গণ্ডার হইতে সাবধান!

শিশির ভট্টাচার্য্যশিশির ভট্টাচার্য্য
Published : 15 Jan 2017, 06:43 AM
Updated : 15 Jan 2017, 06:43 AM

ফরাসিভাষী নাট্যকার ইউজিন ইওনেস্কোর 'গণ্ডার' নাটকে শহরের লোকজন কোনো অজানা কারণে একে একে গণ্ডারে রূপান্তরিত হতে শুরু করে। সকালে যে সুস্থ, বিকালেই তীব্র ব্যথা হয়ে রাতারাতি তার কপালে শিঙ গজিয়ে যায়। নাটকের নায়িকা পর্যন্ত গণ্ডারে পরিণত হয়ে গণ্ডারের পালে মিশে যায় এবং দলবেঁধে শহরময় দাবড়ে বেড়িয়ে ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করে। নায়ক নিজে বার বার কপালে হাতের তালু ঘসে দেখে সেও গণ্ডারে পরিণত হচ্ছে কি না।

এই 'গণ্ডার' একটা মানসিক রোগ বা প্রবণতার রূপক। গণ্ডার রোগে আক্রান্ত রোগীরা বর্ণ, ধর্ম, জাতপাত, মতবাদ ইত্যাদি যে কোনো পার্থক্যের ভিত্তিতে একদল 'আমরা' এবং একদল 'ওরা' সৃষ্টি করে। গণ্ডারদের মনে কোনো সন্দেহ নেই যে, "আমাদের সব কিছুই ভালো আর ওদের সব কিছুই খারাপ। আমরাই শুধু স্বর্গে যাবো, ওদের ভাগ্যে আছে অনন্ত নরক।"

গণ্ডার রোগের মূলে আছে মানুষের মনের সহজাত ঘৃণার প্রবৃত্তি। যে কোনো মূল্যে ওকে, ওদেরকে ঘৃণা করতে হবে। ওদের ধ্বংস করার জন্যে প্রয়োজনে 'আমাদের' দলবদ্ধ হতে হবে এবং তারপর সুযোগ বুঝে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে 'ওদের' উপর।

মন্ট্রিয়ল শহরের পার্ক অ্যাভেনিউতে একটা ফিটনেস সেন্টার আছে যার স্বচ্ছ কাচের দেয়ালের ভিতর দিয়ে দেখা যায় নারী-পুরুষ ব্যায়াম করছে। একদিন দেখা গেল, কাচের উপর সবুজ রঙ লাগানো হয়েছে। কারণ এলাকার কট্টর ইহুদিরা বলেছেন, মেয়েদের অনাবৃত পা ও বাহুমূল দেখলে তাদের অস্বস্তি হয়। মন্ট্রিয়লের নাগরিক, বিশেষত নারীরা প্রতিবাদে ফেটে পড়লেন: কখন কার অস্বস্তি হবে, সে জন্যে মেয়েদের কেন অস্বচ্ছ ঘেরাটোপে বন্দি হতে হবে? গণ্ডাররোগে আক্রান্ত ইহুদিরা শিঙ গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল এবং ফিটনেস সেন্টারের দেয়াল অবিলম্বে পূর্বাবস্থায় ফিরে এসেছিল।

মধ্যযুগে খ্রিস্টান যাজকেরা গণ্ডাররোগে ভুগেছে। কয়েকশ বছর ধরে কত শত পুরুষ-নারীকে যে ওরা নানা অজুহাতে পুড়িয়ে মেরেছিল তার ইয়ত্তা নেই। চীন ও রাশিয়ায় এক সময় প্রচুর সাম্যবাদী গণ্ডার ছিল।

বাংলাদেশের কিছু গণ্ডার প্রায়ই এখানে ওখানে নিরীহ বাউলদের উপর হামলা চালায়। আরাকানের বৌদ্ধ গণ্ডারেরা মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য করছে রোহিঙ্গা মুসলমানদের। ইসরাইলে জায়ানবাদী গণ্ডারেরা নির্বিচারে প্যালেস্টাইনিদের জমি দখল করেও সন্তুষ্ট নয়। গত সপ্তাহেই ইহুদি গণ্ডারেরা মিছিল করে সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে, দখলকৃত এলাকায় প্যালেস্টাইনিদের দেখামাত্র গুলি করা হোক! এদের বেশিরভাগ তরুণ-তরুণী। গণ্ডাররোগে আক্রান্ত হবার কোনো বয়স নেই।

যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণের বেশ কিছু রাজ্যের মানুষ বহু দিন যাবৎ গণ্ডাররোগে আক্রান্ত। সেখানকার অনেক স্কুল-কলেজের সিলেবাসে নাকি ডারউইনীয় বিবর্তনবাদ নয়, বাইবেলের আদম-হাওয়ার কাহিনি অন্তর্ভুক্ত আছে। মেয়েরা জিন্স পড়াতে দক্ষিণ এশিয়ায় ভূমিকম্প হচ্ছে– এই দাবি করেছেন একাধিক ধর্মের গণ্ডারগুরু। গণ্ডারদের হাতে জিন্স-পড়া মেয়েদের অপমানিত হবার ঘটনা ঘটেছে ভারতে, ইন্দোনেশিয়ায়। পান থেকে চুন খসলে মেয়েদের উপর চড়াও হয় ভারতের শিবসেনা গণ্ডার। এই তো কদিন আগে নিজের বাড়ির ফ্রিজে গরুর মাংস রাখার মিথ্যা অভিযোগ তুলে মুসলমান বৃদ্ধকে বাড়ি বয়ে এসে পিটিয়ে হত্যা করেছিল হিন্দুত্ববাদী গণ্ডারেরা।

বাংলাদেশে ২০১৭ সালের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তক থেকে ভিন্ন ধর্মের ও আদর্শের লেখকদের লেখা বাদ দেবার দাবি উঠেছে, ইতিমধ্যে বাদ দেওয়াও হয়েছে। ভিন্ন ধর্মের ও মতের একজন লেখক জীবন ও জগত কীভাবে দেখেন তা শিশুদের জানানো যাবে না। লেখার মান নয়, গণ্ডারদের কাছে লেখকের জন্মকালীন ধর্ম বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

অপলা আনন্দী সিকদার। ঢাকায় এক স্কুল-পড়ুয়া মেয়ের এই নাম দেখে পরীক্ষার হলে এক মহিলা পরিদর্শক-শিক্ষক গজগজ করে উঠলেন: "এই মেয়ে, তোমার বাপ-মা কী ধরনের বেয়াক্কেল যে, এমন একটা হিন্দু নাম রাখল!"

অপলা সেই গণ্ডার পরিদর্শককে কোনোমতেই বোঝাতে পারে না যে, ওর নামটা বাংলা!

তবে বাংলা নাম থাকা সত্ত্বেও সে নাম ব্যবহার করতে চান না অনেক গণ্ডার। ধরা যাক, সুস্থ থাকা অবস্থায় বাপ-মা ছেলের ডাক নাম রেখেছিল 'সবুজ'। গণ্ডার হওয়ার পর সেই একই বাপ-মা ভাবছে, 'সবুজ' শব্দটা উচ্চারণ করলে না জানি কী গুনাহ্ হয়ে যায়। অথচ মুসলমানদের নাম হাসিনা, খালেদা, এরশাদ, রওশন হতেই হবে, এমন বাধ্যবাধকতা যদি থাকত তবে ইন্দোনেশীয়ায় সুহার্তো, সুকর্ণ, মেঘবতী ইত্যাদি নাম রাখা যেত না। 'জয়' বা 'পুতুল'এর মতো বাঙালি মুসলমানের অন্তত একটা বাংলা নাম থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।

"অ্যাই, তুই হিন্দু। তোরা বাড়িতে মূর্তিপূজা করিস, তোর সঙ্গে খেলব না!"– বলে পাঁচ বছরের মিতুকে প্রায়ই খেলা থেকে বের করে দেয় বন্ধুরা। মিতু কাঁদতে কাঁদতে বাবা-মায়ের কাছে গিয়ে জিগ্যেস করে: "বাবা, হিন্দু কী, মূর্তিপূজা কী?"

ঘটনাটা ঘটেছে ঢাকায়, গত মাসে। মিতুর বাবা ফেসবুকে এই সমস্যার সমাধান জানতে চেয়েছিলেন। এক ফেসবুক বন্ধু তাকে বুদ্ধি দিয়েছিলেন অন্য এলাকায় বাসা খুঁজে নিতে।

বিচ্ছিন্ন ঘটনা? একেবারেই নয়। গণ্ডাররোগ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে। গত মাসেই ভিয়েনার এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সাত বছরের সুদীপ্তাকে তার তুর্কি/আফগান/বসনিয়াক সহপাঠীরা জার্মান ভাষায় জিগ্যেস করেছে: "বিস্ট ডু মুসলিম?" (অর্থাৎ 'তুই কি মুসলমান?')

মুসলিম হলে সুদীপ্তাকে তারা খেলায় নেবে, নইলে নয়। শ্রেণিশিক্ষকের কাছে অভিযোগ করার পরামর্শ দিলে সুদীপ্তা বলে: "টিচার নিজেও তো মুসলিম। উনি বলেছেন, লেখাপড়া ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে কথা বলতে তিনি রাজি নন!"

পহেলা বৈশাখ, একুশে ফেব্রুয়ারি ইত্যাদি বাঙালি উৎসব হিন্দুয়ানি কুপ্রথা মনে করে এমন বহু গণ্ডার আছে বাংলাদেশে। বাঙালিয়ানা মানেই এদের বিচারে হিন্দুয়ানা। পহেলা ফাল্গুনে মাথায় ফুল গোঁজা, হলুদ শাড়ি পরা মেয়েদের দিকে প্রচণ্ড ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকাতে দেখেছি ঢাকার অনেক গণ্ডারকে। বাংলা সিনেমার এক প্রাক্তন চাটগাঁইয়া নায়িকা এতটাই গণ্ডারনী হয়ে গিয়েছেন যে, সম্ভব হলে নিজের করা সবগুলো চলচ্চিত্রের কপি তিনি নষ্ট করে ফেলেন।

ইওরোপের বিভিন্ন শহরে যে বাঙালিরা এক সময় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতেন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের মধ্যে অনেকেই গণ্ডারে পরিণত হয়েছেন। নিজেরা গান-বাজনা-নাটক ছেড়ে দিয়েছেন। সন্তানদেরও সংস্কৃতিচর্চা থেকে সরিয়ে রেখেছেন। ধরা যাক, যিনি আগে নাটকে নায়কের পার্ট করতেন, তিনি এখন গণ্ডারের সর্দার। এখনও যারা 'সুস্থ' আছেন, অর্থাৎ গান-বাজনা-নৃত্য-নাটক-কবিতার সংস্কৃতির চর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন, তাদের বেশিরভাগই হয় অমুসলমান, অথবা সদ্য দেশ থেকে এসেছেন।

কন্টিনেন্টে বসবাস করা বাঙালিদের একটি বড় অংশ ইওরোপীয় পাসপোর্ট হাতে পাওয়ামাত্র যুক্তরাজ্যে গিয়ে হাজির হন, বিশেষ করে যদি তাদের মেয়েসন্তান থাকে। কোনো অজ্ঞাত কারণে যুক্তরাজ্যে দক্ষিণ এশীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে গণ্ডাররোগে সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল এবং এখানে এসে অনেকেই এই রোগে আক্রান্ত হন। কেউ যদি কোনো অমুসলমান বন্ধুর বাড়িতে নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেন, তবে গণ্ডারেরা তাকে টিটকারি দেয়। বাধ্য হয়ে সুস্থ লোককেও ধর্মগুরুর কাছে গিয়ে জানতে হয় (ধরা যাক, ওমরাহ করার পর), বিধর্মী বন্ধুর বাড়িতে অবস্থান বা অন্নগ্রহণ জায়েজ হবে কিনা। কোনো হিন্দু প্রতিবেশি যদি মনের ভুলে 'হায় রাম' বা 'হায় ভগবান' বলে ফেলেন, তবে এক গণ্ডারকে বলতে শুনেছি: "ছি! আপনি কীভাবে আমার সামনে ঐ নাপাক শব্দটা উচ্চারণ করতে পারলেন!"

অনেক হিন্দু কুপ্রথা ধীরে ধীরে অহিন্দুদের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে তাদের নিজের অজান্তে। রোগই সংক্রামক, স্বাস্থ্য নয়।

রুজি হারাম হল কি না বেশিরভাগ গণ্ডার সেটা দেখার প্রয়োজনবোধ করে না। মুরগির মাংস বা সাবান হালাল হলেই চলে। মেয়ে-বৌয়ের জন্যে লিপস্টিক বা নেইলপলিশ কিনতে গিয়েও এরা খুঁটে খুঁটে দেখে সেটি হালাল উপাদানে প্রস্তুত কি না। পাশ্চাত্যের গণ্ডারদের মধ্যে অনেকে ছেলেমেয়েকে মূলধারার স্কুলে না পাঠিয়ে ধর্মীয় বিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন। সমস্যা হচ্ছে, ধর্মীয় ডিগ্রি দিয়ে পাশ্চাত্যের বাজারে চাকরি পাওয়া যায় না। সমাজের মূলধারার সঙ্গে একেবারেই মিশতে না পেরে কিশোর গণ্ডারদের মনে হতাশা, অস্থিরতা বাসা বাঁধছে।

যে কিশোরেরা মূলধারার স্কুলে যাচ্ছে তাদের মধ্যে অনেকে জঙ্গিদের খপ্পরে পড়ছে। প্রার্থনাবারে ধর্মস্থানে উত্তেজক বক্তৃতা শুনে শুনে খামাখা ভিন্ন ধর্মের মানুষের প্রতি হিংসাপরায়ণ হয়ে উঠছে তারা। কিশোর গণ্ডারেরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্রার্থনা করছে। অন্য সব বই বাদ দিয়ে তারা শুধু ধর্মপুস্তক পড়ছে। বাপ-মায়ের ধর্মবিশ্বাসের খাঁটিত্ব নিয়েও প্রশ্ন তুলছে ওরা। তারপর একদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে হাজির হচ্ছে সিরিয়া-ইরাকে। জেহাদী জনের মতো কচি হাতে বিধর্মীদের গলা কেটে কেটে স্বর্গের টিকেট কনফার্ম করছে এবং সেই সঙ্গে নিরপরাধ ইয়াজেদি তরুণীদের যৌনদাসী বানিয়ে বেহেস্তসুখ উপভোগ করছে।

অবশেষে একদিন অকালমৃত্যু হওয়ার আগে এরা বুঝতেও পারছে না যে, একটি গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্যে শ্রেফ তাদের ব্যবহার করেছে। গুলশান হামলায় নিবরাজদেরও হয়তো ব্যবহার করা হয়েছিল, ধরা যাক, কোনো বিশেষ দেশের বিনিয়োগকারীদের ভয় দেখানোর জন্যে।

গণ্ডার যেমন তার শিঙের গুঁতো দিয়ে অন্যকে আহত-নিহত করতে চায়, গণ্ডাররোগে আক্রান্তরাও তেমনি সুযোগ পেলেই দুর্বলের উপর পেশিশক্তির অপপ্রয়োগ করে। ধর্মনিরপেক্ষ দলে ঘাপটি মেরে থাকা গণ্ডার পাতিনেতা ট্রাকে করে পশুর পাল নিয়ে এসে নাসিরনগরের সংখ্যালঘু পাড়ায় তাণ্ডব চালায়। অন্য ধর্মের পুরোহিত-যাজক-ভান্তে, ধর্মান্তরিত ব্যক্তি, ভিন্নমতাবলম্বী লেখক, সমকামী– এক কথায়, যারাই 'আমাদের' মতো নয়, গণ্ডারেরা হয় তাদের হত্যা করে, অথবা নিদেনপক্ষে হত্যার খবর শুনে নিজের অজান্তে বলে উঠে: 'মারহাবা'!

কোথাও কোনো সংখ্যালঘু কিশোরীকে ভাগিয়ে এনে ধর্মান্তরিত করার 'সুখবর' ফেসবুকে দেখে আপনি যদি আনন্দিত বোধ করেন এবং মনের অজান্তে একখান লাইক দিয়ে দেন, তবে নিশ্চিত জানবেন, গণ্ডাররোগের দুষ্ট জীবাণু ইতোমধ্যে আপনার মনেও বাসা বেঁধেছে।

যে কোনো ধর্মের মূলনীতি, যেমন ধরুন, সত্যবাচন ও সততায় বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই গণ্ডারদের। সমাজে নানা ধর্মের, নানা মত ও পথের লোক থাকে, কারণ বৈচিত্র্যই জীবনের ধর্ম। কিন্তু 'আমাদের' মতো নয়, এমন কারও সঙ্গেই এরা সহাবস্থান করতে শেখেনি। প্রতিবেশির সুখ-সুবিধার দিকে কখনও গণ্ডারদের নজর নেই। নিজের ইচ্ছা অন্যের উপর চাপিয়ে দেবার ক্ষেত্রে এদের জুড়ি মেলা ভার। দূরপাল্লার বাসে এরা ফুল ভলিউমে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডিত গণ্ডার-গুরু দৈলহসনের বক্তৃতা শুনতে বাধ্য করে অন্য সব যাত্রীকে। প্রার্থনার সময় এলে এদের ইচ্ছায় বাস থামাতে হয়, যার ফলে গন্তব্যে পৌঁছুতে সবার অনর্থক বিলম্ব হয়। একদিন হয়তো গণ্ডারেরা ট্রেন এবং বিমানও থামাতে চাইবে। ট্রেন ও বিমানযাত্রীদের কানও হয়তো দৈলহসনদের বক্তৃতায় ঝালাপালা হবে।

ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করা গণ্ডাররোগের অন্যতম উপসর্গ। গণ্ডারেরা মানতেই চায় না যে, জীবনের প্রয়োজনে ধর্ম, ধর্মের প্রয়োজনে জীবন নয়। ধর্ম জিনিষটা মূলত বিশ্বাস এবং অনুভবের ব্যাপার। একান্ত ব্যক্তিগত এই অনুভব অন্তর্বাসের মতো। জাঙ্গিয়া কাপড়ের ভিতরে রাখতে হয়। গণ্ডারেরা প্যান্টের উপরে জাঙ্গিয়া পড়ে সুপারম্যান সাজতে চায়। ধর্ম কাঁঠালের মতো। কাঁঠালের আঠা, ভূতি বাদ দিয়ে শুধু মিষ্টি কোয়াটা খেতে জানতে হয়। গণ্ডারেরা কিছুমাত্র বাদ না দিয়ে পুরো কাঁঠাল নিজে খেতে চায়, অন্যকে জোর করে খাওয়াতে চেষ্টা করে।

গণ্ডাররোগটা সংক্রামক বটে, কিন্তু এ রোগ সব সময় যে নিজে থেকেই ছড়ায় তা কিন্তু নয়। আমাদের সময়ে সারা পৃথিবীতে গণ্ডার রোগ ছড়িয়ে যাবার পেছনে যুদ্ধবাজ আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর মদদ রয়েছে। কারণটা, বলাবাহুল্য, অর্থনৈতিক। কোনো অঞ্চলে যত বেশি গণ্ডার, তবে বেশি অস্ত্রবিক্রি, তত বেশি যুদ্ধ। মধ্যপ্রাচ্য যেহেতু অস্ত্র কেনার ক্ষমতা রাখে, সেহেতু পাশ্চাত্য যে কোনো অজুহাতে সেখানে যুদ্ধাবস্থা জারি রাখতে চাইবে। নিজের স্বার্থে পাশ্চাত্য কখনও চাইবে না গণ্ডারেরা ধর্মপুস্তক ছেড়ে বিজ্ঞান পড়ুক।

আফগানিস্তানের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, দেশটি যখনই আধুনিক হতে চেয়েছে, পাশ্চাত্য তাতে বাধ সেধেছে। আশির দশকের প্রথমে আফগানিস্তানে রুশ বাহিনীর অনুপ্রবেশের পর থেকেই আমেরিকা-ইওরোপের প্রত্যক্ষ মদদে উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিমে গণ্ডাররোগের সূচনা হয়েছিল। প্রথমে মুজাহিদিন, তারপর তালেবান এবং অতিসাম্প্রতিককালে আইএস পাশ্চাত্যের নিজের হাতে তৈরি ভয়ঙ্কর এক একটি গণ্ডারের পাল। লেখাপড়া করে যে তরুণদের দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখার কথা ছিল, প্রচূর অর্থ বিনিয়োগ করে এবং নানা রকম রাজনৈতিক কলকাঠি নেড়ে পাশ্চাত্য সযত্নে তাদের সশস্ত্র গণ্ডারে পরিণত করেছে।

পাকিস্তান অবশ্য জন্মলগ্ন থেকেই গণ্ডারের সূতিকাগার। মধ্যপ্রাচ্যে যেসব দেশে সচেতন মধ্যবিত্ত শ্রেণির সৃষ্টি হয়েছিল, যেমন ইরাক, সিরিয়া, সেগুলোকে যুদ্ধের আওতায় এনে আরব তরুণদের একটি অংশকে গণ্ডারে পরিণত করা হয়েছে। আরব মায়ের বুক খালি হয়ে পাশ্চাত্যের স্বার্থসিদ্ধি হচ্ছে।

পৃথিবীর বহু দেশে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী সংখ্যাগুরু গণ্ডারদের দ্বারা অত্যাচারিত হচ্ছে। একজন মানুষ সংখ্যাগুরু নাকি সংখ্যালঘু, এটা নির্ভর করে নিছকই তার জন্মগত সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যের উপর। কয়েকশ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েই বাংলাদেশের যে কোনো মুসলমান বার্মা বা ভারতে গিয়ে সংখ্যালঘু হবার (বিধর্মী) স্বাদ নিতে পারে। কাকতালীয়ভাবে বিশেষ ধর্মের বাবা-মায়ের ঘরে জন্মগ্রহণ করার কারণে আজ যিনি নিজেকে সংখ্যাগুরু ভেবে মনে মনে স্বস্তিবোধ করছেন, কপাল খারাপ হলে কাল তিনিই সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়ে চরম দুরবস্থায় পড়তে পারেন। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার সংখ্যাগুরু মুসলমান দলে দলে ইওরোপ-আমেরিকায় গিয়ে সংখ্যালঘুতে পরিণত হচ্ছে। যে আরবেরা একদিন সম্পন্ন গৃহস্থ ছিল, আজ তারা পাশ্চাত্যের রাস্তায় হাত পেতে মালাউনদের করুণাভিক্ষা করতে বাধ্য হচ্ছে।

যদিও প্রায় সব জাতি, সব ধর্মের, সব মতের লোকদেরই গণ্ডার রোগে আক্রান্ত হবার ইতিহাস রয়েছে, তবু আশির দশক থেকে শুধু মুসলমানদেরই জঙ্গি, গোঁড়া, ধর্মান্ধ (অর্থাৎ 'গণ্ডার') হিসেবে দেখানোর অসৎ উদ্দেশ্যে একটি রাজনৈতিক ফাঁদ পাতা হয়েছে। ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক মুসলমানেরাও এই ফাঁদে পা দিচ্ছে। পাশ্চাত্য মিডিয়ার কল্যাণে 'মুসলমান মাত্রেই জঙ্গি' এমন ভুল ধারণা সারা পৃথিবীর অমুসলিম মানুষের মনে ইতোমধ্যে প্রায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।

এই মানসিকতা সৃষ্টি এবং একে সযত্নে লালন করার অন্যতম উদ্দেশ্য যুদ্ধব্যবসা চালু রাখা। পৃথিবীতে মুসলমানেরাই সম্ভবত সবচেয়ে বেশি অস্ত্র কিনে এবং গত কয়েক দশক ধরে সেই অস্ত্রে তারাই সবচেয়ে বেশি অপঘাতে মারা পড়ছে। একটি মানবগোষ্ঠীকে জঙ্গি প্রমাণ করতে পারলে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা এবং সেই গোষ্ঠীর সদস্যদের হত্যা করা জায়েজ প্রমাণ করা সম্ভব হয়।

হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-কমিউনিস্ট-পুঁজিবাদী– গণ্ডাররোগ সংক্রমণের ঝুঁকি থেকে আমরা কোনো মানুষই মুক্ত নই। আজ আমি সুস্থ, কিন্তু কাল আমি নিজেই গণ্ডারে পরিণত হতে পারি– 'গণ্ডার' নাটকের কুশীলরদের মতো। কিশোর বয়সে যাদের কমিউনিস্ট আন্দোলন করতে দেখেছি, আজ পঞ্চাশোর্ধ বয়সে এসে দেখছি, তাদের অনেকেই গণ্ডাররোগে আক্রান্ত। যে সমাজে যত বেশি গণ্ডার, স্বাভাবিকভাবেই সে সমাজে গণ্ডাররোগ সংক্রমণের ঝুঁকি তত বেশি।

গণ্ডার একটি সামাজিক ব্যাধির নাম। এই রোগ থেকে মুক্ত হবার জন্যে আপনার একার ইচ্ছা যথেষ্ট নাও হতে পারে। সমাজকে গণ্ডাররোগ থেকে মুক্ত করতে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির বিকল্প নেই।

'জগত ভরমিয়া দেখি, একই মায়ের পুত'– শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ছাড়া ধর্মবর্ণনির্বিশেষে মানবগোষ্ঠীগুলোর টিকে থাকার দ্বিতীয় উপায় নেই। আশির দশকে পাশ্চাত্যের উদ্যোগে সূচিত হওয়া সংক্রামক গণ্ডাররোগ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্যে সহায়ক নয়, বলাই বাহুল্য। 'বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে'। সুন্দর ও নিরাপদ শৈশব নিশ্চিত করতে হলে: ১) গণ্ডাররোগে আক্রান্ত রোগীদের সুস্থ করে তোলার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে; ২) গণ্ডাররোগের সংক্রমণ রোধ করতে হবে; ৩) গণ্ডাররোগ যারা ছড়ায়, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সেই তথাকথিত 'মানবতাবাদী' গোষ্ঠীগুলোর অপচেষ্টা রোধ করতে হবে।