উন্নয়নের জন্য ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ অপেক্ষা!

গোলাম কিবরিয়া পিনুগোলাম কিবরিয়া পিনু
Published : 29 Nov 2016, 04:17 AM
Updated : 29 Nov 2016, 04:17 AM

সরকারের আওতায় বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে যে ঢিলেঢালা ভাব চলছে, তার বড় এক উদাহরণ সরকারের নেওয়া আবাসিক প্রকল্পগুলো। এটা আমাদের কথা নয়, সরকারের গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের কথা থেকে এমনটা প্রতীয়মান হয়।

কিছুদিন মন্ত্রী মহোদয় বলেছেন, "পূর্বাচলের বয়স ২০-২২ বছর হয়ে গেছে। এসব প্রকল্প কেয়ামত থেকে কেয়ামত চলতে পারে না। কেয়ামত পর্যন্ত এটি চলবে, রাজউক চালাবে, আমি মন্ত্রী থাকতে এটা অ্যালাও করতে পারি না। আমার ম্যাজেস পরিষ্কার। শুধু পূর্বাচল নয়, উত্তরা তৃতীয় প্রকল্পের ক্ষেত্রেও তা-ই, ঝিলমিল প্রকল্পের ক্ষেত্রেও তা-ই।"

ধন্যবাদ মন্ত্রী মহোদয়কে, তিনি সত্যকে অন্ধকূপ থেকে তুলে আলোয় উন্মোচন করলেন!

সরকার ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব রয়েছে তার নাগরিকদের মৌলিক চাহিদা হিসেবে বাসস্থানের সুব্যবস্থা করা; সেই লক্ষ্যে হয়তো উল্লিখিত প্রকল্পগুলো হাতে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এসব প্রকল্প জনগণের কাজে লাগছে কি না, সেটাই বিবেচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কয়েক বছর পর পর বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন কাজের বাজেট বাড়িয়ে নিয়ে কায়েমী স্বার্থবাদী মহল এসব প্রকল্প থেকে তাদের নিজের পকেট ভারী করছে। এসব প্রকল্পের প্লট বিতরণের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন সরকারের আমলে অনিয়মের অনেক খারাপ উদাহরণ রয়েছে।

আগের বিএনপি সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী মির্জা আব্বাস সেই সময়ে বলেছিলেন, "দুই বছরের মধ্যে পূর্বাচলে মানুষ গ্যাস-বিদ্যুৎ নিয়ে বসবাস করতে পারবেন।"

এরপর কত 'দুই বছর' চলে গেছে, তার খবর নেই।

প্রকল্পের উন্নয়নের মধ্য দিয়ে জনগণের আবাসিক চাহিদা মেটানোর চেয়ে সরকারের লোকেরা 'প্লট বাণিজ্য' ও 'সুযোগ-সুবিধা' নিতে বেশি তৎপর। তাদের অনেকের একাধিক ফ্লাট-প্লট তো আছেই। এই তো সেদিন জাতীয় সংসদে রওশন এরশাদ এমপিদের প্লট-ফ্লাট দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অনুরোধ করেছেন। আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, কতজন এমপির বাড়ি-ঘর-ফ্লাট নেই! আর কত সুযোগ-সুবিধা নিতে নিতে আপনরা ক্লান্ত হবেন!

জনগণের বাসস্থানের অধিকার বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী দেশের মানুষের মৌলিক অধিকার; সেই অধিকার নিয়ে তো এমপিরা সংসদে বিচলিত হন না, আলোচনা করেন না। কিংবা উল্লিখিত আবাসিক প্রকল্পগুলো বিভিন্ন অনিয়ম ও অব্যস্থাপনায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছে, তা নিয়েও তো এমপিদের কোনো মাথাব্যাথা নেই!

এসব প্রকল্পে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ হচ্ছে সরকারের মাধ্যমে, তা তো জনগণের করের টাকা। পাাশাপাশি প্লট গ্রহীতার নিয়োগকৃত টাকাও। এর সুফল কে পাচ্ছে?

মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের কথা থেকে আরও বেদনাদায়ক চিত্র আমরা খুঁজে পাই। তিনি বলেছেন, "একজন লোক ৬০ বছর বয়সে জমি পেয়েছেন, ৮০ বছর বয়সে এসে মারা যাচ্ছেন। ২০ বছরেও জমি বুঝে পাচ্ছেন না।"

কী বেদনাদায়ক পরিস্থিতি!

অনেক দেশ আছে, যেখানকার সরকার ১০ বছরে একটি নতুন নগর গড়ে তোলে, নতুন রাজধানীর গোড়াপত্তন করে। আর আমাদের দেশে জমি বুঝে পেতে ২২ বছর চলে যায়, তবু পায় না, কবে পাবে তারও নিশ্চয়তা নেই! পরিপূর্ণ শহর গড়া তো কল্পনার বিষয়। এত ধীর অগ্রগতি, এত দীর্ঘ অপেক্ষায় মানুষের আবাসনের চাহিদা মেটানোর কোনো তাৎপর্য থাকে কি? বিশেষ করে যে মানুষটি স্বপ্ন দেখেছিলেন যে নিজের জায়গায় বাসা করে বসবাস করবেন!

আমাদের সরকারগুলোর কর্ণধাররা শুধু ফাঁকা বুলি আওড়ে ক্লান্ত হতে থাকেন! সরকার জনগণের উন্নতি করছে, কোন পর্যায়ে করছে, তা বিবেচনায় আনারও ফুরসত আমরা পাচ্ছি না। রাজনৈতিক ডামাঢোলে আমাদের মনোযোগ অস্থির হওয়ার কারণে অনেক জরুরি ও মানুষের মৌলিক চাহিদার বিষয়গুলো সেভাবে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হচ্ছে না। আর হচ্ছে না বলেই সরকার ও সংশ্লিষ্টজনেরাও জবাবদিহির অনেক দূরবর্তী অবস্থানে থাকছে।

অনেক ক্ষেত্রে 'উন্নয়ন' নামক মুলো চোখের সামনে দেখতে দেখতে মানুষকে একসময় চোখের পাতা চিরদিনের জন্য বুঁজে ফেলতে হচ্ছে, না হলে 'কেয়ামত থেকে কেয়ামত' পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে।