যে দেশ চেয়েছিলাম যে দেশ এখনও পাইনি

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 18 Dec 2016, 02:14 AM
Updated : 18 Dec 2016, 02:14 AM

এক.

ব্রুস উইলসন ছিলেন 'মেলবোর্ন এজ' পত্রিকার সাংবাদিক। জানি না তিনি এখন বেঁচে আছেন কি না। বেশ কয়েক বছর আগে আমি এক দুবার তাঁর সঙ্গে ফোনে কথা বলেছিলাম। তিনি তখন লন্ডনের এক হাসপাতালে, রোগশয্যায়। তবু কথা বলেছিলেন। একাত্তরে আমাদের হয়ে বিদেশে জনমত গঠনের কাজ করেছিলে তিনি। নয় মাসের বেশিরভাগ সময় ছিলেন মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে। আমার আগ্রহ আর উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় একটুও পাত্তা দেননি ভদ্রলোক। ইতিহাসের নির্মম অনাচার আর বিকৃতির কারণে বীরপ্রতীক প্রয়াত ওডারল্যান্ডের মতো ইনিও ছিলেন বেজায় বিরক্ত। এঁরা বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দীন সৈয়দ নজরুলদের করুণ মৃত্যু মেনে নিতে পারেননি।

তবে ব্রুসের একটি কথা আমার কানে লেগে আছে এখনও। শীতের আসন্ন সন্ধ্যায় তখনকার রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণরত পাকবাহিনী ও বিজয়-আনন্দে ভাসমান বাংলাদেশের জন্মস্বাক্ষী তিনি। সে রক্তস্নাত মুক্তিবিকেলের বিষয়ে নানা প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে বলেছিলেন, "আর কেউ থাক বা না থাকম এ কে খন্দকার তো সেখানে ছিলেন। তাঁকেই তোমরা প্রশ্ন কর না কেন "

আসলেই তো। ছবি দেখুন। ভালো করে তাকিয়ে দেখুন সে ইতিহাসের জীবিত স্বাক্ষী এ কে খন্দকারকে পাবেন ছবিতে। কিন্তু তখন আমি কি জানতাম এর কয়েক বছর পর এই খন্দকার সাহেব বাংলাদেশের মীরজাফর মোশতাক খন্দকারের ভাষায় কথা বলবেন? সারাজীবন যে নেতার দল করলেন, যাঁর কারণে স্বাধীন দেশের পতাকা উড়িয়ে মন্ত্রী হয়ে জাতির শ্রদ্ধা-ভালোবাসা কুড়িয়ে বুড়ো হলেন, তাঁকে বেমালুম ভুলে গিয়ে রণাঙ্গণের এক মেজরকে মূল যুদ্ধের কৃতিত্ব দিয়ে বই লিখবেন?

সেনাবাহিনীর কারণে বা মতিভ্রমের ফলে, যেভাবেই হোক, উইলসনের পরিচিত সেই এ কে খন্দকারের মতো দেশ ও জাতি আজ বদলে যাওয়ার পথেই।

দুই.

যাঁরা যুদ্ধে গিয়েছিলেন তাদের সবাইকে আমরা চিনি না। চেনার কথাও নয়। তবে যাঁরা বীরত্বে ইতিহাস হয়ে উঠেছেন তাঁদের না চেনার উপায় থাকে না। একাত্তরের বিজয় ও যুদ্ধকালীন হিরো কাদের সিদ্দিকী বীরোত্তম। দুবার তাঁর আবেগঘন বক্তৃতা শুনে কেঁদেছিলাম। তেমনি চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক বিজয় মেলায় আমাদের চোখের জলে দিনকে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতে এনে দিয়েছিলেন নূরে আলম সিদ্দিকী। বাগ্মী তিনি। কথায় কথায় রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্গবন্ধুর রেফারেন্স আর কবিতা শোনানোর মতো রাজনীতিবিদ এমন আর একজনও নেই। মুক্তিযুদ্ধের বীর ছাত্রলীগের নেতা। সেই তিনিও আজ আধা-পথভ্রষ্ট।

আগেই পথ হারিয়ে শাহজাহান সিরাজের সিরাজত্ব পরিণত হয়ে গেছে মীরজাফরে। চার খলিফার একজন লোকান্তরে, দুজন পথহারা আর একজন আ স ম রব কালক্রমে রাজনৈতিক ভাঁড়ে রুপান্তরিত এক গিরগিটি। কোথায় তবে ভুল ছিল আমাদের? কেন এরা একজনও পথে-নীতিতে অটুট থাকতে পারলেন না? নাকি আওয়ামী লীগই পারেনি এদের ধারণ করতে?

