আঠারর আগে বিয়ে: আমরা উল্টো দিকে যাচ্ছি কেন?

Published : 26 Nov 2016, 03:54 AM
Updated : 26 Nov 2016, 03:54 AM

ছোটবেলায় গল্পের আসরে শুনেছিলাম ভূতের পা নাকি থাকে উল্টো দিকে। সে তাই সর্বক্ষণ অতীতের দিকে তাকিয়ে থাকে। সামনে এগোতে পারে না, জীবনের পথে হাঁটতে পারে না। 'বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৬' দেখে সে কথাই আবার মনে পড়ল। আইনটির খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পেয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে, মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ থাকছে। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে 'সর্বোত্তম স্বার্থে' আদালতের নির্দেশে এবং মা-বাবার সম্মতিতে যে কোনো অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের বিয়ে হওয়া সম্ভব।

এই বিশেষ ক্ষেত্রে বিয়ের প্রসঙ্গটি ১৯ ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে। বিশেষ ক্ষেত্র বলতে বোঝানো হযেছে কিশোর-কিশোরীর প্রেম এবং গর্ভধারণের পর মা-বাবা চাইলে আঠারর নিচে বয়সী কন্যার বিয়ে দিতে পারবেন। তাছাড়া আদালতের নির্দেশে বিশেষ ক্ষেত্রে কন্যাশিশুর বিয়ে হতে পারবে। বিপজ্জনক বিষয় হল, আঠারর কত নিচে কন্যাশিশুর বিয়ে হতে পারবে তা এখানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি।

১৯২৯ সালের বাল্যবিবাহ আইনে যেখানে মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৪ করা হয়েছিল সেখানে ২০১৬ সালে পৌঁছে আমাদের বিশেষ ক্ষেত্রের কথা শুনতে হচ্ছে, বলতে হচ্ছে। ১৩ বছর বয়সেও কন্যাশিশু গর্ভধারণ করতে পারে। তাহলে কি নতুন আইনে ১৩ বছরের মেয়ের বিয়েও বৈধ হবে?

১৮ বছর বয়সের আগে একটি মেয়ের শারীরিক গঠন পূর্ণতা পায় না। ১৮ বা ২০ বছর বয়সের আগে সন্তান জন্ম দিলে সে সন্তানও হয় অপুষ্টি কিংবা অন্যান্য শারীরিক জটিলতার শিকার। এটি আমার কথা নয়। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যবিদদের কথা।

স্বাস্থ্যগত প্রসঙ্গ বাদ দিলেও একটি মেয়ের লেখাপড়া যে বিয়ের পরই অধিকাংশ ক্ষেত্রে অসমাপ্ত রয়ে যায় সে কথা কি অস্বীকার করার কোনো উপায় আছে? স্কুলপড়ুয়া একটি মেয়েকে বিয়ে দিয়ে তাকে সংসার ও সন্তান পালনের দায়িত্বে আটকে দিলে তার উচ্চশিক্ষা গ্রহণ বা পেশাগত জীবনে প্রবেশ কি আর সম্ভব হবে? মেয়েদের উচ্চশিক্ষা ও পেশাগত জীবন কি আরও পিছনে ঠেলে দিবে না এই আইন?

মেয়েদের বিয়ের বয়স এখন ১৮। কিন্তু বাস্তবে ১৩ থেকে ১৬ বছর বয়সে মেয়েদের বিয়ে হচ্ছে গ্রামে-গঞ্জে এবং শহরের বস্তি এলাকায়। এমনকি কিছুৃ কিছু ক্ষেত্রে শহরের সচ্ছল মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত এবং শিক্ষিত-উচ্চশিক্ষিত পরিবারেও এমন রেওয়াজ রয়েছে। বাল্যবিবাহ ঠেকাতে প্রশাসনের সাহায্য নিতে হচ্ছে বহু জায়গায়। এখন যদি আইনেই ছাড় দেওয়া থাকে তাহলে ভবিষ্যতে এসব ক্ষেত্রে প্রশাসনের সাহায্যও পাওয়া যাবে না। ঘরে ঘরে কিশোরীদের বিয়ের উদ্যোগ নেওয়া শুরু হবে। বখাটেরা অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের বিয়ে করতে আগ্রাসী হয়ে উঠবে। ধর্ষণের শিকার অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরীর বিয়ে হবে ধর্ষকের সঙ্গে।

এসব ভয়াবহ ঘটনার সম্ভাব্যতার কথা ভেবে শিউরে উঠতে হচ্ছে।

অথচ বলা হয়েছে, এটা করা হচ্ছে সর্বোত্তম স্বার্থে। দক্ষিণ এশিয়ায় বাল্যবিবাহের অভিশাপ বহু পুরনো। ৮ বছরে গৌরীদান ও ৯ বছরে রোহিনীদানের নামে শিশু মেয়েকে ঠেলে দেওয়া হত মেরিটাল রেপের নির্মমতার পথে। বিয়ের রাতেই শিশুকন্যার মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে শারীরিক নির্যাতন ও মানসিক ট্রমা থেকে। ধর্মের দোহাই দিয়ে সে সময় বলা হয়েছে মেয়ে যেন পিতৃগৃহে রজঃস্বলা না হয়। একইভাবে ধর্মের দোহাই দিয়ে বাল্যবিবাহের পথে ঠেলে দেওয়া হয়েছে মুসলিম মেয়েদেরও।

ধর্মসম্প্রদায়নির্বিশেষে বাল্যবিবাহের প্রধান কারণ হল নারীর উপর পুরুষের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। একটি শিশু মেয়েকে তার পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে অচেনা একটি পরিবেশে নিয়ে গেলে স্বভাবতই সে প্রচণ্ড অসহায় বোধ করে। সেই ভীতসন্ত্রস্ত শিশুকে স্বামী এবং তার পরিবারের সদস্যরা ইচ্ছামতো পরিচালনা করতে পারে। নারীর ব্যক্তিত্ব যেন স্বাধীনভাবে বিকশিত হতে না পারে সেজন্যই এই ব্যবস্থা।

পাকিস্তানের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, আফগানিস্তান ও ভারতের রাজস্থানের কিছু জায়গায় (যেখানে পুরুষতন্ত্র প্রচণ্ড ক্ষমতাশালী) এখনও বাল্যবিবাহ রয়েছে ভয়াবহ রূপে। আফগানিস্তানে পাঁচ-ছয় বছরের শিশু মেয়েকেও বিয়ে দেওয়া হয়। শিশুর বরও যে সব সময় শিশু হয তা নয়। চল্লিশ বা পঞ্চাশ বছরের পুরুষও শিশু মেয়ে বিয়ে করতে পারে। আমাদের নতুন বাল্যবিবাহ আইনের হাত ধরে আমরা সেদিকে যাবার পাঁয়তারা কষছি কি না সে আশংকা তাড়া করছে।

দক্ষিণ এশিয়ায় সেই উনিশ শতকে মহান সমাজ সংস্কারক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। এই কুপ্রথা নারীর বিকাশের সকল পথ কীভাবে রুদ্ধ করে দেয় তা পরবর্তীকালে বিভিন্ন লেখকের লেখায় প্রকাশিত হয়েছে।

বাংলাদেশে আমরা যে অপুষ্টির বিষচক্রে আবর্তিত হচ্ছি তার একটি প্রধান কারণ বাল্যবিবাহ। আর নারীর উচ্চশিক্ষার পথ রোধের প্রধান হাতিয়ারও এটি। এসব নিয়ে অনেক কথা বলা হয়েছে, লেখাও হয়েছে। সেগুলো আবার নতুনভাবে বলতে গেলে পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটা হবে। কিন্তু প্রশ্ন হল, এত বছর পর আবার নতুন করে বাল্যবিবাহের কুফলগুলো তুলে ধরতে হচ্ছে কেন? বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনে বিশেষ ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়ার মতো প্রগতিবিরোধী চিন্তা ও পদক্ষেপ কেন নেওয়া হল?

সর্ষের ভিতর থেকে এই বিশেষ ছাড়ের ভূতটা দূর করা না গেলে নারীর উন্নয়ের সব প্রচেষ্টা যে ভণ্ডুল হয়ে যাবে একথা তো স্বাভাবিক বুদ্ধিবলেই বোঝা যায়। যে বিশেষ ক্ষেত্রগুলোর কথা বলা হচ্ছে সেগুলো 'রাবিশ' ছাড়া আর কিছুই নয়। বলা হচ্ছে, কিশোর-কিশোরীরা পালিয়ে বিয়ে করে। তাহলে কি ছেলেদেরও বিয়ের বয়স কমানো হচ্ছে? তা কিন্তু হচ্ছে না। তাহলে কীভাবে কিশোর-কিশোরীদের স্বার্থে এই ছাড় দেওয়া হল? বরং কোনো কিশোরীকে যদি কোনো পূর্ণবয়স্ক পুরুষ ফুসলে নিযে যায় সে ক্ষেত্রে ওই লোকটির সুবিধা করে দিবে এই বিশেষ ছাড়।

তর্কের খাতিরে যদি ধরে নিই যে, কিশোর-কিশোরীরা পালিয়ে বিয়ে করছে বলে আইনে তাদের জন্য ছাড় রাখা দরকার ছিল– বাস্তবতা হল, কিশোর বয়সে পালিয়ে বিয়ে করায় কোনোভাবেই উৎসাহ দেওয়া উচিত নয়। বরং সেটি প্রতিরোধের চেষ্টা করা উচিত।

আবার বলা হয়েছে, বাবা-মা যদি ভালো মনে করেন তাহলে শিশু মেয়ের বিয়ে দিতে পারেন। এদেশের অশিক্ষিত ও অসচেতন অনেক পিতা-মাতা ভালো মনে করে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিতে পারেন পাঁচ বছর বয়সেও। প্রলোভনে পড়েও অনেক বাবা-মা শিশু মেয়েকে তার লেখাপড়া মাঝপথে বন্ধ করে বিয়ে দিয়ে দিতে পারেন। রাষ্ট্রও যদি সেটি সমর্থন করে তাহলে মেয়েটির পাশে দাঁড়াবার আর কেউ থাকবে না!

১৮ বছর বয়সের আগে মেয়ে শিশুদের বিয়ের সুযোগ রাখা একটি আত্মধ্বংসী আইন বলে মনে করছি। এত গুরুতর একটি বিষয়ে কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া বা বৈধতা দেওযা চলবে না। ভূত উল্টো দিকে চলতে পারে। কিন্তু সচেতন মানুষ চলে সামনের দিকে, প্রগতির পথে।

এ কথা আমরা বোধহয় জাতি হিসেবেই আর মনে রাখতে পারছি না।