হাইব্রিড হাইব্রিড

মামুন আল মাহতাব
Published : 27 Jan 2017, 05:56 PM
Updated : 27 Jan 2017, 05:56 PM

হাইব্রিড শব্দটি বাংলা ভাষায় নতুন– আরও অনেক শব্দের মতোই ইংরেজি থেকে এর আমদানি। বাংলা আর বাঙালি বরাবরই বন্ধুবৎসল। নানান জাতির মানুষ আর তাদের ভাষাকে আমরা বরাবরই আমরা আপন করে নিয়েছি। নানান ভাষার নানান শব্দ স্থান পেয়েছে আমাদের শব্দকোষে। হাইব্রিডও তেমনই একটি শব্দ।

তবে হাইব্রিড শব্দটির সঙ্গে বরাবরই কেন যেন বিতর্কের সম্পর্ক। হাইব্রিড ধান ছাড়া আমাদের শস্যভাণ্ডার অপর্যাপ্ত। হাইব্রিড মাছ থেকে পেয়ারা– সবই আজ আমাদের খাদ্যতালিকায়। আবার হাইব্রিড খাবার নিয়ে বিতর্কও কম নয়। তবে হাইব্রিড শব্দটি এখন আলোচনায় অন্য কারণে। হাইব্রিড শব্দটির আওয়ামী-সংশ্লিষ্টতা ইদানিং একে অনেক বেশি আলোচিত করেছে। বাঙারি জাতির চেতনাকে যে আওয়ামী লীগ ধারণ করে, যার নেতা বঙ্গবন্ধু, বিশালত্বই যাঁর ও যে দলের বিশেষত্ব, তারা কখনও বদ্ধ-দূয়ার নীতিতে আবদ্ধ থাকেনি। নানা মতের, ধর্মের আর চেতনার স্থান হয়েছে এ দলে। এক সময়ের রুশপন্থী বামেরা যেমন এ দলকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি ভুল বুঝে ফিরে আসা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রীরাও এ দলে জায়গা ফিরে পেয়েছে অনায়াসে। এমনকি এক-এগারোর বিভ্রান্তদের জন্যও দলের দরজা বন্ধ করে রাখেননি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।

দোষেরও কিছু নেই এতে, কারণ এর মুলে ছিল একটি বিষয়– আর তা হল স্বাধীনতার চেতনা আর ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ বিচ্যূত কারও কখনও ঠাই হয়নি বঙ্গবন্ধু আর শেখ হাসিনার নৌকায়।

তবে ইদানিং এর ব্যতয়ে বিচলিত বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারীরা। বিচলিত এমনকি দলটির সর্বোচ্চ নিতীনির্ধারকরাও। দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে তাই উচ্চারিত হচ্ছে শুদ্ধির হুঁশিয়ারি।

হাইব্রিড আমার কাছে দুরকমের। অনেক বছর আগের কথা। আমি তখন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ছাত্র। নব্বই-পরবর্তী পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে দেশের ছাত্ররাজনীতিতে তখন দীর্ঘদিন পরে বইতে শুরু করেছে একটুখানি সুবাতাস। আর ঠিক এমন এক সময়ে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ঘটেছিল এক অদ্ভুতুড়ে ঘটনা। ছাত্র ইউনিয়ন আর জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল সে সময় ছাত্র শিবিরের সমর্থনে মমেকসু নির্বাচনে ঐক্য প্যানেল দিয়ে ছাত্রলীগ-সমর্থিত প্যানেলটিকে অল্প ভোটে পরাজিত করে। ১৯৮৮ সালের এক সকালে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে প্রফেশনাল পরীক্ষার হলে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের চিহ্নিত ক্যাডারদের ছুরির আঘাতে ছাত্রলীগ নেতা রাইসুল হাসান নোমানের আলোচিত হত্যাকাণ্ডের পর ক্যাম্পাস থেকে নির্বাসিত ছাত্রদলের পুনর্বাসনের প্রেক্ষাপট তৈরি করাই ছিল এই অদ্ভুতুড়ে ঐক্যের প্রেক্ষাপট।

বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটি অবশ্য সে সময় প্রশংসনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে। বহিষ্কৃত হন অদ্ভুতুড়ে প্যানেলটির নবনির্বাচিত ভিপি যিনি সম্ভবত সে সময়ে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতিও ছিলেন। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ ইউনিটও বিলুপ্ত করে দেয় ছাত্র ইউনিয়ন। সেই থেকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসে ছাত্র ইউনিয়নের কোনো কমিটি বা কর্মকাণ্ড নেই।

অবাক কাণ্ড– ২০০৯এ আওয়ামী লীগ আবারও ক্ষমতায় এলে ঐ অদ্ভুতুড়ে ভিপিকে আবিষ্কার করলাম আওয়ামী লীগের সহযোগী চিকিৎসক সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের ধ্বজাধারী হিসেবে। আর ২০১১এর পর তিনি এখন আরও উচ্চকণ্ঠ।

এত বছর পরে প্রসঙ্গটি টেনে আনার উদ্দেশ্য কারও ব্যক্তিগত চরিত্রহনন নয়, বরং এটি জীবন থেকে নেওয়া এমন একটি উদাহরণ যা থেকে সহজেই বোঝা যায় যে, এ ধরনের হাইব্রিড চেনা আদৌ কঠিন কিছু নয়। আওয়ামী লীগের নবনির্বাচিত নেতৃত্বের শুদ্ধির কারেন্ট জালে ধরাও পড়বেন এমন অনেকেই। প্রয়োজন শুধু শীর্ষ নেতৃত্বের এই সদিচ্ছার প্রতিফলন তৃণমূলে।

আমি বরং চিন্তিত দ্বিতীয় প্রজাতির হাইব্রিডদের নিয়ে। ২০০৯ থেকে ক্রমাগত ক্ষমতার বাইরে থেকে বিএনপি এখন অনেকটাই ড্রইং রুমের চারদেয়ালে বন্দি। আর পরপর দুবছর ব্যর্থ আগুন-সন্ত্রাসে প্রশ্রয় দিতে গিয়ে তাদের রাজনৈতিক সত্তা আর পরিচয়ও এখন অনেকটাই বিস্মৃতপ্রায়। ক্যাম্পাসগুলোতে তাদের একসময়কার বলিষ্ঠ ছাত্র সংগঠন এখন অনেকটাই ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নির্বাসিত। ফলে গত আট বছর যারা এদেশের ক্যাম্পাসগুলোয় ছাত্র ছিলেন তাদের একমাত্র রাজনৈতিক পরিচয় এখন ছাত্রলীগ। অথচ বিএনপি, বিএনপির মতন আর ছাত্রদল, ছাত্রদলসুলভ রাজনীতি করলে যে কোনো বিবেচনাতেই এদের একটা বড় অংশের রাজনৈতিক পরিচয়টা কিন্তু তখন হত অন্যরকম।

বিশ্বজিৎএর হত্যাকারীরা কি তাই আসলেই ছাত্রলীগ কিংবা খাদিজার হামলাকারী কি আসলেই শিক্ষা-শান্তি-প্রগতির চেতনা ধারণ করে কি না সে কথা প্রমাণ করার কোনো উপায় কিন্তু আর নেই। নব্য এসব হাইব্রিডদের দলচ্যুত করা তো দুরে থাক, তাদের চেষ্টাই তো অসম্ভব। হয়তো তারা চেনে না তাদের নিজেদেরকেই। কারণ তাদের ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির গড্ডালিকা প্রবাহ তো ছিল একমুখী।

তাই এদের চেনার চেয়ে এদেরকে নিজেদেরকে চেনানোটাই বরং বেশি জরুরি। দলীয় শুদ্ধি অভিযানে এদের মুলোৎপাটনও আবশ্যিক, তবে তার জন্য প্রয়োজন আদর্শিক শুদ্ধি। একসময় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে পড়ার সুবাদে আমরাই দেখেছি ছাত্রলীগের পাঠচক্র। নিজেরা পড়েছি আর পরে পড়িয়েছিও। আজ সেই পাঠচক্রগুলোর বড় বেশি প্রয়োজন। আর তা শুধু ছাত্রলীগেই নয়– এর প্রয়োজন যুবলীগে, যুব মহিলা লীগে, স্বেচ্ছাসেবক লীগে, স্বাধীনতা চিাকৎসক পরিষদে, হয়তো-বা এমনটি খোদ আওয়ামী লীগেও। ক্যাম্পাসগুলোয় আবারও প্রয়োজন সংষ্কৃতিবান্ধব প্রশাসন আর সংষ্কৃতিচর্চার বাতায়ন।

ক্যাম্পাসে সুরের সাধনা যেন 'অসুরের কাছে' আর 'তবলা পার্টির প্রলাপসম' মনে না হয়– বরং ক্যান্টিনে শামসুর রহমানের 'স্বাধীনতা তুমি' আবৃত্তি শুনে যেন আমরা বলতে পারি– ঐ তো ছাত্রলীগ, ওরাই তো ঠেকাবে হলি আর্টিজান।

প্রত্যাশা আজ এটুকুই।