দিদির দেশে ঘুরে এসে

মামুন আল মাহতাব
Published : 15 Feb 2017, 04:26 AM
Updated : 15 Feb 2017, 04:26 AM

কয়েকদিন আগে কাজের সুবাদে কোলকাতায় যাওয়া হয়েছিল। পৃথিবীতে বাংলা ভাষাভাষীদের যে কয়টি নিজের বলে পরিচয় দেওয়ার জায়গা আছে, বাংলাদেশ বাদে অন্য দুটি হল পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা। কোলকাতা যাওয়াটা তাই বরাবরই আনন্দের।

তবে ইদানিং যাওয়া হয় কম। ঢাকার সঙ্গে ভারতের আরও বেশ কয়েকটি শহরের সরাসরি বিমান যোগাযোগ চালু হওয়ায় ইদানীং কোলকাতা ঠিক আর যাওয়া-আসার পথে পড়ে না। তাই এবার কোলকাতা যাওয়ার দাওয়াত পাওয়া মাত্রই রাজি হতে দেরি করিনি।

কোলকাতা যেতে এবার যেটা চোখে পড়ল, পুরো কোলকাতা কেমন যেন ইউনিফর্মে মোড়া। কেমন যেন সবকিছু এক রকমের। ছোটবেলায় পড়েছি এবং বড় হয়ে দেখেছি, জয়পুর হল 'পিংক সিটি'– শহরের সব বাড়িঘর গোলাপী রঙে রাঙানো। কিন্তু 'সিটি অব জয়' তো তার চেয়েও বেশি কিছু। যেদিকে তাকাই শুধু সাদা আর নীল। তা সে রাস্তার ফুটপাথ হোক আর পাবলিক বাস, সরকারি অফিস কিংবা ডায়মন্ড হারবারে পশ্চিমবঙ্গ পর্যটনের মোটেল, চারিদিকে শুধু 'সাদা' আর 'নীল'।

ব্যাপারটা কী, বুঝতে চাইলাম। মাদার তেরেসার স্পর্শে ধন্য কোলকাতার হঠাৎ এই 'মাদারলি' সাজের কারণ কী? মাদার তেরেসার জন্ম শতবার্ষিকী জাতীয় কিছু নয় তো?

খবর নিয়ে জানলাম, কোলকাতা 'মা'র নয়, 'দিদি'র সাজে সেজেছে। দিদির প্রিয় রং সাদা-নীল। তৃণমূলেরও তাই। পুরো কোলকাতা তাই সাজবে দিদির সাজে। দিদি বলে কথা!

পশ্চিমবঙ্গের জনগণের ভোটে ৩৫ বছরের বামদূর্গ তিনি গুঁড়িয়ে দিয়েছেন, ভালোমতোই সামলেছেন মোদি তুফানও। অতএব পশ্চিমবঙ্গে যা কিছু সরকারি তা তো দিদিরই! ঠিক কথা, কিন্তু তারপরই মনে হল, আচ্ছা সবকিছু নিজের করে ভাবার এই যে প্রকাশ্য উৎসব, এর পিছনে দলীয়করণের না জানি কতটা ভয়াবহ চিত্র লুকিয়ে আছে। যে নেত্রী নিজের প্রিয় রঙের বাইরে অন্যকিছু দেখতে চান না, তাঁর প্রশাসনের কোনো বামপন্থী কর্মকর্তা-কর্মচারীর বদলি বা পদোন্নতি কিংবা রাজ্যের কংগ্রেসি ভাবাদর্শে বিশ্বাসী কোনো ব্যবসায়ীর ব্যবসার হাল-হকিকতের কথা চিন্তা করা যায় কী? আর এপারে আমরা টিভি টকশোতে আওয়ামীকরণের কেচ্ছা জপতে জপতে কিনা ফেনা তুলছি।

কোলকাতা থেকে ফেরার দিন বিমানবন্দরের কাকাছি আসতেই ট্রাফিক সার্জেন্ট আমাদের ভাড়া করা গাড়িটাকে থামালেন। যথারীতি তিনি আমাদের ড্রাইভারের কাছে গাড়ির কাগজপত্র দেখতে চাইলেন। আর তারপরই নাটকের শুরু। সার্জেন্ট যতই কাগজ চান, ড্রাইভার ততই বলে চলছে, "আরে রাখুন মশাই, একটা ফোন করে নিই।"

এদিকে পেছনে বসে ভাবছি, "এইরে ফ্লাইটটা বোধকরি আর ধরতে পারলাম না! সার্জেন্ট তো এমন বেয়াদাব ড্রাইভারকে থানায় না নিয়ে ছাড়বেন না।"

