বাংরেজি: গলদের গোড়া কোথায়?

শিশির ভট্টাচার্য্যশিশির ভট্টাচার্য্য
Published : 25 Feb 2017, 12:50 PM
Updated : 25 Feb 2017, 12:50 PM

ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলা ভাষা নিয়ে মৌসুমী গণহাহুতাশের একটি বিষয় হচ্ছে বাংরেজি। গত কয়েক দশকে গড়ে ওঠা এই নাগরিক উপভাষার উচ্চারণ অনেকটা ইংরেজির মতো এবং শব্দকোষ ইংরেজি শব্দে ঠাঁসা। বাংলা বাক্যবিন্যাসে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে এই উপভাষা বলা হয়। বাংলাদেশের প্রধান শহরগুলোতে বেড়ে ওঠা তরুণ প্রজন্ম সাধারণত বাংরেজিতে কথা বলে।

প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি তাঁর এক বক্তৃতায় বাংরেজিকে একটা সংক্রামক ব্যাধি বলে উল্লেখ করে ছেলেমেয়েদের এই ব্যাধি থেকে মুক্ত করতে আহ্বান জানিয়েছেন। যে কোনো ব্যাধি নিরাময় করতে হলে ব্যাধিটা ঠিক কী কারণে সৃষ্টি হল সেটা জানা দরকার। আমরা জানি, কারও মাতৃভাষা যদি ফরাসি বা ইংরেজি হয়, তবে তিনি স্বাভাবিকভাবেই বাংলা বলবেন ফরাসি বা ইংরেজি ঢঙে। প্রশ্ন হতে পারে, বাংলাদেশের নাগরিক নতুন প্রজন্ম, যাদের মাতৃভাষা ইংরেজি নয়, তারা কী কারণে ইংরেজি ঢঙে বাংলা বলছে?

যে কোনো ভাষা হচ্ছে একটি যোগাযোগ মাধ্যম এবং এই মাধ্যমটি ব্যবহারে কেউ কম, কেউ-বা তুলনামূলকভাবে বেশি পারঙ্গম। বড় হয়ে উঠতে উঠতে বেশিরভাগ শিশু যে ভাষা শেখে এবং অথবা যে ভাষাতে তারা প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করে, সেই ভাষা তারা সাবলীলভাবে ব্যবহার করতে পারে। এই ভাষায় শিশুর ভালো রকম দখল থাকে এবং শোনামাত্র শিশু সাধারণত বলে দিতে পারে সে ভাষার কোনো শব্দ শুদ্ধভাবে উচ্চারিত হচ্ছে কি না বা কোনো বাক্য ত্রুটিপূর্ণভাবে গঠিত হয়েছে কি না। একবার প্রথম ভাষাটি অর্জিত হয়ে যাবার পর মানবসন্তান যত ভাষাই শিখুক, দ্বিতীয় বা তৃতীয় ভাষা বলার সময় প্রথম অর্জিত ভাষাটির ধ্বনিতত্ত্বের প্রভাব সাধারণত এড়াতে পারে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিশুর মাতাপিতা এবং শিশু একই ভাষাভাষী হওয়ার কারণে শিশুর প্রথম অর্জিত ভাষাটি 'মাতৃভাষা' বলার একটা রেওয়াজ চালু হয়ে গিয়েছে।

মাতৃভাষা সব ক্ষেত্রে যে জন্মদাত্রী মায়েরই ভাষা হবে, এমন কোনো কথা নেই। কোনো বাঙালি মা এবং তার সন্তানকে যদি জন্মের পর থেকে চীনদেশে রাখা হয় তবে সেই সন্তান বাংলা না-ও শিখে উঠতে পারে। শিশু এবং শিশুর মায়ের মাতৃভাষা আলাদা হতে পারে। কানাডার মন্ট্রিয়লের অভিবাসী বাঙালি পরিবারগুলোর কিশোর-কিশোরীরা ভালো বাংলা বলতে পারে না, কিন্তু ফরাসি বা ইংরেজিতে মনের সব ভাব প্রকাশ করতে পারে, যখন কিনা তাদের বাবা-মায় তেমন ফরাসি বা ইংরেজি বলতে পারে না। তাহলে এই কিশোর-কিশোরীদের মাতৃভাষা কোনটি? সব মিলিয়ে 'মাতৃভাষা' মূলত একটি সংস্কার (কুসংস্কার হয়তো নয়)। শব্দটি আমরা হরহামেশা ব্যবহার করি বটে, কিন্তু এর যুক্তিগ্রাহ্য কোনো সংজ্ঞা দেওয়া অসম্ভব।

চমস্কির মতে, মানবসন্তানের ভাষা শেখার একটা কাম্য বয়স আছে। মন্ট্রিয়লের শিশুরা সাবলীলভাবে ফরাসি ও ইংরেজি বলতে পারার কারণ স্কুলে তারা সারাদিন ফরাসি ও ইংরেজি বলে ও শোনে। বাংলাদেশের যে শিশু তিন/চার বছর বয়স থেকে ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করে সে-ও প্রায় সারাদিন নিজে ইংরেজি বলে এবং শিক্ষককে ইংরেজি বলতে শোনে। ইংরেজি ধ্বনিতত্বে অনেকটাই অভ্যস্ত হয়ে যাবার ফলে এই শিশু যখন বাংলা বলতে যায় তখন স্বাভাবিকভাবেই তার বাংলা উচ্চারণে ইংরেজি ঢঙ চলে আসে।

অংক, ইতিহাস, সাহিত্য, ভূগোল ইত্যাদি সব বিষয় ইংরেজিতে পড়ার কারণে শিশুর ইংরেজি শব্দকোষ দিন দিন সমৃদ্ধ হতে থাকে এবং একই সঙ্গে বাংলা শব্দকোষ দুর্বল হতে থাকে। কথা বলার প্রয়োজন হলে শিশু শব্দকোষ হাতড়ে পায় শুধু ইংরেজি শব্দ। অগত্যা অবচেতনভাবে এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে এই শিশুরা বাংলা বাক্যে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করতে থাকে। মানিব্যাগে যার একটিও টাকা নেই, অথচ ডলার আছে দেদার, জিনিসপত্র কিনতে গিয়ে সে যদি ডলার বের করে দেয় তবে তাকে দোষ দেওয়া যায় না।

প্রধানত ঔপনিবেশিক কারণে গত কয়েক শতকে উন্নয়নশীল বিশ্বের বেশিরভাগ ভাষা ইওরোপের একাধিক ভাষা, প্রধানত ইংরেজি, ফরাসি ও স্প্যানিশদের সংস্পর্শে এসেছে। দুটি ভাষা যখন পরস্পরের সংস্পর্শে আসে তখন ভাষাসংযোগ হয়। সংযুক্ত ভাষা দুটির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা ধর্মীয় গুরুত্ব সমান হয় না। যে ভাষার গুরুত্ব বেশি সেই ভাষার শব্দ বন্যার জলের মতো ঢুকে পড়ে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ ভাষাটিতে। একাদশ-দ্বাদশ শতকে বাংলা যখন ফার্সি বা আরবির সংস্পর্শে এসেছিল তখন হাজার হাজার ফার্সি ও আরবি শব্দ বাংলা শব্দকোষে স্থান পেয়েছিল। কারণ বাংলার তুলনায় ফার্সির প্রশাসনিক গুরুত্ব এবং আরবির ধর্মীয় গুরুত্ব বেশি ছিল।

গত দুই শতক ধরে বাংলা শব্দকোষে দেদার ইংরেজি শব্দ ঢুকছে। কারণ বাংলার তুলনায় ইংরেজির অর্থনৈতিক গুরুত্ব বেশি। ছোট্টমণিদের বাংরেজিকে আমরা সমালোচনা করি, কিন্তু আমরা বয়স্কমণিরাও বাংলা বলার সময় কম ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করি না। আমাদের ভাষার সঙ্গে বাংরেজির তফাৎ শুধু উচ্চারণে, এবং এর অন্যতম কারণ, আগেই বলেছি, ওদের ইংলিশ মিডিয়াম প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা, যা আমাদের পিতামাতারা আমাদের উপর চাপিয়ে দিতে পারেননি। সে সামর্থ্যও তাদের ছিল না হয়তো, অথবা আমাদের মতো বে-আক্কেলও তারা ছিলেন না।

যে কোনো ভাষায় শব্দমিশ্রণ স্বাভাবিক এবং অপরিহার্য একটি প্রক্রিয়া। অন্য কোনো ভাষা থেকে শব্দ না নিতে পারলে ভাষার বিকাশ রুদ্ধ হয়ে যাবার আশঙ্কা থাকে। ইংরেজি ভাষার বেশিরভাগ শব্দ ফরাসি ও ল্যাটিন। ফরাসির বেশিরভাগ শব্দ ল্যাটিন। আরবিতেও অনেক বিদেশি শব্দ রয়েছে। বিদেশি শব্দ ব্যবহার করা ভাষার দুর্বলতা নয়, বরং শক্তির পরিচয়। 'বিদেশি শব্দ' কথাটাও অর্থহীন এ কারণে যে, বাংলা ধ্বনিতত্ত্বের নিয়ম মেনে পরিবর্তিত না হয়ে কোনো শব্দই বাংলা শব্দকোষে প্রবেশাধিকার পায় না। সুতরাং বাংলা শব্দকোষে একটিও ইংরেজি শব্দ নেই। ব্যাকরণের দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত ইংরেজিসহ সব বিদেশি শব্দই তাদের খোলনলচে পাল্টে আগাপাশতলা বাংলা হয়ে গেছে।

জলবায়ুর মতো ভাষারও দুই ধরনের পরিবর্তন হতে পারে: স্বাভাবিক ও অস্বাভাবিক। ভাষার স্বাভাবিক পরিবর্তন এত ধীরে হয় যে মানুষ নিজের জীবনে তা খেয়াল করে উঠতে পারে না। স্বাভাবিক ভাষামিশ্রণের ফলে এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় শব্দ আসে, কিন্তু এক ভাষার ধ্বনিতত্ত্ব বা ব্যাকরণ সাধারণত অন্য ভাষায় প্রবেশাধিকার পায় না। বাংলার বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় যখন এক সময়ের দাপ্তরিক ভাষা ফার্সি বলত তখন বাংলা বলার সময় তারা ফার্সি শব্দ ব্যবহার করত বটে, কিন্তু তারা নিশ্চয়ই ফার্সি উচ্চারণে বাংলা বলত না।

নতুন প্রজন্ম যে ইংরেজি ঢঙে বাংলা বলছে সেটা বাংলা ভাষার স্বাভাবিক পরিবর্তন অবশ্যই নয়। কিন্তু এতে নতুন প্রজন্মের কোনো দোষ নেই। শিক্ষার মাধ্যম নির্ধারণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্তহীনতা ও অপরিণামদর্শিতাই বাংলা ভাষার এই অস্বাভাবিক পরিবর্তনের জন্য দায়ী। কোনো প্রকার মর্যাদা বৃদ্ধির জন্যে শিশুকিশোরেরা বাংরেজি বলছে না। তারা সঠিক উচ্চারণে বাংলা বলতে পারে না, কারণ সঠিক বা বেঠিক সব রকম বাংলার প্রবেশ নিষেধ তার স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে– জীবনে ও মননে।

বাংলাদেশের অপেশাদার নীতিনির্ধারকদের মস্তিষ্কই হচ্ছে এদেশের যত গলদের গোড়া। এখান থেকেই সাধারণত সমাজদেহের যাবতীয় পচনের সূত্রপাত হয়। বহু যুগ ধরে বিনা নিয়ন্ত্রণে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল চালু রেখে, কয়েক দশক ধরে নির্বিচারে ইংলিশ মিডিয়াম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দিয়ে এবং কিছুকাল আগে 'গোঁদের উপর বিষফোঁড়া'র মতো বাংলা মিডিয়াম স্কুলেও ইংলিশ ভার্সন চালু করে বাংরেজি প্রজন্ম সৃষ্টি হওয়ার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশের একাধিক সরকার।

ফরাসি দার্শনিক মোঁতেস্কিওর একটি উক্তি এখানে প্রাসঙ্গিক: 'নতুন প্রজন্ম কখনও নষ্ট হয় না যদি-না পূর্ববর্তী প্রজন্ম আগে থেকেই নষ্ট হয়ে গিয়ে থাকে।'