বিদ্বেষ ও ভ্রমণ: দুটোতেই প্রথম পছন্দ ভারত

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 13 Feb 2017, 04:39 AM
Updated : 13 Feb 2017, 04:39 AM

বহু অভিযোগের ভেতর বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পেছনে বড় একটা অভিযোগ ছিল ভারতের কাছে দেশ বেচে দেওয়ার। তাঁকে সরিয়ে অবৈধ গদি দখলকারী 'মীর জাফর' মোশতাক প্রথম ভাষণেই বলেছিলেন, ভারতের সঙ্গে অটুট সম্পর্ক রাখবে তাঁর সরকার। জিয়ার আমলে যাদু মিয়ার এক জনসভায় গিয়ে অামি যখন রীতিমতো ভারতবিরোধী হওয়ার প্রতিজ্ঞা করলাম, পরদিন খবরে দেখি তিনি ভারত ভ্রমণে বেরিয়েছেন। বিএনপি, অাওয়ামী লীগ, মুসলিম লীগ সবার বেলায় একই চিত্র।

অামজনতার যে অংশ ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট খেলায় পাকি-প্রেমে দিশাহারা; কোনো কারণে ভারত জিতলে এরা মন ভালো করতে বিদ্যা বালান বা পুরনো ছবিতে মাধুরীর নাচ দেখতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পিকনিকে যায় টাটা কোম্পানির বাসে চড়ে। মাইকে বাজে হিন্দি ধামাকা বা পাঞ্জাবি ভাংরা। এই এক চরিত্র আমাদের!

মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান আর সমর্থনকে একদল মানুষ চিরদিনের পুঁজি করে নিয়েছে। আরেক দল পাকিস্তানের প্রেমে বিভোর। সেই দ্বন্দ্ব বা সংঘাত যেন আমাদের নিয়তি। ছেলেবেলায় আমরা যখন বড় হচ্ছিলাম ভারত ছিল নিষিদ্ধ এক দেশ। সেই দেশের রেডিও শোনার জন্য ট্রানজিস্টারে তার পেঁচিয়ে এরিয়াল বানিয়ে কত কসরৎ করতে হত। আর আজ? বাংলাদেশের ঘরে ঘরে ভারতীয় চ্যানেলের ছড়াছড়ি। সে-ও এক আগ্রাসন বটে। কিন্তু সে আগ্রাসন কি আমরাই টেনে আনিনি?

স্বাভাবিকতার ভেতর থাকে মিত্রতা ও ন্যায্য বিরোধিতা। ভারতের বেলায় এর একটাও নেই। যখন কোনো খেলা হয় দেখবেন আমরা যুদ্ধংদেহি হয়ে উঠি। এ যেন ইজ্জতের এক আখেরি লড়াই। ভারতও কম যায় না। সুযোগ পেলেই তার আঁচ টের পাইয়ে দেয়। মাঝে মাঝে সীমান্তে যখন লাশ পড়ে, ফেলানীর দেহ কাঁটাতারে ঝুলে থাকে, আমরা ক্রোধে ফেটে পড়ি। কিন্তু তারপর আবার ভুলে যাই।

অন্যদিকে মিয়ানমারের বেলায় যেন এক নীরব পাথর এই সমাজ। আমি ব্যক্তিগতভাবে এটিকে হিন্দুবিরোধিতা বলতে নারাজ। তাই যদি হত তবে নেপালের সঙ্গে আমাদের বিরোধিতা হতো বেশি। সেই ছিল একমাত্র হিন্দু দেশ। তার মানুষের নাম সরস্বতী, গোপাল বা নারায়ণ। অন্যদিকে আমরা ফখরুদ্দীন কিংবা মনজিত সিংয়ের দেশকে বানিয়েছি আসল 'দুশমন'; যার কারণ রাজনীতি।

ভারতের সঙ্গে আমাদের তিনদিকে সীমান্ত। আয়তনে বড় এক দেশ। আমেরিকার সঙ্গে মেক্সিকো বা চীনের সঙ্গে ভিয়েতনামের মতো অনেক সমস্যা আর মানুষের উদ্বাস্তু হওয়ার কাহিনি আছে দুদেশের। ইতিহাসের এক অধ্যায়ে আছে মারামারি ও দাঙ্গার ভয়াবহতা। সেটাই কি মূল সমস্যা? তা-ই যদি হবে আমরা ভারতের দালালি করি কোন কারণে?

বিএনপি-জামায়াতের ওপর দোষ চাপানো সহজ; বাস্তবে সব দল সব রাজনীতিই সময় ও সুযোগ বুঝে এর এস্তেমাল করে। আমি খুব বিস্ময়ের সঙ্গে দেখি আওয়ামী লীগও আছে শীর্ষে। তাদের নেতারা বিষ খেয়ে বিষ হজমের মতো এর সঙ্গে সুসর্ম্পকের কথা বললেও তলে তলে বিদ্বেষ আর ঘৃণা লালন করে।

আমাদের সঙ্গে ওপার বাংলার সংস্কৃতি ও অতীত ঐতিহ্য মিলেমিশে একাকার। সেটা বাদ দিলে বাকিদের সঙ্গে তেমন কোনো মিল নেই। অথচ এই বাকিরাই, বিশেষত হিন্দি চেপে আছে ঘাড়ের ওপর। দেশের ছেলেমেয়েরা এখন এমন সব ভাষা বলে যা মারাঠি বা হিন্দিভাষী না হলে বোঝা মুশকিল! কই সেটা ঠেকানোর চেষ্টা তো নেই। অকারণ বিরোধিতার জায়গাটা এত বড় যে এগুলো কারো চোখে পড়ে না।

একটি বৃহৎ প্রতিবেশীর সঙ্গে যে সৎ ও স্বভাবসুলভ সম্পর্ক থাকার কথা সেটা নেই বলেই একধরনের আতংক আর দুর্বলতা ঘিরে আছে। সীমান্তের বড় সমস্যা কিছু হলেই অসহায় সংখ্যালঘুরা দেশ ছেড়ে পালায়। এই পলায়ন যাদের জন্য ভয়াবহ বা যাদের ভোটবাক্সে প্রভাব ফেলে তারাও এ নিয়ে কিছু বলে না বা করে না। রাজনীতির মেরুদণ্ডহীন নেতৃত্ব ভজনার কাজে ব্যস্ত। আর দেশের আনাচে-কানাচে ভারত মানে হিন্দু এই ধারণায় বেড়ে ওঠা মানুষের মনে চলছে ঘৃণার নিত্যনতুন কৌশল ও তার বাড়বাড়ন্ত। গরিব মানুষ বা ধনীরা এগুলোর বাইরে।

সুবিধাবাদী মধ্যবিত্ত আর সুযোগসন্ধানীরা মুখে এক, কাজে আরেক। এরা এই বিরোধ জিইয়ে জমি দখল থেকে নিজেদের ভারতে চিকিৎসা বা ভ্রমণের কাজটা ভালোই করে চলেছে। যে কারণে খবরে দেখলাম যুক্তরাষ্ট্রকে হটিয়ে বাংলাদেশ ভারত ভ্রমণে এক নম্বর দেশের জায়গা নিয়েছে। এত পর্যটক অার কোনো দেশ থেকে যায় না সেদেশে। দেশ ভ্রমণ অন্যায় কিছু না। কে কোন দেশে বেড়াতে যাবে সেটাও আমাদের ভাবনার বিষয় হতে পারে না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে মন আর কাজের তফাৎ।

ভারতের মানুষ কিন্তু তাদের দেশের ব্যাপারে কখনও কিছু বলে না। সে হিন্দুই হোক আর মুসলমান হোক। তাদের দেশবোধ তাদের মতো। বরং আমাদের এই বিরোধিতার ধরন দেখে তারা মজা পায়। একবার এক সিপিএম নেতা আমাকে বলেছিলেন, তোমাদের দেশে যত ভারত বিরোধিতা তত আমাদের লাভ। আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিলাম কীভাবে? ভদ্রলোক বলেছিলেন, "ভারতবিরোধী মিছিল-মিটিংয়ে আসা-যাওয়ার জন্য লোক বাড়বে সে লোকের যাতায়াতের জন্য টাটা কোম্পানির ট্রাক আরও বিক্রি হবে।"

তাঁর পান খাওয়া লালা ঝরা মুখের সেই ব্যঙ্গাত্মক হাসি আমি ভুলিনি। কিন্তু কথাটা কি মিথ্যে? বিএনপির রমরমা সময়ে একবার দেশে গিয়ে মনে হয়েছিল, ভারতশাসিত কোনো মুসলমান প্রধান রাজ্যে এসেছি! বাজারে সাইনবোর্ড আর প্রচলিত টাকা না থাকলে কে বুঝত আমরা কোথায়? সকালে ভারতীয় টুথপেস্টে দাঁত মাজা, তাদের সিরামিক বাসনে খাওয়া, সন্ধ্যায় তাদের টিভি দেখে বিনোদন নেওয়া, রাতে ভারতীয় চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমানো।

সেই জায়গাটা অনেকভাবে কমিয়ে এনেছে আজকের বাংলাদেশ। শেখ হাসিনার সরকারের আমলে নানাবিধ উন্নয়ন আর দেশের মানুষের পরিশ্রমে আমরা এখন অনেকটাই স্বাবলম্বী। তারপরও এই সরকারকেই ভারত তোষণের দায় নিতে হয়। সরকারের বড় ব্যর্থতা তারা বিরোধের বিষয়গুলো পরিস্কার করে না।

ভারতের সঙ্গে প্রতিবেশী নেপাল, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান বা আফাগানিস্তানের সম্পর্ক মধুর না। নেপালে গিয়ে দেখেছি তারা প্রচণ্ড ভারতবিরোধী। কিন্তু ব্যবসাবাণিজ্য বা লেনদেনে তারা তাদের চটায় না। শ্রীলঙ্কা ব্যস্ত এগিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতায়। বলা হচ্ছে, এভাবে চললে তারাই হবে এই এলাকার 'সিঙ্গাপুর'। অন্যদিকে পাকিস্তান তার নিজের কোনো ভবিষ্যৎ নেই জেনে মজে আছে শারীরিক বিরোধিতায়। আমরা কেন সে পথ ধরব?

আমাদের যে মেধা ও শ্রমের যোগ্যতা তা দিয়ে ব্যবধান রচনা করা সম্ভব জেনেও আমরা করি না। সুন্দরবন ইস্যুতে যারা ভারত বিরোধিতা উসকে দিল তাদের আচরণে বোঝা গেল না কোনটা আসলে মূখ্য? রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র ঠেকানো না বিএনপির নিস্তেজ ভারতবিরোধী আন্দোলন চাঙ্গা করে তোলা? এই আমাদের আরেক সমস্যা। অথচ আমরা পছন্দ করি বা না করি ড. ইউনূস কিন্তু এই ভুল করেন না। তিনি অনেক আগেই বলেছিলেন, "আমরা যদি দুপাটি চপ্পলও তাদের বাজারে ঢোকাতে পারি ১০০ কোটি মানুষ যদি তা কেনে তাহলে ভারসাম্যের পাল্লায় হেরফের ঘটবেই।"

খবরে দেখলাম তিনি তাঁর ব্যাংকের শাখাও খুলেছেন সেই দেশে। এটাই হল উপযুক্ত কাজ। ভারত বিরোধিতাকে তার অন্ধ আবরণ থেকে বাইরে এনে এভাবেই মোকাবিলা করতে হবে। আমাদের মিডিয়াও কম দায়ী নয়। যেসব মিডিয়া মোঘল তাদের দেখলেই বেহুঁশ হয়ে পড়ে তারাই নানাভাবে দেশের মানুষকে উসকে দিতে সচেষ্ট। প্রতিবেশীকে অস্বীকার বা মাথায় তোলা কোনোটা সম্ভব নয় জেনেও আমরা কেন জানি প্রতিকারে অনাগ্রহী।

বিরোধিতার যে কত ধরনের চেহারা আছে! একবার এক ইসরায়েলি মেয়ে আমাকে প্রশ্ন করেছিল, আমাদের দেশের পাসপোর্টে তাদের দেশে যাওয়া নিষিদ্ধ কেন? আমার জবাব শুনে তার চোখ উঠেছিল কপালে। তার একটাই জিজ্ঞাসা তা-ই যদি হবে তো মিসর, ফিলিস্তিন আর জর্দানসহ অন্যান্য আরব দেশের মানুষেরা আকছার যাতায়াত করছে কীভাবে? এর কোনো উত্তর আমার জানা ছিল না। আমার ধারণা, যারা পাসপোর্টে এই না যাওয়ার সিলটা মেরেছে তারাও এর উত্তর ভালো করে জানে না।

কোনো নীতি কোনো ধারা কোনো সভ্যতা আমাদের টানে না। আমাদের আছে হয় অন্ধ বিরোধিতা নয়তো স্তাবকতা। যে কারণে আমরা মুখে বিরোধিতার কথা বললেও আমেরিকা বা ভারতের রাজদূত দেখলেই গলে পড়ি। তারা আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর যে খবরদারি করে যেভাবে 'সাইজ' করে আর সাজেশানের নামে নাক গলায়– সেটা রাজনীতিতে বিন্দুমাত্র সম্ভ্রমবোধ থাকলেও সম্ভব হত না।

একমাত্র শেখ হাসিনাই জন কেরির মতো মানুষের কথা শোনেননি। তিনি তাঁর পিতার মতো অকুতোভয়। অথচ তাদেরই আমরা এদেশ ওদেশের কাছে দেশ বিক্রির দায়ে অভিযুক্ত করি, ভোটদানে বিরত থাকি।

চারদিকে ভারতের নামে যে এত বিদ্বেষ আর এত জুজুর ভয়, ভারতীয়রাও হয়তো জানে না। তারা আসলে যে মর্যাদা ও সম্মানের চেহারা দেখে বুঝতেও পারে না এগুলো মূলত বানানো। ভারতের নামে রাজনীতি মিথ্যাচার করে। ভারতের নামে হিন্দুরা পদদলিত হয়। ভারতের নামে নৌকায় ভোট কমে। ভারতের নামে বিএনপি জেতে আর সেই ভারতের কাছে ধর্না দেওয়ার নাম নাকি গদি পাওয়ার প্রধান কৌশল।

বিরোধিতার লোকজনই এবার ভারত ভ্রমণে আমেরিকাকে পেছনে ফেলে আমাদের দেশকে এক নম্বরে নিয়ে এসেছে। এত ভারত প্রীতি এত তোষণ আর কোনো দেশ করে না। তবু জরিপ করুন, ভারত বিদ্বেষে অামরাই এক নম্বর অার অামার মতো মানুষেরা ভারতের দালাল।

কে যে দালাল, কে হালাল বা হারাম– লীলা বোঝা দায়।