সব দায় সংখ্যাগুরুর!

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 26 Jan 2017, 07:26 AM
Updated : 26 Jan 2017, 07:26 AM

বিএনপির নেতারা যখন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করেছিলেন তাদের হাসি হাসি মুখ দেখে অামরা ভেবেছিলাম, বরফ বোধহয় গলার পথে। অাসলে বরফ গলে না। রাজনীতি যেখানে দুশমনি– যেখানে ঝগড়া বড় অাদর্শ, কথার কথা– সেখানে সমঝোতা থাকে না। ছিনিয়ে না নেওয়া পর্যন্ত কেউ কাউকে এক বিন্দুও ছাড় দেয় না।

এটা মানি যে, অাওয়ামী লীগের কাছে বিএনপি শিশু। এদেশের ইতিহাস ও অতীতের বিবেচনায় তারা অাসলেই নাবালক। বিএনপি ভুলে গিয়েছিল, ষড়যন্ত্র অার গদিতে থেকে মাঠে গড়ে ওঠা দলের সঙ্গে পারার কথা নয়। কিন্তু তার মূল শক্তি বা বল হচ্ছে এ দেশের বিকৃত অথবা ইতিহাসবিমুখ জনগণ। তাই এখনও তারা স্বপ্ন দেখে।

এদিকে অাওয়ামী লীগ ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছে। সরকারে থাকার সুফল হিসেবে এবার তারা প্রশাসন ও অাইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পূর্ণ সমর্থন পেয়েছে। সে কারণে তারা মনে করছে গদি নিরাপদ। এই নিরাপত্তার মাশুল দিতে গিয়ে জনগণ যা হারিয়েছে বা হারাচ্ছে, একদিন তার জন্য হাত কামড়ানোর বিকল্প থাকবে না। আওয়ামী লীগ বিএনপি ঠেকাতে গিয়ে যেসব নতুন দানব টেনে এনেছে তারা জামায়াতের চেয়ে কম ভয়ংকর নয়।

দেশ ও জাতিকে এসব অাপদের হাত থেকে মুক্তি দিতে জাতীয় সমঝোতার বিকল্প নেই। যারা মনে করেন ঘাড়ে চেপে ভূত তাড়াবেন তারা এখনও ভুলের জগতে। মাঝে মাঝে ভূতকে অাপোষে বোতলবন্দি করতে হয়। বিএনপি ও জামায়াতের ঐক্য এখন অদৃশ্য বটে তবে তা অাছে। জাতীয় রাজনীতিতে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে মোকাবেলা না করলে পরিণাম ভালো হবে না। শেখ হাসিনা একা লড়ছেন। তার বিকল্প নেই। তৈরি করার কোনো প্রয়াসও নেই। খালেদা জিয়ার দলে তিনি গেলে হাতে-ভূতে লড়াই হবে।

তখন কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে জাতীয় ঐক্য? সবার অাগে যদি দেশ হয় তো বিএনপির উচিৎ সমঝোতার পথে পা বাড়ানো। অাওয়ামী লীগ জনগণ থেকে দূরে যাবার পথ বন্ধ না করলে এদেশে ওয়ান-ইলেভেনের অাগমন বা এমন দুঃস্বপ্ন থেকে যাবে।

রাজনীতির এই গোঁজামিলে সব দোষ পড়ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাঁধে। সংখ্যালঘু ও অবহেলিতদের ওপর নির্যাতনের দায় মস্তান সন্ত্রাসী বা ধর্মান্ধদের হলেও দায় গিয়ে পড়ছে বাঙালি মুসলমানের ওপর।

কথায় কথায় বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষদের সাম্প্রদায়িক বলাটা এখন রোগের মতো হয়ে গিয়েছে। মানছি যে, দেশে অনেক কিছু আগের মতো নেই। পচন ঢুকেছে মগজে। পচন মেধায়। পচন রাজনীতিতে, সংস্কৃতিতে। তার মানে কি এই যে, সব মানুষ সারাদিন হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে? রাজনীতি ও দেশ যারা চালায় তারা আজ দেশ ও সমাজকে এমন একটা জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে যেখানে বিশ্বাস ব্যাপারটাই নড়বড়ে। অথচ আপনি যদি ভালো করে চোখ মেলে দেখেন, রাজনীতি ও ধর্মান্ধতা সমার্থক না হলে মানুষের মন ও মননে এসবের প্রতিক্রিয়া নেই।

একটা সময় হিন্দুরা উচ্চপদে আসীন হতে পারত না। বিএনপি বা জামায়াতের শাসনামলে সুনীল গুপ্ত বা নিতাই বাবু কিংবা গয়েশ্বরের মতো দুচারজন খয়ের খাঁ পোষার বাইরে তারা সংখ্যালঘুদের দূরে রাখত। এখন তো তা নয়। এদেশের প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা। যাঁর হাতে দেশের সর্বোচ্চ আদালত ও আইন বিচারের ভার তিনি নিজেই অমুসলিম। যখন তিনি সিডনি এসেছিলেন তাঁর সঙ্গে সৌজন্যমূলক দেখা ও একসঙ্গে খাবার সুযোগ হয়েছিল। তাঁর কথা ও আচরণে যে দৃঢ়তা তা কিন্তু একবারও প্রমাণ করে না যে, তিনি সংখ্যালঘু হিসেবে ভীত বা শঙ্কিত।

এখন পুলিশের বড় কর্তা সচিব বা দেশের প্রশাসনেও অমুসলিমদের সংখ্যা কম নয়। সামাজিকভাবে তাদের যে ভয় সেটা রাষ্ট্র দূর করতে পারেনি বা চায়নি। চাইলে অবশ্যই পারত। কারণ আমাদের দেশের মানুষের বসবাস বা জীবনযাপন এমন একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। তাছাড়া বাড়িঘর জায়গা-জমি এমনকি জীবন ও পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে।

আমি কোনোভাবে বিশ্বাস করতে পারি না যারা আমাদের ছেলেবেলা থেকে বিয়ের সময় পর্যন্ত গায়ে খেটে টাকা-পয়সা ধার দিয়ে বন্ধুর দায়িত্ব পালন করেছে– যারা আমাদের মা-বাবাকে নিজের মা-বাবার মতো সম্মান করেছে– তারা আজ হিন্দু দেখলেই মারতে আসে। এখনও নব্বই শতাংশ মুসলিম বাঙালির দেশে অন্যরা ঘটা করে ধর্মীয় উৎসব করে, বিয়ে করে, সামাজিক অনুষ্ঠান করে। চট্টগ্রাম শহরের প্রাণকেন্দ্রে দিনরাত মাইক আর ঢাকঢোলের শব্দে মুখর জায়গাটিতে যেসব সংখ্যাগুরু মানুষের থাকেন তাদের ধৈর্য ও সহনশীলতার জন্য জাতীয় পুরস্কার দেওয়া উচিত। কিন্তু তারপরও কোনো দিন সেখানে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।

একথা বলছি না যে, সমস্যা নেই। না থাকলে রামুর বুদ্ধমূর্তি টুকরো টুকরো হত না। প্রায়শ দেবদেবীর ভাঙ্গা মূর্তি দেখে মন খারাপ হত না মানুষের। পুজা বা উৎসবের আগে আতঙ্ক থাকত না। শ্যামল কান্তিকে কান ধরাতে পারত না কেউ। সঙ্গে এটাও ভাবতে হবে– মুসলমানদেরও কি একই সমস্যা পোহাতে হচ্ছে না?

যত জন মুক্তচিন্তার মানুষ বলি হয়েছেন চাপাতির কোপে, জান দিয়েছেন, তাদের পরিচয় দেখুন। বেশিরভাগ সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের। বিষয়গুলো একতরফা নয়। এর পেছনে আছে সংখ্যালঘু ও প্রগতিশীল মুসলমান নিধনের গভীর ষড়যন্ত্র। কোনো রাজনীতি তার দায় নেয় না। তারা আমাদের নিয়ে খেলে, খেলায়। আর সে সুযোগে ভারত-বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িকতার ছদ্মবেশে হিন্দুদের বা সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর সম্পদ লুট হয়– তাদের চাকরি দেওয়া হয় না। এক সময় নিরাপত্তার অভাবে তারা দেশ ছেড়ে চলে যায়। এই কাজে আওয়ামী লীগ বিএনপি বা জামায়াত কারও উৎসাহ কিংবা আক্রোশের কমতি নেই। অথচ দায়টা গিয়ে পড়ে সাধারণ মুসলমানের ওপর।

আমরা ভুলে যাই এদেশে এখনও নির্মলেন্দু গুণ আর মহাদের সাহাই বড় কবি। ভুলে যাই গয়েশ্বর বাবু যেভাবে শেখ আসিনার সরকারের বিরুদ্ধে বলেন, সেভাবে মওদুদ আহমেদরাও বলেন না। ভুলে যাই দাপট না থাকলেও প্রভাব-প্রতিপত্তি অন্যদেরও কম নয়। আমরা যারা লিখি তাদের লেখা যারা ছাপান তারাও মুসলমান। যেভাবে আমরা গড়পড়তা মুসলমানদের গালমন্দ করি, আক্রোশের শিকার করি, রাগে-অভিমানে গায়ের ঝাল মেটাই, তারা কি তা ধারণ করেন না? ফলে এ কথা বলার সুযোগ নেই যে, সবাই সাম্প্রদায়িক বা একপেশে।

এই জাতির সংখ্যাগুরু মানুষরাই বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন। ওপার বাংলায় বাংলা ভাষার ওপর বলাৎকার, হিন্দির নির্যাতনের পরও তারা টুঁ শব্দটি করে না। এদেশের সংখ্যাগুরুরাই 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি' বলে কেঁদে বুক ভাসায়। আবার যদি পতাকা ও সঙ্গীতের ওপর আক্রমণ আসে তারাই সামাল দেবে। দুচারজন সংখ্যালঘু বাদে বাকিরা বলবেন, "ধুর, এদেশে আর হবে না"– তারপর তারা দেশ ছেড়ে চলে যাবেন। যাদের কোথাও যাবার জায়গা নেই তারাই আঁকড়ে রাখবেন এই মাটি।

আমার ব্যক্তিগত অভিমতে, বাঙালি মুসলমানের বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা অকৃত্রিম। তারা মাইক্রো-লেভেলে অসাধারণ। তবে সামাজিকভাবে মেক্রো-লেভেলে তারা সমাজ ও রাজনীতি বা ধর্মের চাপে অসহায়। এক শ্রেণির মানুষের সঙ্গে আছে জমি ও নারীর লোভ। তাই আসল জায়গায় হাত দিতে হবে। ঢালাও অভিযোগ বা তাদের পিঠ দেয়ালে না ঠেকিয়ে তাদের সঙ্গে থেকে লড়াই ও শুদ্ধতার কাজ করতে হবে। সংস্কৃতি এককালে তা করলেও এখন করছে না, সেটাই ভয়ের।

বাঙালি মুসলমানের যেন দোষের অন্ত নাই। আর বাকিরা সব ধোয়া তুলসী পাতা বা সাধুর দল। এ ভাবনা বন্ধ করতে হবে।