গ্রামীণ অর্থনীতি ও নারী

মুহম্মদ মাহবুব আলী
Published : 22 Oct 2011, 08:41 AM
Updated : 19 Feb 2017, 04:17 AM

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাংলাদেশ এনজিও ফাউন্ডেশন (বিএনএফ) উজ্জ্বল ভূমিকা রেখে চলেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ মধ্যম আয়ের রাষ্ট্রে পরিণত হতে যাচ্ছে। এই অবিস্মরণীয় যাত্রাপথে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত কাজ করে চলেছেন। দেশের গরিব-দুঃখী মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে বিএনএফের যে দীর্ঘ ও বলিষ্ঠ ভূমিকা রয়েছে তা তার কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে প্রতিভাত হয়ে ওঠে। গ্রামীণ অর্থনীতির বুনিয়াদ প্রতিষ্ঠা, নারীর ভাগ্য উন্নয়ন, দরিদ্র ও অতিদরিদ্রদের মধ্যে সেবা কার্যক্রম বিতরণে বিএনএফ তাদের পার্টনার এনজিওদের মাধ্যমে নিরলস কাজ করে চলেছে।

বিএনএফ তাদের কর্ম উদ্দীপনায় প্রমাণ করেছে সরকারি প্রতিষ্ঠান হয়েও সেবব্রতী প্রতিষ্ঠান হিসেবে মানুষের পাশে দাঁড়ালে আস্থা ও ভালবাসায়, কর্মচাঞ্চল্যে সহজেই দেশ, সমাজ ও জাতির উন্নয়নে ভূমিকা রাখা সম্ভব। ২০০৫-০৬ সালে যেখানে সহযোগী এনজিওর সংখ্যা ছিল ১১৭টি, ২০১৫-১৬ সালে এটি দাঁড়িয়েছে ১১২০টিতে।

বিএনএফ অর্থ মন্ত্রণালয়ের জন্য গর্বস্বরূপ। তারা প্রমাণ করেছে, অর্থনৈতিক শাস্ত্রে যারা পিছিয়ে পড়া মানুষ তাদের সুযোগ দিলে কখনও সে অর্থ ফেরত যায় না, বরং অর্থনৈতিক উন্নয়নে গতিময়তা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। গ্রামীণ ব্যাংক এখন মান্ধাতার আমলের ধ্যান-ধারণায় কবলে মুনাফামুখী র্কমকাণ্ড করছে। গ্রামীণ ব্যাংকে দক্ষ ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও চেয়ারম্যান নিয়োগ করা দরকার।

কয়েকদিন আগে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন যে, ক্ষুদ্রঋণ নয়, ক্ষুদ্র সঞ্চয় মানুষের ভাগ্য ফেরাতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর একজন অনুসারী হিসেবে বলব এর চেয়ে চমৎকার কথা হতে পারে না। বস্তুত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পরই সঞ্চয় বিনিয়োগের জন্য গ্রামীণ এলাকায় ব্যাংক নিয়ে গিয়েছিলেন। বিআরডিবির মাধ্যমেও কাজ শুরু করেছিলেন। আজ তাঁর সুযোগ্য কন্যার নেতৃত্বে সেখানে বৈশ্বিক ও দেশীয় প্রেক্ষাপটে সময়ের বিবর্তনে একজন অগ্রগামী দেশ পরিচালক হিসেবে আরও এগিয়ে নিচ্ছেন।

উল্লেখ্য যে, এ লেখকের নেতৃত্বে একটি গবেষক দল সামাজিক যোগাযোগের অর্থাৎ 'সামাজিক নেটওয়ার্কিং' নামে একটি তত্ত্ব পরীক্ষা করে দেখেছে। প্রাথমিক পরীক্ষায় প্রমাণতি হয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রীর কথাই যথার্থ। ক্ষুদ্রঋণ নয়, বরং ক্ষুদ্র সঞ্চয় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে জনকল্যাণ করে থাকে। গবেষণার মাধ্যমে এটা সুস্পষ্ট হয়েছে যে, হাজার বছরের বাঙালি ঐতিহ্য, সামাজিক সর্ম্পক ও বন্ধন নানামুখী প্রতিকূলতার মধ্যেও মানুষের দারিদ্র্যসীমা অতিক্রমে সহায়তা করে থাকে।

বিশেষ কর্মসূচির আওতায় বিএনএফ ২০০৭ সালে সিডর আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত বাগেরহাট জেলার মোড়েলগঞ্জ উপজেলার দোনাগ্রামে ৭৩টি পাঁকা ঘর নির্মাণ ও তিনটি মসজিদ মেরামতের জন্য ৯৭,৮৭,৮০৪/- টাকা দেয়। এতে ৩৬৫ জনের উপকার হয়। একই বছর সিডরে ক্ষতিগ্রস্ত পটুয়াখালী, বরগুনা ও পিরোজপুর জেলায় ১২৭টি গাভী ও ৯৫টি নৌকা ও জাল বিতরণের জন্য ৩৩,৯৮,৫০০/- টাকা ব্যয় করে। ১৫টি গ্রামীণ তথ্যকেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে ৭৫,০০০ জনের উপকার করা হয়েছে।

লালমনিরহাট জেলায় স্ট্রবেরি চাষের জন্য ৭,৪৫,০০০/- টাকা ব্যয়ে ৫০০ জনের উপকার করা হয়েছে। এদিকে টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতি উপজেলায় অত্যন্ত অবহেলিত চর এলাকায় খাসকলাই ও আফজালপুর গ্রামে ৫০টি নলকূপ ও ১০০টি ল্যাট্রিন স্থাপনের জন্য ১০,০০,০০০/- টাকা ব্যয়ে ৭৫০ জনের উপকার করা হয়েছে। ২০১৫ সালে গাইবান্ধা, বগুড়া, টাঙ্গাইল ও খুলনা জেলায় ১,২০,০০০/- টাকা ব্যয়ে ৬০০ জনের উপকার করা হয়। দরিদ্র ও ছিন্নমূল এবং বানভাসীদের উপকার করে আর্থ-সামাজিক অবস্থান সুসংহত করা হয়।

বিএনএফ ঋণ দেয় না বরং এককালীন অনুদান দেয় যেটি গরিবের জন্য অধিক উপযোগী। বিএনএফ ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে দারিদ্র্য বিমোচন এবং স্বাবলম্বী মানুষ গড়ে তোলার নিরন্তর প্রয়াস গ্রহণ করেছে। সেক্ষেত্রে তারা নিম্নোক্ত কর্মসূচিসমূহ গ্রহণ করেছে: ওয়াটসান, স্বাস্থ্যসেবা, নারীর ক্ষমতায়ন, প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ও পুনর্বাসন, ছাগল পালন, হাঁস-মুরগি পালন, গরু মোটাতাজাকরণ এবং সবজি চাষ, প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা, সেলাই ও হস্তশিল্প ও দর্জি প্রশিক্ষণ, সমন্বিত কৃষি উন্নয়ন, বয়স্ক শিক্ষা, সামাজিক বনায়ন, বৃক্ষরোপণ ও পরিবেশ উন্নয়ন, মানবাধিকার বিষয়ক প্রশিক্ষণ, উপজাতি, আদিবাসী ও নিম্নবর্ণের হিন্দু পরিবারের উন্নয়ন, খাদ্য ও পুষ্টি, মৎস্য পালন, এইচআইভি/এইডস, কিশোর-কিশোরী উন্নয়ন, বাল্যবিবাহ, যৌতুক ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধ, মাদকবিরোধী গণসচেতনতা সৃষ্টি, কম্পিউটার প্রশিক্ষণ, এনজিওদের দক্ষতা উন্নয়ন এবং অন্যান্য।

আসলে বিএনএফ তাদের বহুমাত্রিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নারী-পুরুষের ভাগ্য উন্নয়নে নিরলস প্রয়াস অব্যাহত রাখছে যা আমাদের মোট জাতীয় আয়প্রবাহ এবং জীবনমান উন্নয়নে একটি কার্যকরী ভূমিকা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এখন বিএনএফ এসডিজির (টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা) ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে ৯টির কর্মসূচি বাস্তবায়নে সচেষ্ট রয়েছে।

বিএনএফ তাদের সৃষ্টির অব্যবহিতকাল থেকে এখন পর্যন্ত ১০২.৯৯ কোটি টাকা বিতরণ করেছে। এর ফলে ৬২.২৮% নারী এবং ৩৭.৭২% পুরুষ উপকৃত হয়েছে। মোট উপকারভোগী পরিবারের সংখ্যা হচ্ছে ১৮,০৩,৬০০টি। ৬৪ জেলায় তাদের পার্টনার এনজিওদের মাধ্যমে দক্ষতা ও কার্যকারিতার সংমিশ্রণে বিএনএফ তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ১,১২০টি (মার্চ ২০১৬ পর্যন্ত) এনজিওর মাধ্যমে তারা মানবকল্যাণে ব্রত রয়েছে। এ মানবকল্যাণে আমাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গৌরবদীপ্ত ভূমিকা পালন করে চলেছে। এ প্রতিষ্ঠানটি সম্পূর্ণভাবে দুর্নীতিমুক্ত যা প্রমাণ করে যে দেশের জন্য, সমাজের জন্য ভালো কিছু করার আকাঙ্ক্ষা তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু করে শীর্ষপর্যায় এবং প্রতিষ্ঠানের কর্মীবাহিনীর আন্তরিকতার মাধ্যমে সমুজ্জ্বল।

বিএনএফ অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে সুনামের সঙ্গে বর্তমান সরকারের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তাদের এ কার্যক্রমে গতিময়তা আনতে সরকারের পাশাপাশি প্রবাসীরা যাতে তাদের ফান্ডে অর্থ প্রেরণ করতে পারে সেজন্য 'প্রবাসী অনুদানে দুস্থ নির্মূল' নামে একটি ফান্ড গঠন করা যেতে পারে। বিভিন্ন দূতাবাসের মাধ্যমে প্রবাসীদের বিষয়টি জানিয়ে ওই ফান্ডে তহবিল গঠনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

প্রবাসীদের সঙ্গে আলাপ করে দেখেছি, তারা দেশের সাধারণ মানুষ বিশেষকরে তৃণমূল পর্যায়ের দুস্থ মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে অর্থ প্রেরণ করতে চায়। এ অর্থ যাতে সুবিধাবঞ্চিত প্রকৃত উপকারভোগীদের কাজে লাগে সেজন্য তারা সবসময় সচেষ্ট থাকলেও এক শ্রেণির টাউট-বাটপার ভুল পথে পরিচালিত করে ভিন্ন খাতে অর্থ নিতে সচেষ্ট থাকে। তাই সরকারি পর্যায়ে এত ভালো কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ পেলে প্রবাসীরা দেশের নিরন্ন মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে অবশ্যই সাহায্য করতে দ্বিধা করবে না। এ ব্যাপারে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করছি।

বস্তুত যুগোপযোগী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেই বর্তমান সরকারের 'ভিশন ২০২১' বাস্তবায়িত হচ্ছে। এটি দেশ ও জাতির জন্য গর্বের বিষয়। বিএনএফের কার্যক্রম যেন জনকল্যাণে অব্যাহত থাকে সেজন্য আরও অধিক বরাদ্দ ও স্বাবলম্বী হওয়া এবং অন্যান্য খাত থেকে অর্থ সংগ্রহের প্রয়াসের উপর গুরুত্ব দিতে চাই যাতে শোষণমুক্ত বাংলাদেশকে সব মানুষের বাসযোগ্য করা যায়। সুবিধাবঞ্চিত মানুষেরা পায় আত্মনির্ভরতার সুযোগ।

বিএনএফ হতে পারে সরকারের কর্তৃত্বে পরিচালিত একটি সার্থক উন্নয়ন মডেল। এ মডেলের প্রাণভোমরা হচ্ছে অনুদান, যা প্রমাণ করছে অনুদানের প্রতিটি পয়সা উন্নয়ন খাতে ব্যয়িত হয়ে মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন ও দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে মুক্ত হওয়ার দিকনির্দেশ করে।

এক কোটি গ্রামীণ, অবহেলিত, দরিদ্র ও হতদরিদ্র মানুষ এ প্রতিষ্ঠানটির যে উপকার পাচ্ছে তা অব্যাহত রাখতে বেসরকারি নিঃশর্ত সহায়তা ও অনুদানের যেমন বিকল্প নেই, তেমনি বর্তমান সরকারের 'ভিশন ২০২১' রূপায়নে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের একটি জ্বলন্ত উদাহরণস্বরূপ যা মানুষকে দিয়েছে ক্ষুধা থেকে মুক্তি, পরনির্ভরশীলতা থেকে মুক্তি এবং অজ্ঞানতা থেকে মুক্তি। সরকার র্বতমানে উদ্যোক্তা শ্রেণি তৈরিতে তৎপর।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন 'ঢাকা স্কুল অব ইকনোমিক্স' উদ্যোক্তা শ্রেণি তৈরির জন্য শিক্ষামূলক কাজ শুরু করছে যা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে অর্থনৈতিক বিকাশ বারবার হােঁচট খেয়েছে। তদুপরি অর্থনীতিকে গতিশীল করছে বেসরকারি খাত। তরতর করে বেড়ে চলছে আমাদের অর্থনীতি। একইসঙ্গে সামাজিক সূচকগুলােকেও এগিয়ে নিয়েছে গতিশীল অর্থনীতি। যদি রাজনৈতিক ঝুঁকি না থাকত, তবে বাংলদেশের প্রবৃদ্ধি এত দিনে 'ডাবল ডিজিটে' গড়াত।