প্রাইভেট, পাবলিক ও সোশ্যাল মিডিয়া

পলাশ দত্ত
Published : 12 Jan 2012, 04:15 PM
Updated : 12 Jan 2012, 04:15 PM

সোশ্যাল মিডিয়ার কনটেন্ট পাবলিক, না প্রাইভেট? এ প্রশ্নের মীমাংসা পশ্চিমের অনেক দেশে হয়ে গেছে। আমাদের মতো দেশে, যারা এই মিডিয়ায় পৌঁছেছি দেরিতে তাদের জন্য এটি এখনো প্রশ্ন বটে।

শুরু থেকে আজকের মতো সর্বত্রগামী অবস্থায় পৌঁছুতে সোশ্যাল মিডিয়ার সময় লেগেছে কমবেশি পাঁচ বছর। এরই মধ্যে এই মিডিয়ার চরিত্র বুঝে নানা দেশের নানা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নিজেদের জন্য নীতিমালা তৈরি করে নিয়েছে। কেন? তারা অভিজ্ঞতা থেকে বুঝে নিয়েছে যে সোশ্যাল মিডিয়া শেষ পর্যন্ত একটি পাবলিক মিডিয়া। এ কারণে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় তাদের কর্মী-শিক্ষার্থীদের জন্য নীতিমালা তৈরি করেছে। এখানে বলে রাখা ভালো, মিডিয়াটির পাবলিক চরিত্রের কারণে এতে মানুষের অ্যাক্টিভিটি নিয়ন্ত্রণে চীনা ধরনের নীতি/আইনের কথা বলা হচ্ছে না। যদিও চীনের সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতি কঠোর মনোভাব আসলে এই মিডিয়ার পাবলিক চরিত্রের অকাট্য প্রমাণ। এ মিডিয়া পাবলিক বলেই এখানে আমার-আপনার বলা কথা, শেয়ার করা তথ্য শুধু আমার-আপনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। এগুলো আমার-আপনার 'বন্ধুদের' মাধ্যমে একটি বড় পরিসরে ছড়িয়ে পড়ে। যে পরিসরকে কোনোভাবে আমি আমার ব্যক্তিগত পরিসর হিসেবে দাবি করতে পারি না।

অন্য কারো প্রবেশের কোনো সুযোগ বা অধিকার নেই- এমন একটি পরিসরে আমি আমার বন্ধু-পরিচিত-আমন্ত্রিতদের সঙ্গে যখন কথা বলি তখন সেটাকে আমার ব্যক্তিগত পরিসর বলা যেতে পারে। উল্টোদিকে এমন এক পরিসরেও আমি কথা বলতে পারি যেখানে আপনি আমার অপরিচিত হওয়া সত্ত্বেও- কিংবা আপনি আমার পরিচিত অথচ এই কথাবার্তার সময় আপনাকে আমি ডাকিনি- আমার কথাগুলো শুনে ফেলতে পারেন। সেই শোনা কথাগুলো আপনি আবার আপনার কোনো বন্ধুকেও বলতে পারেন; যদিও আমি আপনার সেই বন্ধুকেও চিনি না কোনোভাবেই। এইভাবে আমার বলা কথাটি থেকে আমি যার সম্পর্কে বা যে বিষয়ে বলেছিলাম তা নিয়ে একটা ধারণা গড়ে উঠতে পারে একদল মানুষের মনে। সেই ধারণার কারণে ওই মানুষটি সম্পর্কে এক ধরনের নেতি\ইতিবাচক ধারণা সমাজের একটি অংশে ছড়াতে পারে। তাহলে সেই পরিসর আর আমার ব্যক্তিগত পরিসরে না থেকে চলে গেল পাবলিক পরিসরে। জ্ঞাতসারে এই পাবলিক পরিসরে আমার বলা কথার কারণে কারো ক্ষতি হলে সে দায় কি আমি এড়াতে পারবো? সোশ্যাল মিডিয়ায় কথা বলা মানে পাবলিক পরিসরেই বলা। এ কারণেই সাম্প্রতিক আরব বিপ্লবের মতো ঘটনা ঘটে। ঘটে অকুপাই ওয়াল স্ট্রিটের মতো ঘটনা। এটি পাবলিক পরিসর বলেই সোশ্যাল মিডিয়া সাইটগুলোও তাদের ব্যবহারের শর্তাবলীতে মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে কী কী সচেতনতা মেনে চলা উচিত তার তালিকা দিয়ে রাখে। যদিও 'স্বাভাবিকভাবেই' আমরা সেগুলোর দিকে লক্ষ্য রাখি না।

বিশ্বের সবেচেয়ে বড় সোশ্যাল মিডিয়া ফেইসবুকও এ বিষয়ে স্পষ্ট কিছু নির্দেশনা দিয়ে রেখেছে তার ওয়বসাইটেই। ফেইসবুক বলছে তার সাইট ব্যবহার করে আপনি- (১) কাউকে গালি দেবেন না, ভয় দেখাবেন না, কিংবা হয়রানি করবেন না; (২) এমন কিছু পোস্ট করবেন না যা বিদ্বেষ, হুমকি সৃষ্টি করে কিংবা পর্নো ঘরানার; যা সহিংসতা উস্কে দেয় কিংবা অশ্লীল; (৩) বেআইনি, বিপথগামী করে এমন কিছু কিংবা কাউকে ব্যথিত, আহত করে বা মানসিক চাপে ফেলে বা বৈষম্য সৃষ্টি করে এমন কিছু ফেইসবুক ব্যবহার করে করবেন না; (৪) এমন কিছু পোস্ট করবেন না বা এমন কোনো কাজ ফেইসবুকে করবেন না যা অন্যের অধিকার লঙ্ঘন করে কিংবা অন্য কোনোভাবে আইন ভঙ্গ করে।

আমরা এইসব নির্দেশনা পড়ে দেখি না, দেখলেও মেনে চলার চেষ্টা করি না। আমাদের মতোই আমাদের সরকারও এ নিয়ে কোনো উদ্যোগ নেয় না। যদিও সোশ্যাল মিডিয়ায় পাবলিক পরিসরে আমাদের আচরণ অন্যের জন্য হানিকর হতে পারে; হতে পারে আমার নিজের জন্যও আইনি দিক দিয়ে বিপজ্জনক। বাংলাদেশ সরকারও কি ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে সঙ্গে নিয়ে একটি নীতিমালা করতে পারে না যা আমাদের পাবলিক পরিসরে কথা বলার পুরনো নীতিগুলোই হয়তো আবার প্রয়োজনের তাগিদে স্মরণ করিয়ে দেবে? যে ধরনের নীতিমালার অভাবে আবেগের বশে ব্যক্তিগত পরিসর ছেড়ে সচেতন বা অসচেতনভাবে পাবলিক পরিসরে হানিকর মন্তব্য করে ফেলেন একজন খন্দকার রুহুল আমিন। সোশ্যাল মিডিয়া কনটেন্টের কারণে রুহুল আমিনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার নির্দেশের ঘটনাটি শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো বিশ্বের জন্য সোশ্যাল মিডিয়া নীতিমালার ক্ষেত্রে একটি দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়াতে পারে। রুহুলের ঘটনাটি কি আসলেই এরকম একটি মামলায় পড়ার মতো? এ নিয়ে বাংলা ব্লগ পরিমণ্ডল প্রশ্নে একাকার ছিল কয়েকদিন।

এখন এখানে একটি বিষয় ভেবে দেখুন তো। রুহুল কী করেছিলেন? তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরসহ পাঁচজনের সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার দিন একটি খেদমাখা স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন ফেইসবুকে: গত ১৩ অগাস্ট মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও এটিএন নিউজের প্রধান সম্পাদক মিশুক মুনীরসহ পাঁচ জনের মৃত্যুর পর ফেসবুকে তিনি স্ট্যাটাস দেন, "পরীক্ষা ছাড়া ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়ার ফল তারেক ও মিশুক মুনীরসহ নিহত ৫: সবাই মরে, হাসিনা মরে না কেন?" এই স্ট্যাটাসের কারণে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হতে পারে কি না সে সিদ্ধান্ত আইনের। এখানে আপনি একবার ভেবে দেখতে পারেন এই স্ট্যাটাসের কারণে শেখ হাসিনা তার কোনো হানি হয়েছে বলে বিবেচনা করতে পারেন কি না। এটা যখন একজন ব্যক্তির স্ট্যাটাস তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মনে হতে পারে যে না হানি হয়নি।

এবার তাহলে এরকম একটি পরস্থিতি ভাবুন তো যে এই স্ট্যাটাসের কথাগুলো নিয়েই কেউ বা কিছু লোক পোস্টার ছাপাল এবং তা লাগিয়ে দিল ঢাকা শহরের দেয়ালে দেয়ালে। এতে তো হাসিনার এক ধরনের হানি হতে পারে- পোস্টার যারা দেখবে তাদের মধ্যে হাসিনা সম্পর্কে কোনো না কোনো এক ধরনের করুণাসুলভ মনোভাবও জায়গা করে নিতে পারে। এবং প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে এরকম বক্তব্যের একটি পোস্টারের দায়ে এর প্রকাশককে আইনের আওতায় আনা যেতে পারে- এক্ষেত্রে খুব কম মানুষই দ্বিমত করবে। কেননা তারা জানে যে এই নেতিপ্রচারের পোস্টার লাখ লাখ মানুষ দেখেছে।

এখন পোস্টারের জন্য সাজা হতে পারলে ফেইসবুক স্ট্যাটাসের জন্যও হতে পারে। কেননা সেটিও পাবলিক পরিসরে ছড়ানো। রুহুলের যদি এ কথা ফেইসবুকে তার কয়েকশ বন্ধুকে বলার ইচ্ছে না থাকত তাহলে তিনি তা সুনির্দিষ্ট এক বা একাধিক ফেইসবুক বন্ধুর সঙ্গে শেয়ার করতে পারতেন যার সুযোগ ফেইসবুক তার প্রাইভেসি সেটিংসের মধ্যে দিয়েই রেখেছে। এই কথা অল্প সংখ্যক মানুষের সীমা থেকে বেরিয়ে শতকে পৌঁছালে তা আর ব্যক্তিগত পরিসরে থাকে না। উপরন্তু ওই একশ জন থেকে গুণিতক হারে তা ছড়িয়ে পড়ে। তারেক-মুনীরের ওই দুর্ঘটনার পরপরই সে সময়কার যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের পদত্যাগ দাবি করে বহু স্ট্যাটাস আপডেট এসেছিল ফেইসবুকেই। সৌভাগ্য/দুর্ভাগ্যজনকভাবে ওই ফেইসবুক ব্যবহারকারীরা কোনো মামলার মুখোমুখি হননি।

রুহুলের স্ট্যাটাস এবং এই নিয়ে আদালতের আইনি প্রক্রিয়াটি বাংলাদেশের জন্য একটি স্মরণীয় এবং প্রয়োজনীয় ঘটনা হয়ে থাকবে বলেই মনে হয়। কেননা এর থেকেই দ্রুত ধাবমান সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে একটি দিক-নির্দেশনার দিকে এগুতে পারে বাংলাদেশ, যা দৃষ্টান্ত হয়ে উঠতে পারে নতুন এই মিডিয়ার ইতি-নেতি নিয়ে অনুসন্ধিত্সু অন্যান্য দেশের মানুষদের কাছে। এ ঘটনা থেকে দেশের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও তাদের নিজস্ব সোশ্যাল মিডিয়া নীতিমালার প্রয়োজনীয়তাও বুঝে উঠতে পারে।

পলাশ দত্ত: কবি ও সাংবাদিক।