কথা চালাচালির একপর্যায়ে আমাদের ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমে সার্জেন্টকে একটু পেছনে ডেকে নিল। ভাবলাম বোধহয় লেনদেন জাতীয় কোনো কিছু হবে। যাক তাহলেও তো রক্ষা। কিন্তু পেছন ফিরে তাকাতেই দেখি সার্জেন্ট সাহেব ড্রাইভারের মোবাইলে কারো সঙ্গে কথা বলছেন। একটু পরে ড্রাইভার 'বিজয়ের হাসি' হাসতে হাসতে ফিরে আসায় রহস্য উম্মোচন হল।

আমাদের গাড়িটাকে থামানোর কারণ ছিল এটা ভাড়ায় চালানোর পারমিট নেই। ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য রেজিষ্ট্রেশন করা এই গাড়ীতে যাত্রী নেওয়া আইনের চোখে অপরাধ। গাড়ির মালিকের এ ধরনের মোট ১৭টা গাড়ি আছে। তিনি ক্ষমতাসীন দলের একজন নেতার ডিউটি করেন। এই সুবাদে গাড়ির মালিকের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের দারুণ খাতির। ড্রাইভারের কাছে খররটা পেয়ে গাড়ির মালিক উপর মহলে জানিয়েছেন। আর এরপর উপর থেকে সরাসরি ফোন এসেছে ড্রাইভারের মোবাইলে এবং তাতেই এ যাত্রা আমাদের মুশকিল আসান হল। শুনে প্রথম প্রথম ভালোই লাগল। ড্রাইভারের মতোই মনে হচ্ছিল, "ভালোই একটা শিক্ষা দেওয়া গেল অবাধ্য সার্জেন্টকে!"

কিন্তু তারপরই ভাবলাম, আচ্ছা এমন যদি হত– হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছাকাছি কোথাও আমার গাড়িটাকে কোনো কারণে ট্রাফিক সার্জেন্ট থামালেন। পেশাগত কারণে আমারও তো দু-চারজন চেনাজানা আছে। এমন অবস্থায় পড়লে আমি কি তাদের কাউকে ফোন করার সাহস করতাম? আর যদি করতামও, তারা কেউ কি ট্রাফিক সার্জেন্টের সঙ্গে আমার ড্রাইভারের মোবাইলে কথা বলে আমাকে ছেড়ে দিতে বলতেন? চোখ বন্ধ করে বলতে পারি, "কখনও না।"

বাংলার এপার-ওপারে দলবাজির এই যে ব্যাবধান– না জানি আমাদের 'দলকানা' বুদ্ধিজীবীরা কবে তার কদর বুঝবেন!

কবিগুরু বলেছেন:

"সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী,
রেখেছ বাঙালী করে, মানুষ কর নি।"

সময়ের বিবর্তনে এপারের সাত কোটি ১৭ হলেও, বাঙালি কিন্তু বাঙালিই বয়ে গেছে। তবে ওপারের নেতারা কেউ কেউ বোধ করি 'মানুষ' হয়েছেন। নিজেদের ভালোটা ভালোই বুঝতে শিখেছেন। তাই বাংলা আর বাঙালির চেয়ে ক্ষমতা তাদের কাছে অনেক আপন, ইলিশের চেয়ে মৌলবাদের কদর তাই তো খাগরাগড়ে অনেক বেশি। তিস্তার পানি তাই এদেশে আসুক আর না-ই আসুক, এসেছে সারদার টাকা।

ইস! রবীন্দ্রপ্রেমে আসক্ত আর কোলকাতাই শাড়ির ভক্ত এপারের আমরা যদি এরকম মানুষ হতে পারতাম!

পাদটীকা: এক গ্রামে ছিল এক মস্ত পেটুক। যা-ই পেত তা-ই খেত, আর খেয়েই বলত, খাওয়াটা ঠিক জমলো না। এ কথা শুনে এলাকার জমিদার ঠিক করলেন পেটুককে খাইয়ে তিনি খুশি করবেন। যেই ভাবা সেই কাজ। পেটুককে দাওয়াত দিয়ে আনা হল জমিদার বাড়িতে, আয়োজন যথারীতি বিশাল। পেটুক খেল মহাতৃপ্তিতে। খাওয়া শেষে জমিদার জানতে চাইলেন, "এই যে পেটুক, কেমন খেলে?"

পেটুক বিনয়ী ভঙ্গিতে উত্তর দিল, "হুজুর, বেশি ভালো ভালো না।"