নারী নির্যাতন কি বৈধতা পাবে?

রণেশ মৈত্র
Published : 4 Dec 2016, 03:38 AM
Updated : 4 Dec 2016, 03:38 AM

সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভা নারী-পুরুষের বিবাহযোগ্য ন্যূনতম বয়স যথাক্রমে ১৮ এবং ২১ নির্ধারণ করে আইনের একটি খসড়া অনুমোদন দিয়েছে। আইনটি যদি এখানেই থামত তবে দ্বিধাহীন কণ্ঠে তা সর্বজনীন সমর্থন পেতে পারত। সবার দাবিও ছিল তেমনই। বিশেষ করে বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের প্রগতিশীল নেতৃত্বের। কিন্তু না, খসড়া আইনটি ওখানে থেমে থাকেনি। 'কিন্তু' আর 'যদি' লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।

'বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৪' নামে আইনের খসড়াটিতে বলা হয়েছে, কোনো মেয়ে বা ছেলে নির্ধারিত বয়ঃসীমার কম বয়সে বিয়ে করে সে ক্ষেত্রে সামাজিক বিশেষ অবস্থা বিবেচনায় রেখে আদালত ও অভিভাবকদের সম্মতি থাকলে ওই বিয়ে 'বৈধ' বলে বিবেচিত হবে। না হলে সে ক্ষেত্রে ওই বিয়ে অবৈধ বিবেচনা করে 'নামকাওয়াস্তে' সামান্য কিছু শান্তির বিধান রাখা হয়েছে। খসড়াটি মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পরবর্তী ধাপ হল সেটিকে জাতীয় সংসদে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে উত্থাপন করা হবে। সংসদে তাতে অধিকাংশ সদস্যের সমর্থন পেলে তা আইন হিসেবে পরিগণিত হবে। অবশ্য তাতে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের প্রয়োজন হবে।

রাষ্ট্রপতি সংসদের পাস করা আইনে স্বাক্ষর দিলেই তার গেজেট প্রকাশ এবং সেই সঙ্গে আইন প্রণয়ন ও পাসের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হয়ে যায়। যেহেতু আমাদের দেশের পার্লামেন্টে কোনো বিরোধী দলের অস্তিত্ব নেই বা সংসদ-সদস্যদের নিজস্ব অভিমত অনুযায়ী ভোটদানের অধিকারেরও স্বীকৃতি নেই, তাই মন্ত্রিসভা যা অনুমোদন দেয় সংসদে তা হুবহু পাস হয়ে যায়।

এ পর্যন্ত ভোটে কোনো আইনের খসড়া সংসদে পাস হয়নি বা এমনকি সংসদে কোনো আইনের খসড়া ভোটাভুটির কবলে পড়েছে– এমন নজির নেই। মন্ত্রিসভা যে খসড়া অনুমোদন করে দেয় কণ্ঠভোটে তা সংসদে পাস হয়ে থাকে।

আর রাষ্ট্রপতি? বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রপতির পদটি একটি 'decorative post' মাত্র। তাঁর মর্যাদা আছে, কিন্তু মন্ত্রিসভার বা সংসদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যাওয়ার ক্ষমতার স্বীকৃতি নেই। তাই সংসদে পাস হলেই তা চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হয় এবং রাষ্ট্রপতি তাতে স্বাক্ষরও দিয়ে থাকেন। এর কোনো ব্যতিক্রম চোখে পড়েনি। রাষ্ট্রপতির নিজস্ব মতে তিনি যে তা সংসদে পুনর্বিবেচনার জন্য ফেরত পাঠাবেন তারও কোনো নজির নেই। এ কারণেই দেশব্যাপী নারীবান্ধব মানুষদের এত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা।

সবার প্রত্যাশা এই যে, সংসদ অধিবেশনে পেশ করার আগেই 'কিন্তু', 'যদি', 'বিশেষ কারণ' প্রভৃতি বলে যেভাবে অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েদের বিয়ের সুযোগ আইনের খসড়াটিতে রাখা হয়েছে সেগুলো অবিলম্বে প্রত্যাহার করে ন্যূনতম ১৮ বছর না হলে মেয়েরা এবং ন্যূনতম ২১ বছর না হলে ছেলেরা বিয়ে করতে পারবে না মর্মে স্পষ্টভাবে বিধান রাখা হবে।

কিন্তু যদি তেমন উদ্যোগে কোনো মেয়েছেলে, প্রতিবেশী, ময়-মুরুব্বী বা অভিভাবক কেউ গ্রহণ করে নাবালক আবস্থায় বিয়ে করেন, বিয়ে দেন বা বিয়েতে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে উৎসাহিত করেন তবে ন্যূনতম ১০ বছরের জেল, তিন লাখ টাকা জরিমানা করা হবে। আইনটিতে এমন বিধান দেশের নারীর সার্বিক পরিস্থিতির দিকে তাকালে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে বলে সবাই মনে করেন।

'সামাজিক বাস্তবতার বিবেচনায়' বলে যে কথা বলতে চেয়েছেন নারী ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী তা আরও উদ্বেগজনক এই কারণে যে প্রকৃতই তা হলে বাস্তবতা কী, সরকার তা সম্যক উপলব্ধি করতে সম্ভবত ব্যর্থ হয়েছে।

এ কথা অনস্বীকার্য যে, বাংলাদেশে অাজ নারীবান্ধব, নারী নির্যাতনবিরোধী কঠোর আইন রয়েছে। কিন্তু তার দ্বারাই আমরা কি দাবি করতে পারব যে বাংলাদেশ নারী নির্যাতন মুক্ত? অথবা বলতে পারব যে, ওই কঠোর আইনগুলোর যথাযথ প্রয়োগ করা হয়ে থাকে? এমন দাবি করার কোনো অবকাশ নেই বাংলাদেশে। বরং প্রকৃত বাস্তবতা হল এই যে আন্তর্জাতিকভাবে নারী নির্যাতনের সূচকে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ যথেষ্ট এগিয়ে এবং এর মধ্যে বাল্যবিবাহজনিত নির্যাতনই প্রধান।

বেসরকারি সংস্থার তথ্যমতে, ৭৬% কিশোরীই যৌন হেনস্থার শিকার। কী ভয়ংকর! তাই দেখা যায় যে, এমনকি চার থেকে ছয় বছর বয়সী কন্যাশিশুও ধর্ষিত হচ্ছে, কিন্তু এই ভয়াবহ পাশবিকতারও উপযুক্ত বিচার হচ্ছে না। অপরাধীরা অনেক ক্ষেত্রেই সরকারি দলের কোলে আশ্রিত, লালিতপালিত হওয়ার ফলে পুলিশ তাদের বিচারের আওতায় আনতে গড়িমসি করে। তাই একদিকে যেমন নারী নির্যাতনরিরোধী কঠোর আইনগুলো যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে, তেমনি আবার নারী নির্যাতন যাতে না ঘটে বা তা যাতে যথেষ্ট পরিমাণে কমে আসে তার জন্য প্রতিষেধকও খুঁজতে হবে।

চোখের সামনে যদি দেখি, আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে গ্রামীণ অশিক্ষিত সমাজের শিশু-কন্যা থেকে শুরু করে শহুরে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত যুবতীরা ও তাদের সহপাঠী এবং কখনও কখনও তাদের শিক্ষকদের দ্বারা, শিশু-কন্যারা যখন মাদ্রাসা ও স্কুল শিক্ষদের দ্বারা, নার্স-মেয়েরা যখন ডাক্তার কিংবা ক্লিনিকের মালিক দ্বারা, রোগিনী যখন পুরুষ নার্স বা ডাক্তার দ্বারা, নারী কনস্টেবল যখন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের দ্বারা, ব্যাংকে কর্মরত নারী কর্মচারী-কর্মকর্তারা যখন তাদের সহকর্মীদের দ্বারা, সরকারি-বেসরকারি অফিসগুলোতে যখন কর্মরত নারীরা তাদের ঊর্ধ্বতন সহকর্মীদের দ্বারা প্রায় প্রাই ধর্ষিত-অত্যাচারিত হচ্ছে তখনও কি আমরা একে 'মহামারী' বলে ধরে নেব না? এটা দূর করতে সব শক্তি নিয়োগ করব না?