কাদের সিদ্দিকীর কথা বলছিলাম। এখন তিনি হাফ আরবি হাফ বাংলায় কলাম লেখেন। অথচ পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে চলে গিয়েছিলেন ভারতে। কাদেরিয়া বাহিনীর কত জোয়ান ঘর ছেড়েছিল, কত জন প্রাণ হারিয়েছিল আর কত জন কখনও ফিরতে পারেননি তার খবর রাখে না কেউ।

এই যে ধর্মীয় ভাষার নামে নিজেকে ধার্মিক প্রমাণের অপচেষ্টা, সেটা অন্যেরা করলে কিছু বলার ছিল না। কিন্তু তাঁকে তো স্বয়ং জ্যোতি বাসু একটি লাইব্রেরি করার মতো মালমশলা দিয়েছিলেন। যাতে কাদের সিদ্দিকীর জানা-বোঝার ক্ষমতা বাড়ে। পশ্চিমবঙ্গের ঝানু বাম নেতারা বুঝে নিয়েছিলেন এই লোকটির সাহস আর আন্তরিকতা থাকলেও মগজে বিদ্যা কম। সে কথা তিনি দেশে ফেরার পর প্রথম ইন্টারভিউতে অকপটে স্বীকারও করেছিলেন। বিবিসিকে দেওয়া তাঁর সেই ইন্টারভিউ শোনার সময় চোখের জল ধরে রাখতে পারিনি।

আজ তাঁর কী চেহারা! বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার না হওয়া অবদি মাংস না খাবার কঠিন শপথ ভাঙলেন জলসা করে। সাংবাদিকদের দাওয়াত দিয়ে। পতন আর অধঃপতনে আজ কাদের সিদ্দিকীকে চেনা দায়। এর নাম রাজনীতি না এটাই আমাদের চরিত্র?

তিন.

দুনিয়ার যেসব দেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল তাদের সঙ্গে আমাদের চারিত্রগত তফাৎ একটাই। বিজিতরা সব দেশে মাথা নুইয়ে পরাজয় মেনে মূলস্রৌতে মিশে গেছে। পলপটের কথা মনে আছে আমাদের। কম্বোডিয়ার মানুষদের জীবন অতীষ্ঠ করে তোলা এক দানব। চাষীর রক্ত পবিত্র, এই ভুয়া স্লোগানে তিনি ও তাঁর দল সে দেশে যে রাজাকার বাহিনী তৈরি করেছিলেন, তারা হাজার হাজার মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছিল। এমনও দেখেছি, চশমা পরলে বিশেষত ভারী পাওয়ারের চশমা পরলে গুলি করার নির্দেশ ছিল সেখানে। কারণ এরা নাকি বুদ্ধিজীবী। তরুণরা হস্তমৈথুনের সময় ধরা পড়লেও গুলির আদেশ ছিল।

এমন কঠিন নির্লজ্জ শাসকের অনুসারীদের মাফ চাওয়া চিঠি আর মূলস্রোতে ফেরার জন্য কান্নাকাটির দলিলে ভরা এদের যাদুঘর। যে কারণে তৈরি হতে পেরেছিল জাতীয় সমঝোতা।

আমাদের দেশে? মৃত্যু মানে ফাঁসির আগে একজন রাজাকার নেতাও কৃতকর্মের জন্য মার্জনা চায়নি। তারা বারংবার বলেছে, তারা যা করেছিল সেটাই সঠিক। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ আর ইতিহাস বিষয়ক কোনো গবেষক এ নিয়ে কোনো গবেষণা করেন না। কেন আমাদের লোকজন দলে দলে রাজাকার হয় আর তাদের একজনও দোষ স্বীকার করে না বা মাফ চায় না? তার সুরাহা না হলে কি আসলেই আমাদের জাতীয় ঐক্যের মীমাংসা হবে কোনো দিন?

আজকাল এমন হাল বিজয় বা মুক্তি শব্দগুলোই অপাংক্তেয়। আমি এক তরুণকে চিনি যে তার বিজয় নামের জন্য মর্মাহত। তার ধারণা, এই নাম তার পরিচয় ও ভবিষ্যতের জন্য বিপদের হতে পারে। তাকে ভরসা দেওয়ার মতো কেউ আছেন কোথাও?

চার.

বঙ্গবন্ধু সবার ওপরে সূর্যের মতো থাকলেও একাত্তরে তিনি ছিলেন অন্তরীন। তাঁর নামে ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতি ও নেতারা এ দেশ স্বাধীন না করে নিদ্রা যাননি। আর আজ? শেখ হাসিনার কিছু হলে দল তো দল, দেশের কী হতে পারে ভাবলে মাথার চুল খাড়া হয়ে যায়।

সামষ্টিক নেতৃত্ব বলে এখন আর কিছু নেই। কোনো দলে কোনো রাজনীতিতে সেকেন্ড ম্যান বা তৃতীয় ধাপে কেউ নেই। থাকলেও তারা ঠুঁটো জগন্নাথ। ফলে সমস্ত চাপ গিয়ে পড়ে একজনের ওপর। এমন ধারায় সে দল যদি একবার গদিচ্যূত হয় তাহলে তার কী হাল হতে পারে বিএনপিই সেরা উদাহরণ।

মুক্তিযুদ্ধের যাবতীয় দায় যেমন একা আওয়ামী লীগের বা তারা মনে করে দেশের ইতিহাস ও অতীতে তারা ব্যতীত কারও জায়গা নেই, নেতৃত্বেও তাই। এর পরে কী হবে সেটাই ঘুম হারাম করে দেয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেষ কবে একজন ভালো নেতার জন্ম হয়েছে কেউ বলতে পারবে না।

পাঁচ.

একটি দেশ স্বাধীন করার সময় যেসব অঙ্গীকার নিয়ে জন্মায় চল্লিশ বছর পর তা বদলাবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, সে তার জন্মপ্রক্রিয়া অস্বীকার করবে। তার জন্মের সময়কার সব বাঙালি সব ধর্মের মানুষকে সে ভুলে যাবে। আজকের বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক পরিবেশ পাকিস্তানের চাইতে ভালো কিছু নয়। জায়গায় জায়গায় ক্লেদ আর ঘৃণা। হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান-বা আদিবাসী কেউ এখন শান্তিতে নেই। প্রায় এক দলের আধিপত্যের পরও কারা এসবে ইন্ধন দেয়? কারা তাদের অভিভাবক?

বাংলাদেশের ডিজিটাল রূপের যেসব নমুনা সাঁওতালরা দেখলেন, যে তাণ্ডবে রামুর বুদ্ধ মাথার ওপর ছাদ হারালেন বা ভেঙে টুকরো হলেন তার নাম চেতনা? যে ঘৃণায় একজন শিক্ষককে কান ধরিয়ে সবাই হাততালি দেয়, মালাউন বলে মজা পায়, তার নাম স্বাধীনতা? যে নারী পুলিশ কর্তার বিবাহিতা স্ত্রী হয়ে ভোরবেলায় রাজপথে লাশ হন এবং আজ অবদি তার রহস্য উদঘাটিত হয় না তার নাম বিচার?

বিজয় মানে কি বদলে যাওয়া কিছু মানুষের মুখোশ?

এবার অামরা মধ্যচল্লিশে বিজয় দিবস পালন করেও কি এ কথা বলব যে দেশ অামরা চেয়েছিলাম তাই পেয়েছি? বিজয়ের খুব নিকটের দিনটি মনে করি। হাত-পা বাঁধা বুদ্ধিজীবীদের শহীদ হবার দিন। অাজও কি সে ভয় নেই? এখন তো যারা মারে তারা অারও ভয়ংকর। সে সময় চোখ বেঁধে রাতে নিয়ে গিয়ে মারা হত। অার এখন দিনেদুপুরে চোখ খুলে মারা হয়। তখনকার ঘাতক চৌধুরী মঈনউদ্দীনরা দেশ ছেড়ে পালাত। এখন খুনিরা দেশে থাকে– মুক্তমনের খোলা হাওয়ার মানুষ কোনোরকমে পালাতে পারলে বাঁচে।

উন্নয়নের একটি ধারা দেশকে সামনে নিয়ে যাচ্ছে। এর নাম সময় ও অর্থনীতি। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিকে ক্রমাগত পচন অার অন্ধত্ব। কোথাও উজ্জ্বলতা নেই। যারা সমাজ বদলাতে পারেন তাদের মুখে প্রগতি মগজে পরকাল ও অন্ধত্ব। এককালের অাওয়ামী মুসলিম লীগ অাওয়ামী লীগ থেকে মুসলিম অাওয়ামী লীগে ধাবমান। বিএনপি পাকপ্রেমী। বাকিরা দিশেহারা।

খেয়াল করবেন, নিয়ম মানার বাইরে বিজয় দিবসও তেমন প্রবল কিছু নয়। বিদেশে কেউ পালনও করে না। কারণ হয়তো অামরা পতাকা চাই, গদি চাই, দেশের কেউকেটা হতে চাই, কিন্তু পাকিস্তানের তেমন পরাজয় চাইনি। তা আবার ভারত ও মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে।

তবু লাখো শহীদের রক্ত আর ত্যাগ মাটি ভুলতে পারে না। সেটাই শক্তি দেয়। সঙ্গে অাছে তারুণ্য অার জননীরা। এরাই দেশ ও জাতির রক্ষাকবচ। এটুকু জানি, এ দেশ ও বিজয় যত নিস্প্রভ বা মলিন হোক, তার মেধা ও সাহসই তাকে ঘুরে দাঁড় করিয়ে দেবে।

এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি।
জয়তু বাংলাদেশ।