মুক্তির গান খুলে দিল দ্বার

আকতার হোসেন
Published : 19 Dec 2016, 08:39 AM
Updated : 19 Dec 2016, 08:39 AM

১৯৭১ সালের পঁচিশে মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট শুরু হবার সাথে সাথেই সাধারণ মানুষ বুঝে ফেললো বিশেষ কোন রাজনৈতিক নেতা বা দলের উপর নয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পুরো বাঙালি জাতিকে আক্রমণ করেছে। কাজেই যুদ্ধ ছাড়া মুক্তির উপায় নেই। সেই থেকে দলবদ্ধ হতে লাগল সকলে। প্রতিরোধ গড়ে তুলল যার যা আছে তাই দিয়ে। কেউ হয়ে গেল অস্ত্র হাতে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা, কেউ নিয়োজিত থাকল খবর ও তথ্য সংগ্রহের কাজে। কেউ কেউ দিল টাকা পয়সা খাদ্য আশ্রয় বাসস্থান। যাদের প্রশিক্ষণ ও পেশাগত দক্ষতা ছিল তাদের মধ্যে অনেকে চিকিৎসা সেবা ও কারিগরি সাহায্য নিয়ে হাত বাড়িয়ে দিল। মাঝিমাল্লা রিকশাচালক গাড়োয়ান তারাও পারাপারের বন্ধু হয়ে এগিয়ে এলো। শুরু হয়ে গেল জনযুদ্ধ।

ঢাকা থেকে বেরিয়ে পাকিস্তান মিলিটারিরা যখন মফস্বলের দিকে এবং পরবর্তীতে গ্রামে গ্রামে ঢুকতে শুরু করল তখন নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের পশ্চিম বাংলা সহ বিভিন্ন প্রদেশে আশ্রয় নিতে ছুটে গেল বাংলাদেশের মানুষ। সেখানে গিয়েও কেউ বসে রইল না। মুক্তির লড়াইয়ের সঙ্গে জড়িয়ে গেল সকলে। বন্ধুরূপে এগিয়ে এল সমগ্র ভারতবাসী বিশেষ করে পশ্চিম বাংলার অধিবাসীরা। বাংলাদেশের মানুষের জন্য তারা বাসা বাড়ি ফসলের জমি ছেড়ে দিল। তাদের জমিজমাতেই গড়ে উঠল হাজারো শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প। প্রতিবেশিদের প্রতি এই মহানুভবতা ইতিহাসের নজিরবিহীন ঘটনা।

লেখক সাংবাদিক শ্রী দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায় নামের এক সিপিআই নেতা একদিন বাংলাদেশের কিছু মুক্তমনা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের সঙ্গে দেখা করে বললেন, "এই যে প্রতিদিন হাজার হাজার লোক আসছে বাংলাদেশ থেকে, এঁদের মধ্যে তো অনেক গান-জানা ছেলেমেয়ে থাকার কথা। এদের দিয়ে একটি গানের দল করে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলুন, দেখবেন সকলে মন দিয়ে আপনাদের কথা শুনবে। দরকার হলে শরণার্থী শিবিরের মন-ভাঙ্গা মানুষগুলোকে আবার জাগিয়ে তুলবেন। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে গিয়ে গানে গানে জয় বাংলার কথা বলবেন।"

অস্ত্রযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল প্রতিরোধের প্রথম প্রহরে। অস্ত্র সৈনিকদের সঙ্গে শোনা যেতে লাগল শব্দসৈনিকদের নাম। সাংবাদিক শিল্পী সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক কর্মীরাও বসে থাকলেন না। শ্রী দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে 'বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি' নামে একটা প্রতিষ্ঠান গড়া হল। যার পরিচালক ছিলেন অধ্যাপক ওয়াহিদুল হক এবং সভাপতি ড. সানজিদা খাতুন। এঁদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় প্রায় শতাধিক শিল্পীকে একত্র করা গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সেই সংখ্যা দাঁড়ায় ১১৭ জন। যাদের মধ্যে কণ্ঠশিল্পী, চিত্রশিল্পী, বাদ্যযন্ত্রী, কবি সাহিত্যিক, সুরকার, গীতিকার সহ সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিভিন্ন নিবেদিত সদস্য রাতদিন পরিশ্রম করে সমিতির কাজ করে যেতে লাগল।

এঁদের মধ্য থেকে বাছাই করে গড়া হল 'বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা' নামে একটি গানের দল। কলকাতার ১৪৪ নম্বর লেনিন সরণীতে অবস্থিত দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের দোতালা বাড়ির নিচের তলায় আশ্রয় মিলল বাংলাদেশের এই সমস্ত শিল্পীদের। সেখানেই সকাল সন্ধ্যা রিহার্সাল করে ছেলেমেয়েরা জাগরণের গান কণ্ঠে ধারণ করে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ত। এক এক দলে থাকতো দশ বারো জনের একটি টিম।

সে রকম একটি দলের নেতা ছিলেন মাহমুদুর রহমান বেণু। একটি মালবাহী ট্রাকের দুই পাশে বাংলাদেশের পতাকা লাগিয়ে লাল কাপড়ের উপর সংগঠনের নাম ও জয় বাংলা লিখে ক্যাম্প ক্যাম্পে গিয়ে তারা গান গাইত। মাহমুদুর রহমান বেণুর এই দলের অন্য সদস্যরা হলেন, শাহিন মাহমুদ, শারমিন মুরশিদ, নায়লা জামান, বিপুল ভট্টাচার্য, তারিক আলী, লুবনা মরিয়ম, স্বপন চৌধুরী, দুলাল চন্দ্র শীল, লতা চৌধুরী, দেবব্রত চৌধুরী এবং আরো অনেকে। সকাল ৬টা থেকে শুরু করে রাত বারোটা পর্যন্ত এরা চেষ্টা করত অন্ততপক্ষে ১২- ১৪টা গান যেন গাওয়া যায়। তারপর ফিরত সেই মধ্য রাতে।

স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে একসময় মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস মিথ্যার আড়াল দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছিল। সে এক করুণ কাহিনি। কাউকে জানতে দেয়া হত না রক্ত-রাঙানো ইতিহাসের পেছনের মানুষগুলোর কথা। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি ক্ষমতার ভেতর বাইরে থেকে সরকারের উপর চাপ দিত। একটি বিশেষ শক্তির ইশারায় পছন্দমতো বুদ্ধিজীবী দিয়ে যেমন খুশি তেমন গৌরবহীন ইতিহাস রচনা করেছিল ওরা। সেই সমস্ত দিনগুলোতে গোপনে গোপনে কাজ করত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কিছু মানুষ। কবিতা গল্প নাটক প্রবন্ধ উপন্যাস তথ্যচিত্র নানান মাধ্যমে তারা অবিরাম মুক্তিযুদ্ধের কথা বলত। আমেরিকাতে বসবাসরত অবস্থায় তারেক মাসুদ ও তার স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ দম্পতি সেই সমস্ত মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সৈনিক যারা যুদ্ধের নয় মাস সরাসরি বন্দুক যুদ্ধে অংশ না নিয়েও 'মুক্তিযুদ্ধ' নিয়ে যুদ্ধ করেছে যুদ্ধ পরবর্তী দিনগুলোতে।

আমেরিকান একজন চলচ্চিত্র পরিচালক ও আলোকচিত্র শিল্পী হলেন লিয়ার লেভিন। যিনি ১৯৭০ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের পর ছুটে এসেছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। বাঙালিদের উপর তখন থেকেই তাঁর একটা মায়া লেগে যায়। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার পর একদিন তিনি তার উকিল মর্টেন হ্যামবার্গ এর কাছ থেকে জানতে পারেন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও শরণার্থীদের দুর্দশার কথা। এরই মধ্য নিউইয়র্ককে ১ আগস্ট 'দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ' তাঁকে অনুপ্রাণিত করে।

উল্লেখযোগ্য যে, বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য সচেতনতা এবং ত্রাণ তহবিল বাড়ানোসহ পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর নৃশংসতার খবর বিশ্বের কাছে পৌঁছে দেওয়ার প্রচেষ্টায় অনুষ্ঠিত 'দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ' এখন ইতিহাসের একটি অংশ। এতে অংশ নিয়েছিলেন জর্জ হ্যারিসন, ওস্তাদ রবি শঙ্কর, বব ডিলান, লিয়ন রাসেল, রিঙ্গো স্টার, ওস্তাদ আলী আকবর খান, ওস্তাদ আল্লা রক্ষা, বিলি পিস্টনের মত খ্যাতিমান সব শিল্পীরা।

লিয়ার লেভিন এদের প্রায় সকলকে চিনতেন। কেননা তিনি তখন শর্ট ফিল্ম, ডকুমেন্টারি বানানোর পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৭১ সালে লিয়ার লেভিন ও তার স্ত্রী তাদের প্রথম সন্তানকে বরণ করার জন্য উদগ্রীব হয়ে দিন কাটাচ্ছিলেন। তারপরও তিনি চুপচাপ বসে থাকতে পারলেন না। স্ত্রীকে একা রেখে চলে এসেছিলেন পশ্চিম বাংলায়। বাঙালিদের কথা সেলুলয়েডে ধারণ করার জন্য দুই মাস অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন।

এভাবে কাজের মধ্যে ডুবে থেকেই একদিন লিয়ার লেভিন 'বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা'র ট্রাকটি দেখে ফেলেন এবং সেইদিন থেকেই তিনি এই গানের দলের সঙ্গে ঘুরতে থাকেন শরণার্থী ক্যাম্প থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে। অক্লান্ত পরিশ্রমী এই আলোকচিত্র শিল্পী তাঁর ত্রিশ তম জন্মদিন (নভেম্বর ১০) পালন করেন গোলাবারুদের গন্ধের ভেতর বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে।

'বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা'র শিল্পীবৃন্দের গানগুলো যে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই করে নিচ্ছে সেদিন হয়তো তিনি এতটা বুঝতে পারেননি। তবুও যারা মানব প্রকৃতি সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন তাঁরা ভালো করেই বুঝতে পারেন অতীতের দিনগুলো ফিরে দেখার মধ্যে কতটা ভালোবাসা কতটা আবেগ লুকিয়ে থাকে– আবার সেটা যদি হয় ইতিহাস লিখনি সময়। তাই হয়তো তিনি মুক্ত হবার অদম্য শক্তির ভাষা তুলে যেতে লাগলেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

এমন সৃষ্টিশীল কাজের সঙ্গে যারা জড়িত থাকেন তাদের থাকে দুটি প্রত্যাশা। প্রথমত, তাৎক্ষণিক মনোযোগ আদায়ের জন্য এই শৈল্পিক সৃষ্টিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা; দ্বিতীয়ত, অতীতের বাতিঘর নিখুঁত ভাবে জ্বালিয়ে রাখা যাতে বর্তমানে দাঁড়িয়ে আলোকিত হাবার অভাব না থাকে।

লেভিনের আশা ছিল পাকিস্তানিদের সহিংসতার কথা আমেরিকাবাসীদের জানাতে 'জয় বাংলা' নামে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করা। যা কিনা প্রথম প্রত্যাশা মেটানোর কাজ হত। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত প্রয়োজনীয় আর্থিক সাহায্য বা যোগান না পাওয়াতে তার ২২ ঘণ্টার ধারণকৃত ফুটেজ পড়ে থাকলো বাড়ির বেসমেন্টে। অর্থাৎ তিনি তার পরিশ্রমের ফসল ঘরে তুলতে পারেন নি ইচ্ছা থাকা স্বত্বেও। আশ্চর্য জনক ভাবে যা ঘটে গেল তা হল শূন্য থেকেই অর্থাৎ প্রথম ধাপটি না পেরিয়েই প্রত্যাশার দ্বিতীয় কাজটি শুরু করে দেন তারেক মাসুদ ও তার স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ।

