আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে

সাজ্জাদুল হাসান
Published : 24 Oct 2011, 02:26 AM
Updated : 3 March 2017, 03:07 AM

দুধে-ভাতে কিংবা মাছে-ভাতে অথবা অধুনা ডাল-ভাতে– বাঙালির জীবনে সময়ের পরিক্রমায় অনেক কিছুই বদলেছে, ভাত রয়ে গেছে তার স্বীয় মহিমায় সমুজ্জ্বল। দুই অক্ষরের শব্দটি কি নিছক একটি খাদ্যদ্রব্য? বাঙালির সামগ্রিক জীবনাচরণের একেবারে কেন্দ্রে এই ভাত। কী রাজনীতি, কী সংস্কৃতি অথবা অর্থনীতি– সর্বক্ষেত্রে রয়েছে ভাতের আবেগঘন অবস্থান।

দুবেলা দুমুঠো ভাত– অনেকের কাছে জীবনের মানে তা-ই। প্রবাসে অবস্থান কালে অধিকাংশের দীর্ঘশ্বাস: 'কতদিন ভাত খাই না!' জমকালো দাওয়াতে হরেক মুখরোচক বাহারি খাবারের ভিড়ে শোনা যায়: 'একটু ভাত হবে?' রাতে ভাত না খেয়ে ঘুমাতে গেলে মনে হয়– 'সারা দিন কিছুই খাওয়া হয়নি।'

প্রিয় বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর ডাইনিংয়ের সেই মজার মানবিক ব্যবস্থা– ভাত-ডাল ফ্রি, যত খুশি তত; পেটচুক্তি যাকে বলে!

ভাত নিয়ে সংক্ষুব্ধ কবির প্রতীকী প্রতিবাদ:

"ভাত দে হারামজাদা, তা না হলে মানচিত্র খাব।"

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (FAO) পরিসংখ্যান অনুযায়ী বছরে মাথাপিছু ভাত খাওয়ার (per capita rice consumption) হিসাবে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ– ১৬৬ কিলোগ্রাম। এই তালিকায় প্রথম দেশ ব্রুনেই– ২৪৫ কিলোগ্রাম। ভিয়েতনাম এবং লাওস রয়েছে যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে। কাকতালীয়ভাবে ভাত/চাল উৎপাদনেও বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে চতুর্থ– প্রায় ৩৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে যথাক্রমে চীন, ভারত ও ইন্দোনেশিয়া।

খাদ্য (চাল) উৎপাদনে বাংলাদেশের সাফল্য রূপকথাকেও হার মানিয়েছে। হেনরি কিসিঞ্জার বা সমগোত্রীয় অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের তথাকথিত 'তলাবিহীন ঝুড়ি তত্ত্ব' মিথ্যা প্রমাণ করে বাংলাদেশ আজ খাদ্যশস্য (চাল) উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আজ থেকে ৪৬ বছর আগে বাঙালি যখন রক্তাক্ত এক মুক্তিসংগ্রামের মধ্যে দিয়ে প্রিয় লাল-সবুজ পতাকার অধিকার অর্জন করে, এ ভূখণ্ডের লোকসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি আর খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ মাত্র ১০ লাখ টন। যুদ্ধবিধ্বস্ত এক জনপদ, শূন্য রাষ্ট্রীয় কোষাগার, বেহাল প্রশাসনিক কাঠামো আর জনগণের প্রত্যাশা পূরণের পর্বতসম চাপ নিয়ে যাত্রা শুরু হয় এ নবীন রাষ্ট্রের। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ যা, অনেকের মতে, এক সুগভীর ভূরাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের ফল।

প্রকৃতি যেমন উদারহস্তে বিলিয়েছে তার কৃপা, তেমনি কখনও কখনও হয়েছে খড়্গহস্ত। এই অসংখ্য নদীবিধৌত বদ্বীপে ঝড়-বন্যা-সাইক্লোন নিত্যকার ব্যাপার। বারংবার কেড়ে নিয়েছে সর্বস্ব, ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে কত যে স্বপ্ন! তাতে কী? যুদ্ধ করে যে জাতি স্বাধীন হয় কে তাদের আর রোখে– "জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার, তবু মাথা নোয়াবার নয়।"

