বিএনপি কি বাংলাদেশের রাজনীতিতে টিকে থাকবে?

সাঈদ ইফতেখার আহমেদসাঈদ ইফতেখার আহমেদ
Published : 11 Feb 2017, 05:21 AM
Updated : 11 Feb 2017, 05:21 AM

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রথম প্রশ্ন ওঠে ১৯৭৮ সালে দলটির প্রতিষ্ঠালগ্নেই। রাজনীতিশাস্ত্র নিয়ে যারা পড়াশোনা করেন তাদের অনেকের মনেই তখন প্রশ্ন জেগেছিল, বাংলাদেশের রাজনীতিতে সামরিক আমলাতন্ত্রের স্বার্থরক্ষার নিমিত্তে রাষ্ট্রশক্তির সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত এ দলটি অদূর ভবিষ্যতে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে টিকে থাকতে পারবে কি না।

১৯৮১ সালে দলটির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান চট্রগ্রামে একদল বিদ্রোহী সেনাসদস্যের হাতে নিহত হওয়ার পর আবারও অনেকের মনে দলটির ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন জাগে। বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে যারা চিন্তা ভাবনা করেন এরকম অনেকের কাছেই তখনও মনে হয়েছিল, জিয়াউর রহমানের অনুপস্থিতে দলটি হয়তো টিকে থাকতে পারবে না।

পরবর্তীতে এরশাদের স্বৈরশাসনের সময় জেনারেল জিয়ার স্ত্রী খালেদা জিয়া যখন দলটির হাল ধরেন তখনও অনেকে ভেবেছিলেন, মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোতে না পারা একজন বিধবা নারীর নেতৃত্বে দলটির পরিণতি অচিরেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকা আলেম ভাসানীর হাতে খণ্ডিত ন্যাপের (ভাসানী) একাংশের যে পরিণতি হয়েছিল, দলটি বোধহয় তেমন পরিণতিই ভোগ করতে যাচ্ছে। কিন্তু সেই বেগম জিয়ার নেতৃত্বেই বিএনপি অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে এবং এরশাদ সরকারের পতনের পর দুবার পূর্ণ মেয়াদে সরকার গঠন করে। ফলে এ দুই মেয়াদের সরকারের মধ্যে ১৯৯৬ সালে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি গণ-আন্দোলনের ফলে অনেকটা এরশাদ সরকারের মতো ক্ষমতা থেকে উৎখাত হলেও বিএনপির রাজনৈতিক অস্তিত্বের প্রশ্নটি আর তেমন করে সামনে আসেনি।

বিএনপির রাজনৈতিক অস্তিত্বের বিষয়টি আবার নতুন করে সামনে চলে আসে ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচন প্রতিহত করতে ব্যর্থ হওয়ার পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারার ফলে। অনেকেরই সেসময় ধারণা জন্মেছিল, ভোটারবিহীন একতরফা নির্বাচন করে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সরকার যেমন গণ-আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিল, তেমন পরিণতি হয়তো শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারও বরণ করতে যাচ্ছে।

কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের এক বছর পর কিছুদিনের জন্য জামায়াতনির্ভর পেট্রোল বোমা সন্ত্রাস ছাড়া বিএনপি আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। এমনকি নির্বাচন ঠেকাবার জন্যও বিএনপি কোনো আন্দোলন না করে জামায়াত এবং অনান্য নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের পেট্রোল বোমানির্ভর 'তালেবান স্টাইল' সন্ত্রাস, তথা স্কুল পুড়িয়ে দেওয়া এসবের ওপর নির্ভর করেছিল।

বিএনপির নেতৃত্বাধীন পেট্রোল বোমানির্ভর সন্ত্রাস আওয়ামী লীগ সরকার অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে অল্প সময়ে দুবারই নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারার এ ব্যর্থতা থেকেই বিএনপি নামক এ রাজনৈতিক দলটির সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের একটি বড় দাগে ফারাক জাতির সামনে পরিস্কার হয়ে যায়। দুদলের এ ফারাকের পাশাপাশি দ্বিতীয়বারের মতো পেট্রোল বোমানির্ভর সন্ত্রাস ব্যর্থ হওয়ার পর 'সাইন বোর্ড' সর্বস্ব ছোট দলগুলোর মতো বিএনপির কার্যক্রম চার দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ায় দলটির রাজনৈতিক পূর্বসূরি মুসলিম লীগের মতো একই পরিণতি বরণ করতে যাচ্ছে কি না– এ প্রশ্নটি আবার নতুন করে সামনে চলে আসে।

মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর 'দ্বিজাতি তত্ত্ব' বিনির্মাণ করে জেনারেল জিয়ার নেতৃত্বে তৎকালীন সামরিক আমলাতন্ত্র রাষ্ট্রক্ষমতায় তাদের অংশিদারিত্ব নিশ্চিতকরণ এবং অবৈধ ক্ষমতা দখল বৈধকরণের প্রক্রিয়া হিসেবে জাতীয়য়াবাদী দল গঠন করে। উচ্চাভিলাশী শিয়া মুসলিম পটভূমি থেকে আসা জিন্নাহ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতা হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষ নীতির জোরালো সমর্থক থাকলেও কংগ্রেস পার্টিতে মহাত্মা গান্ধীর ব্যক্তিত্ব অতিক্রম করতে পারবেন না মনে করে দীর্ঘ নয় বছর কংগ্রেস রাজনীতি করেও ১৯১৩ সালে মুসলিম লীগে যোগ দেন।

কংগ্রেসে থাকাকালীন যাঁকে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রতীক মনে করা হত, সে জিন্নাহই মুসলিম লীগে যোগদান করে বলতে থাকেন, হিন্দু ও মুসলমান দুটি পৃথক জাতি, ফলে একটি রাষ্ট্রে এ দুই জাতির সহাবস্থান সম্ভব নয়। আত্মপরিচয় নিয়ে মর্যাদা সহকারে বাঁচার জন্য তিনি মনে করলেন, মুসলমানদের পৃথক রাষ্ট্র প্রয়োজন, যে রাষ্ট্রের জাতির পিতা (কায়েদ-এ-আজম) হবেন তিনি।

ব্যক্তিজীবনে ইসলামের বদলে পাশ্চাত্যের অনুশাসন অনুসরণ করলেও জিন্নাহ তাঁর রাজনৈতিক লক্ষ্য হাসিলের জন্য বক্তৃতা-বিবৃতি থেকে শুরু করে সব জায়গায় একজন কট্টর 'ইসলামপন্থী' রাজনৈতিক নেতার মতোই ইসলামকে ব্যবহার করেন। ইসলামের এ সুচতুর রাজনৈতিক ব্যবহার উপমহাদেশে মুসলিম সমাজের মধ্যে সংখ্যালঘু শিয়া সম্প্রদায় থেকে উঠে আসা জিন্নাহকে পোশাক এবং ব্যক্তিজীবনে পাশ্চাত্যপন্থী হওয়া সত্ত্বেও বিপুল জনপ্রিয়তা দেয়। ভারতীয় উপমহাদেশের যেসব অঞ্চলে জিন্নাহ এবং মুসলিম লীগ বিপুল জনপ্রিয় ছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল তৎকালীন পূর্ববাংলা বা আজকের বাংলাদেশ।

১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে মুসলিম লীগের শোচনীয় পরাজয় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ থেকে 'দ্বিজাতি তত্ত্বে'র প্রভাব দূর করতে পারেনি। তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা মাওলানা ভাসানী এ বিষয়টি সেসময় উপলদ্ধি করতে পারেন। তিনি বুঝতে পারেন এ তত্ত্বকেই কিছুটা ভিন্ন মোড়কে জনগণের সামনে উপস্থাপন করতে পারলে মুসলিম লীগের পরাজয়ের ফলে রাজনীতিতে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে সেই শূন্যতা দ্রুত পূরণ করে আওয়ামী লীগের একটি বিকল্প রাজনৈতিক দল দাঁড় করানো সম্ভব।

