খালেদা জিয়ার উসকানির রাজনীতি

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 4 Jan 2017, 08:02 AM
Updated : 4 Jan 2017, 08:02 AM

আসিফ নজরুল ফতোয়া দিয়েছেন, গেল বছরের ব্যর্থতম দল নাকি বিএনপি। ভাবছেন সমালোচনা বা বিরোধিতা করা হয়েছে? মোটেও না। এটা 'নেগেটিভ পপুলারটি' এনে দেওয়ার বহু পুরনো তরিকা। গেল বছর কেন, বলতে গেলে বিগত দশ বছর ধরে বিএনপি আসলে ব্যর্থতার বোঝা মাথায় নেওয়া একটা দল। মাঝেমধ্যে গা ঝারা দেওয়ার নামে দেশকে অশান্ত করে তোলার ব্যর্থ প্রয়াস ছাড়া আর কী করতে পেরেছে তারা?

আগুন, জ্বালাও-পোড়াও আর টিভি বা মিডিয়ার সামনে মাইক্রোফোন হাতে কিছু নেতার বক্তৃতার বাইরে গঠনমূলক কী কাজ করেছে দলটি? অথচ আসিফ নজরুলদের মতো সুবিধাবাদীরা এখনও মনে করেন, বিএনপি-ই হচ্ছে দেশের 'সাইলেন্ট মেজরিটি'-এর প্রধান দল। সাইলেন্ট মেজরিটি নামের বোকা ও নিরীহ মানুষগুলোকে কোনোভাবে রাগিয়ে বা মাঠে নামিয়ে ফায়দা লুটতে না পারায় আজ তারা এই জাতীয় নেগেটিভ কথা বলছেন।

যেটুকু জনপ্রিয়তা বা মানুষের সমর্থন ছিল তা কাজে লাগাতে চাইলে বিএনপি সংসদে আসত। রাজনীতিতে নিয়মতান্ত্রিকতার ধারা মানত। সেটা না করার পেছনে এমাজ উদ্দিন, জাফরুল্লাহ আর আসিফ নজরুলরাই এখন খালেদা জিয়াকে চাঙ্গা করার জন্য এভাবে নেগেটিভ ছুরি শান দিতে চাইছেন!

আমরা বলি না যে, বিএনপির রাজনীতি করার দরকার নেই। দরকার অবশ্যই আছে। কিন্তু তাদের একটা সঠিক চেহারায় আসতে হবে। তারা ইচ্ছেমতো জামায়াতের সঙ্গে আবার সুযোগ বুঝে 'মুক্তিযুদ্ধের ঘোষকের দল'-এ পরিণত হতে চাইলে তা হবে না। এবং এটাই এখন তাদের জন্য 'ক্লিয়ার ম্যাসেজ'।

বিএনপির বুদ্ধিজীবীরা যে কথাটা বুঝতে পারছেন না, সেটা হল খালেদা জিয়ার দিন প্রায় শেষ। তাঁর আগের জনপ্রিয়তা বা ইমেজের ছিটেফোটাও অবশিষ্ট নেই। তা ছাড়া আওয়ামী লীগের মতো সারি সারি নেতা আর কর্মীর দলও না বিএনপি; এর জন্ম সরকারের গর্ভে। গদিতে থেকে দল করার নেতারা মারা গেলে বা গদি হারালে দল টেকে না। এটাই ইতিহাস। বরং বিএনপির ভাগ্য ভারতবিরোধিতা, পাকিস্তানপ্রীতি আর আওয়ামী লীগের দুর্বলতার কারণে এখনও তারা মিডিয়া ও একশ্রেণির মানুষের কল্যাণে বহাল তবিয়তে টিকে আছে। বিএনপি নেত্রী কম কথা বলেন এমন ধারণা আমরা মানি বটে, বুঝতে পারি না কেন? বললে আসলে তিনি কী বলেন?

বেগম জিয়া প্রায়ই নীরব থাকেন। একসময় তাঁর এই নীরবতা বা চুপ থাকা তাঁর ইমেজ তৈরিতে যথেষ্ট সাহায্য করেছিল। বিপরীত প্রান্তে থাকা আওয়ামী লীগ নেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সবসময় সরব। যাঁরা সরব বা মুখ খোলা রাখেন তাঁদের অন্তর সরল হলেও মুখের কথা মাঝেমধ্যে বিপদে ফেলে বইকি। শেখ হাসিনা সোজাসাপ্টা, সরাসরি কথা বলেন বলে প্রায়ই সমালোচনার মুখে পড়েন। তাঁকে পছন্দ করতে না পারা মুক্তিযুদ্ধ ও প্রগতিবিরোধীরা এর সুযোগ নিয়েছে বহুবার। অন্যদিকে তাদের মুখে বলতে না পারলেও মনের ভেতরে থাকা খালেদা জিয়াকে তারা চুপ থাকতে বলে। কারণ, মুখ না খুললে অনেক কথা বের হয় না আর বের না হলে বোঝা যায় না কী বলছেন, কেন বলছেন, কাকে বলছেন?

সেদিন এখন বিগত। শেখ হাসিনা এখন অনেক পরিণত। তাঁর সঙ্গে পাল্লা দিতে হলে খালেদা জিয়াকেও কিছু বলতে হবে। আমি বলি না যে, তিনি বলেন না। মাঝেমধ্যে লাগসই কথা বলে খালেদা জিয়া বেশ চমক তৈরি করেন। তবে তিনি যে মুখ খোলেন না সেটা আসলে তাঁর দল ও নিজের জন্যই মঙ্গলের। অনেকদিন পর যাও মুখ খুললেন তাও কিন্তু স্রেফ উসকানি।

বিএনপির নেতৃত্ব কতটা দিশেহারা সেটা মীর্জা ফখরুলের কথা শুনলে আর মওদুদদের চেহারা দেখলেই বোঝা যায়। তাঁরা না পার‍ছেন কোনো উত্তেজনা তৈরি করতে, না মানুষকে মাঠে নামাতে। বদলে যাওয়া বাস্তবতায় মানুষ আর আগের মতো মাঠে নেমে রাজপথে রাজনীতির জন্য জান দেবে না। সেটা বিএনপি টের পেলেও মানতে পারছে না। তাদের জ্বালাও-পোড়াও মানুষের জান নিয়ে খেলার জবাব দিয়েছে এ দেশের নিরাপত্তা বাহিনী। অন্যদিকে জনগণের মনেও তৈরি হয়েছে বিরূপ ধারণা। তারপরও গদির লোভ বলে কথা! বিএনপি নেত্রী সম্প্রতি ছাত্রদলের সভায় তাঁর মুখ খুলে আবারও প্রকাশ্যে উসকানি দিতে ভুল করেননি।

ছাত্রদলের এখন সময় খারাপ। 'যুবরাজ' লন্ডনে যাওয়ার পর থেকে ছাত্রদলের তেমন কোনো কার্যক্রম নেই। শিবিরের ছেলেরা মাঠে-ময়দানে ঝামেলা পাঁকালেও ছাত্রদল নেই। তারা গৃহবন্দি অথবা আত্মগোপনে। অনেকদিন পর যাও নেত্রীর সামনে স্লোগান দিল খালেদা জিয়ার তা ভালো লাগেনি। খবরে দেখলাম, তিনি তাদের ভালোই শাসিয়ে দিয়েছেন। জানিয়ে দিয়েছেন, রাজপথে থাকার স্লোগান দিলেও ঠিক সময়ে তাদের নাকি দেখা মেলে না। তবে উসকানিটা এসেছে অন্য ভাষায়। তিনি তাদের বলেছেন:

"জনপ্রিয়তা থাকলে হবে না। গদিতে যাওয়ার রাস্তা ক্লিয়ার করার জন্য যা যা করার সব করতে হবে।"

কথাটা ভেবে দেখার মতো। এই যে যুবসমাজ বা ছাত্ররা– তারা কোনো দল বা কাউকে গদিতে যাওয়ার জন্য আসলে কী করতে পারে? তারা নিশ্চয় অন্যের ভোট নিজেরা দিতে পারবে না। পারবে না আওয়ামী লীগকে টেনেহিঁচড়ে গদি থেকে নামাতে। তাহলে কী করতে বলছেন খালেদা জিয়া? এর মানে তিনি চাইছেন তারা এমন সব কাজ করুক বা নৈরাজ্য তৈরি করুক যাতে সরকার টিকতে না পারে!

এই জাতীয় কথা আসলেই রাজনীতির জন্য অপমানজনক। এবং এ কারণেই মানুষ রাজনীতির ওপর বিরক্ত। খালেদা জিয়া একটু ভেবে দেখলেই বুঝতেন, তাঁর দল বা বিএনপির আক্রমণাত্মক নীতি ও রাজপথে সন্ত্রাস মানুষ নেয়নি, বরং সে কারণে সরকারের নানা নেগেটিভ কাজের পরও জনগণের মনোভাবে চিড় ধরেনি। অথচ এসব বিবেচনা ব্যতিরেকে খালেদা জিয়া ছাত্রদলকে খামোখা উসকে দিলেন।

জানি, এতে কারো কোনো লাভ নেই, লোকসানও নেই; সরকারেরও না। তারপরও আমরা জাতির স্বার্থে মানুষের স্বার্থে আর দেশের কল্যাণে এমন রাজনীতি চাই যা দেশ ও জনগণকে নিরাপদে রাখবে। সরকার আসবে, সরকার যাবে। গদি কারো নিজস্ব সম্পত্তি না। দেশ শাসনের অধিকারও কোনো দলের নিজস্ব বিষয় হতে পারে না। কিন্তু বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সুযোগ মিললেই উসকানির কাজটি করতে কসুর করে না।

এতদিন পর বিএনপি যখন আসলেই কোণঠাসা আর দল যখন মরিয়া তখন সঠিক দিকনির্দেশনার পরিবর্তে এমন বক্তব্য মূলত রাজনীতির দীনতা আর কুরুচির পরিচায়ক। আমরা কি এর কবল থেকে কখনও মুক্ত হতে পারব না? এখন তো দেখছি এরা যত নীরব থাকেন ততই মঙ্গল! রাজনীতিতে মুখ খোলা মানে কি কেবলই বিপদ টেনে আনা, না গৃহযুদ্ধ লাগিয়ে দেওয়া?

উন্নয়নের যে পথ দেশ খুঁজে পেয়েছে তার সঙ্গে দেশের রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই, বরং খালেদা জিয়ার এবারের বক্তব্য আর আসিফ নজরুলদের উসকানি মিলে নতুন দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের ভয় দেখাচ্ছে! সঙ্গে আছে আওয়ামী লীগের নেতাদের 'বাজে' ভূমিকা।

সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এখন তাঁর পদের আনন্দে বিভোর! হঠাৎ হঠাৎ এমন সব কাণ্ড করেন আর কথা বলেন যাতে আমরা চমকে উঠি। তিনি বলেছেন, শেখ হাসিনার কিছু হলে সারা দেশে নাকি আগুন জ্বলে উঠবে। সরকার প্রধানের কোনো জাতীয় কিছু হলে দেশে তার দল আগুন জ্বালাতে চাইবে– এটা একটি শিশুও বলতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, এমন আতংক সরকারি দলের সম্পাদকের মনে বাসা বাঁধল কী কারণে? আর ইতিহাস থেকে আমরা কী পাঠ নিয়েছি? অঘটন ঠেকানো, না অঘটন ঘটে গেলে মাতম করা? বঙ্গবন্ধুর আমলে দেয়াল লিখন ছিল:

"দরকার হলে আলেন্দের মতো রক্ত দেব তবু মাথা নিচু করব না।"

অথচ রক্তপাত ঠেকানোর চেষ্টা করা হয়নি সেসময়। বলা উচিত ছিল, "আলেন্দের কাছ থেকে শিখেছি, রক্তপাত হতে দেব না আমরা।"

ঠিক একইভাবে আজ আবার কিছু হলে আগুন জ্বলবে শুনে ভয় জাগে আমাদের মনে! সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক মানুষকে আশা ও ভরসা দেওয়ার পরিবর্তে ভয়ের কথা জানিয়ে বিএনপির ব্যর্থতার রাজনীতিকেই কি সার্থকতার মুখ দেখাচ্ছেন না?

আমরা এ দেশে শান্তি ও সহমর্মিতার রাজনীতি চাই। আমরা খালেদা জিয়ার কাছ থেকে তাঁর বুদ্ধিজীবীদের কাছে হিংসা ও ঘৃণার বিপরীতে জনকল্যাণের কথা আশা করি। আর সরকারি দলের কাছে চাই আশা ও শান্তির নিরাপত্তা। রাজনীতিই আর কত পচলে তারপর ঘুরে দাঁড়াতে শিখবে?

নতুন বছরে কি এতটুকুও আশা করতে পারব না আমরা?