বাংলাদেশে লিভার ক্যান্সার চিকিৎসায় সাম্প্রতিক অগ্রগতি

মামুন আল মাহতাব
Published : 14 Jan 2017, 04:39 AM
Updated : 14 Jan 2017, 04:39 AM

লিভারের ক্যান্সার বাংলাদেশে ক্যান্সারজনিত মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। আর এটি বিশেষভাবে প্রযোজ্য পুরুষদের ক্ষেত্রে, যাদের বেলায় এটি তৃতীয় প্রধান ঘাতক ক্যান্সার। সাধারণত মানুষ ৫৫ থেকে ৬০ বছর বয়সে লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। অথচ বাংলাদেশের বেলায় লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার গড় বয়স মাত্র ৩৫-৪৫ বছর। অর্থাৎ এদেশে একজন মানুষ তার জীবনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সময়টাতেই এই গুরুব্যাধিতে আক্রান্ত হবার ঝুঁকিতে থাকেন।

আমাদের দেশে লিভার ক্যান্সারের প্রধান কারণ হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাস। এদেশে মোট জনসংখ্যার প্রায় চল্লিশ শতাংশ জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে ইনফেকটেড হয়েছেন। এদের অনেকেই ভবিষ্যতে লিভার ক্যান্সারের ঝুঁকিতে আছেন। কাজেই এটি খুবই স্বাভাবিক যে, বাংলাদেশে লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত শতকরা প্রায় সত্তর জন রোগী হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত।

হেপাটাইটিস বিএর পরে আছে হেপাটাইটিস সি ভাইরাস আর ফ্যাটি লিভার। প্রাপ্ত তথ্য উপাত্ত অনুযায়ী আমাদের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক শতাংশ হেপাটইটিস সি ভাইরাসে আক্রান্ত।

আর অন্যদিকে বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশকে বলা হয়ে থাকে বিশ্বের 'ফ্যাটি লিভারের রাজধানী'। জন্মগতভাবে আমাদের এই উপমহাদেশের মানুষের লিভারে চর্বি জমার আশংকা বেশি। এমনকি শিশুরাও এই ঝুঁকির বাইরে নয়। আর এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, একটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সেদেশে ফ্যাটি লিভারের রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়। কারণ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি জীবন করে বিলাসবহুল, জীবিকা করে প্রতিযোগিতামূলক আর খাবারের অভ্যাসে আনে আমুল পরিবর্তন। সব মিলিয়ে আমাদের দেশে ফ্যাটি লিভার তাই ঘরে ঘরে।

লিভার ক্যান্সারের চিকিৎসা অবশ্য অন্যান্য ক্যান্সারের চিকিৎসার তুলনায় একবারেই আলাদা। প্রচলিত কেমোথেরাপি বা রেডিওথেরাপির এখানে কোনো ভূমিকা নেই বললেই চলে। প্রাথমিক অবস্থায় অথবা ছোট লিভার ক্যান্সার অপারেশনের মাধ্যমে অপসারণ করা সম্ভব। কিন্ত লিভার ক্যান্সারের বেশিরভাগ রোগী অনেক দেরিতে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। কথাটি শুধু বাংলাদেশেই নয়, বরং পুরো ভারতবর্ষের জন্যই প্রযোজ্য। তাছাড়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব রোগীর লিভারে সিরোসিসের মতন মারাত্বক রোগ থাকে। ফলে অপারেশন করা সম্ভব হয় না। লিভারে ক্যান্সারের অবস্থান ও আকৃতিগত কারণেও অনেক সময় অপারেশন দুরুহ হয়ে পড়ে।

এই ধরনের রোগীদের ক্ষেত্রে বর্তমান বিশ্বে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি এবলেশন (আরএফএ) আর ট্রান্স-আরটারিয়াল কেমো-এম্বোলাইজেশন (টেইস) অত্যন্ত কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি। সুখের কথা, এ দুটি পদ্ধতিতেই লিভার ক্যান্সারের চিকিৎসা এখন আর বাংলাদেশে স্বপ্ন নয়, বরং সত্যি। এই দুই পদ্ধতিতেই ন্যূনতম কাটা-ছেঁড়ার প্রয়োজন নেই এবং প্রায় কোনোরকম জটিলতা ছাড়াই এগুলো পুনরায় করা সম্ভব। প্রাথমিক অবস্থায় বা ছোট টিউমারে এর যে কোনোটি, বিশেষ করে টেইস, করা গেলে লিভার ক্যান্সার অনেক ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নিরাময় করা সম্ভব। আর বড় টিউমারের ক্ষেত্রে রোগীরা অনেক দিন সুস্থ থাকেন।

আরএফএতে লিভার টিউমারের মধ্যে বৈদ্যুতিক তাপ তৈরি করে ক্যান্সার সেল ধ্বংস করা হয়। জাপানে প্রায় পনেরশটিরও বেশি সেন্টারে নিয়মিত আরএফএ করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশেও এখন এই চিকিৎসা করা হচ্ছে। ফলে এদেশের লিভার ক্যান্সারের রোগীরা এখন নিজ দেশে বসেই এই আধুনিক চিকিৎসা গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছেন।

অন্যদিকে টেইসএ রক্তনালীর মাধ্যমে সরাসরি লিভার ক্যান্সারের টিউমারে কেমোথেরাপি ইনজেকশন দেওয়া হয়। এটি লিভার ক্যান্সার চিকিৎসার সর্বাধুনিক পদ্ধতি যেখানে ক্যাথল্যাবে লিভারের এনজিওগ্রাম করার প্রয়োজন পড়ে। গত বছর ভারতে প্রশিক্ষিত একদল তরুণ লিভার বিশেষজ্ঞ ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে প্রথমবারের মতো সফলভাবে টেইস সম্পাদন করেন। এরপর থেকে তারা নিয়মিত টেইস করে চলেছেন। তাদের সাফল্যের হার বর্তমানে প্রতিবেশি ভারতের যে কোনো এডভান্সড সেন্টারের সঙ্গে তুলনীয়। শুধু তাই নয়, খরচের দিক থেকেও তারা হার মানিয়েছেন এমনকি ভারতের সরকারি হাসপাতালের খরচও।

উল্লেখ্য, ভারতেও হাতেগোনা কয়েকটি হাসপাতালে টেইস করা হয়ে থাকে। লিভার ক্যান্সার চিকিৎসায় এই আধুনিক পদ্ধতির প্রয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশ ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজির এক নতুন আঙ্গিনায় প্রবেশ করেছে।

বাংলাদেশের লিভার বিশেষজ্ঞরা এখন দেশেই বাংলাদেশের লিভার ক্যান্সার রোগীদের আরএফএ ও টেইসএর মতন অত্যাধুনিক চিকিৎসা সুবিধা প্রদান করছেন যা নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক। আর তারা তা সম্ভব করেছেন পার্শ্ববর্তী ভারতের তুলনায়ও প্রায় অর্ধেক খরচে। আশা করা যায় এদেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতেও এ চিকিৎসা শীঘ্র শুরু করা সম্ভব হবে। আর তাহলে এদশের আরও অনেক বেশি লিভার ক্যান্সারের রোগী আরও অনেক বেশি উপকার পাবে।

আশাজাগানিয়া নেতৃত্বে আজকের বাংলাদেশের নতুন নতুন যে বিস্ময়কর সব অর্জন, এদেশের চিকিৎসক সমাজও তার বাইরে নন। লিভার ক্যান্সার চিকিৎসায় এদেশে আরএফএ আর টেইসএর মতো আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির সহজ প্রাপ্তি ও প্রয়োগ তাই-ই প্রমাণ করে।