ভাসানী 'দ্বিজাতি তত্ত্ব'কেই কিছুটা নতুনভাবে বিনির্মিত করে এর সঙ্গে সমাজতন্ত্রের শ্লোগান যুক্ত করে জনগণের সামনে উপস্থাপন করেন। ইসলামের এ সুচতুর রাজনৈতিক ব্যবহার জনগণের একটি বড় অংশের মধ্যে তিনি এবং তাঁর দল ন্যাপকে খুব অল্প সময়ে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জনে সাহায্য করে। মুসলিম লীগের ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারা থেকে বেরিয়ে এসে ভাসানী এবং বঙ্গবন্ধু ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক ধারার রাজনীতি করার প্রত্যয়ে যে আওয়ামী লীগ গঠন করেছিলেন তা থেকে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ভাসানী সরে এসে 'কাগমারী সম্মেলনে'র মাধ্যমে ১৯৫৮ সালে পৃথক দল ন্যাপ গঠন করেন, যা জনগণের মধ্যে ভাসানী-ন্যাপ হিসেবে পরিচিত ছিল। মুসলিম লীগের 'দ্বিজাতি তত্ত্ব'ভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারাটি মূলত এ দলটির মধ্য দিয়েই জারি থাকে।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠিত হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করার জন্য যখন জামায়াতসহ অন্যান্য ধর্মনির্ভর দল এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করা হয় তখন এ ভাসানী-ন্যাপের মাধ্যমেই বাংলাদেশে ধর্মকেন্দ্রিক রাজনীতি টিকে থাকে।

মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির আপাত বিজয়ে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি যখন একেবারেই কোণঠাসা হয়ে পড়ে তখন ভাসানী স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে বাঁচিয়ে রাখতে অত্যন্ত জোরালো ভূমিকা পালন করেন। সেসময় ভাসানী ধর্মনির্ভর রাজনীতি টিকিয়ে রাখার জন্য ভূমিকা পালন না করলে পরবর্তীতে দেশে প্রচলিত ভাষায় যাকে বলা হয় 'ধর্মীয় মৌলবাদ', সেই মৌলবাদী রাজনীতির বিকাশ ঘটত কি না– সেটা নিয়ে বিতর্ক বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সবসময় থেকে যাবে।

সামরিক পটভূমি থেকে আসলেও জিয়া তৎকালীন রাজনীতির গতিপ্রকৃতি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। নানাবিধ জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক চাপের মুখে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ গড়ার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে যখন ধর্মনিরপেক্ষ নীতির উপর ভিত্তি করে বঙ্গবন্ধু দেশকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন, সেই মুহূর্তে সেনাবাহিনীর কিছু জুনিয়র অফিসার বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবার এবং তাঁর সরকারের অনেককে হত্যা করে। এ অফিসারদের কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেও তারা ধর্মনিরপেক্ষ নীতির ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির ধারণা– যা বঙ্গবন্ধু সরকার স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন– তা মেনে নিতে পারেনি। তারা চাইছিলেন দেশ স্বাধীন হলেও দেশ পরিচালিত হোক 'দুই জাতি'ভিত্তিক মুসলিম জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে এবং সংবিধানে সমাজতন্ত্রের কোনো ধারা অন্তর্ভুক্ত না করতে।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বিপুলসংখ্যক বাঙালি অফিসারকে– যারা মুসলিম জাতীয়তাবাদ এবং পাকিস্তানের অখণ্ডতায় বিশ্বাস করার ফলে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি– বঙ্গবন্ধু সরকার কোনো রকম বাছবিচার না করে তাদের সবাইকে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। পাকিস্তান সামরিক একাডেমিতে ট্রেনিংপ্রাপ্ত এ অফিসাররা এক অদ্ভুত বিপরীতমুখী আদর্শ দ্বারা পরিচালিত হত, যা আমরা পরবর্তীতে সামরিক এবং বেসামরিক উভয় ক্ষেত্র থেকে আসা বিএনপির অনেক নেতার মধ্যে প্রত্যক্ষ করেছি। এ সামরিক অফিসাররা জিন্নাহর মতো একদিকে বিশ্বাস করতেন হিন্দু এবং মুসলমান হচ্ছে দুটো পৃথক জাতি এবং এর ফলে জাতীয়তাবাদ হিসেবে বিশ্বাস করতেন মুসলিম জাতীয়তাবাদকে।

অপরদিকে মুসলিম জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করলেও ব্যক্তিজীবনে ইসলামের কোনো অনুশাসন পালন তো করতেনই না, বরং তাদের জীবনযাত্রায় এমন কিছু বিষয় ছিল যা ইসলামী অনুশাসনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। ব্যক্তিজীবনে তাদের ইসলাম পালন মূলত কিছু ধর্মীয় পরিভাষা ব্যবহারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।

মুসলিম জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করলে সারা বিশ্বের মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত না করে শুধুমাত্র কেন পাকিস্তানের মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত করে রাষ্ট্র গঠন করতে হবে, অথবা পাশ্চাত্যের ইহুদি-খ্রিস্টান সংস্কৃতি হতে জন্ম নেওয়া জাতীয়তাবাদের ধারণাটি ইসলামি উম্মাহর ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি না সেসব প্রশ্নের কখনও মুখোমুখি হতে চাইতেন না।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনের গণতন্ত্র সম্পর্কে তারা অতি উচ্চ ধারণা পোষণ করলেও একইসঙ্গে মনে করতেন পাকিস্তান গণতন্ত্রের জন্য উপযোগী হয়ে ওঠেনি; পাকিস্তানের জন্য ভালো হল সেনাশাসন। মাও সে তুংয়ের গণচীন সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা থাকলেও সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে তাদের ধারণা ছিল নেতিবাচক। সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের চোখে ছিল নাস্তিক্যবাদী দেশ এবং ইসলামের জন্য ক্ষতিকারক। তারা হিন্দু জনগোষ্ঠী প্রধান ভারতকে শত্রু রাষ্ট্র মনে করলেও অফিসিয়াল হিন্দু রাষ্ট্র নেপালকে মনে করত বন্ধু রাষ্ট্র।

পাকিস্তানি অফিসাররা নিজেদের মনে করত এলিট এবং পাকিস্তানের সাধারণ জনগণকে অত্যন্ত হেয় চোখে দেখত। এর মধ্যে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ সম্পর্কে তাদের ধারণা ছিল তারা সবাই নিম্নবর্ণের হিন্দু থেকে রূপান্তরিত হওয়া মুসলিম এবং বাঙালিরা নিজস্ব আচার-আচরণ-রীতির কারণে পূর্ণাঙ্গ মুসলিম নয়। বাঙালি অফিসারদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ মনে-প্রাণে এবং আচরণের দিক থেকে তাদের পশ্চিম পাকিস্তানি কলিগদের মতো হতে চাইত। তাদের রাজনৈতিক বিশ্বাসই শুধু পশ্চিম পাকিস্তানি সেনা অফিসারদের মতো ছিল তা-ই না, তারাও বিশ্বাস করত বাঙালি মুসলমানরা আচরণ ও সংস্কৃতির দিক থেকে পূর্ণাঙ্গ মুসলমান নয়। কারণ এ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাপনের ওপর সনাতন (হিন্দু) ধর্মের রয়েছে প্রবল প্রভাব।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যেসব বাঙালি অফিসার মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিল যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে তাদের কারো কারো বক্তব্য এবং নানা কর্মকাণ্ডে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে উপরে উল্লিখিত চিন্তাধারা ধারণ করেই তাদের কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেছিল। ২৫ মার্চে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে গণহত্যা চালায় এবং এর পাশাপাশি তাদের নানা অন্যায়, অবিচার এসব অফিসারদের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে অনুপ্রাণিত করেছিল। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেও তারা পাকিস্তান সামরিক একাডেমিতে শিক্ষাপ্রাপ্ত 'দ্বিজাতি তত্ত্ব' এবং এর ভিত্তিতে গড়ে ওঠা মুসলিম জাতীয়তাবাদকেই স্বাধীন বাংলাদেশের রূপপকল্প হিসেবে দেখতে চেয়েছিল। ফলে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ যখন ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং সমাজতন্ত্রকে ভিত্তি করে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশকে গড়ার প্রক্রিয়া শুরু করে তখন এ প্রক্রিয়াকে স্তব্ধ করার প্রক্রিয়া হিসেবে পাকিস্তানি মানসিকতার মুসলিম জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী অফিসাররা বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে সামরিক অভুত্থান সংগঠিত করে।

