নতুন নির্বাচন কমিশন ও বিএনপির বাধ্যবাধকতা

আমানুল্লাহ কবীর
Published : 24 Oct 2011, 03:36 PM
Updated : 24 Feb 2017, 04:07 AM

ব্যর্থতার দায়ভার নিয়ে বিতর্কিত কাজী রকিবউদ্দীনের নির্বাচন কমিশন মেয়াদ শেষে বিদায় নিয়েছে। নতুন আয়োজনে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে। নতুন আয়োজনের কথা বললাম এ কারণে যে, নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য সংবিধানে যে আইন তৈরির কথা বলা হয়েছে, স্বাধীনতার বয়স পঁয়তাল্লিশের বেশি হলেও তা প্রণয়ন করা হয়নি।

নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলিসহ সব মহলে যে সচেতনতা ও নজরদারি ছিল, তা নজিরবিহীন। আয়োজনেও ছিল কিছু ব্যতিক্রম। সার্চ কমিটি করে তল্লাশি দিয়ে কমিশনের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তিদের খুঁজে বের করার রেওয়াজ চালু হয়েছিল সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের আমলে। এবারের সার্চ কমিটি বাড়তি যে কাজটি করেছে– যা প্রশংসিত হয়েছে– তা হল দিকনির্দেশনামূলক মতামত জানার জন্য বিশিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গে দুই পর্যায়ে বৈঠক।

তবে পুরো প্রক্রিয়া বির্তক এড়াতে পারেনি। যাঁকে প্রধান করে এবার সার্চ কমিটি গঠন করা হয়েছিল– বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন– তাঁর নেতৃত্বেই আগের সার্চ কমিটিও গঠিত হয়েছিল। তবে ব্যতিক্রমও ছিল। এবারের সার্চ কমিটিতে নাগরিক সমাজের দুজনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, যাঁরা ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক। তাদের একজন নারী।

সম্ভাব্য কমিশনারদের নাম প্রস্তাবের ক্ষেত্রে সার্চ কমিটি পূর্বের নিয়মনীতি অনুসরণ না করে একটু ভিন্নতা আনার প্রয়াস চালায়। রাষ্ট্রপতির কাছে যে দশজনের নাম প্রস্তাব করা হয়, ওই তালিকায় নাগরিক সমাজের তিনজনের নামও ছিল, যা আগের সার্চ কমিটি করেনি; তাঁরা আমলাদের ভেতর থেকেই সবার নাম প্রস্তাব করেছিল।

কিন্তু চূড়ান্তভাবে যাঁরা রাষ্ট্রপতির নিয়োগ পান তাদের সবাই সাবেক আমলা বা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী; নাগরিক সমাজের কাউকে কমিশনার হিসেবে নিয়োগের জন্য যোগ্য মনে করা হয়নি। সার্চ কমিটি সামাজিক মতামতের আলোকে গতানুগতিকতার বাইরে আসার যে চেষ্টা করেছিল, শেষ পর্যন্ত তা বাস্তব রূপ লাভ করেনি; ব্যতিক্রম কেবল একজন নারী কমিশনার।

রাজনৈতিক দলগুলির নাম প্রস্তাব নিয়ে কথা উঠেছে। বিএনপিসহ বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ, প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ একজন বাদে যাদের কমিশনার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তারা প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগেরই পছন্দসই ব্যক্তি। তবে তাদের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে ১৪ দলের বিভিন্ন শরিকের মাধ্যমে। এর সত্যাসত্য সম্পর্কে কথা হয়েছিল ১৪ দলের এক শরিক দলের নেতার সঙ্গে। তাকে জিজ্ঞাস করেছিলাম, নাম প্রস্তাবের ব্যাপারে আপনাদের কাছে আওয়ামী লীগের কি কোনো পরামর্শ ছিল? তিনি প্রশ্নের সরাসরি জবাব না দিয়ে বললেন, রাজনীতি করলে তো রাজনৈতিক কৌশল অবলম্বন করতেই হয়। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে বিতর্কের তেমন কিছু নেই। কেননা কমিশনারদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে সার্চ কমিটির প্রস্তাবিত নামের তালিকা থেকেই, যাদের মধ্যে রয়েছেন আওয়ামী লীগের একজন এবং বিএনপির একজন।

কমিশনের নিয়োগের পর সিদ্ধান্তে দ্বিধাগ্রস্ত বিএনপি প্রতিক্রিয়া জানাতে বিলম্ব করেছে। তারা হয়তো আওয়ামী লীগের কৌশলটা প্রথমে বুঝতে পারেনি। একদিন পর প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়েও সতর্কতা অবলম্বন করেছে। তাদের প্রতিক্রিয়া:

"নির্বাচন কমিশন গঠনে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে। এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে অবাধ ও নিরপক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়।"

ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আওয়ামী লীগ স্বাভাবিকভাবেই রাষ্ট্রপতির নিয়োগকে অভিনন্দন জানিয়েছে। বিএনপির অভিযোগ সত্য হলেও কোনো উপায় নেই। কারণ প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া রাষ্ট্রপতির কোনো কিছু করার ক্ষমতা নেই, সংবিধান সংশোধন করে যা যোগ হয়েছিল বিএনপি সরকারের আমলেই।

রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বিএনপি প্রতিনিধিদলের সাক্ষাতের ব্যাপারে যেমন প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি ছিল, তেমনি রাষ্ট্রপতি বিএনপির সঙ্গে বৈঠকের পর যে নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেন, সে ব্যাপারেও প্রধানমন্ত্রীর সায় বা পরামর্শ ছিল। এটা বিএনপি নেতৃত্বের না জানার কথা নয়। সুতরাং নির্বাচন কমিশন গঠনে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার প্রতিফলন না ঘটাই অস্বাভাবিক।

মজার ব্যাপর হচ্ছে, রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি– এ দুই বড় দল নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য দ্রুত আইন প্রণয়নের উপর গুরুত্ব আরোপ করেনি। উভয় দলই নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য সাংবিধানিক নির্দেশ উপেক্ষা করে আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠনেই আগ্রহ প্রকাশ করেছে। দুটি দলই রাষ্ট্রক্ষমতায় বারংবার এসেছে এবং আইন না করে তাদের অনুগত ব্যক্তিদের দিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করেছে, যাতে নির্বাচনের ফলাফলে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে। অর্থাৎ নির্বাচন কমিশন গঠনের মাধ্যমে তারা নির্বাচনে জয়ের প্রথম ধাপ নিশ্চিত করতে চায়।

যদি কেউ নিরপেক্ষভাবে বিচার করেন, তাহলে বলতেই হবে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতায় আলী ইমাম মজুমদার এন এম নূরুল হুদার চেয়ে সর্বমহলে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। আলী ইমাম মজুমদার যেহেতু কেবিনেট বা মন্ত্রিসভা সচিব ছিলেন, জ্যেষ্ঠতার কারণেই আমলাদের মধ্যে তাঁর প্রভাব ও প্রতিপত্তি অনস্বীকার্য, যা নির্বাচন কমিশনের মতো একটি দায়িত্বপূর্ণ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য সহায়ক ও প্রয়োজন। তুলনামূলকভাবে নূরুল হুদার সাচিবিক জ্যেষ্ঠতা ও অভিজ্ঞতা অনেক কম হলেও রাষ্ট্রপতি যে কোনো বিচারেই হোক তাঁকেই প্রধান নির্বাচন কমিশার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। এখন এটা বাস্তবতা। কোনো দুর্ঘটনা না ঘটলে এই বাস্তবতার মধ্যেই ২০১৯ সালের জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়ে হইচইটা এ কারণেই।

নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়ে বিএনপির যত মাথাব্যাথা, আর কোনো দলের তত মাথাব্যাথা নেই। কারণ রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে একমাত্র বিএনপিই আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী এবং তাদের এই নির্বাচন কমিশনের অধীনেই নির্বাচন করতে হবে। এটা বিএনপি যেমন জানে, তেমনি আওয়ামী লীগও জানে। বিএনপির অভিযোগ, নূরুল হুদা জনতার মঞ্চের লোক এবং কাজী রকিবউদ্দীনের চেয়েও বেশি আওয়ামী ঘেঁষা। এ অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেছেন, এটা বিএনপির রাজনৈতিক কৌশল। আর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আগামী নির্বাচনে পরাজয় নিশ্চিত জেনে বিএনপি এখন থেকেই মাঠ তৈরি করছে।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে যে বাকযুদ্ধ শুরু হয়েছে, তা চলবে। রাজনৈতিক ও আইনগত পরিস্থিতিটা এমন দাঁড়িয়েছে যে এক দল আরেক দলকে ছাড়া চলতে পারছে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তিনি আর কোনো প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন দেখতে চান না। এ বক্তব্যে স্পষ্টতই তিনি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের প্রতি ইঙ্গিতে করেছেন, যে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে-বিদেশে বির্তক শুরু হয়েছিল এবং সরকার বৈধতা সংকটে (Legitimacy crisis) পড়েছিল। চাপে পড়ে শেখ হাসিনা ও তাঁর কেবিনেটের অনেক সিনিয়র মন্ত্রী সেদিন বলেছিলেন, এটা সংবিধান রক্ষার নির্বাচন, সবার অংশগ্রহণে শিগগিরই আরেকটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

