কবন্ধ পুতুল, মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা ও রাজনৈতিক দলের ভূমিকা

গোলাম কিবরিয়া পিনুগোলাম কিবরিয়া পিনু
Published : 30 Dec 2016, 12:35 PM
Updated : 30 Dec 2016, 12:35 PM

একের পর এক নৃশংস হত্যাকাণ্ড হয়েছে, তা যে মহলই এসব ঘটাক না কেন, তারা শুভবুদ্ধির কেউ নয়; তারা ধর্মের নয়, মানুষ পরিচয়দানকারী মনুষত্বের অধিকারীও নয়। তারা যে সূচিভেদ্য অন্ধকার টেনে এনে এ দেশের ভবিষ্যৎ আরও অন্ধকারময় করে তুলতে চেয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

তাদের ছুরির তলায় থেকে লেখক-প্রকাশক, পুলিশ, ধর্মীয় নেতা ও সাধারণ নাগরিক শুধু জীবন হারায়নি, তাদের ছুরির তলায় রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, যুক্তিবাদ, সহনশীলতা, ধর্ম ও শুভ-কল্যাণকর যাবতীয় উদ্যোগ। যারা এসব করছে, তারা অন্ধ শুধু নয়, কবন্ধ পুতুলও। তাদের মস্তিষ্ক নেই; তাই বোধ নেই, বিবেচনা নেই।

ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞ শুধু নয়, যারা ধর্ম সম্পর্কে অপব্যাখ্যা দিয়ে নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থ হাসিল করছে কিংবা ক্ষমতালোভী হয়ে বিভিন্ন মহলের সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করছে, তাদেরই পুতুলে পরিণত হয়ে ভূমিকা রাখছে। এরা শুধু পুতুলই নয়, রোবটীয় পুতুলে পরিণত হয়েছে। তাই তারা আরও ভয়াবহ! এরা তৈরি হচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে, প্রতিষ্ঠানে, আনাচে-কানাচে।

সরকারের এসব পুতুলের হাত থেকে লেখক-প্রকাশক, পুলিশ, ধর্মীয় নেতা ও সাধারণ নাগরিকদের বাঁচাতে যে সামর্থ্যের পরিচয় দেওয়ার কথা ছিল, তা অনেক সময় অনেক ক্ষেত্রে পারেনি। সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের জোরালো প্রচেষ্টার উন্নতি হয়েছে বলে দৃশ্যমান হচ্ছে। অন্তত এ ক্ষেত্রে আরও জোরালো ধারাবাহিক ভূমিকা রাখার বিকল্প নেই। এ জন্য বিশেষ আইন ও আইন ব্যবস্থাপনা জরুরিভাবে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন।

বিচারের দীর্ঘসূত্রতা ছাড়াও মনোযোগ ও আগ্রহ সরকারের বাড়ানো দরকার। এ ক্ষেত্রে সরকারে দৃষ্টিভঙ্গি ও দোদুল্যমানতা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। আওয়ামী লীগ ভুলে গেছে যে, তারা এসব মহলকে প্রতিরোধের অঙ্গীকার নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে। তারা এখন বলছে, বাংলাদেশকে 'মধ্যম আয়'-এর দেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ঠিক আছে! তারা কি উপলব্ধি করতে পারছে না যে, দেশটা মধ্যযুগে ফিরে যাওয়ার অনেক প্রবণতা নিয়ে এখনও বিপদসংকুল হয়ে আছে?

এই বিপদের ধারাবাহিকতায় অনেক হত্যাকাণ্ড আর বেদনাদায়ক পরিস্থিতি মুখোমুখি হতে হয়েছে আমাদের! এসব কঠোরভাবে মোকাবেলা করতে না পারলে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকে বাংলাদেশ এক বেদনাদায়ক দেশে পরিণত হতে পারে!

জঙ্গিদের তৎপরতায় কার কী লাভ হচ্ছে, তা জটিল অংকের বিষয় হলেও এ ধরনের তৎপরতা যে অসহায় ব্যক্তিজীবনকেও বিপদের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে তা আমরা সহজভাবেই বুঝতে পারি। বিভেদ টেনে এনে ধর্মীয় অপব্যাখ্যা করে তরুণদের বিপদগামী করা হচ্ছে, এর ফলে বিপদের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে তরুণের পরিবার, তার সমাজ, তার ধর্ম ও তার দেশ!

এই পরিণতি যত জটিল হবে ততই জীবনের মূল্য কমে যাবে, মানুষের জীবন হবে আরও অনিরাপদ। দেশে ও দেশের বাইরের কুচক্রিরা আরও জাল ফেলে আমাদের অর্জন ও সম্ভাবনা নষ্ট করে নিজেদের স্বার্থ পূরণে আরও সফল হবে। সে কারণে জঙ্গিদের এই তৎপরতা ভয়াবহভাবে অন্ধকারের বিষয়ে পরিণত হয়েছে; এই অন্ধকারে পতিত হয়ে জঙ্গিরা আরও অন্ধ হয়ে পড়েছে, তাদের মস্তিষ্ক থেকে স্বাভাবিকবোধও লুপ্ত হচ্ছে, তারা কবন্ধ পুতুলে পরিণত হচ্ছে!

জঙ্গিদের আওতা থেকে দেশকে রক্ষা করতে হলে রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ধর্মীয় সংগঠনসহ শুভবোধসম্পন্ন মানুষকে তৎপর হতেই হবে। বড় বেশি বিস্তৃত ব্যাখ্যা না করে বলা যায়, এখন হয়তো সরকার ও সরকারি দলের টনক কিছুটা নড়ছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের মতো প্রাচীন রাজনৈতিক দলটি তাদের লাখ লাখ কর্মীদের জঙ্গি তৎপরতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য দলীয়ভাবে কোনো দৃষ্টিভঙ্গি জোরালোভাবে গড়ে তুলতে পেরেছে কি? তাদের কর্মীদের সচেতনার স্তর কোন পর্যায়ে তা-ও হয়তো অনেকে আমরা জানি।

আওয়ামী লীগ যদি শুধু সরকারে অবস্থান নেওয়ার পর শুধু ক্ষমতায় থাকার সংকীর্ণ দৃষ্টি নিয়ে তার দল ও কর্মীদের অনেকাংশে ব্যবহার করে, তবে তা হবে দুঃখজনক। আমাদের মনে হয়েছে, তারা যদি নিজেদের কর্মীদের ক্ষমতা থাকার এই কয়েক বছরে রাজনৈতিকভাবে শিক্ষিত করতে পারত ও জনগণের আস্থা বাড়াতে পারত, তাহলে জঙ্গিদের ভিত্তিমূল আরও দুর্বল হয়ে পড়ত। একটি রাজনৈতিক দল শুধু কি সেই দলের একটি গোষ্ঠীর কায়েমি স্বার্থ রক্ষার জন্য ব্যবহৃত হবে?

আওয়ামী লীগ যদি জরুরি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও সুচারু সাংগঠনিক কার্যক্রমের মাধ্যমে মতাদর্শগত সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে পাড়ায়-মহল্লায়, গ্রামে-ইউনিয়নে, শহরে-বন্দরে জঙ্গিবিরোধী পদক্ষেপ গ্রহণ করে তাহলে এই বিপদ মোকাবেলার জন্য জনগণও উৎসাহিত হবে।

কাজটি শুধু স্বল্পমেয়াদি ও তাৎক্ষণিক কার্যক্রম দিয়ে মোকাবেলা করা যাবে না। সে জন্য আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের বোধোদয় হতে হবে। তারা যদি জঙ্গিদের সৃষ্ট পটভূমি কাজে লাগিয়ে ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে চায়, তাহলে তারা নিজেদের পায়ে শুধু কুড়াল মারবে না, সেই কুড়াল এক সময়ে তাদের মস্তকও নামিয়ে ফেলবে!

আমাদের আত্মসমালোচনা করতেই হবে। তা খারাপ লাগতে পারে অনেকের, তবু। আমাদের চোখের সামনে দেখছি, আমাদের অনেকের চেয়ে অনেক কম ভূমিকা রেখেও মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নিয়ে ভাতা তুলছি, সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করছি। অথচ এদের অনেকে বেশ স্বচ্ছল ও সমাজে বেশ সুবিধাপ্রাপ্ত। অনেকে প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধ না করেও মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নিয়ে সংবর্ধনা নিচ্ছি, তা-ও আমাদের চোখের সামনে দেখেছি বা দেখছি! আরও দেখলাম প্রত্যক্ষ যুদ্ধ করার পরও অনেকের সার্টিফিকেটই নেই। আমরা ভাবছি 'মুক্তিযোদ্ধা' কারা?

মুক্তিযুদ্ধ ছিল বহুমাত্রিক। মুক্তিযুদ্ধ তো সাধারণ মানুষই করেছে। মুক্তিযুদ্ধ মানেই গোলাগুলি শুধু নয়। মুক্তিযুদ্ধে কতজনের কত রকমের ভূমিকা, কতজনের কত ধরনের আত্মত্যাগ! কতভাবে অংশগ্রহণ! গুটিকয়েক লোক ছিল, যারা চিহ্নিত রাজাকার-আলবদর ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারী। আর অন্যরা বহুভাবে বহুস্তরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। সেসব বিস্তৃত ভূমিকা মুক্তিযুদ্ধের কণ্ঠলগ্ন হয়ে আছে।

যিনি আহত হয়েছেন, যিনি স্বজন হারিয়েছেন, যাঁর ঘর-বাড়ি লুঠ হয়েছে, সর্বস্ব হারিয়ে হয়েছেন সর্বহারা, যে খাদ্য দিয়েছেন, আশ্রয় দিয়েছেন নিরাশ্রয়দের, যিনি অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন, তাঁদের কি কোনো অবদান নেই মুক্তিযুদ্ধে?

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ মানেই হল বেশিরভাগ মানুষের সম্মিলিত অংশগ্রহণ। আর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ মানে প্রথম থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ গণমানুষের অংশগ্রহণের দৃঢ় অবস্থানের ইতিহাস, তা শুধু কয়েকজনের নয়। একদিক থেকে তাঁরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। জনগণের সেই সম্মিলিত ও বিস্তৃত ভূমিকাকে খণ্ডিত করে শুধু কিছু সার্টিফিকেটের আওতায় মধ্যে সীমাবদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাকে বিবেচনা করা মুক্তিযুদ্ধের বহু বিস্তৃত পটভূমি ও তাৎপর্য় অনেকাংশে সংকুচিত ও ম্লান করা হয় বলে মনে করি।

বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল অনন্য ও গণমানুষের গণযুদ্ধ। এই মুক্তিযুদ্ধকে সংকীর্ণ ও একরৈখিকভাবে মূল্যায়ন করা কোনোক্রমেই ঠিক হবে না।

যখন থেকে সার্টিফিকেট-নির্ভর মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় টেনে নিয়ে সুবিধা বিলানোর উদ্যোগ নেওয়া হল, তখন থেকেই মুক্তিযুদ্ধকে সংকীর্ণ গলির মধ্যে ঠেলে দেওয়া হল! আর এই কারণে পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে যারা ক্ষমতা দখল ও ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার চেষ্টা করেছে, তারাই প্রথম 'মুক্তিযোদ্ধার সাইনবোর্ড' ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করার চেষ্টা করেছে। এ ক্ষেত্রে সুবিধাবাদী 'মুক্তিযোদ্ধা' নামধারী কিছু লোক ব্যবহৃত হয়েছে ক্ষমতার পাটাতনে বসা লোকদের স্বার্থে। এই প্রবণতা এখন আর চলতে দেওয়া ঠিক নয়।

মুক্তিযোদ্ধার অর্ন্তনিহিত মানে হল দেশমাতৃকার জন্য আত্মত্যাগ, জনগণের মুক্তির জন্য লড়াই করে জীবন দান করার মানসিকতা ও গৌরবময় ভূমিকা পালন করার ইচ্ছা ইত্যাদি– এটাই তো তাঁর ইমেজ। এই ইমেজের বাইরে 'মুক্তিযোদ্ধা'র নামে কিছু আমলা ও সুবিধাভোগীদের আরও সুবিধা দিয়ে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের ইমেজ কাদামাখা করা হয়েছে এবং হচ্ছে।

মুক্তিযোদ্ধাদের সংকীর্ণ পোশাকি অবস্থানে ঠেলে দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সীমাবদ্ধ করা সমীচীন নয়। তা মানাও যায় না! এর ফলে আত্মত্যাগের মহিমা দূরে ঠেলে দিয়ে সুবিধামুখী প্রতিকৃতির পরিচয় মেলে ধরে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের ভূমিকা নতুন প্রজন্ম ও ইতিহাসের কাছে ছোট করা সমীচীন নয়। এটা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধার গৌরব কাদামাখা করারই শামিল!

কবন্ধ পুতুলদের সম্পর্কে সচেতন হয়ে একদিকে কঠোর হাতে হত্যাকাণ্ড ও অমানবিক তৎপরতা মোকাবেলা করা প্রয়োজন, অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের দৃষ্টিভঙ্গিজাত দর্শন সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নিয়ে দেশের মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ভূমিকা পালনের বিকল্প নেই।

স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, প্রতিষ্ঠান, পাড়া-মহল্লা, গ্রাম-গঞ্জ এবং অন্য সব পর্যায়ে রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ভূমিকা পালনের জন্য মুক্তিযুদ্ধ ও উদার গণতান্ত্রিক ধারার সব ধরনের সংগঠনকে নিরবিচ্ছিন্ন ভূমিকা পালন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সময়োপযোগী যোগাযোগ, কৌশল ও সাংগঠনিক ভূমিকা পালন করতে হবে। চোখ-কান খোলা রেখে সৃজনশীলভাবে জোরালো ও সময়োপযোগী ভূমিকা পালনের জন্য নড়েচড়ে বসতে হবে।