১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে জিয়াউর রহমানের বিভিন্ন কার্যক্রম এবং বক্তব্যে যে বিষয়টি পরিস্কার হয়ে ওঠে তা হল জিয়া মূলত এ ধারারই প্রতিনিধিত্ব করতেন। খুব সম্ভবত 'দুই জাতি'ভিত্তিক মুসলিম জাতীয়তাবাদের রূপকল্পই তিনি স্বাধীন বাংলাদেশে দেখতে চেয়েছিলেন এবং এ উদ্দেশ্য মাথায় রেখেই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালে অভ্যু্ত্থান পাল্টা-অভ্যুত্থান প্রক্রিয়ায় জাসদের গণবাহিনীর সমর্থনে ক্ষমতা দখল জিয়ার সামনে পাকিস্তানি ধারায় আবার দেশকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া সুযোগ তৈরি করে। আর এ ধারায় দেশকে ফিরিয়ে নেওয়ার পদক্ষেপ হিসেবেই ১৯৭৮ সালে গঠন করা হয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি। আর এ দলের সমর্থক শক্তি হিসেবে পাওয়ার জন্য জামায়াত, মুসলিম লীগসহ স্বাধীনতাবিরোধী সব রাজনৈতিক দলের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন তিনি।

ন্যাপ (ভাসানী) দল বিলুপ্ত করে বিএনপিতে যোগ দেয় একজন সামরিক, স্বৈরশাসকের মাধ্যমে 'দুই জাতি'ভিত্তিক মুসলিম বাংলা গঠন সহজ হবে এ বিবেচনা থেকে। এছাড়া মুসলিম লীগ এবং বিভিন্ন 'চীনপন্থী' দলগুলো থেকে দলে দলে নেতাকর্মীরা সামরিক, বেসামরিক আমলা দ্বারা গঠিত এ দলটিতে যোগদান করে। ক্ষমতাসীন দলের সদস্য হওয়ার সুবিধাবাদিতা থেকে অনেকে সদ্যগঠিত হওয়া এ দলটিতে যোগ দিলেও এসব দলের নেতাকর্মীদের একটা সাধারণ প্লাটফরম ছিল, সেটা হল আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরোধিতা এবং জাতীয় ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ও হিন্দু বিরোধিতা। বস্তুত রাজনৈতিক চিন্তার এ সাযুজ্যই এসব দলের নেতাকর্মীদের জিয়ার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ করেছিল।

জিয়ার স্বৈরশাসনের সময় জিয়া ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্মূল বা রাষ্ট্রব্যবস্থায় চরম কোণঠাসা করে বিএনপি এবং অনান্য ইসলামভিত্তিক দলগুলোর জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে চেয়েছিলেন। এর ফলে আওয়ামী লীগ, সিপিবি, জাসদের নেতাকর্মীরা অবর্ণনীয় দমন-পীড়নের শিকার হয়। এসব দলের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে কারারুদ্ধ করা হয়। এ সময় অনেকেই মনে করেছিল, প্রথম সারির নেতৃত্ব হারানো আওয়ামী লীগের পক্ষে বোধহয় জিয়া সরকারের নিপীড়ন-নির্যাতন সহ্য করে টিকে থাকা সম্ভব হবে না। কিন্তু সেসময় সারা দেশের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এ নিপীড়নের বিরুদ্ধে যে বীরোচিত প্রতিরোধ গড়ে তোলে তা দলটির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত নেতৃত্ব ছাড়াও দলটি যে জুলুম-নিপীড়ন সহ্য করে শুধু টিকে থাকা নয় প্রতিরোধ গড়ে তুলতেও সক্ষম তা ১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার আগমন পূর্ব দলটির পৌনে ছয় বছরের ইতিহাস প্রমাণ করেছে। ওই সময়ে দলটি কোনো অবস্থাতেই আজকের বিএনপির মতো নিজেদের 'ঘরোয়া রাজনীতি'তে আবদ্ধ রাখেনি।

মুসলিম জাতীয়তাবাদভিত্তিক জিয়া উদ্ভাবিত বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের রাজনীতিকে– যা কিনা বাংলাদেশের বাস্তবতায় 'দ্বিজাতি তত্ত্বে'রই বিনির্মিত রূপ– এগিয়ে নেওয়ার জন্য তিনি শুধু ধর্মনিরপেক্ষ ধারার রাজনৈতিক দলগুলোকেই নয়, বরং এ চিন্তাধারায় বিশ্বাসী সেনাসদস্যদেরও প্রতিপক্ষ মনে করেছেন, যার ফল হল জিয়া কর্তৃক কয়েক হাজার সেনাসদস্য হত্যা। এ হত্যাকাণ্ড বা অন্য কোনো কারণেই হোক জিয়াউর রহমানকেও ট্র্যাজিকভাবে একদল বিদ্রোহী সেনাসদস্যের হাতে প্রাণ দিতে হয়।

বিএনপির ইতিহাসে সবচেয়ে নিন্দিত অধ্যায় হিসেবে যে বিষয়টি চিহ্নিত হয়ে থাকবে তা হল জিয়াপত্নী খালেদা জিয়া দুবার পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকলেও তিনি বা তাঁর দলের জিয়াহত্যার তদন্ত বা বিচারের কোনো উদ্যোগ না নেওয়া। বিএনপি যা করেছে তা হল রাষ্ট্রপতি সাত্তারের সময় সেনাবিদ্রোহের অভিযোগে কিছু সেনাসদস্যের সামরিক আদালতে গোপন বিচার, জিয়াহত্যার বিচার নয়।

জিয়া হত্যার পর একই রাজনৈতিক চিন্তাধারায় বিশ্বাসী জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা দখলের পর কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত ব্যাপকসংখ্যক বিএনপির নেতাকর্মীর জাতীয় পার্টিতে যোগদানে দলটির অস্তিত্ব নিয়ে আবার প্রশ্ন উঠেছিল। জিয়াপত্নী খালেদা জিয়া ব্যক্তিগত ক্যারিশমা এবং জিয়ার ইমেজ ব্যবহার করে দলকে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হলেও আন্দোলনে ভূমিকা রাখার প্রশ্নে দলটির দুর্বলতা ধরা পড়ে। ১৯৮৬ সালে ব্যাপক এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় হটাৎ করে আওয়ামী লীগ, সিপিবিসহ কিছু রাজনৈতিক দল যখন তাদের ভাষায় 'আন্দোলনের কৌশল' হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়, তখন বিএনপির পক্ষে তার সমমনা দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে এরশাদবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। এরশাদবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে উঠে যৌক্তিক পরিণতি লাভ করে যখন আওয়ামী লীগ সংসদ থেকে বের হয়ে এসে আন্দোলনের মাঠে ফিরে আসে।