কিন্তু সরকার তার অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক কর্মকাণ্ডের দ্বারা বৈধতার সংকটের কারণে সৃষ্ট প্রতিকূল পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠে সুর বদলে ফেলে বলতে থাকে, যথাসময়ে অর্থাৎ মেয়াদপূর্তির পরেই ২০১৯ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সে নির্বাচন যাতে গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি না হয়, সেজন্যই আওয়ামী লীগ বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে তৎপর।

নির্বাচন কমিশনে বিএনপির প্রস্তাবিত একজনকে অন্তর্ভুক্ত করে ক্ষমতাসীন দল সে বার্তাই দিয়েছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে বিএনপি বস্তুত অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। জিয়াউর রহমান যখন রাষ্ট্রক্ষমতায় তখন বিএনপির জন্ম। জন্মের পর থেকে জেনারেল এরশাদের মেয়াদ বাদ দিলে বিএনপি এত দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে ছিল না। রাষ্ট্রক্ষমতাকেন্দ্রিক দলের সমস্যা এই যে, এ ধরনের দল দীর্ঘদিন ক্ষমতাবঞ্চিত থাকলে সাংগঠনিক সংকটে পতিত হয়। বিরোধী দলে থাকলেও একধরনের রাষ্ট্রক্ষমতার ব্যবহার করা যায় এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন বেনিফিটের ভাগীদার হওয়ার সুযোগ ঘটে। যার কিছুই আজ বিএনপির নেতাকর্মীদের ভাগ্যে জুটছে না।

নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে হইচইয়ের আরেকটি বড় কারণ: গণতন্ত্র বলতে আমরা কেবল নির্বাচনকেই বুঝি। কেবল আমাদের দেশেই নয়, সারা বিশ্বেই রাজনীতিবিদরা সুপরিকল্পিতভাবে জনগণকে গণতন্ত্রের পূর্ণ স্বাদ থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে। নির্বাচন নিঃসন্দেহে গণতন্ত্রের প্রথম ও প্রধান শর্ত, কিন্তু একমাত্র শর্ত নয়।

গণতন্ত্র বলতে মানুষের রাজনৈতিক অধিকারসহ অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অধিকারকেও বোঝায়। বিশ্বায়নের বাজারে অর্থনীতির যে দাপট তার ঢেউ আমাদের দেশেও লেগেছে, ধনী-দরিদ্রের অর্থনৈতিক বৈষম্য লাগামহীনভাবে বেড়েই চলেছে, যা নিয়ে আমাদের রাজনীতিবিদ ও এলিট শ্রেণির মধ্যে বির্তক নেই। একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর হাতে সব সম্পদ পুঞ্জিভূত হচ্ছে। অপরদিকে বেড়ে চলছে ন্যূনতম আয়ের মানুষের বঞ্চনা। জনগণকে এখন থেকে অধিকার সচেতন করা না হলে বাংলাদেশ যখন মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হবে, তখন ধনী-দরিদ্রের এই বৈষম্য আরও বেড়ে যাবে।

গণতন্ত্রের জন্য এখন অবাধ ভোটের সংকট, তখন নতুন সংকট সৃষ্টি হবে। গণতন্ত্র যদি অংশগ্রহণমূলক না হয়, তাহলে একটার পর একটা সংকট বা সমস্যার জন্ম হবেই। কেবল রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের জন্য তথাকথিত গণতন্ত্রকে ব্যবহার না করে গণতন্ত্রকে কত বেশি অংশগ্রহণমূলক করা যায়, আমাদের রাজনীতিবিদদের দৃষ্টি সেদিকেই ফেরাতে হবে।

এখন আমরা যা করছি, তা তার উল্টোটা। 'ভোট ছাড়াই' আমরা নির্বাচন করেছি এবং সরকার গঠন করে বহাল তবিয়তে রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকেছি। ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচন যে নজির স্থাপন করেছে, ভবিষ্যতের জন্য তা হুমকি হয়ে থাকবে এ কারণে যে, এর পুনরাবৃত্তির আশংকা থেকেই যাবে। অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র, যার পূর্ব শর্ত সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন, তা ছাড়া সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়, আর সুশাসন তখনই সম্ভব যদি তা অংশগ্রহণমূলক (Participatory governance) হয়।

গণতন্ত্রের স্বার্থেই নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করতে হবে যাতে সব দল নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে এবং সব ভোটার নির্বাচনে অবাধে ভোট দেওয়ার সুযোগ পায়।

হারজিতের হিসাব-নিকাশ করেই বিএনপি গত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিএনপিই। তবে ক্ষতি হয়েছে গণতন্ত্রও। জাতীয় সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ একতরফাভাবে শাসন চালিয়েছে এবং সমাজের সব স্তরে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়েছে।

যা হোক, সাংগঠনিক ও আইনগত কারণেই এবার বিএনপিকে জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। কেননা, আইনে আছে– কোনো দল পরপর দুবার জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নিলে তার নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাবে।

নির্বাচন কমিশন গঠনের পর শর্ত হিসেবে বিএনপি এবার অন্য দাবি তুলেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির বিকল্প হিসেবে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের দাবি করছে। নির্বাচনকালীন সরকার কোনো নতুন কনসেপ্ট নয়, বহু গণতান্ত্রিক দেশেই নানা ধরনের নির্বাচনকালীন সরকারের প্রচলন রয়েছে।

গত জাতীয় নির্বাচনের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিএনপিকে সরকারে অংশগ্রহণের যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তা নির্বাচনকালীন সরকারই ছিল। তবে সেটা স্থায়ী কোনো ব্যবস্থার প্রস্তাব ছিল না, ছিল বিশেষ সময়ের জন্য।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, তারা প্রধানমন্ত্রীর কাছে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রস্তাব দেবেন। তবে তার কোনো রূপরেখা প্রকাশ করেননি। মির্জা ফখরুলের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের কোনো নেতা এখন পর্যন্ত প্রতিক্রিয়া জানাননি। তবে তাদের অবস্থান হচ্ছে সংবিধান অনুসারে বিএনপিকে নির্বাচন করতে হবে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনেই।

চূড়ান্ত পর্যায়ে রাজনীতির দৃশ্যপট কী হবে, তা না জেনে কোনো কিছু বলা যাবে না। তবে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে সংবিধান অপরিবর্তিত রেখেও নির্বাচনকালীন সরকার গঠন সম্ভব বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

বিএনপির সাধ আর সাধ্যের মধ্যে ফারাক অনেক। নির্বাচনকালীন সরকারের প্রস্তাব নিয়ে শেষ পর্যন্ত আপস-মীমাংসা হলেও বিএনপির জন্য নির্বাচনে অংশগ্রহণের পথ প্রশস্ত হয়ে যাবে, তা নয়। রাজনৈতিকভাবে বিএনপি ঝঞ্ঝাটমুক্ত অবস্থায় নেই। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহত করতে গিয়ে এবং এর পরের বছর একই সময় বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে যে জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন চালায়, বিএনপির নেতাকর্মীদের এখনও সে ধকল পোহাতে হচ্ছে।

জেল-জুলুম তো রয়েছেই, বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ঝুলছে। স্বয়ং বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দুটি গুরুতর মামলা রয়েছে। যেগুলোর রায় কাছাকাছি যে কোনো সময় হতে পারে। মামলার রায় কী হবে এবং রায়ের প্রেক্ষিতে সরকার কী মনোভাব গ্রহণ করবে তার উপর নির্ভর করছে নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ কতটা স্বস্তির সঙ্গে হবে।

জার্মানি সফরের সময় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আদালতের রায়ে খালেদা জিয়ার জেল হলে সরকারের কিছু করার নেই। খালেদা জিয়ার যদি জেল হয় তাহলে বিএনপির অবস্থা হবে এতিমের মতো। দণ্ডপ্রাপ্ত আসামী তারেক রহমানের পক্ষেও দেশে প্রত্যাবর্তন সম্ভব নয়। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বিএনপি তা কীভাবে সামাল দেবে, বিএনপির নেতৃত্ব সম্পর্কে যাদের ধারণা রয়েছে তাদের পক্ষে বোঝা কঠিন নয়।

গোটা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, একটা সমঝোতাপূর্ণ পরিবেশে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হলে তা কতটুকু অংশগ্রহণমূলক হবে, তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়।

নতুন নির্বাচন কমিশনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলি ও ভোটারদের আস্থা অর্জন করা, যা রকিবউদ্দীন কমিশন হারিয়ে ফেলেছিল। এর কারণ ওই কমিশনের অধীনে যতগুলি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তার দু-তিনটি বাদ দিলে সবগুলি নির্বাচনই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। অথচ ওই নির্বাচন কমিশনের অধীনে একটি জাতীয় নির্বাচনসহ বিভিন্ন পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের সাফল্য নিয়ে রকিবউদ্দীন কমিশন ও ক্ষমতাসীন দলের নেতানেত্রীর মুখে গর্বের শেষ নেই। এটি ছিল ওই কমিশনের শেষ নির্বাচন। তাহলে প্রশ্ন উঠে, আগের নির্বাচনগুলো অবাধ নিরপেক্ষ হয়নি কার বা কাদের দোষে? সে ব্যর্থতার জন্য দায়ী কে বা কারা? নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন থেকে এটা পরিষ্কার যে, সরকার ও নির্বাচন কমিশন চাইলেই কেবল নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হতে পারে। যদিও অংশগ্রহণকারী দল ও ভোটারদের ভূমিকা অস্বীকার করা যাবে না।

ইতিপূর্বে অনুষ্ঠিত পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সাফল্য নিয়েও প্রায়ই কথা বলা হয়ে থাকে। নির্বাচনের পরবর্তী সমাচার কী? নির্বাচিত মেয়ররা বিএনপি মনোনীত প্রার্থী ছিলেন বলে তাঁরা মেয়রের আসনে বসতে পারেননি; ঠাঁই হয়েছে জেলে। হাইকোর্ট থেকে জামিন পেলেও তাদের মেয়রের দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া হচ্ছে না। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে সরকার সেলিনা হায়াৎ আইভীর জয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত ছিল বলেই তা অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হওয়ায় কোনো বাধা ছিল না। 'তালগাছটা আমার' হলে গণতন্ত্র চর্চায় কোনো বাধা নেই, না হলেই যত বিপত্তি।

যে কথা বলছিলাম, হুদা নির্বাচন কমিশন কি হারানো আস্থা পুনরুদ্ধার করতে পারবে? সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা উঠলেই প্রায়ই চলে আসে প্রতিবেশী ভারতের নির্বাচন কমিশনের কথা। স্বাধীনতা উত্তরকালে ভারতের সবচেয়ে বড় অর্জন হল গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের নির্মল ঐতিহ্য গড়ে তোলা। ভারতের নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা কতটা শক্তিশালী তার একটা সাম্প্রতিক উদাহরণ হচ্ছে, মোদি সরকার উত্তপ্ত কাশ্মীরে নির্বাচন করতে চেয়েছিল, কিন্তু সেখানে নির্বাচনের উপযোগী পরিবেশ নেই বলে নির্বাচন কমিশন তা নাকচ করে দিয়েছে। এর অর্থ ভারতে নির্বাচন কমিশন সরকারের প্রভাব বলয়ের বাইরে অবস্থান গ্রহণ করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

আমাদের নির্বাচন কমিশন কি পারবে সরকারের প্রভাব বলয়ের বাইরে থেকে ভূমিকা পালন করতে? সংবিধান তাদের সে ক্ষমতা দিলেও তা প্রয়োগ করে নিজেদের সার্বভৌম অবস্থানকে নিশ্চিত করতে বারংবার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে আমাদের নির্বাচন কমিশনগুলি।

কমিশনারদের অনেকেই হয়তো মনে করেন, তাদের নিয়োগ তাদের কৃতকর্মের পুরস্কার, যে কারণে তারা তাদের সাংবিধানিক অবস্থান বুঝতে পারেন না। নিয়োগকে দায়িত্ব হিসেবে নিলে এই মানসিক সমস্যা হত না। রকিবউদ্দীন কমিশনের উত্তরসূরি হিসেবে হুদা কমিশনের আমলেও যাতে বিতর্কিত অধ্যায়ের পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সে জন্যই এত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, আলোচনা-সমালোচনা।