গত ৪৬ বছরে জনসংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে খাদ্য উৎপাদন প্রায় সাড়ে তিন গুণ! এ কোনো যাদুর পরশ বা ঈশ্বরপ্রদত্ত কৃপা নয়; এ এক সম্মিলিত লড়াইয়ের গল্প। যে গল্পের প্রতিটি চরিত্রের লক্ষ এক, যারা সবাই অবিচল, দৃঢ় আর প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কী যেন এক অদৃশ্য বন্ধনে আবদ্ধ সবাই। সুসংগঠিত এক অর্কেস্ট্রা দল, সুরের মুর্ছনায় আবিষ্ট করে তৈরি করে চলেছে একের পর এক সফলতার গল্প। এই পথচলায় সমানভাবে শামিল হয়েছে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নীতিনির্ধারণী মহল, এ মাটির প্রতিভাবান বিজ্ঞানী, নিবেদিতপ্রাণ সম্প্রসারণকর্মী আর সর্বোপরি অজেয় কৃষককূল– মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, সব প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে যারা ফলায় সোনার ফসল।

তবে এ সাফল্যের ধারাবহিকতা ধরে রাখতে হলে এখন থেকে হতে হবে সতর্ক। আত্মতুষ্টিতে না ভুগে ভবিষ্যতের সামগ্রিক খাদ্য নিরাপত্তার কথা মাথায় নিয়ে প্রকৃতি ও পরিবেশবান্ধব দীর্ঘমেয়াদী টেকসই পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। ষাটের দশকে শুরু হওয়া সবুজ বিপ্লবের ধারাবাহিকতায় শুকনো মৌসুমে (বোরো) ধান আবাদের যে যুগান্তকারী পদক্ষেপ শুরু হয়েছিল, মূলত সে কারণেই দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। দেশের মোট ধান উৎপাদনের ৫০ ভাগের বেশি উৎপন্ন হয় বোরো মৌসুমে। এটা কারও অজানা নয় যে, এই মৌসুমে ধান চাষের জন্য যে সেচের প্রয়োজন হয় তার সিংহভাগ আসে ভূগর্ভস্থ পানি থেকে। এক কেজি ধান উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন হয় নূন্যতম দুই হাজার লিটার পানি। এ বিপুল পরিমাণ পানি সরবরাহ করতে গিয়ে ক্রমাগতভাবে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে পানির স্তর দিনে দিনে আশঙ্কাজনকভাবে নিচে নেমে যাচ্ছে।

প্রতিবেশি ভারত এখনও তাদের সেচের জন্য ভূউপরিস্থ পানির ব্যবহার করে থাকে। আমাদের এ দিকটায় নজর দিতে হবে। বর্ষা মৌসুমের বৃষ্টির পানি ধরে রাখা, নদীসমূহের গভীরতা বজায় রাখা যাতে তারা অধিক পানি ধারণক্ষম হয়, পরিকল্পিত খাল খননের মাধ্যমে সেচকাজে নদীর পানির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিতকরণ ইত্যাদি কাজসমূহ অত্যন্ত জরুরি ও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুরু করতে হবে।

আশার কথা, নীতিনির্ধারণী মহলে ইতোমধ্যে এ নিয়ে চিন্তা শুরু হয়েছে। সরকার বোরোর উপর নির্ভরতা কমানোর উপায় হিসেবে আউশ ও আমন মৌসুমের উপর জোর দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। এর ফলে এই মৌসুমে ধান আবাদের জন্য বিনামূল্যে সার, বীজ এবং সেচের জন্য বিশেষ প্রণোদনা প্রদান করছেন। তবে এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, আউশ এবং বিশেষ করে, আমন মৌসুমে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা, সাইক্লোন ইত্যাদির প্রকোপ থাকে অনেক বেশি। কাজেই অনিশ্চয়তাও তুলনামূলক অনেক বেশি। সুতরাং আমাদের সব দিক বিবেচনায় নিয়ে এগুতে হবে যাতে করে এ কষ্টার্জিত সাফল্য ধরে রাখা যায় এবং সর্বোপরি দেশের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে না পড়ে।

বিশ্বখ্যাত পরামর্শক প্রতিষ্ঠান পিডব্লিউসির (PwC) এক রিপোর্টে (The World in 2050) প্রকাশ, ২০৫০ সাল নাগাদ ক্রয়ক্ষমতার সমতার (Purchasing Power Parity- PPP) ভিত্তিতে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৩তম বৃহৎ অর্থনীতি। আর এই অভাবনীয় অগ্রযাত্রায় ভাত হবে অন্যতম এক নিয়ামক।

বেঁচে থাক বাঙালির আজন্মলালিত স্বপ্ন। কবি ভারতচন্দ্র যা বর্ণনা করে গেছেন আজ থেকে তিনশ বছর আগে–

"আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে!"