এমনিতেই নারীরা আমাদের দেশে, এমনকি নিজ বাড়িতেও মা-বাবার সঙ্গে থাকাকালে এবং পরবর্তীতে পাঠ্যজীবনে এবং অতঃপর বিবাহিত জীবনেও, মা-বাবা দ্বারা, শিক্ষকদের কারও কারও দ্বারা এবং সবশেষে স্বামী-শ্বশুর-শাশুড়ি-ননদদের দ্বারা অনেকেই যেভাবে অবহেলিত ও নির্যাতিত হতে থাকে জীবনের শুরু বা জন্মকাল থেকেই, তাতে সন্দেহাতীতভাবেই বলা যায়, নারী নির্যাতন কমানো যেতে পারে, কিন্তু তা আমাদের 'সমাজদেহ' থেকে নির্মূল করা সহজে যাবে না।

আমাদের পারিবারিক সামাজিক রীতিনীতি, ধর্মীয় বিধিবিধান বহু ক্ষেত্রেই যে নারীর জন্য উৎপীড়ক ও বৈষম্য সৃষ্টিকারক তাতে সন্দেহ নেই। আর এই সামগ্রিক ব্যাপারগুলো আমলে নিয়ে তার যথাযথ এবং সাহসী সংস্কার অপরিহার্য হওয়া সত্ত্বেও সমাজপতিরা ও রাষ্ট্রনায়কেরা কেন যে এগিয়ে আসেন না, তা-ও ভেবে পাওয়া যায় না। মাননীয় আইনমন্ত্রী, যাঁকে একজন আধুনিক মানুষ এবং প্রাজ্ঞ আইনজীবী হিসেবে জানতাম, জানতাম তাঁকে বঙ্গবন্ধুর লালিত স্বপ্ন ও আদর্শের একজন বিষ্ঠাবান সমর্থক হিসেবে, আজ তাঁর সম্পর্কে তেমন ধারণার অনেকটাই তিরোহিত এবং তা আবার তাঁর নিজস্ব কাজকর্ম ও বক্তব্যের কারণেই।

তাই আসলেই ভয় হয় এখন তাঁর মুখ থেকে কোনো কথা শুনলে! যেমন ভয় পাই তিনি জামায়াত নিষিদ্ধ করার (হেফাজত বা ধর্মভিত্তিক দলকে নয়) ব্যাপারে আদালতে মামলা ঠুকে দেবেন এবং এ লক্ষ্যে অনেক আগেই আইন প্রণয়ন করে মন্ত্রিসভার অনুমোদনের জন্য পেশ করবেন– এমন কথা এক বছরেরও বেশি আগে বললেন। কিন্তু বাস্তবে তেমন কোনো পদক্ষেপ আজও দৃশ্যমান নয়।

কেন যে জামায়াতের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে হবে এবং কেনই বা ধর্মাশ্রয়ী দল গঠন বা তার কার্যপরিচালনা সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে নিষিদ্ধ করা হবে না, তাও বোধগম্য নয়, বরং অত্যন্ত দুর্বোধ্য। কারণ মামলা ছাড়াই তো বঙ্গবন্ধু এগুলো নিষিদ্ধ করেছিলেন।