খালেদা জিয়া এবং বিএনপি চমৎকারভাবে তৎকালীন রাজনীতিকে ম্যানিপুলেট করতে সক্ষম হয়, যা ১৯৯১ সালে জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির বিজয় নিশ্চিত করে। বিএনপি জনগণের একটি বড় অংশকে বোঝাতে সক্ষম হয়, শেখ হাসিনা হলেন 'জাতীয় বেঈমান' অপরদিকে খালেদা জিয়া হলেন 'আপসহীন নেত্রী' এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে দেশে দুর্ভিক্ষ হবে ১৯৭৪ সালের মতো, ভারতের প্রভাব বাড়বে এবং ইসলাম ধর্মের ক্ষতি হবে।

পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে শুধুমাত্র এসব নেতিবাচক প্রচারণাকে ভিত্তি করে রাজনীতি করা দলটি তার প্রচারণার হাতিয়ার হারিয়ে ফেলে, যা দলের রাজনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার জায়গাটিতে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত করে। তবে বিএনপির ইতিহাসে সবচেয়ে ট্র্যাজিক অধ্যায়টি হয়তো লেখা থাকবে আওয়ামী লীগ সংগঠিত গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার বিষয়টি। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আওয়ামী লীগই একমাত্র দল থাকল যাদের আন্দোলন বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড কোনোভাবেই ক্ষমতাচ্যুত করা যায়নি এবং অবিভক্ত পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ইতিহাসে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো আন্দোলনও সফল করা সম্ভব হয়নি।

আওয়ামী লীগ কর্তৃক ক্ষ্মতাচ্যুত হওয়ার পর বিএনপির জামায়াতসহ ইসলামপন্থী দলগুলোর ওপরে মানসিক নির্ভরতা বৃদ্ধি পায়। বিএনপি মনে করতে থাকে ইসলামপন্থী দলগুলোর উপর নির্ভর করে ইসলামকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে না পারলে হয়তো রাজনীতিতে টিকে থাকা যাবে না। বর্তমান ৯/১১-উত্তর পরিবর্তীত বিশ্বপরিস্থিতিতে ইসলামপন্থী দলগুলোর উপর এ নির্ভরতা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহল থেকে বিএনপিকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। পাশাপাশি শেখ হাসিনার ত্বরিত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতার বিপরীতে খালেদা জিয়ার সিদ্ধান্থীনতা, ধীরে সিদ্ধান্ত নেওয়া বা সিদ্ধান্ত নিতে না পারা এবং এর পাশাপাশি অন্দোলন প্রশ্নে দলীয় নেতাকর্মীদের চরম সুবিধাবাদিতা, 'গা বাঁচিয়ে' চলা নীতি এবং ২০১৫ সালে পেট্রোল বোমানির্ভর সন্ত্রাস করে সরকারকে উৎখাত করতে না পারা– এসব কিছুই দেশের রাজনীতিতে বিএনপিকে চরম কোণঠাসা অবস্থানে নিয়ে গেছে।

এ অবস্থা থেকে বিএনপি নিজেদের উত্তরণ ঘটাতে পারবে কি না, বিএনপির অবস্থা তার পূর্বসূরি ন্যাপ (ভাসানী) বা মুসলিম লীগের মতো হবে কি না, এর সবকিছু এখন নির্ভর করছে ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রশ্নে দলটির সঠিক অবস্থান নিতে পারার ওপর। এ সঠিক অবস্থান কি বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ, না আগের মতো নির্বাচন বর্জন– সেটা সঠিকভাবে নিতে পারার উপরই আগামীদিনগুলোতে দলটির ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে।