সাম্প্রদায়িকতা ও ইতিহাসের শিক্ষা

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 9 Nov 2016, 06:05 AM
Updated : 9 Nov 2016, 06:05 AM

নাসিরনগর কি ডিজিটাল বিপদ-সংকেত? এর জের এখন দেশের নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। একজন ক্যানসার রোগীকে যত দামি কাপড় বা পোশাক পরিয়ে রাখা হোক না কেন অসুখ ছেড়ে কথা বলে না। উন্নয়নের তকমা অার মুখে যত কথাই বলা হোক সাম্প্রদায়িকতা এখন গভীরে। অামি তো তারুণ্যেও তা দেখতে পাই। খুব বেশি দিনের কথা নয়, অামাদের নাম জানার পর অনেকে বলতেন, "ও অাপনি হিন্দু মানুষ? অনেক কথা বলে ফেললাম, কিছু মনে করবেন না।"

যেন হিন্দু কোনো অচেনা গ্রহের জীব। দেশে ফোন করলে অনেকেই শুরুতে সালাম দিয়ে পরে চিনতে পেরেই বলেন, "স্যরি দাদা। অাদাব।"

অামি খুব অবাক হয়ে প্রশ্ন করি, "অামার ওপর শান্তি পড়লে অাপনার কি খুব অসুবিধে?"

কথায় কথায় 'ভারতের দালাল' অার 'মালাউন' শুনতে অভ্যস্ত অামরা মন্ত্রী ছায়েদুল হকের কথায় কেন রাগ করলাম? লীগের বহু বড় নেতা দিনে ১০০ বার এসব বলে গালি দেয়। জানি, কিন্তু মানি না! এখন ঘাড়ের ওপর পড়ার পর অামরা বললেও কী আর না বললেও কী।

এ দেশে সাম্প্রদায়িকতার মূল টার্গেট হিন্দু জনগোষ্ঠী। সেটা ইতিহাসের দায়। কিন্তু স্বাধীনতার এত বছর পরও এমন বর্বর কায়দায় অাক্রমণ হতে পারে– এটা মানা যায় না। এমন ভাবা ভুল যে, এটি অাসলে বিচ্ছিন্ন একটি ঘটনা। কোনো দেশ বা জাতির ভেতরে রাতদিন সাম্প্রদায়িকতা লালন করা না হলে এভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে না। যে কোনো অজুহাতে জমিদখল, নারী নির্যাতন আর মূর্তিভাঙা সুশীলদের চোখে না পড়লেও এটাই বাস্তবতা। এ কারণে এবারের অাওয়ামী অাচরণ ওলামা লীগের এজেন্ডার প্রতি সমর্থন ভাবা অন্যায় মনে হবে না।

ধারাবাহিকভাবে হিন্দু নির্যাতন, মূর্তিভাঙা, লুটপাট আর নারীদের ইজ্জত নিয়ে খেলাটা কি সাম্প্রদায়িকতা? আমি আসলে একধরনের ধন্দে পড়ে গেছি। প্রায়ই দেখি এখানে-ওখানে আকছার ঘটে চলেছে এসব। এখন শুরু হয়েছে ধর্ম অবমাননার নামে কুৎসা রটানো। এ জাতীয় অপপ্রচার কত ভয়াবহ হতে পারে রামুর নির্বাক বুদ্ধই তার বড় উদাহরণ।

প্রতিবেশী ভারত, অতীতের দেশভাগ, পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কারণে হিন্দুরা আগে থেকেই টার্গেট। কিন্তু বৌদ্ধদের বেলায় তেমন কিছু ছিল না। বরং একাত্তরে বাংলাদেশের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের একাংশ চৈনিক রাজনীতির নামে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল।

আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমরা যখন দিনভর পালিয়ে বেড়াতাম আশ্রয়ের জন্য এ পাড়ায় ও পাড়ায় দৌড়াদৌড়ি করতাম, দেখতাম কোনো কোনো এলাকায় উর্দু ও ইংরেজিতে লেখা– "ইহা একটি চাইনীজ বৌদ্ধ পাড়া।"

সেই তারাও আজ জামায়াতী বা ধর্মান্ধদের কাছে রেহাই পায় না। বদলে যাওয়া বাংলাদেশে আমরা যতই ডিজিটাল অসাম্প্রদায়িক বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে চিৎকার করি না কেন আসলে খোলনলচে পাল্টে যাওয়ার খুব বেশি দেরি নেই আর!

শুরু হয়েছে ধর্ম বাঁচানোর নামে এক আজগুবি খেলা। বিশ্বায়নের এই যুগে খোলা দুনিয়ায় মিডিয়া মানুষের হাতের মুঠোয়। ইচ্ছে করলেই যে কোনো কিছু করা যায়। কত ধরনের 'অপশন', কত ধরনের বুজরুকি। এর ছবি ওর কাঁধে লাগিয়ে, ওর মাথা এর মুখে লাগিয়ে কত মানুষকে যে অপমান করা হয়! কত ধরনের অপপ্রচার আর ফটোশপ। এমনও দেখি বিশ্বের বাঘা বাঘা নেতা-সেলিব্রেটিও বাদ যায় না। কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যে বোঝা যেমন কষ্টের তেমনি আসল-নকল নির্ণয় করাও কঠিন।

এমন সময়ে বাংলাদেশের মতো লেখাপড়া না জানা পিছিয়ে পড়া সমাজে মানুষকে মিথ্যে তথ্য ও ভূয়া খবর দিয়ে উত্তেজিত করে তোলা কোনো ঘটনাই না। সেটার এমন ইস্তেমাল আগে দেখিনি কোনোদিন। ভাবখানা এই, ইসলাম এত ঠুনকো এক বিশ্বাস যে যে কেউ কিছু বললেই তার গোড়ায় টান পড়বে!

যে ধর্ম শুরু থেকে কঠিন দুশমনদের মোকাবিলা করে কোরাইশদের হিংসা ও আক্রমণ থেকে বাঁচিয়ে জগৎ জয় করেছিল, তার সবকিছু কি আসলে এ মূর্খদের ওপর নির্ভরশীল? খেয়াল করবেন, প্রচারণা ও অপপ্রচার কত সাংঘাতিক।

ধরে নিলাম, কোনো একজন হিন্দু বা অমুসলিম গায়ে লাগার মতো কিছু বলেছে। সেটা তো তার বা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। শাস্তি তাদের প্রাপ্য। তাদের শাস্তি দেবে আইন। সরকার দেখবে কীভাবে তা করা যায়। আইন নিজের হাতে নেওয়া এই মানুষগুলো তার ধার ধারে না। ধার ধারে না আরও একটা জিনিসের। তারা ওই মানুষগুলোকে শাস্তি দিতে চায় কি না– সেটাও প্রশ্নবোধক। তাদের ধরতে পারুক বা না পারুক এরা ঠিকই ঝাঁপিয়ে পড়ে হিন্দু কমিউনিটির ওপর। একজন বা একাধিক ব্যক্তির দায় কেন একটি জাতিগোষ্ঠী নিতে যাবে? কেন নিরীহ সাধারণ হিন্দু ও তাদের দেবদেবীরা হবে আক্রোশের নির্মম শিকার?

দেশে উন্নয়নের জোয়ার বইছে বলে যারা গলা ফাটাচ্ছেন, তাদের কাছে প্রশ্ন করি, উন্নত দেশে বা আগ্রসর সমাজে কি এমনটা সম্ভব? এভাবে কি প্রতিশোধ নেওয়া আইনসিদ্ধ? না নৈতিক? সরকার জানে না এমন কী আছে বা এমন কী থাকে একটি দেশে? কয়েক দিন পর পর দেশের নানা জায়গায় হিন্দুদের ওপর এভাবে আক্রমণ চালানো এখন নিয়মিত হয়ে পড়েছে। প্রায়ই দেখি দেবদেবীর ভাঙামূর্তি গড়াচ্ছে মাটিতে। অসহায়ের মতো বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে কোনো দেবী বা দেবতার মুখ!

কী প্রমাণ করতে চায় এরা? মূর্তির প্রতিরোধ করার শক্তি নেই? নাকি এদের টার্গেট হিন্দুদের জমিজমা? অনেকে সেটা মনে করলেও আমার তা মনে হয় না। কত আর জমিজমা তাদের? আর জমিজমা দখলের জন্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামার দরকার নেই আদৌ। দু-একরাত ভয় দেখালেই তারা পানির দামে জমি দিয়ে সীমান্ত পাড়ি দেবে। কারো ঘরে সোমত্ত মেয়ে বা জওয়ান বৌ ধাকলে তো কথাই নেই।

রাজনীতির চেহারাটা দেখুন। যতদিন বিএনপি-জামায়াত জোট গদিতে ছিল আমরা তাদের দোষারোপ করতাম। তাদের নিয়ম ছিল জমি দিতে হবে। ভোটে জিতুক বা হারুক মার খেতে হবে। মেয়েটাকে দিয়ে চলে যেতে হবে। আওয়ামী লীগের আমলে তার একটু রদবদল হয়েছে মাত্র। ভোটতো দিতেই হবে, সঙ্গে জমিও দিতে হবে। মাস্তান বা নেতার নিরাপত্তায় সীমান্ত পার করিয়ে দেওয়াও হবে। সেই নেতা বা মাস্তান এ-ও বলে রাখবেন, তার শরীর ঠিক না থাকলে তিনি যখন কলকাতা বা প্রতিবেশী দেশে যাবেন তখন তার দেখভাল করতে হবে। না হলে দেশে ফেলে যাওয়া আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব কেউ ভালো থাকবে না। এই পরম্পরা চলছে, চলবে।

হিন্দি সিনেমার মতো এক ডন যায় তো আরেক ডন আসে। ভাগ্য বদলায় না।

এদিক থেকে ওলামা লীগই বরং ঠিক। তাদের মন ও মুখ এক। অন্যদিকে 'সুশীল' নামের কথিত উদার যারা তারাই 'হিপোক্রেট'। সরকারি-বেসরকারি বিরোধীদলে যারা আছেন তারা এবং সুশীলদের কারো সংখ্যালঘু নিয়ে ভাবার সময় নেই। ভাবখানা এই, এসব সব দেশে হয়, হতে থাকবে! যার পোষাবে না সে না থাকলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়!

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে থাকা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা একাই শুধু ব্যতিক্রম। তিনি জানেন, এভাবে চললে দল দুর্বল হবে। ভারসাম্য নষ্ট হবে রাজনীতির। ভোটের বাক্সে যে ব্যবধান সেটা কমানোর জন্য বিএনপি-জামায়াত এই চাল চালছে অনেকদিন থেকে। কিন্তু এখন আওয়ামী লীগের অনেকে পা দিয়েছেন সেই ফাঁদে।

এটা আরেক ধরনের চক্রান্ত হোক বা আর যাই হোক– এ খেলা এখন চলছে। দেশের অসহায় দুর্বল ভীতিপ্রবণ হিন্দু বা সংখ্যালঘুদের নিয়ে এ আরেক খেলা। আজ এখানে কাল ওখানে দেশের নানাপ্রান্তে নির্যাতনের মাধ্যমে তাদের তাড়ানোর কাজটি চলছে অজান্তে। এতে কার লাভ কার লোকসান সবাই জানে। তবু আওয়ামী লীগের হুঁশ ফেরে না।

কে না জানে এখন দেশে সক্রিয় কোনো রাজনৈতিক দল নেই। নেই বিরোধী দলও। সবকিছু একতরফা। যদি তাই সত্য হয় কারা এসব করে? কাদের গুণ্ডাবাহিনী বা কাদের লেলিয়ে দেওয়া উত্তেজিত জনতার নামে একদল লোক এগুলো করে, তারা জানে না? এত গোয়েন্দা বাহিনী এত বাহিনী এত ক্যাডার তারপরও কেন কোনো প্রতিকার হয় না? কী আশ্চর্য বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিও এখন আপসকামী। লোক-দেখানো 'আহা', 'উহু' ছাড়া তাদের যেন কিছু করার নেই আর।

হিন্দুদের গিনিপিগ বানানোর পরিনাম কী হয় বা হতে পারে তার একটা উদাহরণ দেব প্রয়াত কথা সাহিত্যিক শওকত ওসমানের একটি ভাষণ থেকে। সে আয়োজনে তাঁর সঙ্গে আমারও কথা বলার সুযোগ মিলেছিল। তিনি তখন বয়োবৃদ্ধ। বারবার মাইক্রোফোন থেকে সরে যাচ্ছিলেন। ধরে এনে দাঁড় করাতে হচ্ছিল মাইক্রোফোনের সামনে। শওকত ওসমান বলছিলেন, তাঁর যৌবনে তিনি একদিন ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন দলে দলে লোক দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে। তাঁর পরিচিত দাদা-কাকাবাবু-জ্যাঠামশাই-মাসিমা-কাকিমারা পালাচ্ছেন ভয়ে। রাতের আঁধারে তাদের এই চলে যাওয়া তাঁকে ব্যথিত করলেও তিনি ছিলেন নিরুপায়। বারবার অজ্ঞাতের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন রাখছিলেন এর কি কোনো প্রতিকার বা জবাব নেই?

তিনিই বললেন কীভাবে সময় এর জবাব দিয়েছিল তাঁকে। কয়েক বছর পর তিনি দেখলেন, আবারও দলে দলে লোক পালাচ্ছে প্রাণভয়ে। এবার যারা যাচ্ছিল তারা কেউ সংখ্যালঘু না। সংখ্যাগুরু মানুষও পালাচ্ছে সেই একই গন্তব্যে। পাকিস্তানিদের ভয়ে।

সময় ও নিয়তি কাউকে ছেড়ে কথা বলে না। লোভ ও হিংসার হাত বড় নির্মম। তার থাবা একসময় ঘরের ওপর চড়াও হয়। বাংলাদেশে মাইক্রস্কোপিক হিন্দু বা অন্যান্যদের তাড়ানোর পর কে কার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বা কারা কাদের ওপর চড়াও হয়– সেটা আমাদের অজানা কিছু না। সেদিকেই কি চলছে বাংলাদেশ?

একটি দেশে একটি বিশেষ ধর্ম-বিশ্বাসী মানুষদের ওপর লাগাতার আক্রোশের কারণে কী হয় পাকিস্তান তার বড় প্রমাণ। সেটা না হওয়ার জন্য লাখো মানুষের আত্মদানে, ইজ্জতের বিনিময়ে মুক্তিযুদ্ধে পাওয়া দেশ আমাদের। এ দেশে কতিপয় বা কিছু অসভ্য মানুষের কারণে সবকিছু নষ্ট হয়ে যাবে– এটাই কি আমাদের চাওয়া? দেশ ও সরকারের দায়িত্ব মানুষের ভালো করা। তাদের নিরাপত্তা বিধান করা। আজ এই ডিজিটাল দুনিয়ায় যদি সেটা করা না যায় বাংলাদেশ কি তার মূল চেতনা নিয়ে সামনে যেতে পারবে?

বাংলাদেশের নাসিরনগর অাসলে 'টেস্ট কেইস'। পাকিস্তান আমলের সঙ্গে তুলনাও এখন মুখে মুখে। এই সরকারের অামলেই হয়তো তারা বলবে পাকিস্তানি জামানাতেই ভালো ছিলাম অামরা!

সাম্প্রদায়িকতা কীভাবে ঢুকেছে সেটা এখন পোশাক, খাবার, বিশ্বাসের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। এমন দিনও হয়তো অাসবে প্রতিবাদ করা যাবে কি যাবে না– সেটাও জায়েজের প্রশ্নে বিচার করব অামরা। মালাউনের দিন শেষ হল বলে। সাবধান দেশ, সাবধান জাতি।

তারপরও এ দেশ তার নিজগুণে রুখে দাঁড়ায়। অাপামর জনতা খারাপ বা হিন্দুবিদ্বেষী হলে পূজা-পার্বণ এভাবে হতে পারত না। থাকতে পারত না কেউ পাশাপাশি। ঢাকায় যারা অালো হাতে মিছিল করেছে, যাদের বুকে এখনও ভালোবাসা বহমান, তারাই অামাদের শক্তি। আমার মতো মানুষের 'ডাবল' বিপদ। মালাউন বলায় মন খারাপ বা রাগের কথা বলতে গিয়ে দেখি নিজের স্ত্রী ছাড়া যাদের বলেছি তারা সবাই মুসলমান। এরাই অামার বন্ধু-আত্মীয়।

এমন দেশে সাম্প্রদায়িকতা টেকার কথা নয়। তবে প্রতিদিন প্রতিকাজে একটু একটু করে বিষের ইনজেকশান অন্ধতার সিরিঞ্জ পুশ করলে যা হয়– এটা তার বিষময় ফলাফল। এখান থেকে বেরুতে না পারলে জাতির পতন ঠেকানো যাবে না। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা।