নতুন নির্বাচন কমিশন : প্রত্যাশার কিছু কথা

সৌরিন দত্ত
Published : 7 Feb 2017, 07:00 PM
Updated : 7 Feb 2017, 07:00 PM

নাসিরুদ্দিন হোজ্জা একবার মেয়েকে পাঠাবেন কুয়া থেকে পানি আনতে। মাটির কলসি নিয়ে মেয়ে পানি আনার জন্য রওয়ানা হতেই হোজ্জা মেয়েকে ডেকে বললেন– "শোন, কলসি যেন না ভাঙে"– বলেই মেয়ের গালে লাগালেন সপাটে চড়। পাশে দাঁড়ানো হোজ্জার প্রতিবেশি অবাক হয়ে বললেন: "হোজ্জা, বিনাদোষে আপনি মেয়েকে চড় মারলেন কেন?"

একটুও অপ্রস্তুত না হয়ে হোজ্জার উত্তর: "আরে, কলসি যদি ভেঙেই ফেলে তখন আর চড় মেরে কী হবে?"

মধ্যযুগের তুর্কীবাসী হোজ্জার গল্পটির প্রাসঙ্গিকতা আজকের বাংলাদেশে একটুও কম নয়। অবশেষে আমরা পেলাম আমাদের নতুন নির্বাচন কমিশন। কিন্ত কিছু কিছু সামাজিক মাধ্যমে ইতোমধ্যেই চোখে পড়েছে নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনারের প্রতি কিছু মন্তব্য। জনতার মঞ্চের সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা এবং তৎপরবর্তী সরকারের আমলে তাঁর ওসডি থেকে অবসরগ্রহণের খবরগুলো ঘুরেফিরে আসছে বিভিন্ন মাধ্যমে। বিষয়টির সত্য-মিথ্যা জানি না। কিন্তু সেটি যদি সত্য হয়েও থাকে তবে বলব, আমরা হয়তো যোগ্য লোককেই বেছে নিয়েছি। কবিগুরু বলে গেছেন, 'প্রয়োজনে যে মরিতে জানে বাঁচিবার অধিকার শুধু তাহারই'। নিজের বিচার-বুদ্ধিতে একটি ভালো চাকরির মায়া ত্যাগ করে যে লোক অনিশ্চিত আন্দোলনে জড়াতে পারেন, প্রয়োজনের মুহূর্তে তিনি যে আবার সেই কাজ করতে পিছু হঠবেন না তা সহজেই অনুমেয়। সেই সঙ্গে বলব, আমাদের নতুন কমিশনের সব সদস্য আমাদের কাছে অভিবাদন পাওয়ার দাবি রাখেন।

পত্রিকা মারফত জানতে পারলাম, নতুন কমিশনের দুজন সদস্য প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের প্রদত্ত তালিকায় ছিলেন। রাজনৈতিক দলের তালিকায় থাকলেই যে কেউ দলীয় লোক হবেন সরাসরি এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছুনো বালখিল্যতার পরিচায়ক। বরং বিষয়টি এভাবেই দেখতে চাই যে, রাজনৈতিক দলের তালিকার নামগুলো সার্চ কমিটির অনুসন্ধানের পরিধি বাড়িয়ে দিয়ে পরোক্ষে উনাদের সহযোগিতাই করেছেন। তালিকায় অন্য দুটি নাম নিয়ে যেহেতু ষোল ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও এখনও কোনো বিতর্ক সৃষ্টি হয়নি (তা বলে ভাবছি না যে হবে না)– কাজেই ধরে নিতে পারি যে, জীবনের অতিক্রান্ত পথে তাঁরা মোটামুটি নিরপেক্ষতার স্বাক্ষর রেখে এসেছেন।

আর যদি তা না-ও করে থাকেন, কুছ পরোয়া নেই। Every saint has a past and every devil has a future বলে ইংরেজিতে একটি কথা আছে। মানুষকে অতীতের মাপকাঠিতে বিচার করে তাঁর ভবিষ্যতের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ করা মোটেই সমীচীন নয়।

দলীয় তালিকা থেকে আসা দুজনকে নি্যে একটু বলি। আচ্ছা, উনারা কি জানতেন কোন দল তাদের নাম প্রস্তাব করেছে? উত্তর হ্যাঁ বা না দুটোই হতে পারে। কিন্তু যা-ই হোক না কেন বাস্তবতা এই যে, এখন তাঁরা জানেন। আর জানেন বলেই এবং সার্চ কমিটির যোগ্যতার মানদণ্ডে তাঁরা উত্তীর্ণ হয়েছেন বলেই এখন তাদের কাঁধে আরও বড় দায়িত্ব। উনাদের নিজেদের প্রমাণ করতে হবে উনারা দলীয় লোক নন। উনাদের দায়িত্ব নাম প্রস্তাবকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সেইসব দলের স্বার্থ দেখা নয়– ষোল কোটি মানুষের স্বপ্নের সার্থক রূপায়ন। উনারা অবশ্য ইতোমধ্যেই সংবিধানের আলোকে নিজেদের নিরপেক্ষতার প্রমাণ দেওয়ার দৃড় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। আমাদের শুভাকামনা রইল তাদের প্রতি।

আমরা এই প্রথম নারী নির্বাচন কমিশনার পেলাম। প্রতিবেশি ভারত এবং পাকিস্তান ইতোমধ্যেই নারী প্রধান নির্বাচন কমিশনার পেয়ে গেছে। আশায় রইলাম সেই সুদিনের। নির্বাচনী ব্যবস্থায় নারীর আসন এবং সংরক্ষণের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নে আমাদের যে অগ্রযাত্রা তার পথ আরও প্রশস্ত হবে একজন নারী কমিশনের সদস্য হিসেবে নিয়োগ পাওয়ায়, এটা আমার দৃঢ়বিশ্বাস।

প্রাক্তন কমিশন সদস্য অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাখাওয়াত হোসেন উনার কর্ম, বাক্য এবং সমকালীন রাজনৈতিক সংকটের মূহূর্তে মন্তব্য দিয়ে সেনা কর্মকর্তার নির্বাচনী দায়িত্ব পালনকে এক অন্য উ্চ্চতায় নিয়ে গেছেন। উনার নিরপেক্ষতা এবং দক্ষতা নিয়ে তেমন বিতর্ক ছিল না। পরিসংখ্যানের ভাষায়, if sample is a true representative of population– তবে বলব, নতুন কমিশনের সদস্য অবসরপ্রাপ্ত সেনাকর্মকর্তাও সেই পথে হাঁটবেন। আরেক সদস্য, তিনিও প্রজাতন্ত্রের সাবেক কর্মকর্তা, সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে কাজ করে তার রন্ধ্রে রন্ধ্রের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। জাতি যে বিশাল দায়িত্ব তাঁর কাঁধে দিয়েছে তিনি সেটির যোগ্য বলেই আমার বিশ্বাস।

অনেক আগে এক নেত্রী বলেছিলেন, পাগল ও শিশু ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নয়। কিন্তু নাম ঘোষণার সোল ঘণ্টা পরেও যেহেতু সদস্যদের আরএস-বিএস ঘেঁটে এখনও আমদের মতো কাদা-ঘাঁটা জাতি তেমন কিছু বের করতে পারিনি। তাই মহামান্য রাষ্ট্রপতি অবশ্যই তাঁর অর্পিত দায়িত্ব পালনে সফল বলতেই হবে। নতুন কমিশনের কাছে প্রত্যাশা 'ক্যাসাব্লাঙ্কা'র মতো। আপনারাও বলবেন, "my father, must I stay"– সাংবিধানিক আর কোনো পদ নিয়ে এতটা উন্মুখ হয়ে থাকে না জাতি। আপনারা হারলে হেরে যাবে আগামী প্রজন্ম।

এক গ্রামে ছিল এক বুড়ি। তার কাজই ছিল বাড়ি বাড়ি ঘুরে গৃহস্থ বউদের নিন্দা করা। কারও বউ লেখাপড়া জানে না, কারও বউ জাতে-কুলে ভালো নয়। কারও ব্উয়ের চুল ছোট তো কারও ব্উ হাঁটলে মাটি কাঁপে। কারও বউ রান্না জানে না তো কারও বউ সেলাই জানে না। সেই গ্রামে এল এক নতুন বউ। লেখাপড়াও জানে, ভালো রাঁধে, জাতে-কুলে ভালো, লেখাপড়াও জানে। বুড়ি আর কোনো মতেই তার দোষ খুঁজে পায় না। এইবার বুড়ির হার। কিন্তু বুড়িও সহজে হারার মানুষ নয়। শেষে বুড়ি বলল, "বেশি ভালো হওয়া ভালো না।"

আসুন, সেই বুড়ির গল্প বাদ দিয়ে নতুন কমিশনের সদস্যদের শুভকামনা জানাই।