গণজাগরণকে ‘না’, হেফাজতকে ‘হ্যাঁ’

সুলাইমান নিলয়সুলাইমান নিলয়
Published : 16 Feb 2017, 04:17 AM
Updated : 16 Feb 2017, 04:17 AM

বাংলাদেশের ইতিহাসে ২০১৩ সাল সহজে ভোলা যাবে না। যুদ্ধাপরাধের দায়ে দণ্ডিত কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন দণ্ড দেওয়ায় শাহবাগে মিলিত হয়েছিল গোটা বাংলাদেশ। টানা ১৭ দিন চলে সেই অবস্থান। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ের বহু পরিবর্তনের অনুঘটক এই আন্দোলন।

এই আন্দোলনের সময়েই বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় সক্রিয় হয় হেফাজতে ইসলাম। শাহবাগের আন্দোলনকারীদের 'নাস্তিক' আখ্যা দিয়ে মাঠে নামে তারা। ঘোষণা করে ১৩ দফা দাবি। এর মধ্যে অন্যতম একটি দাবি ছিল, 'ঢাকাকে মূর্তির নগরে রূপান্তর এবং দেশব্যাপী রাস্তার মোড়ে ও কলেজ-ভার্সিটিতে ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন বন্ধ করা।'

নারীদের প্রকাশ্যে চলাচলের বিরুদ্ধেও অন্য এক দফায় বলা হয়, ব্যক্তি ও বাকস্বাধীনতার নামে সব বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ বন্ধ করতে হবে।

শাহবাগ-হেফাজত বিরোধিতার মধ‌্যেই খুন হন গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী রাজিব হায়দার। মঞ্চকর্মীদের খুন হওয়ার ধারাবাহিকতা পরেও বজায় থাকে।

যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবি মাঠে গড়ালে নাস্তিক ইস্যু মাঠে গড়ানোর ইতিহাস এই দেশে নতুন নয়। নব্বইয়ের দশকে 'ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি' যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে মাঠে নামলে গণআদালতের বিচারক আহমদ শরীফকে নাস্তিক আখ্যা দিয়ে ওই সময় মাঠে নেমেছিল একই ধরনের কয়েকটি দল।

২০১৩ সালের মে মাসে ১৩ দফা দাবিতে মতিঝিলে অবস্থান নেয় হেফাজতকর্মীরা। দিনভর সংঘাতের পর ৫ মে রাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে মতিঝিল ছাড়তে হয় হেফাজতকে। ওই সময় আক্রান্ত হয় মতিঝিলের বলাকাও।

হেফাজতের ঢাকা ছাড়ার পর এই অধ্যায়ের মোটামুটি সমাপ্তি হয়েছে বলে মনে করা হলেও শিগগিরই তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়। সরকার থেকে হেফাজত আমিরের ছেলেকে নানা সুবিধা দেওয়ার খবর ছাপা হতে থাকে পত্রপত্রিকায়। পরাজিত হেফাজতের সঙ্গে সরকারের একটি মহল 'নতজানু' আচরণ করতে থাকে বলে অনেক মানুষ বলতে থাকে।

নারীর স্বাধীনতা ও ভাস্কর্যের বিরোধী অবস্থানে থাকা হেফাজত আবার ফিরে এসেছে। পৌঁছে গেছে উচ্চ আদালতেও; সেখানে স্থাপিত একটি ভাস্কর্য অপসারণের দাবি নিয়ে।

সুপ্রিম কোর্টের মূল ভবনের সামনে 'লিলি ফোয়ারা'য় গত ডিসেম্বরে এই ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়। রোমান যুগের ন্যায়বিচারের প্রতীক 'লেডি জাস্টিস'-এর আদলে এটি নির্মাণ করেছেন ভাস্কর মৃণাল হক।

ভাস্কর্যটিতে চোখে কাপড় বাঁধা এক নারীর ডান হাতে তলোয়ার, বাম হাতে দাঁড়িপাল্লা; তলোয়ারটি নিচের দিকে নামানো আর দাঁড়িপাল্লাটি পরিমাপ করছে– এমন ভঙ্গী প্রকাশ পেয়েছে।

বর্তমান বিশ্বে প্রচলিত আইনশাস্ত্রের গোড়াপত্তন হয় রোমান যুগে। বাংলাদেশেও আইনশাস্ত্রে রোমান আইন পড়ানো হয়ে থাকে। রোমানদের লেডি জাস্টিস গ্রিকদের কাছে পরিচিত ছিল 'দেবী থেমিস' হিসেবে।

এই ভাস্কর্যকে 'গ্রিক দেবীর মূর্তি' আখ্যায়িত করে তা অপসারণের দাবিতে প্রধান বিচারপতি বরাবর স্মারকলিপি নিয়ে যায় হেফাজতের প্রতিনিধি দল। সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের একান্ত সচিব আতিকুস সামাদ মাজার গেট থেকে এই স্মারকলিপি গ্রহণ করেন। এর আগেও এ ধরনের দু-একটি সংগঠন একই দাবিতে স্মারকলিপি দিয়েছে বলে জানান আতিকুস সামাদ।

স্মারকলিপি দেখেই মনে পড়ে গেল ২০১৩ সালের একটি স্মৃতি– যখন গণজাগরণ মঞ্চের প্রতিনিধিরা গিয়েছিল স্মারকলিপি নিয়ে। ওই প্রতিনিধিরা স্মারকলিপি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে পৌঁছাতে পারলেও তা গ্রহণ করেননি রেজিস্ট্রার। আদালত স্মারকলিপি গ্রহণ করতে পারেন না বলে তখন যুক্তি দেওয়া হয়েছিল।

গণজাগরণ মঞ্চের দাবি ছিল সুপ্রিম কোর্টে একটা ছুটি বাতিল-সংক্রান্ত। এই ছুটি ব্রিটিশ আমল থেকে চলে আসছে। লম্বা এই ছুটিতে ইউরোপীয় বিচারকরা সাগর পাড়ি দিয়ে স্বদেশে যেতেন।

সেই ছুটি পৌনে এক শতাব্দী পরও রয়েছে। এই ছুটি নিয়ে আদালতে কম বিতর্ক হয়নি। সর্বশেষ এই ছুটি কমানোর কথা এসেছে প্রধান বিচারপতির তরফ থেকেও।

যত দূর মনে পড়ে, সুপ্রিম কোর্টের এই ঘটনা ২০১৩ সালের অাগস্টের। গণজাগরণ মঞ্চ তখন 'ভরা যৌবনে'। এর মধ‌্যেই সামনে এসে দাঁড়ায় সেই ছুটি।

ছুটিতে হাইকোর্টে অবকাশকালীন বেঞ্চ থাকলেও প্রায় দেড় মাস বসবে না আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চ। অন্য মামলার মতো বন্ধ থাকবে যুদ্ধাপরাধের আপিল শুনানিও।

যেখানে হাইকোর্টের বিচারকরাই যে কোনো সময় যে কোনো জায়গায় কোর্ট বসিয়ে দিতে পারেন, এমনকি দূর প্রবাসে বাংলাদেশ দূতাবাস, লাল-সবুজের পতাকাবাহী বিমান-জাহাজেও তাঁরা বসাতে পারেন কোর্ট, করতে পারেন বিচার– মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত এই রাষ্ট্র তাদের সেই অধিকার দিয়েছে। এমন এখতিয়ার থাকার পরও গণজাগরণ মঞ্চের নিয়ে যাওয়া স্মারকলিপি গ্রহণ করা হয়নি।

তবে সাড়ে তিন বছর পর ন্যায় বিচারের প্রতীকের একটি ভাস্কর্য সরাতে প্রধান বিচারপতিকে দেওয়া হেফাজতের স্মারকলিপির অনুলিপি গ্রহণ করেছেন আদালতের এক কর্মকর্তা।

সাম্প্রতিক সময়ে পাঠ্যপুস্তকে হেফাজতের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে পরিবর্তন আনার পর আমাদের আশঙ্কা, হয়তো মানা হবে তাদের এ দাবিও।

ভাস্কর্য ভাঙার জন্য নব্বইয়ের দশকে একটি প্রতাপশালী মৌলবাদী দলকে নিষিদ্ধ করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সময় পাল্টেছে। এখন ভাস্কর্য নিষিদ্ধ হওয়ার সময়!

হয়তো এই সময় আমরাই এনেছি… ভুল সময়ের জনক-জননী হয়ে বেঁচে আছি আমরা। আরও কত ভুলের জন্ম দেব কে জানে!