যোগাযোগব্যবস্থা নিয়ে যোগসূত্রহীনতা

Published : 5 Jan 2017, 09:43 AM
Updated : 5 Jan 2017, 09:43 AM

গত ১০ ডিসেম্বর দেশে গিয়েছিলাম সরকারের আমন্ত্রণে। সফর শেষে লন্ডনে ফিরে আসি ২৫ ডিসেম্বর। দুই সপ্তাহের সফরে নিজের দেশের 'চেহারা' গভীরভাবে পরখ করার চেষ্টা করেছি। সময় স্বল্পতার কারণে খুব বেশি ঘুরতে পরিনি। সফরকালীন প্রায় সব কর্মসূচি ছিল ঢাকায়। ঢাকা ছেড়ে বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরের যানজট নিরসনের জন্য ফ্লাইওভার নির্মাণের জোর উদ্যোগ চোখে পড়ার মতো। ঢাকায় দেখা গেল এর সুফলও পাচ্ছে নগরবাসী।

তবে চট্টগ্রামের ফ্লাইওভারগুলোর নির্মাণ প্রক্রিয়া নিয়ে এখনই বলার মতো কিছু পাইনি। কারণ এর সর্বশেষ চেহারা কী হবে তা কর্তৃপক্ষ বলতে পারবে। তারপরও আমার মনে হয়েছে চট্টগ্রামের ফ্লাইওভারগুলো কিছুটা ভুল পরিকল্পনায় নির্মিত হচ্ছে। ফ্লাইওভারগুলোর সূচনা রাস্তার এক প্রান্ত থেকে আবার শেষ হয়েছে রাস্তার আরেক প্রান্তে। তাতে করে মনে হয়েছে যানজট এড়াতে গাড়িগুলোকে একই রাস্তার এক প্রান্ত থেকে নিয়ে অপর প্রান্তে ফেলছে। তাতে করে যান চলাচলের কোনো বিকল্প রাস্তা কিন্তু তৈরি হল না। ফ্লাইওভার নির্মাণ করাই হয় একটি রাস্তা থেকে বিকল্প অন্য কোনো রাস্তায় নিয়ে গিয়ে গাড়িগুলোকে নতুন গতিপথ দেওয়া; এই দৃশ্য চট্টগ্রামের ফ্লাইওভারে পরিলক্ষিত নয়।

তবে নির্মাণকাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত চূড়ান্ত কিছু বলতেও চাই না। আমি কেবল বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ততম শহর লন্ডনের বিভিন্ন ফ্লাইওভার নির্মাণের কৌশল পর্যবেক্ষণপূর্বক কিছু অসঙ্গতি তুলে ধরছি।

আমাদের পরিকল্পকারীদের এটা মনে রাখতে হবে যে, কেবল ফ্লাইওভার কিন্তু একটি শহরের যানজট নিরসন করতে পারে না। ফ্লাইওভার একটি শহরের যানজট আরও বাড়িয়েছে– এমন উদাহরণও রয়েছে। আমরা জানি, বিশেষ করে ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরের যানজট নিরসনে সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনা রয়েছে। যোগাযোগব্যবস্থার প্রভূত উন্নয়ন সাধনে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পরিকল্পনা ধীরে ধীরে বাস্তবায়িত হচ্ছে। কথা হচ্ছে এই মন্ত্রণালয় তো আগেও ছিল, কিন্তু কাজ সেভাবে হয়নি। এখন হচ্ছে কারণ, পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী নিজেই উদ্যোগী এবং অনেক বেশি সক্রিয় হয়ে মাঠে নেমে কাজ করছেন।

প্রত্যেক মন্ত্রী যদি দায়িত্ব পালনে এভাবে সচেষ্ট হন তাহলে সরকারের যে উন্নয়ন পরিকল্পনা রয়েছে তা বাস্তবায়ন অনেক বেশি ত্বরান্বিত হবে। সামগ্রিকভাবে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চোখে পড়ার মতো। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। এই যে উন্নয়ন, এর সুফল পেতে হলে অবশ্যই যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। কেননা, একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্তই হচ্ছে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন। পণ্য পরিবহন থেকে শুরু করে শ্রমশক্তির দ্রুততা নিশ্চিত করতে পারে যোগাযোগব্যবস্থা। ফলে প্রথমেই সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে অবাধে সড়কপথের যোগাযোগ। তাহলেই কেবল জনশক্তির শ্রমঘণ্টা যথাযথভাবে কাজে লাগানো সম্ভব হবে।

একটা কথার প্রচলন আছে যে, ঢাকা শহরে দিনে একটির বেশি কাজ করা সম্ভব নয়। এর জন্য দায়ী যানজট। তবে আমি এবার ঢাকায় দিনে একাধিক কাজ করেছি। তারপরও যানজটে যে বিরক্তির উদ্রেক হয়নি তা নয়। তারপরও অতীতের তুলনায় ঢাকা শহরে যানচলাচল যে দ্রুত হয়েছে, তা 'না' বলি কীভাবে? এই যে ইতিবাচক পরিবর্তন যোগাযোগের ক্ষেত্রে সূচিত হয়েছে, তা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের অর্থনীতি অচিরেই একটি পর্যায়ে উন্নীত হবে, যা বিশ্ব অর্থনীতিতে চমক দেখাবে।

তবে ঢাকা শহর নিয়ে আরও কথা আছে। অনেকেই বলে থাকেন, রিকশা বন্ধ করে দিলে রিকশাচালকরা বেকার হয়ে পড়বে। তাই রিকশা বন্ধ করার বিপক্ষে তাদের মতামত। বিষয়টি এভাবে দেখা মনে হয় ভুল। একটু খেয়াল করলেই দেখবেন, ঢাকা ও চট্টগ্রামে এখন যে যানজট তৈরি হয় তার বেশিরভাগই হয় রিকশা কারণে। মূল রাস্তা থেকে রিকশা উঠিয়ে দিলে এই যানজট কিন্তু থাকে না। এখন কথা হচ্ছে রিকশা বন্ধ করে দিলে এর চালকরা বাঁচবে কী করে?

একটি সমীক্ষা দেখেছি, তাতে বলা হয়েছে, এসব রিকশাচালক কেউ শহরে অন্য কাজ খুঁজে নেবে, নতুবা গ্রামে ফিরে যাবে। সেখানে আদি পেশা কৃষিকাজে মনোনিবেশ করবে। এই যুক্তিটি আমার কাছে খুবই কার্যকর বলে মনে হয়েছে।

কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে গ্রামে কৃষক নেই। কৃষকরা একে একে কাজের খোঁজে চলে আসছে শহরে। যাদের অধিকাংশই শহরে এসে পেশা হিসেবে বেছে নেয় রিকশা চালানো। এই শ্রেণিকে আবার কৃষিকাজে ফেরাতে হলে শহরে রিকশা বন্ধ করা অনেকটা কাজে দেবে বলে মনে হয়। তাছাড়া শহরে যানজট নিরসনের মধ্য দিয়ে কর্মঘণ্টা যথাযথভাবে যদি কাজে লাগানো সম্ভব হয় তাহলে তার ইতিবাচক প্রভাব দ্রুতই দেখা দেবে অর্থনীতিতে। অর্থনীতির গতি সঞ্চার হলে দেশে বিনিয়োগের হার বাড়বে। সেই সঙ্গে তৈরি হবে নতুন নতুন কর্মসংস্থান।

প্রসঙ্গক্রমে একটি উদাহরণ টানা যেতে পারে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে মন্ত্রী মহোদয় সিএনজি চলাচল নিষিদ্ধ করেছেন। এই খবরটি পাওয়ার পর আমি একে ইতিবাচক উদ্যোগ বলে স্বাগত জানিয়েছি। কারণ, এই উদ্যোগের মাধ্যমে যাত্রীদের প্রাণনাশের হার অনেকটাই কমেছে। আগে এই সিএনজি দুর্ঘটনায় অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর খবর আমরা পেয়েছি। চট্টগ্রামের বার আউলিয়ায় আমার নিজের ফুফাতো ভাই নিজের কন্যাসহ নিহত হন দুর্ঘটনায়। এ ধরনের অনেক ঘটনা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নিরাপত্তা প্রায় শূন্যের কোটায় নিয়ে আসে। সিএনজি উঠিয়ে দেওয়ার পর এই মহাসড়কে দুর্ঘটনার হার কমে গেছে।

সিএনজি বন্ধ করে দেওয়ার পর অনেকেই প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। প্রশ্ন তুলেছিলেন, সিএনজি চালকদের রুটি-রোজগার নিয়ে। আমি এবার সরকাররি সফরকালে দেখেছি, ওই সব সিএনজি চালক এখন একই রাস্তায় হাইস কিংবা কার চালাচ্ছেন, কেউবা অন্য পেশায় নিয়োজিত হয়েছে। ফলে যে রাস্তা ধরে একসময় চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যেতে প্রায় ছয় ঘণ্টা সময় লাগত, সেখানে এখন তিন ঘণ্টায় যাওয়া যায়। এতে করে মানুষের কাজের গতি বেড়েছে। আর সেই গতি সঞ্চারিত হচ্ছে অর্থনীতিতে।

তবে ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়ক নিয়ে কিছুটা সমালোচনাও রয়েছে। আমি ভ্রমণ করতে গিয়ে দেখেছি দ্রুতগতির যানের এই সড়কে এক একটি ইউটার্ন রয়েছে প্রায় সাত মাইল পর পর। এই যে সাত মাইল রাস্তা, সেখানে রয়েছে অন্তত পাঁচ-ছয়টি বাজার, রয়েছে লোকালয় এবং গ্রাম। তাদের ভোগান্তি বেড়েছে। তারা কাজ থেকে নিজের বাড়িতে কিংবা বাজারে আসতে হলে ওই সাত মাইল ঘুরে আবার উল্টো আসতে হয়। এতে করে সময় নষ্ট হচ্ছে এবং ব্যয় বেড়েছে। দেখা গেছে, কেউ কেউ সময় বাঁচাতে গিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উল্টোপথে গন্তব্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করে, যা কোনোভাবেই অনুমোদনযোগ্য নয়। তারপরও দেখা যায় অনেকে সেই কাজটিই করছে।

আমি সীতাকুণ্ডে নিজের গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার সময় আমার ড্রাইভারও সে কাজটি করছিল। আমি তাকে থামিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে, সে যা করতে যাচ্ছে তা কতটা ভয়াবহ। উত্তরে সে বলে, সব ড্রাইভারই একই কাজ করছে। কারণ, নিয়ম মেনে গন্তব্যে যেতে হলে আরও সাত মাইল চালিয়ে ইউটার্ন দিয়ে পার হয়ে তারপর উল্টো আবার গন্তব্যে আসতে হবে।

এ বিষয়ে কথা বলার সময় আমার গ্রামের বাজার পন্থিছিলার কয়েকজন মুরব্বি আরও ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরলেন। বললেন, রাস্তা পারাপারের কোনো ফুটওভার ব্রিজ না থাকায় প্রতিদিন শত শত মানুষ জীবন বাজি রেখে ডিভাইডার টপকে রাস্তা পার হয়। রাস্তা পার হতে গিয়ে গত এক বছরে বেশ কয়েকজন পথচারী নিহত হয়েছে। পন্থিছিলায় তিনটি মসজিদ, দুটি মাদ্রাসা, একটি এতিমখানা, একটি হাইস্কুল, একটি প্রাইমারি স্কুল এবং একটি কিনডার গার্টেনসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষ এই রাস্তায় চলাফেরা করে। কিন্তু এখানে কোনো ফুটওভার ব্রিজ করার পরিকল্পনা যোগাযোগ ও সেতু মন্ত্রণালয়ের নেই।

তালিকা অনুযায়ী ফুটওভার ব্রিজ করা হবে পন্থিছিলা থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে বটতলা নামক স্থানে। সেখানে রাস্তার পাশে একটি মসজিদ ছাড়া আর কিছুই নেই। তাহলে কেন সেখানে ওভারব্রিজ? জানলাম, ওই এলাকার একজন কৃতিসন্তান আছেন, যিনি সরকারের একজন সচিব। তাঁর ইচ্ছাতে সেখানে ওভারব্রিজটি হবে। সরকারের এই ঊর্ধতন কর্মকর্তা হয়তো দুই-তিন বছরে একবার গ্রামের বাড়িতে যান। তখন তিনি নিরাপদে রাস্তা পার হওয়ার জন্য 'স্বার্থপরের' মতো নিজ এলাকায় ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণের উদ্যোগ নিলেন! কিন্তু অদূরেই হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন যে জীবন হাতে নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে সে বিষয়টি তিনি গুরুত্ব দিলেন না! আমার বিশ্বাস, মাননীয় মন্ত্রী বিষয়টি জানেন না।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহসড়কে এ ধরনের ক্ষমতার অধিপত্য আরও থেকে থাকবে। আমরা আশা করি, মন্ত্রী মহোদয় বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখবেন। অর্থ ব্যয়ে নির্মিত হবে ফুটওভার ব্রিজ, কিন্তু তার সুবিধা যদি সিংহভাগ মানুষ নিতে না পারে, তাহলে সরকারের অর্থ ব্যয় তেমন কোনো কাজে আসবে না। অন্যদিকে এসব বিষয়ে জনগণকেও সচেতন হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে অনেক ফুটওভার ব্রিজ রয়েছে, কিন্তু সেগুলো কেউ ব্যবহার করছে না। জীবন হাতের মুঠোয় নিয়ে পার হচ্ছে রাস্তা। এটি একেবারেই অপ্রত্যাশিত।

এ থেকে বোঝা যায় সরকার যতই উন্নয়ন করুক না কেন, মানুষ যদি সচেতন না হয়, মানুষ যদি সে সুযোগ নিতে না জানে তাহলে কোনো উন্নয়নই টেকসই হবে না। ফলে টেকসই উন্নয়নের জন্য সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে। দুই সপ্তাহের সফরে গিয়ে এ বিষয়টি বেশি চোখে পড়েছে। মানুষের সচেতনতার অভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে। অন্যদিকে উন্নয়নের সুফল পেতে হলে পদ্ধতিগত (System) উন্নয়নের যে বিষয়টি রয়েছে তা-ও হচ্ছে না। এ দুটি বিষয়কে সরকার এবং জনগণকে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। তা না হলে কোনো উন্নয়ন কাজে দেবে না।