এবারে আইনমন্ত্রী 'সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার আইন' করবেন বলাতে পুনরায় শঙ্কিত বোধ করছি। কারণ সরকারের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা এখনও নাসিরনগর গিয়ে বলছেন, "বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক নজিরবিহীন দেশ।"

অথচ দেশ-বিদেশে সভা-সমাবেশ চলছেই নাসিরনগর ও অন্যান্য জেলা-উপজেলায় হিন্দু নির্যাতন এবং গোবিন্দগঞ্জসহ নানাস্থানে বর্বরোচিতভাবে আদিবাসী সাঁওতালদের উপর অকথ্য নির্যাতন, জমি দখল প্রভৃতির বিরুদ্ধে। তবুও আইনের প্রসঙ্গে যখন স্বয়ং আইনমন্ত্রী বলেই ফেলেছেন– আগামীতে বিষয়টির নানাদিক নিয়ে লিখব এমন প্রত্যাশা রেখে আজকের লেখাটি নারীর বিয়ের বয়সের মধ্যেই সীমিত রাখছি।

মা-বাবার কাছে মেয়েশিশুর চেয়ে ছেলেশিশু যে অনেক বেশি আদরের তা বেশিরভাগ পরিবারে আজও দৃশ্যমান। ছেলেদের পোশাক বেশি দামি, ভালো খাবারটা তাদের, ঘরের কাজে মেয়েশিশুদের ব্যবহার, মেয়েদের গৃহবন্দি করে রাখার প্রবণতা এবং তাদের পোশাকের উপর অভিভাবক বা শিক্ষকদের অবৈধ নিয়ন্ত্রণ, চার-চারটি বিয়ে করা যাবে– পুরুষের জন্য শুধু এমন বিধান বা অধিকার, বাবা বা স্বামীর সম্পত্তিতে মেয়ে বা স্ত্রীর অধিকারহীনতা বজায় রেখে আবার নানা তুচ্ছ অজুহাতে অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েশিশুর বিবাহে বৈধতা দিয়ে সেই মধ্যযুগীয় ব্যবস্থাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে টিকিয়ে রাখা ও বৈধতা প্রদান যে কী ভয়াবহভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষতি ডেকে আনতে পারে, তা কি মন্ত্রিসভা বুঝতে অক্ষম?

আইনমন্ত্রী স্বয়ং তা কি উপলব্ধি করতে পারলেন না? পারলেন না মন্ত্রিসভায় অবস্থানকারী অনেক প্রবীণ নারীরাও, পারলেন না বামপন্থার রাজনীতিতে জীবন শুরু করে যৌবনের শেষে মন্ত্রিত্বে আসীন হওয়া প্রগতিশীল মন্ত্রীরাও?

এখনও সময় আছে মাননীয় আইনমন্ত্রী ও তাঁর মাধ্যমে মন্ত্রিসভার প্রতি আহ্বান জানাই আইনটি যেভাবে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে সেভাবে নয়, তা সংশোধন করে সরাসরি লিখুন–

"কোনো ক্রমেই ১৮ বছরের কম বয়সী কোনো মেয়ের বা ২১ বছরের কম কোনো ছেলের বিয়ে দেওয়া, বিয়ে করা, বিয়ে মেনে নেওয়া বা তাতে উৎসাহিত করা, তা যে কোনো অজুহাতেই হোক না কেন, কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এ আইন অমান্য করলে দশ বছর, ন্যূনতম পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও তিন লাখ টাকা জরিমানা উভয় শাস্তি প্রদান করা হবে।"

এ আইন আজ অপরিহার্য আমাদের সমাজে নারীর শিক্ষা-দীক্ষা এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে চাইলে।

আশা করি, মন্ত্রিসভার সুমতি হবে। কোনো ক্রমেই যেন বর্তমানে যে রূপে মন্ত্রিসভা অনুমোদন দিয়েছে, সে রূপে আইনটি সংসদে পেশ বা উত্থাপন করা না হয়।