‘ব্র্যাকাথন’ ও নতুনের জয়গান

কে এ এম মোরশেদ
Published : 16 Feb 2017, 03:56 PM
Updated : 16 Feb 2017, 03:56 PM

আমাদের উন্নয়নের পথ সুগম করার যে কাজে আমরা নেমেছি সে কাজে আমাদের মতো মধ্যবয়সী বা বয়সীদের বুদ্ধি আর চলছে না। একে তো উন্নয়নের প্রতিটি ধাপ আগের ধাপের চেয়ে কঠিন– তার ওপর জনসংখ্যার বৃদ্ধি, শহরমুখী স্রোতের তোড়ে টালমাটাল নগরায়ন, কৃষি হতে শিল্পে পেশা পরিবর্তন, জলবায়ু পরিবর্তন, বিশ্বায়নের আগ্রাসন, বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা, ইত্যাদি মিলিয়ে সমস্যার প্রকার ও প্রকৃতি বদলাচ্ছে প্রতিনিয়ত। সত্যি বলতে কী, এসব অভিনব সমস্যার সমাধানে বহু ব্যবহৃত পথ মাড়িয়ে, গত শতাব্দীর কৌশল নিয়ে আর অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার চেষ্টা প্রায়ই কাজ করছে না।

তবে এমন যে হবে তা বিজ্ঞানী আইনস্টাইন অনেক আগেই বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, "যে মেধা দিয়ে তোমরা সমস্যা তৈরি করেছ, সেই মেধা দিয়ে তার সমাধান হওয়ার নয়।"

তাঁর সেই বাণীর মতো এখন আমাদেরও হাত তুলে আত্মসমর্পণের সময় হয়েছে নতুনের কাছে, নতুন চিন্তার কাছে; আর সেজন্যই 'ব্র্যাকাথন'।

ব্র্যাকাথন ব্যাপারটা একটু ব্যাখ্যা করি। বাইরে থেকে দেখলে এটা একটা প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগীরা হল নতুন প্রজন্মের তরুণ-তরুণী; একা, দলগত বা কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি। তাদের সামনে বেশ কয়েকটি সামাজিক সমস্যা দেওয়া হয়। তারা একক বা দলে সমস্যা বেছে নিয়ে, তাদের উদ্ভাবনী শক্তি কাজে লাগিয়ে একটা সমাধানের ধারণা তৈরি করে। তাদের এই ধারণা পছন্দ হলে, তাদের নিয়ে শুরু হয় শলাপরামর্শ যেখানে আমরা আমাদের যতটুকু সাধ্য তা দিয়ে তাদের সমাধানের ধারণা আরেকটু ধারালো করার জন্য পরামর্শ দিই।

এরপর প্রতিযোগিতার মূল পর্ব। এই পর্যায়ে তারা তাদের ধারণার একটা বাস্তব রূপ দেওয়ার চেষ্টা করে। তাদের তৈরি এসব প্রটোটাইপ থেকে বিচারকদের একটা দল শ্রেষ্ঠ সমাধান নির্বাচন করে। শ্রেষ্ঠ দলগুলিকে তারপর আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতা দেওয়া হয়, যাতে তারা ধারণাটির একটি চূড়ান্ত রূপ দিতে পারে। এছাড়া তাদের তৈরি সমাধানটি ব্র্যাক তো ব্যবহার করেই, এসব সমাধান প্রস্তুতকারকরা যেন অন্য প্রতিষ্ঠানে বিপণন করতে পারে, সে সহায়তাও করা হয়।

কীভাবে এই ব্র্যাকাথন দেশের উন্নয়নে নতুন প্রাণের সঞ্চার করবে? প্রতিযোগী দলগুলি প্রায় প্রতি ক্ষেত্রেই– তা আমরা যেসব সমস্যা নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছি– তার একটা চমকপ্রদ সমাধান বের করে। কীভাবে? যেহেতু তারা নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি, আমাদের মতো শত ব্যর্থতায় নতুন কিছু করার সাহস হারিয়ে ফেলেনি– তাই এই সমাধানগুলো হয় উচ্চাভিলাষী, তবে সৃষ্টিশীল।

এই প্রজন্মের ধ্যান-ধারণাও আমাদের চেয়ে অনেক আলাদা। তাই তাদের সমাধানগুলিও হয় প্রচলিত সমাধানের চেয়ে একদম আলাদা। কিন্তু আলাদা হলেই কি ভালো? আমার তো তা-ই মনে হয়। একটা কঠিন সমস্যা সমাধানে একই ধরনের চেষ্টা বারবার করে ব্যর্থ না হয়ে নতুন কিছু করাই শ্রেয়, তাতে বরং সফলতার একটা সুযোগ তৈরি হয়।

ব্র্যাকাথনের আরও একটি উদ্দেশ্য আছে। এই জাতীয় প্রতিযোগিতার মাধ্যমে আমরা যুবসমাজের সবচেয়ে সক্রিয় একটি অংশকে দেশের উন্নয়নের বিষয়ে আগ্রহী করে তুলি। প্রায়ই অভিযোগ করা হয় যে, হালের শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের খুব স্বার্থপর করে তৈরি করছে, তারা নিজেদের ক্যারিয়ার নিয়ে, নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত থাকে। তবে সত্যি যা-ই হোক, ব্র্যাকাথনের মতো প্রতিযোগিতা যুবসমাজকে তাদের ক্যারিয়ারের অংশ হিসেবেই দেশের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া অংশের সমস্যা ও তার সমাধানের ব্যাপারে আগ্রহী করে তোলে।

এরকম একটা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার পর, আশা করি, এদেশের নাগরিক হিসেবে তারা আরও সচেতন হবে; তাদের অনেকে আমার মতো উন্নয়নকর্মীর পেশা (ও নেশা) গ্রহণ করতে আগ্রহী হবে, আর এভাবেই হয় নতুনের অভিষেক।

এছাড়া এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট শেষে প্রতিযোগীরা কর্মজীবনে পা রাখার আগে একটা সত্যিকার সমস্যার চমকপ্রদ সমাধান করার মাধ্যমে একটি অনন্য অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারে। এই ধরনের অভিজ্ঞতা যাদের আছে তারা প্রায়ই চাকরির বাজারে একটা সুবিধা পেয়ে থাকে। সবশেষে একটি বাস্তব সামাজিক সমস্যা ও তার সমাধান নিয়ে নিবিড় শলাপরামর্শের মাধ্যমে– আমাদের যারা বহুদিন উন্নয়নকর্মী হিসেবে কাজ করছি তারাও– অনেক নতুন নতুন ধারণা পাই; সঙ্গে সঙ্গে নতুন প্রজন্মের যারা এই পেশায় আসতে চায় তাদের সঙ্গে আমাদের জমানো অনেক অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করে নিতে পারি।

ব্র্যাকাথন নিয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা আরও ব্যাপক। আমরা চাই অদূর ভবিষ্যতে এই প্রতিযোগিতায় সরকারি ও বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠান– যারা বিভিন্ন উন্নয়ন বিষয়ক সমস্যা সমাধানে আগ্রহী– অংশগ্রহণ করবে। এসব প্রতিষ্ঠান যেসব সমস্যা সমাধানে আগ্রহী সেসব সমস্যাও ব্র্যাকাথনের প্রতিযোগীরা সমাধান করবে এবং ধীরে ধীরে প্রতিযোগিতাটি উন্নয়ন বিষয়ক সমস্যা সমাধানের একটি গ্রহণযোগ্য মঞ্চে পরিণত হবে।

সবশেষে এবারের ব্র্যাকাথনের সব প্রতিযোগীর সাফল্য কামনা করছি। আশা করছি প্রতিবারের মতো প্রতিযোগিতার প্রতিটি ধাপেই শতকণ্ঠে গীত হবে নতুনের জয়গান।