মাহমুদুর রহমান বেণুর কাছ থেকে তারেক মাসুদ জানতে পারেন লিয়ার লেভিনের কথা। তারপর থেকেই শুরু হয় লেভিনকে খোঁজার পালা। অবশেষে ১৯৯০ সালে আসে সেই শুভক্ষণ। তারেক মাসুদ ও তার স্ত্রী ক্যাথরিন গিয়ে সরাসরি হানা দেন লিয়ার লেভিনের বাড়ি। মূলত ক্যাথরিন মাসুদই লিয়ার লেভিনকে রাজি করিয়ে এবং প্রয়োজনীয় চুক্তি সই করে ২০ বছর পর উদ্ধার করে আনেন মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য দলিল। তখন থেকেই শুরু হয়ে যায় তাদের কাজ।

আগেই বলেছি যে, মুক্তিযুদ্ধের কথা এক সময় ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল নতুন প্রজন্মকে। মুখ ফুটে কেউ উচ্চারণ করতে পারতো না বঙ্গবন্ধুর নাম কিংবা জয় বাংলা স্লোগান। কোন বীর যোদ্ধা কিংবা গর্ব করার মতো যুদ্ধের কথাও শুনানো হত না তখন। ভারতের সহযোগিতার কথা উল্লেখ করার তো প্রশ্নই আসে না। অবস্থা যখন এতই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি সেই পরিবেশে ওরা স্বামী স্ত্রী ঠিক করলেন, প্রামাণ্যচিত্র নয়, 'মুক্তির গান' নামে একটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র তৈরি করবে তারা।

প্রায় পাঁচ বছর লেগে যায় তাদের এই কাজ শেষ হতে। একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে যা যা করতে হয় সে ভাবেই তারা এগুতে লাগল। ছবিগুলোই শুধু আগে তোলা হয়েছিল। নিয়মের বাইরে গিয়ে সেই ফুটেজ ভিত্তি করে লেখা হয় চলচ্চিত্রের স্ক্রিপ্ট। মূলত লিয়ার লেভিনের ফুটেজ ব্যবহার করেই চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করা হয়। তবুও শেষের দিকে এসে অন্যান্য সূত্র থেকে পাওয়া আরও কিছু তথ্য ও ফুটেজ ব্যবহার করা হয়েছে মুক্তির গানে। লিয়ার লেভিনের ফুটেজে যাদের গান গাইতে দেখা গেছে 'বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা'র সেইসব শিল্পীদের একত্র করে গানের নতুন অডিও রেকর্ডিং করা হয়। প্রয়োজনীয় জায়গাগুলোতে করা হয় শব্দ সংযোগ। জোগাড় করা হয় বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণের মুল কপি। কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে জিয়াউর রহমানের ঘোষণা পাঠের মূল কপি, আকাশবানীর প্রখ্যাত সংবাদ পাঠক দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিয়ে খবর রেকর্ডিং, এছাড়াও সুন্দর একটা স্টোরি লাইন দাঁড় করানো হয় বিশ বছর আগে তোলা প্রামাণ্যচিত্রের সঙ্গে।

ছবিটির মূল সম্পাদক ছিলেন ক্যাথরিন মাসুদ তবে তাঁকে সহযোগিতা করেছেন তাঁর সহকর্মী দিনা হোসেন ও নজরুল ইসলাম। মাসুদ দম্পতি নিষ্ঠা ও সততা দিয়ে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে ১৯৯৫ সালে জ্বালিয়ে দেন মুক্তিযুদ্ধের নতুন শিখা, 'মুক্তির গান'। এই শিখা বাংলাদেশের মানুষের মুখ কতটা উজ্জ্বল করেছিল সেটা অনুধাবন করতে পেরে 'মুক্তির গান' ছবির পরিচালক তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ পরবর্তীতে 'মুক্তির কথা' নামে আরও একটি ডকুমেন্টারি না বানিয়ে পারেননি।

এই 'মুক্তির কথা' নির্মাণের কাজে যোগ দেয় আর একজন মুক্তিকামী তরুণ, যার নাম মিশুক মুনীর। 'মুক্তির গান' যেমন একটি শক্তিশালী চলচ্চিত্র তেমনি বারুদে ভরা প্রামাণ্য চিত্র হল 'মুক্তির কথা'।

আজ পৌঢ়ত্বে এসে 'মুক্তির গান' চলচ্চিত্রের জন্য লিয়ার লেভিন অনেক সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। তিনি বলেন ক্যাথরিন মাসুদ ও তারেক মাসুদ সন্তানের মত করে মুক্তির গানকে সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরেছে। তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। এই চলচ্চিত্র দেখে আজও যদি কারও চোখে পানি চলে আসে তাহলে সব কৃতিত্ব এটি নির্মাণের কাজে নিয়োজিত সকল ব্যক্তিদের। ভয়েস অব আমেরিকার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে আহসানুল হককে তিনি বলেছেন, "তারেক মাসুদ ছিল আমার খুব প্রিয় মানুষ, আমার ভাইয়ের মতো। আমি আমার আপন ভাইয়ের সাথেও এত আন্তরিক ছিলাম না। ছেলেটি অনেক কষ্ট করেছে, আমি তার কাছে ঋণী। আমি এখন তাঁকে অনেক খুঁজি। তার চলে যাওয়া হৃদয়বিদারক ঘটনা। তারেক আর ক্যাথরিন না হলে আমি টেলিফোন ডাইরেক্টরিতে শুধু মাত্র একটি নাম হয়ে থাকতাম তারাই আমাকে বিশ্বসভায় ঠাই করে দিয়েছে।"

মুক্তির গান সেন্সর বোর্ড এর প্রয়োজনীয় অনুমোদন পেলেও সিনেমা হলে প্রদর্শনের অনুমতি পায়নি। সেই সময় সেটা পাবার কথাও নয়। তাই ব্যক্তিগত উদ্যোগে শহরে গ্রামে বন্দরে এই ছবিটির প্রদর্শনী করতে হয়। মুক্তির গান দেখার পর অনেক মুক্তিযোদ্ধা কিংবা শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া মানুষকে খুঁজে পাওয়া গেছে। 'মেকিং অব মুক্তির গান' এবং 'মুক্তির কথা' তথ্যচিত্রে সে সব লোক নিজেদের নিয়ে কথা বলেছেন। একটি প্রামাণ্য চিত্র মুক্ত করে দিয়েছে কালো কাপড়ের নিচে ঢেকে রাখা সঠিক ইতিহাসের অনেকখানি অংশ। জন্ম দিয়েছে ইতিহাস ভিত্তিক আলোচনা, চিনিয়ে দিয়েছে অনেক অচেনা মুখ।

এবার একটু ভিন্ন কথায় আসি। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসের কোনো এক দিন একটি জিপগাড়িতে করে ধলথিতা ক্যাম্প থেকে আমাকে নিয়ে আসা হয় ৯ নম্বর সেক্টরের হেডকোয়াটার নামে পরিচিত 'বাকুন্ডিয়া' ক্যাম্পে। এই ক্যাম্পটির জন্য বিশাল এলাকা ছেড়ে দিয়েছিলেন সেই সময়কার বিধান সভার এক সদস্য শ্রী রাঁধা কিশোর ঘোষ। পশ্চিম বাংলার ধলথিতা ক্যাম্পের ইন-চার্জ ছিলেন খুলনা থেকে নির্বাচিত এমপিএ জনাব বারী সাহেব। তার সাথে বাকুন্ডিয়া ক্যাম্প ইন-চার্জ ক্যাপ্টেন সুলতানের ওয়ারলেসে কি আলাপ হয়েছিল সেটা আমি জানতাম না। আমাকে নিয়ে আসার পথে জিপ গাড়িটি দুই তিনটি ক্যাম্প থেকে আরও কিছু ছেলেকে উঠিয়ে নেয়।

বাকুন্ডিয়া ক্যাম্পে এসে দেখি একটি ফিল্ম ক্রু অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। সেই দলের প্রধান ছিলেন চিত্রপরিচালক বাবুল চৌধুরী, যিনি দেখতে ছিলেন অনেকটা জহির রায়হানের মত। আমি জহির রায়হানকে খুব ছোটবেলায় এফডিসিতে একবার দেখেছিলাম। সম্ভবত 'বাহানা' সিনেমার শুটিং হচ্ছিল সেই সেটে। বাবুল চৌধুরীকে আমি চিনতাম না, তবে স্বাধীনতার পর ঢাকায় ফিরে জিগাতলা থাকা অবস্থায় তার নাম জেনেছিলাম।

যাহোক, সারাদিন কেটে গেল বাবুল চৌধুরীর ক্যামেরার সাথে দৌড়াদৌড়ি করে। সেদিনের একটি কথা আজও মনে গেঁথে আছে। সাইকেলের উপর ক্যামেরা হাতে শুয়ে ছিলেন বাবুল চৌধুরী। আমরা তখন সারিবদ্ধভাবে কাঁধে থ্রি নট থ্রি বা মার্ক ফোর রাইফেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। একজন লোক সাইকেলটি টেনে টেনে সামনে থেকে পেছনে আবার পেছন থেকে সামনে করছিল। তিনি সাইকেলে উপর শুয়ে থেকেই আমাদের পায়ের ছবি তুলছিলেন। আমাদের কারো পায়ে জুতা ছিল আবার কারো পা খালি। কেউ লুঙ্গি পরা কেউ প্যান্ট। ভিন্নতার এক অপূর্ব সমতাকে তিনি বন্দী করে নিলেন ক্যামেরায়।

দেশ স্বাধীন হবার পর বলাকা সিনেমা হলে গিয়েছিলাম একটা ছবি দেখতে। মুল ছবিটি (সম্ভবত রংবাজ) শুরু হবার আগে দেখানো হল মুক্তিযুদ্ধের উপর একটি প্রামাণ্যচিত্র। নামটা এখন আর মনে পড়ছে না, তবে 'নাইন মান্থ টু ফ্রিডম বাংলাদেশ' হতে পারে। আমি অবাক হয়ে দেখলাম আমাদের সেই ক্যাম্পের দৃশ্য। দেখলাম মুখে কুচকুচে কালো দাড়ি ভরা ক্যাপ্টেন সুলতান সাহেবকে, দেখলাম আমাদের ওস্তাদ ল্যান্সনায়েক আব্দুর রশিদকে, আরো দেখলাম সাইকেলের উপর থেকে তোলা ভুলতে না পারা দৃশ্যটি।

তখন হাই স্কুলের ছাত্র ছিলাম। হাল্কা হাল্কা মোচ উঠতে শুরু করেছে। অন্য ছেলেদের বয়সও খুব বেশি হবে না। হয়তো ক্যাপ্টেন সুলতানের মায়া লেগে গিয়েছিল আমাদের প্রতি। তাই তিনি আমাদের কাউকে ফেরত না পাঠিয়ে যুদ্ধের শেষ দিনটি পর্যন্ত রেখে দিয়েছিলেন তার ক্যাম্পে। ৯ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিল সবুজ রঙের জিপে চড়ে প্রায়ই 'টাকি' অফিস থেকে আসতেন আমাদের ক্যাম্পে। খুব কাছ থেকে অনেকবার দেখেছি তাঁকে, একবার সামান্য কথাও হয়েছিল।

আমাদের এই ক্যাম্পে এসেছিলেন জেনারেল ওসমানী, নূরে আলম সিদ্দিকী সহ কিছু ছাত্র নেতা। নূরে আলম সিদ্দিকীকে খুব ভাল করে চিনতাম। যুদ্ধের আগে 'পাকিস্তান দেশ কৃষ্টি' নামে একটি বই বাতিল নিয়ে আন্দোলন হয়েছিল। তখন বটতলাতে বিভিন্ন স্কুল থেকে ছেলে মেয়েদের আসতে হত। নূরে আলম সিদ্দিকীর আগুন ঝরা বক্তৃতা শুনে শুনে তাঁর ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম।

বাকুন্ডিয়া ক্যাম্পে থেকে যাওয়ায় আমার একটা লাভ হয়েছিল। এই ক্যাম্পের সামান্য দূরে গড়ে ওঠা নতুন একটি ক্যাম্পের নাম ছিল শাকচূড়ার ক্যাম্প। সেই ক্যাম্পের ইন-চার্জ ছিলেন আমার আব্বা। আম্মা এবং তিন বোনকে বাংলাদেশে রেখে আমি আর আব্বা চলে এসেছিলাম ইন্ডিয়াতে। মাঝে মাঝে তাই আব্বার দেখা পাওয়া মানে জীবন ফিরে পাওয়ার মত লাগত। বঙ্গবন্ধুর একজন আত্মীয় ছিলেন আমাদের বাকুন্ডিয়া ক্যাম্পে। তার নাম ছিল সম্ভবত শেখ ফরিদ। আব্বা আর শেখ ফরিদ ছিল পূর্ব পরিচিত। সময় পেলে দুজনে এক সাথে বসে কথা বলতেন। আমাদের ক্যাম্পের ভেতর বিশেষ অনুমতি পেয়ে একটি মুদির দোকান খুলেছিল আব্দুর রহমান নামের এক ভারতীয় যুবক। মুখে চাপ দাঁড়ি কিন্তু বয়সে ছিল তরুণ। বড় রাস্তার পাশে ছিল তার ঘর। সেখান থেকে এসে প্রতিদিন দোকান খুলত আব্দুর রহমান। তার দোকান থেকে কলা কিনে খেতেন আব্বা আর শেখ ফরিদ।

আমরা যখন রাতের আঁধারে অপারেশন করতে ক্যাম্প ছাড়তাম কিংবা সিএনবি রোডের উপর এমবুশ করতে যেতাম, তখন একবার আব্বার ক্যাম্পের পাশ দিয়ে যেতে হয়েছিল। মধ্য রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকার তবুও মনে হয়েছিল যদি তার পা ছুঁয়ে সালাম করে যেতে পারতাম। কে জানে যদি ফিরে না আসি! কিন্তু তখন কোন অপারেশনের কথা কাউকে বলা হত না। এমনকি আমরাও আগে থেকে জানতে পারতাম না। ঘুমের মধ্য ক্যাপ্টেন সুলতান চোখের উপর টর্চের আলো ফেলে ইশারা দিতেন। তার মানে তুমি যাচ্ছ আজ রাতের অপারেশনে।

এভাবেই কেটে গেছে আমার যুদ্ধের দিন। আজ মনে হচ্ছে যদি বাবুল চৌধুরীর কিংবা লিয়ার লেভিনের মতো আরও অনেক লোককে আমরা পেতাম তাহলে হয়তো প্রচুর তথ্য থাকত আমাদের হাতে হাতে। আবার সব কষ্ট কিন্তু আলোর মুখ দেখেনি। যেমন লিয়ার লেভিনের ফুটেজ ২০ বছর পরেছিল তাঁর বেসমেন্টে। বাবুল চৌধুরীর ধারণকৃত সব ফুটেজও ব্যবহার করা যায়নি ঐ ডকুমেন্টারিতে। আজকের এই সেলফোন ভিডিও যদি তখন থাকত যুদ্ধটা হয়তো অন্য মাত্রা পেত।

মনে আছে একটা ছেলে আমাদের মোল্লাহাট চিতলমারীর কমান্ডার শেখ হাবিবের ক্যাম্পে দুই মাইল দৌড়ে এসে একটা গোপন খবর দিয়েছিল। আজকের মতো সে যুগে যদি সবার কাছে সেলফোন থাকত তাহলে হয়তো ছেলেটিকে দুই মাইল ওভাবে দৌড়ে আসতে হত না। তবুও যতটুকু আমাদের কাছে আছে সেটুকুই-বা কম কী? একাত্তরের মানুষগুলো তো এখনও বেঁচে আছে, তাদের কাছেই জমা আছে প্রতিদিনের হিসাব নিকাশ, বাস্তব ফুটেজ। বাকিটুকু দিয়েছেন লিয়ার লেভিন কিংবা বাবুল চৌধুরীর মতো নিঃস্বার্থ লোকেরা।

হে একাত্তররে বন্ধু, পাশে ছিলে বলেই আজও তোমরা আছ কাছে, হৃদয়ের গভীরে। তোমাদের জানাই অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতা।