আলো জ্বালল অন্ধকার গাম্বিয়া

শাকিল রিয়াজ
Published : 17 March 2017, 03:08 AM
Updated : 17 March 2017, 03:08 AM

আমেরিকান লেখক আলেক্স হ্যালির পূর্বপুরুষ কুন্তা কিন্তেকে গাম্বিয়ার একটি গ্রাম থেকে ধরে এনে দাস হিসেবে বিক্রি করা হয়েছিল আমেরিকায়। সাত পুরুষ আগের ঘটনা। আলেক্স হ্যালির নানির দাদার নানা ছিলেন কুন্তা কিন্তে। 'রুটস' উপন্যাসে দেখি ১৭ বছরের মুসলিম বালক কুন্তা কিন্তের শেকড় উন্মূলের কাহিনি। দেশ, ধর্ম, এমনকি নিজের নাম থেকে বিতাড়িত করার নির্মম গল্পের সঙ্গে আমরা বেড়ে উঠেছি। ১৯৭৬ সালে বের হওয়া বইটি টিভি সিরিজ হতে সময় লাগেনি।

মনে আছে, শৈশবে আমাদের নাম কেউ জিজ্ঞেস করলে প্রথমে বলতাম, "কুন্তা কিন্তে"। পরে আসল নাম বলতাম। নিলামে বিক্রি হওয়া কিন্তের নতুন নাম হয় 'টবি'। দাসপ্রথা আর বর্ণবাদের নির্দয় নিগ্রহের শিকার কিন্তের লোমহর্ষক ইতিহাস খুলে দিয়েছিল আমেরিকার মুখোশ।

'রুটস' বাদ দিলে, আমেরিকা আর গাম্বিয়া– এ দুদেশের মধ্যে তেমন কোনও কমন কাহিনি নেই। দুদেশ মিলিয়ে কোনো সংবাদ কখনও চোখে পড়েছে, মনে করতে পারছি না। দুটি দুমেরুর দেশ; স্বার্থে, রঙে, জীবনযাপনে, সংস্কৃতিতে, অর্থে। শুধু গত জানুয়ারিতে দেশ দুটিতে ঘটেছে একই রকম দুটি ঘটনা। একই সপ্তাহে দুদেশে শপথ নিয়েছেন দুই নতুন প্রেসিডেন্ট। দিন-তারিখের এই মিলের বাইরে যে মিলটা এখন আলোচ্য, দুই প্রেসিডেন্টই বদলে ফেলেছেন দেশের অভিমুখ। উল্টোপথে হাঁটছেন তাঁরা।

গত ২২ বছর আফ্রিকার সবচেয়ে ছোট দেশ গাম্বিয়া শাসন করেছেন স্বৈরশাসক ইয়াহিয়া জাম্মেহ। ১৯৯৪ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে নিপীড়ন চালিয়েছেন দেশ ও দেশের জনগণের উপর। ভূলুণ্ঠিত ছিল মানবাধিকার, নাগরিক অধিকার। ছিল না মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। নিরাপত্তাবাহিনীর নামে দুর্ধর্ষ এক বাহিনী রাষ্ট্রময় ত্রাস করে বেড়াত। তারা খুঁজে খুঁজে বের করত ভিন্নমতের কেউ আছে কি না, প্রেসিডেন্ট বা সরকারের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলছে কি না। শাস্তি মানে গুম, খুন কিংবা কুখ্যাত জেলখানা 'মাইল-২'-তে (Mile-2) ধুঁকে ধুঁকে মরা।

ইয়াহিয়ার যে কাণ্ডগুলো বিশ্বের নজরে এসেছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে সাংবাদিক দেইদা হায়দারাকে হত্যা, ২০০৯ সালে মৃত্যুদণ্ডের আইন নতুন করে চালু করা এবং এই আইনের আওতায় নয়জন বিরোধী রাজনীতিকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর, দেশের সব সমকামীকে হত্যার হুমকি ইত্যাদি। তিনি দাবি করেছেন, এমন এক ভেষজ ওষুধ তিনি স্বয়ং উদ্ভাবন করেছেন যা দিয়ে 'এইডস' সারানো যাবে। এবং এই চিকিৎসার বাইরে অন্য কোনো চিকিৎসা নেওয়া যাবে না। ঘোষণা দিয়েছিলেন, কোটি বছর তিনি গাম্বিয়া শাসন করবেন।

বছর বছর হিউম্যান রাইটস, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, রিপোর্টারস সান্স ফ্রন্টিয়ারস ইত্যাদি মানবাধিকার ও নজরদারি সংস্থা ইয়াহিয়ার অপকীর্তির রিপোর্ট প্রকাশ করত। এসব অবশ্য মোটেই পাত্তা পেত না তাঁর কাছে। বরং সগর্বে জাহির করতেন নিজের ঔদ্ধত্য আর শক্তিমত্তা।

প্রায় একই সময়, যখন ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে অভিষিক্ত হলেন, পশ্চিম আফ্রিকার এই ছোট দেশটিতে মঞ্চস্থ হল এক নাটক। ডিসেম্বরের নির্বাচনে হেরে গেলেন ইয়াহিয়া জাম্মেহ, কিন্তু ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজি হলেন না। ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার নানা ফন্দি আঁটতে লাগলেন। নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট আডামা ব্যারো তখন প্রতিবেশী দেশ সেনেগালে। গাম্বিয়ায় ঢুকতে বাধা দেওয়া হচ্ছে তাঁকে। এ সময় এগিয়ে এল ইকোওয়াস (ECOWAS — Economic Community of West African States); 'অপারেশন রিস্টোর ডেমোক্রেসি' নামে অভিযান চালাল গাম্বিয়ায়।

ঠিক যে সময় ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে তাঁর অভিষেক ভাষণ দিচ্ছিলেন, যদিও ট্রাম্পের দাবি সেটা ছিল মেঘমুক্ত রৌদ্রজ্জ্বল দিন, ঠিক সে সময়ই পদত্যাগে বাধ্য হন জাম্মেহ। কঠোর পাহারায় তাঁকে তুলে দেওয়া হয় প্লেনে। গন্তব্য একোয়াটরিয়াল গিনি। সেখানে আরেক ডিক্টেটরের আশ্রয়ে দিনাতিপাত করবেন তিনি। আর একই সঙ্গে অবসান হল ২২ বছরের নির্মম স্বৈরশাসনের।

ইন্টারেস্টিং যেটা, আমেরিকা আর গাম্বিয়া এ দুদেশের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টদ্বয় শপথের প্রথম সপ্তাহেই কিছু প্রশাসনিক আদেশ দিয়ে আলোচনায় আসেন। যে দুটি আদেশপত্রে সই করে ট্রাম্প সারা বিশ্বে ঘৃণা আর ধিক্কারের পাত্র হয়েছেন সেগুলো হচ্ছে আমেরিকা ও মেক্সিকোর মাঝে দেয়াল তুলে দেওয়া এবং সাতটি দেশের মানুষের আমেরিকা ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা।

আলোকিত দেশটির এই অন্ধকার অভিমুখে যাত্রার পাশাপাশি অন্ধকার দেশ গাম্বিয়ার দিকে চোখ ফেরানো যাক। প্রেসিডেন্ট আডামা ব্যারো বেছে নিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পথ। এ পথ আলোর দিকে যাওয়ার, এ পথ গণতন্ত্রমুখী, মুক্তচিন্তার, প্রগতিশীলতার। প্রথম সপ্তাহেই ব্যারো নতুন করে সংযুক্ত হয়েছেন ব্রিটিশ কমনওয়েলথের সঙ্গে। উদ্দেশ্য বিশ্ববাণিজ্যের স্রোতে গাম্বিয়াকে আবার অবগাহন করানো।

২০১৩ সালে কমনওয়েলথের সঙ্গে যাবতীয় সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন ইয়াহিয়া এই অজুহাতে যে, কমনওয়েলথ আসলে ভিন্ন রঙে ব্রিটিশ উপনিবেশ ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রথম সপ্তাহেই আর যে একটি বড় পদক্ষেপ নিয়েছেন তা হচ্ছে সংবাদপত্র তথা বাক ও মতপ্রকাশের ওপর আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে ফেলা।

আডামা ব্যারো তাঁর নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে বেছে নিয়েছেন মানবাধিকারের জন্য লড়াই করা এক আইনজীবীকে। নিয়ম করেছেন, নিরাপত্তাবাহিনীর প্রশিক্ষণকালে বিষয় হিসেবে মানবাধিকার অবশ্যপাঠ্য থাকবে। মানুষের অধিকার রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত বেতনভূক কর্মীদের মানুষের অধিকার হরণের প্রথাকে 'গুড বাই' জানাতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীনের মতো বিশ্বশক্তিরা যখন দাম্ভিকতা, অহমিকা, হিংসার পথে হাঁটছে, হয়ে উঠছে স্বৈরাচারী, অন্তর্মুখী, যখন বিধিনিষেধ মতপ্রকাশে, মিডিয়া যখন ট্রাম্প-পুতিনের আক্রোশ আর আক্রমণের লক্ষ্যস্থল তখন আডামা ব্যারোর সাহসী পদক্ষেপগুলো আমাদের আনন্দ দেয়।

কট্টর স্বৈরশাসন থেকে নিষ্কলুষ গণতন্ত্রে ফেরা রাতারাতি সম্ভব নয়। বিশ্বের কোথাও নিষ্কলুষ গণতন্ত্রের অস্তিত্বও নেই। কিন্তু গণতন্ত্রায়ণের যে আলো জ্বালাবার চেষ্টা ব্যারো করে যাচ্ছেন, বিশেষ করে অন্ধকার মহাদেশের অন্ধকারতম এক প্রান্তে বসে, সেই প্রচেষ্টায় আমরা ভরসা রাখতে চাই।

কখনও কখনও এমন জায়গায় আশার আলো জ্বলে ওঠে– ভাবনারও অতীত। নক্ষত্রেরা ব্ল্যাকহোল অভিমুখী হলে অন্ধকার থেকেই মোম হাতে কেউ বের হয়। গাম্বিয়ার হাতে এখন এই প্রদীপ; আশা, এ আলো ছড়িয়ে যাবে সবখানে…