্য অপরাধ। মন্ত্রিপরিষদ অনুমোদিত বিশেষ বিধান প্রয়োগ করে আইনের মাধ্যমে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের বিবাহের বৈধতার সুযোগ দেওয়া হলে তা হবে আইন করে শিশুধর্ষণ। এছাড়া এই বিধানের সুযোগ নিয়ে ধর্ষক ও নারী উত্ত্যক্তকারীরা বিবাহের মাধ্যমে অপরাধ করেও পার পেয়ে যাবে।

নতুন বিলটিতে থাকা বিধান অনুযায়ী অপ্রাপ্তবয়স্কদের বিয়ের অন্যতম শর্ত হচ্ছে মা-বাবা বা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অভিভাবকের সম্মতি। সেখানে মেয়ের সম্মতির কোনো প্রয়োজন নেই। তার মানে, এটা হবে এক ধরনের জোরপূর্বক বিয়ে। আইন করেই এ ধরনের জোরপূর্বক বিয়েতে সরকার উৎসাহিত করতে চাইছে। এ ধরনের আইন হবে নারী ও শিশুঅধিকারের পরিপন্থী। এমনকি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সংবিধানে সবার মতপ্রকাশের অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

বিয়ের ক্ষেত্রে ছেলেমেয়ের শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক যোগ্যতা অবশ্যই বিবেচিত হওয়া উচিত। এ জন্য ছেলেমেয়েদের বয়স যোগ্যতা, শারীরিক সামর্থ্য, সাংসারিক ব্যয়ের জন্য আর্থিক স্বচ্ছলতা অবশ্যই জরুরি। সুতরাং যে বয়সে বিয়ে করলে নারীর স্বাস্থ্যহানি হবে বা জরায়ুর ক্যান্সার, রক্তশূন্যতা, অপুষ্ট শিশুজন্মের আশঙ্কা ইত্যাদি বাড়বে, সর্বোপরি মা ও শিশুর মৃত্যুঝুঁকি বাড়বে সে অবস্থায় অবশ্যই বিয়ে করা উচিত নয়। ১৮ বছরের আগে কোনো মেয়ের বিয়ের বিষয়ে আইনি সমর্থন দেশকে পেছনে নিয়ে যাবে।

মেয়েদের অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ জায়েজ করার জন্য বিশেষ বিধান রাখার যুক্তি মেনে নেওয়া কঠিন। এই বয়সী মেয়েরা কীভাবে নিরাপদ থাকবে, তা সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে। কেউ অন্তঃসত্ত্বা হলে তাকে বিয়ে দিয়ে দিলেই এ ধরনের সমস্যার সমাধান হবে না, বরং সমস্যা বাড়বে। এ রকম আইন হলে অসচেতন অনেক মা-বাবাই এ সুযোগ নেবেন এবং কম বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা আরও বাড়তে পারে।

এই আইন সারা দেশে অভিভাবকদের এই বার্তা দেবে যে, অন্তত কিছু ক্ষেত্রে সরকার বাল্যবিবাহ যৌক্তিক মনে করছে। মনে রাখা দরকার যে, বাল্যবিবাহের কুফলজনিত সমস্যার চরিত্রটি গভীরভাবে সামাজিক, শুধুই চিকিৎসা-সংক্রান্ত বা স্বাস্থ্যগত নয়। বাল্যবিবাহ অর্থ শুধু কমবয়সে সন্তান জন্মদান ও পরবর্তী স্বাস্থ্যহানি এবং মানসিক আঘাতজনিত প্রভাব নয়, অনেক ক্ষেত্রে বাল্যবধূ মেয়েটিকে স্বামীপরিত্যক্ত ও গৃহনির্যাতনের শিকার হয়ে বাবার বাড়িতে ফিরে আসতে হয়।

উল্লেখ্য, ২০১৫ সালের জুলাই মাসে ইউনিসেফ ও যুক্তরাজ্য সরকারের যৌথ আয়োজনে ২১ থেকে ২৩ জুলাই লন্ডনে অনুষ্ঠিত গার্ল সামিটে অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছর বয়সের আগে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ১৮ বছরের আগে মেয়েদের বিয়ে সম্পূণর্ভাবে বন্ধ করার অঙ্গীকারের কথা জানিয়েছিলেন।

প্রধানমন্ত্রীর এই অঙ্গীকার বাস্তবায়নে বাংলাদেশ থেকে বাল্যবিবাহ বন্ধ করার জন্য একটি কার্যকর ঘোষণা ও প্রতিশ্রুতি ছিল প্রত্যাশিত। বিয়ের ন্যূনতম বয়স না কমিয়ে, কোনো রকম ফাঁকফোকর না রেখে কীভাবে এই সামাজিক সমস্যা থেকে দেশকে মুক্ত করা যায়, সে ব্যাপারে বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ এ মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি কাজ হওয়া উচিত।

এ ক্ষেত্রে সমন্বিত উদ্যোগের পাশাপাশি একটি কার্যকরি শক্তিশালী আইন বাল্যবিবাহ বন্ধে খুবই জরুরি। এই আইন তৈরির পাশাপাশি মেয়েদের সামাজিক নিরাপত্তা বাড়াতে হবে। উত্ত্যক্তকারীদের সঠিক বিচার নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে সরকার 'সর্বোত্তম স্বার্থ' বলতে যা বুঝিয়েছে, তার দরকার হবে না।

মনে রাখা দরকার যে, মানুষের কল্যাণেই বিধি-বিধান। সুতরাং যে বয়সে বিয়ে করলে নারীর স্বাস্থ্যহানি হবে বা জরায়ুর ক্যান্সার, রক্তশূন্যতা, অপুষ্ট শিশুজন্মের আশঙ্কা ইত্যাদি বাড়বে, সর্বোপরি মা ও শিশুর মৃত্যুঝুঁকি বাড়বে সে অবস্থায় অবশ্যই বিবাহ করা উচিত নয়।

'সর্বোত্তম স্বার্থ' রক্ষার নামে সরকার আইন করে মেয়েদের 'স্থায়ী ক্ষতি'র সুযোগ করে দিক, তা মোটেও কাম্য নয়।