রোহিঙ্গা আখ্যান: অস্তিত্বের বিপন্ন বিস্ময়

দেবপ্রসাদ দেবু
Published : 24 Dec 2016, 06:30 AM
Updated : 24 Dec 2016, 06:30 AM

১.

'রোহিঙ্গা'– বিশ্বমিডিয়ায় আলোচিত একটা নাম। নামটি শুনলেই আমাদের চোখে ভেসে আসে নিপীড়িত একটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর করুণ প্রতিচ্ছবি। যে জনগোষ্ঠীর মানুষেরা স্রোতের টানে বা ধাক্কায় কেবল ভেসেই চলেছে যুগের পর যুগ, সাঁতরে ভাঙায় ভেড়ার ফুসরত পাচ্ছে না। ধর্মীয় বিশ্বাসে এবং প্রথায় এরা ইসলামের অনুসারী। আইলান কুর্দিও তাই ছিল। কদিন আগে নাফ নদীর তীরে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা রোহিঙ্গা শিশু তোহাইত'ও তাই। আইলানরা মুসলিম হবার পরও 'ইসলামিক স্টেটে'র ধাক্কায় ভূমধ্যসাগরের তীরে মুখ থুবড়ে পড়তে হয়েছে– আবার তোহাইতরাও নিপীড়িত মুসলিম হবার কারণেই।

না, আমি সাম্প্রদায়িকতা খুঁজে নিয়ে সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিতে কথাটা বলছি না। তোহাইতদের পূর্বপুরুষরা ঠিক মুসলিম পরিচয়েই 'স্বাধীন আরাকান' অঞ্চল গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন ধর্মের ভিত্তিতে, অর্থৎ, ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ। বার্মার ইতিহাসে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের যে সূচনা আমরা দেখতে পাই সেখানে স্লোগান ছিল Burma for Burmese– কিন্তু ব্রিটিশরা সুকৌশলে সেটাকে ঠেলে দেয় Burma for the Buddist Burmansএর দিকে।

সেই সময় আরাকান অঞ্চলের মুসলমানরা ঠিক রোহিঙ্গা মুসলিম নামে ব্যাপক পরিচিত ছিল না। যদিও ১৭৯৯ সালে ড. ফ্রান্সিস হেমিলটন বুচম্যান Comparative Vocabulary of some of the languages spoken in Burma Empire বইতে উল্লেখ করেছেন মোহাম্মদীন সম্প্রদায়ের লোকজন, যারা দীর্ঘদিন ধরে আরাকান অঞ্চলে বসতি গড়ে আছে তারা নিজেদের রোইঙ্গা (Rooinga) নামে পরিচয় দেয়। রোহিঙ্গা শব্দটির বিস্তৃতি মূলত নব্বই দশকের গোড়ার দিক থেকেই। এর আগের একাডেমিক রেফারেন্সগুলোতে এদের আরাকান মুসলিম বা রাখাইন মুসলিম হিসেবেই বেশি চিহ্নিত করা হয়েছে।

আমরা যদি ইতিহাসের দিকে নির্মোহভাবে তাকাই তাহলে দেখতে পাব তৎকালীন আরাকান অঞ্চলে মুসলমানদের যাওয়া হয়েছিল মূলত ভাগ্যের অন্বেষণে– কখনো-বা দাস বা শ্রমিক হিসেবে এবং সেটা তৎকালীন বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকেই। নবম (মতান্তরে সপ্তম) দশক থেকেই এদের যাত্রা শুরু। পরবর্তীতে আরবীয় বা পার্সিয়ান বণিকরাও এদের শ্রম-ঘামের ফসল তুলেছে। কাউকে কাউকে বিশ্ব দাসবাজারে বিক্রিও করে দেওয়া হয়েছে চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে।

বার্মা তথা মিয়ানমারের ইতিহাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ বছর হচ্ছে ১৮২৪। ১৮২৪ থেকে ১৮২৬ পর্যন্ত ব্রিটিশদের সঙ্গে বার্মার প্রথম যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং বার্মা তার আরাকান অঞ্চলের দখল হারায় ইংরেজদের কাছে। সেই সময় অর্থাৎ, ১৮২৫ সালে রাখাইন বা আরাকান অঞ্চল কৃষি, বিশেষত ধান চাষের জন্য প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে এবং চট্টগ্রামের নিম্নআয়ের মানুষ অধিক মজুরির আশায় সেই অঞ্চলে বসতি গড়ে বলেও প্রমাণ মেলে এক আমেরিকান মিশনারির লেখায়। রিভারেন কমস্টক নামের এই ভদ্রলোক ১৮৩৪ থেকে ১৮৪৪ সাল পর্যন্ত রাখাইন অঞ্চলে ছিলেন। তিনি লিখেছেন–

বিগত কয়েক বছরে অধিক মজুরি কিংবা আরেকটু ভালো থাকার আশায় চট্টগ্রামের মানুষ বসতি গড়েছিল রাখাইন অঞ্চলে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, ব্রিটিশরা আরাকানের দখল নেওয়ার পর আরাকানের পতিত জমি আবাদ করার জন্য আরাকান পতিত জমি অধ্যাদেশ আইন ১৮৩৯ এবং ১৮৪১ এবং পেগু পতিত জমি অধ্যাদেশ আইন ১৮৬৫ ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক জারি করা হয়। যেই অধ্যাদেশের আওতায় ব্রিটিশ সরকার চট্টগ্রাম থেকে বহু লোককে আরাকানে এনে পতিত জমি বিতরণ করে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে।

[সূত্র: "রোহিঙ্গা জাতির ইতিহা " , এন এম হাবিব উল্লাহ]

এছাড়াও রাখাইন বা আরাকান অঞ্চলের জনসংখ্যার যে নির্ভরযোগ্য তুলনামূলক চিত্র আমরা পাই তাতে দেখা যাচ্ছে যে, ১৮৬৯ সালের আদমশুমারি অনুসারে রাখাইন অঞ্চলের মোট জনসংখ্যা ছিল ৪,৪৭,৯৫৭ জন, যার মধ্যে ২৪,৬৩৭ জনকে দেখানো হচ্ছে 'মোহাম্মদীন' হিসেবে; অর্থাৎ, ইসলাম ধর্মের অনুসারী হিসেবে। যেটা মোট জনসংখ্যার ৫ শতাংশ। তখন ইসলামের অনুসারীরা মূলত আকিয়াব (Akyab) [তৎকালীন আরাকান অঞ্চলের রাজধানী] অঞ্চলেই বেশি বসবাস করত এবং সেটা ঐ অঞ্চলের মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ। আবার ১৯১২ সালের আদমশুমারি অনুসারে আকিয়াব অঞ্চলের মোট জনসংখ্যা পাওয়া যায় ৫,২৯,৯৪৩ জন, যেখানে বাংলাভাষী মুসলিম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল ১,৮১,৫০৯ জন, অর্থাৎ ৩৪ শতাংশ।

দেশীয় সীমানা সুরক্ষার ক্ষেত্রে বর্তমানের মতো কড়াকড়ি না থাকায় নাফ নদী পার হয়ে সহজেই প্রান্তিক মানুষ ওপারে বসতি গড়েছে কৃষিনির্ভর জীবনের জন্য অধিক অনুকূল এলাকা হিসেবে। প্রাসঙ্গিকভাবে আরও মনে করা যেতে পারে যে, ব্রিটিশ কলোনিয়াল সময়ের দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা এবং রাখাইন অঞ্চল একই পলিটিক্যাল কনস্টিটিউন্সিতে ছিল।

১৯৩৭ সালের এপ্রিল মাসে ব্রিটিশ ভারতের সঙ্গে বার্মার প্রশাসনিক বিচ্ছেদ ঘটে। এমনটা হবে সে আভাস আগেই ছিল। ফলে ঐ অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে, বিশেষত যারা বসতি গড়েছে আরাকান অঞ্চলে, তাদের মধ্যে নতুন সামাজিক, রাজনৈতিক চিন্তা দানা বাঁধতে শুরু করে এবং সেটা পৃথক কিন্তু ঐক্যবদ্ধ জাতিগত কিংবা ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তি ধরে। ১৯৩৬ সালে গঠিত হয় জামাত রোহিঙ্গা উলেমা পরিষদ। সম্প্রদায়গত জোটবদ্ধতার আউটপুট হিসেবে ১৯৪২ সালে সংঘটিত হয় ভয়ংকর বৌদ্ধ এবং মুসলিম দাঙ্গা।

আমরা ফিরে দেখতে পারি সমসাময়িক জেমস বক্সটারের ইন্ডিয়ান ইমিগ্রেশন রিপোর্ট, যেটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪১ সালে। সেটিতে তিনি দেখিয়েছেন, আরাকান অঞ্চলের ৫০ ভাগ অধিবাসী ভারতীয় অঞ্চল থেকে বসতি-গাড়া জনগণ এবং সেখানে বাংলাভাষী জনগণের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ। আবার এদের আশি ভাগেরই জন্ম আরাকান অঞ্চলেই। সেই রিপোর্টে বক্সটার আশংঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে, ভবিষ্যতে এই বসতি-গাড়াদের নিয়ে কমিউনাল সমস্যা তৈরি হতে পারে যদি এখনই সঠিক সিদ্ধান্ত না নেওয়া হয়।

বক্সটারের সেই আশংঙ্কা মিথ্যা হয়নি। '৪৭এর দেশভাগের পর রাখাইন অঞ্চলের মুসলমানরা প্রথমে ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত 'মুসলমান রাষ্ট্র পাকিস্তান'এর সঙ্গে যেতে চেয়েছে। সেই লক্ষ্যে ১৯৪৭এর এপ্রিল মাসে রোহিঙ্গা সংগঠনের প্রতিনিধিরা মোহাম্মদ আলি জিন্নাহর সঙ্গে যোগাযোগ করে, কিন্তু জুলাই মাসে আং সান এবং জিন্নাহ একমত হন যে, নাফ নদীর ওপারের সীমানা নিয়ে নতুন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না পাকিস্তানের পক্ষ থেকে। ফলে লাহোর প্রস্তাবের মুসলিম 'স্টেটস' পাকিস্তান নামক 'স্টেটে' এসে থেমে যায়।

এদিকে রাখাইন অঞ্চলের মুসলমানরা মূলত তখন থেকেই নিজেদের আলাদা নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী হিসেবে জাহির করানোয় মনোযোগ দেয় এবং প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে, চট্টগ্রামের সঙ্গে ভাষাগত অনেকাংশে মিল থাকলেও এরা আলাদা নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী এবং পাকিস্তানের আদলে আলাদা মুসলিম রাষ্ট্র গড়ে পুরোনো আরাকান রাজ্য উদ্ধারের সংগ্রামে লিপ্ত হয়।

তৎপরবর্তী সময়ে স্বাধীন আরাকান অঞ্চল বা রোহিঙ্গা অঞ্চল গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিভিন্ন সংগঠন গড়ে উঠে ওই অঞ্চলে। এদের অন্তর্দ্বন্দ্ব ছিলো বলেই বিভক্তি বাড়তে থাকে এবং সংগঠনের সংখ্যাও বাড়ে। ১৯৬৩ (মতান্তরে ১৯৬৪) সালে গঠিত হয় রোহিঙ্গা ইন্ডিপেনডেন্ট ফোর্স (আরআইএফ)। পরে, ১৯৬৯ সালে গঠিত হয় রোহিঙ্গা ইন্ডিপেনডেন্ট আর্মি (আরআইএ), যেটি আবার ১৯৭৪ সালে রোহিঙ্গা পেট্রিয়িটিক ফ্রন্ট বা আরপিএফ নামে রূপান্তরিত হয়।

এ রকম বিভিন্ন সংগঠন গঠিত হলেও মিয়ানমারের মধ্যবিত্ত রোহিঙ্গাদের একটা অংশ মিলিট্যান্ট এসব সংগঠনের প্রতি আস্থা রেখেছিল এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না। তারা বরং মিয়ানমার রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত থেকেই অন্য দশজন নাগরিকের মতো অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার পক্ষে ছিল বলে একাডেমিক রেফারেন্স পাওয়া যায়।

উপরের সমস্ত একাডেমিক রেফারেন্স রোহিঙ্গাদের চট্টগ্রাম অরিজিনকে নির্দেশ করলেও ১৯৯২ সালে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের একটি রিপোর্টে রাখাইন অঞ্চলের কয়েকজন রিফিউজি মুসলমানের ভাষ্য ছিল, তাদের পূর্বপুরুষ হচ্ছে আরবীয় এবং পার্সিয়ান বণিক, যারা এই অঞ্চলে এসেছিল কয়েক শত বছর আগে এবং তারা দাবি করে যে, তারা বাঙালি অরিজিন নয়।

২.

এবার দেখা যাক এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রতি কী আচরণ হচ্ছে মিয়ানমারে। মার্টিন লুথার কিং বলেছিলেন,

The best way to solve any problem is to remove its cause.

আবার আং সান সু চিও বলেছেন–

If you want to bring an end to long-standing conflict, you have to be prepared to compromise.

কিন্তু তাঁর সরকার বা মিয়ানমারের অতীত সরকারগুলো কি এই থিওরিতে চলেছে? বা চলছে? 'ওয়াশিংটন পোস্ট' পত্রিকায় প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে সু চি বলেছেন–

The govt. is now verifying the citizenship status under the 1982 citizenship law. I think they should go about it very quickly.

১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনটি যদি ভিত্তি ধরা হয় রোহিঙ্গাদের ভাগ্য নির্ধারণে, তাহলে সেই আশায় গুড়ে বালি। কেননা সেই আইনে নাগরিকত্ব পাওয়ার ভিত্তি বছর ধরা হয়েছে ১৮২৩। বলা হয়েছে যে, ১৮২৩ সালের আগে যারা মিয়ানমারের স্থায়ী অধিবাসী ছিল তারাই মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হবে। ১৮২৩ সালকে ভিত্তি বছর ধরার পেছনে কারণ হচ্ছে, ১৮২৪ সালে ইংরেজদের সঙ্গে বার্মার প্রথম যুদ্ধ হয়েছিল এবং সেটিতে মিয়ানমার পরাজিত হয়ে আরাকান অঞ্চলের অধিকার হারিয়েছিল। ১৮২৩ সালের আগেও অনেক মুসলিম আরাকান অঞ্চলে বসতি গড়েছে, তবে মূল স্রোতটা ১৮২৬ সাল থেকেই।

একটা দেশের নাগরিকত্ব আইন, যেটা প্রণয়ন হয়েছে ১৯৮২ সালে, সেটাতে কখনও ১৫৯ বছরের অতীত ভিত্তি ধরে করা যেতে পারে না। কেননা সেই সময়ের পরে আবার যখন আরাকান বার্মার সঙ্গে যুক্ত হয়, ততদিনে অনেক কিছুই ঘটে গিয়েছে। নির্যাতন-নিপীড়নও নেহাত কম হয়নি এদের উপর। এমনটা ধরলে অনেক দেশের নাগরিকই তাদের নাগরিকত্ব হারাবে।

জেনারেল নে উইনের নেতৃত্বাধীন বার্মা ইন্ডিপেন্ডেস আর্মি (BIA) প্রথম ১৯৪২ সালে সাম্প্রদায়িক ম্যাসাকার পরিচালনা করেন আরাকান অঞ্চলে (বর্তমান রাখাইন স্টেইট)। সেই নির্মমতায় প্রায় এক লক্ষ রোহিঙ্গা প্রথমবারের মতো আরাকান অঞ্চল ছাড়তে বাধ্য হয়। ধ্বংস করে দেওয়া হয় রোহিঙ্গা-অধ্যুষিত অনেক গ্রাম। ফলে যে বাসযোগ্য খালি জমির সৃষ্টি হয়, সেটিতে বসতি গড়ে রাখাইনসহ অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষ এবং এ ক্ষেত্রে সরকারও সহযোগিতা করে।

জেনারেল নে উইন ১৯৬২ সালে ক্ষমতা দখল করার পর আরও বিভিন্ন সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন আরাকান অঞ্চলে। ফলে সমস্যা দীর্ঘায়িত হয় এবং জটিল আকার ধারণ করে। এই সামরিক অভিযানগুলোর মধ্যে ১৯৭৮ সালে পরিচালিত 'কিং ড্রাগন অপারেশন' অন্যতম। যেই অভিযানে প্রায় তিন লক্ষ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়। নির্যাতনের সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৮২ সালে নতুন এই নাগরিকত্ব আইন প্রণয়ন করে সরকার। যে আইনের বলে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়।

সামরিক এইসব অপারেশন ছাড়াও রাখাইন অঞ্চলের মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর সরকার নানা রকমের অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিপীড়ন চালিয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরেই। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক David Dapice ২০১৪ সালে এক গবেষণায় জানাচ্ছেন–

২০১০ সালে মিয়ানমারের জাতীয় পর্যায়ে যখন পার ক্যাপিটা বিদ্যুৎপ্রাপ্তি ১২১ কিলোওয়াট এবং ইয়াঙ্গুনে যখন ৫৬২ কিলোওয়াট তখন রাখাইন স্টেইটে মাত্র ৩ কিলোওয়াট। নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত রোহিঙ্গারা অন্য অঞ্চলে যেতে পারে না সরকারের অনুমতি ছাড়া। এদের জন্মহারও নিয়ন্ত্রিত হয় সরকারের আদেশবলে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ২০১২ সালে ০-৯ বছর বয়সী জনসংখ্যা জাতীয় পর্যায়ের তুলনায় রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৩৭ শতাংশ বেশি। এই জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কেবল মাত্র ধর্মীয় কারণে নয়, শিক্ষা বা সচেতনতার অভাবেও হতে পারে, মেডিকেল সুবিধার অভাবেও হতে পারে। কিন্তু মিয়ানমার সরকার ধর্মীয় কারণে এরা বেশি সন্তান জন্ম দিচ্ছে ধরে নিয়ে সেটিকে নিয়ন্ত্রণ করছে। কিন্তু জাতিসংঘ কনভেনশন অনুসারে কোনো একটা নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর উপর জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা জেনোসাইড হিসেবে চিহ্নিত হবে।

এছাড়া আমরা বিভিন্ন সময় মিয়ানমারের প্রশাসনিক লোকদের মনোজাগতিক চিন্তার প্রতিফলন দেখতে পাই তাদের বিভিন্ন উক্তিতে। ২০০৯ সালে হংকং এ একটি কনফারেন্সে মিয়ানমারের তৎকালীন কনস্যুল জেনারেল Ye Mint Aung রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে বলেন–

They are as ugly as orges.

অর্থাৎ, রোহিঙ্গারা রাক্ষসের মতো কুৎসিত। তিনি রোহিঙ্গাদের শরীরের বর্ণ নিয়ে চরম রেসিস্টের মতো আরও বলেন–

রোহিঙ্গাদের শরীরের রঙ আমার শরীরের রঙের মতো সুন্দর এবং নরম নয়, এ থেকে বুঝা যায় ওরা বার্মিজ অরিজিন নয়, ওরা অবৈধ অভিবাসী।

আমরা মিডিয়া মারফত দেখতে পাই তোহাইয়াতদের ভেসে ওঠা লাশ। দেখতে পাই শরণার্থী স্রোতে ভেসে আসা রাখাইন অঞ্চলের মানুষের উপর চলা করুণ নির্যাতনের চিত্র। রাখাইন অঞ্চল থেকে অবৈধভাবে বাংলাদেশে ঢুকে পড়া নিরীহ মানুষের জবানিতে শুনতে পাই সেনাবাহিনী যুবকদের গুলি করে মারছে, শিশুদের সাগরে ছুঁড়ে ফেলছে কিংবা উপরে ছুঁড়ে দিচ্ছে, নারীদের ধর্ষণ করছে এবং মিয়ানমারজুড়ে এইগুলো হচ্ছে শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর উপর, সেই জনগোষ্ঠী হচ্ছে রোহিঙ্গা। তাহলে ফিরে যাই জাতিসংঘের জেনোসাইডের সংজ্ঞায়।

গণহত্যা প্রতিরোধ ও গণহত্যার শাস্তি-বিষয়ক ইউএন কনভেনশন ১৯৪৮এর আর্টিকেল ২ অনুসারে কোনো জাতিগোষ্ঠী, নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী, সামাজিক অথবা ধর্মীয় জনগোষ্ঠীকে অথবা তাদের একটা অংশকে নির্মূল করার উদ্দেশ্যে সেই জনগোষ্ঠীর মানুষকে হত্যা করা হলে, অথবা মারাত্মক ধরনের শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন করা হলে অথবা সেই জনগোষ্ঠীর শারীরিক ক্ষতি হয় এমন কর্মকাণ্ড উদ্দেশ্যমূলকভাবে পরিচালনা করা হলে বা সেই জনগোষ্ঠীর জন্মহার নিয়ন্ত্রিত করা হলে বা সেই জনগোষ্ঠীর সন্তানদের অন্য জনগোষ্ঠীতে রূপান্তরের চেষ্টা করা হলে সেটা গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত হবে।

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর সামাজিক, অর্থনৈতিক নির্মম অত্যাচারের পরও জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান সম্প্রতি মিয়ানমার ঘুরে এসে বলেছেন যে, মিয়ানমারে গণহত্যা চলছে এটা বলা ঠিক হবে না, গণহত্যা টার্মটা ব্যবহারের আগে আরও সতর্ক হতে হবে সবাইকে। কারণ কী?

বিশ্বমোড়লরা কেন এগিয়ে আসছে না প্রাচীনতম এই সমস্যার সুরাহা করতে? এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত ফরেন অ্যাফেয়ার্স ম্যাগাজিনে ২০১৩ সালের ৭ মার্চ ফ্রিল্যান্স রিপোর্টার এবং বিশ্লেষক Eric Randolph লিখেছেন–

ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর মিয়ানমারের চলমান ধ্বংসযজ্ঞ নিয়ে যথেষ্ট সরব না হয়ে নীরব থাকার পেছনে কৌশলগত কারণ আছে। চীন তার সীমান্তের কাছের দ্বন্দ্ব নিয়ে চিন্তিত হলেও তাদের রয়েছে মিয়ানমারে নতুন তেল ও গ্যাস লাইনসহ অন্যান্য প্রজেক্টে ১৪ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ, যেটা মে ২০১৩ সালে শুরু হয়েছে। আবার ২০১০ সালের খবর ছিল মিয়ানমার পারমাণবিক শক্তি সঞ্চয়ের লক্ষ্যে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্কে আগ্রহী। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য ছিল এ থেকে তাদের নিবৃত্ত করা। সেটাতে তারা সফল হয়েছে। ফলে মিয়ানমারের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে কুটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নে মনোযোগী হয়েছে তারা। অন্যান্য দেশগুলোও হঠাৎ করে মিয়ানমারে আকর্ষণীয় বাজারের সন্ধান পেয়েছে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ায়।

ফলে সমস্যা সমাধানে আগ্রহী হওয়া না-হওয়াটা বাজারের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে গেছে বিশ্বমোড়লদের কাছে। এই অবস্থায় দীর্ঘমেয়াদী এই সমস্যা সমাধানে কেবলমাত্র আইন, নৃতাত্ত্বিকতা, ইতিহাস, কালচার এসব হিসাব করলে হবে না। বিষয়টা দেখতে হবে মানবিক বিশ্ব গড়ার প্রয়াস হিসেবেই।