সৈয়দ অাশরাফের বিদায়, কাদেরের কাছে প্রত্যাশা

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 26 Oct 2016, 03:29 AM
Updated : 26 Oct 2016, 03:29 AM

বাংলাদেশের ইতিহাস ও আওয়ামী লীগের ইতিহাস সমান্তরাল। একে অপরের হাত ধরাধরি করে এই চলার ভেতর আছে আনন্দ-বেদনার নানা উপাখ্যান। স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রনায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধুসহ চার জাতীয় নেতার মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর একসময় দল প্রায় অবরুদ্ধ ও কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল। দেশ ও জাতিকে পাকিস্তানি কায়দায় নতুনভাবে পরিচিত করানোর জন্য মাঠে আনা হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ধারীদের। পথভ্রষ্ট, নষ্ট মুক্তিযোদ্ধাদের মাধ্যমে এ দেশের শাসন ও পরিচালনায় এসে তারা খোলনলচে পাল্টে দেওয়ার সব চক্রান্ত শেষ করলেও সময় ছেড়ে কথা বলেনি।

যে চীন ও আমেরিকা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সরাসরি বিরোধিতাকারী, আজ তারাও লাইন দিয়ে আছে এ দেশের সঙ্গে একযোগে ব্যবসা করতে। এমন এক সময় এসেছে আজ যেখানে ইতিহাসের দায় চুকানোর মতো কঠিন কাজও প্রায় শেষ। ঘরে-বাইরে স্বাধীনতার দুশমনদের এত খারাপ সময় আর কখনও আসেনি। আওয়ামী লীগের হাতে এই কাজ হবে বা হতে পারে এমন ভাবনা যখন প্রায় অস্তমিত তখনই পাদপ্রদীপের আলোয় এলেন শেখ হাসিনা। এখন যে যেভাবে পারছে তাঁকে নিয়ে প্রশস্তি গাইছে। দলের মাথা ছাপিয়ে ওপরে ওঠা প্রধানমন্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার পাশাপাশি তাই ভীতির ব্যাপারটাও জানিয়ে রাখতে চাই।

২০তম কাউন্সিলে আওয়ামী-ময় ঢাকা আমার মতো অনেককে অবাক করেছে। এ দেশের মানুষের মূল ভাবনা ও মৌলিক চিন্তায় প্রগতিশীলতা থাকার পরও এটা মানতে হবে, সময়ের হাত ধরে দুনিয়ার রাজনীতি ও ধর্মের কারণে নানা ধরনের সমস্যাও ঢুকেছে। একসময় মিডিয়া এত প্রকট ও প্রভাবশালী না থাকায় মানুষ অনেককিছু জানত না, দেখতও না। তখন তাদের ভাসা ভাসা ধারণায় বিপদও ছিল ভাসা ভাসা। এখন একদিকে যেমন কোনোকিছু গোপন থাকে না তেমনি নানা দেশের সমস্যা ও বিপদের আগুন সহজেই আঁচ করা যায় অন্য দেশে বা অন্য সমাজে।

মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকা ও পাশ্চাত্যের ভ্রান্ত নীতি আর যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার ফসল যে জঙ্গিবাদ তা আমাদের দেশেও আস্তানা গেড়েছে। গুলশান ঘটনার পর নীরব থাকার মানে নেই। বলা ভালো, শেখ হাসিনার সরকার শাপলা চত্বর থেকে গুলশান পর্যন্ত সব ঘটনাই সামাল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিকভাবে দেশ আর আগের জায়গায় নেই।

এ লেখা যখন লিখছি তখনও তিনি নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁর কর্মীদের কাছে দেওয়া ভাষণে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে দল ও সরকারের কঠোর মনোভাবের কথা বলেছেন। তাঁর আন্তরিকতা প্রশ্নহীন। কিনতু মনে রাখতে হবে এই জায়গাটায় আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তার পেন্ডুলাম সবচেয়ে বেশি দোদুল্যমান। আজকের বাংলাদেশে সুবিধাবাদী মধ্যবিত্ত এর সুযোগে তাঁকে এবং আওয়ামী লীগকে অজনপ্রিয় করার চেষ্টায় মত্ত। সেখানে সামাল দেওয়ার জন্য চাই প্রকৃত দেশপ্রেমিক ও দেশকে জঙ্গিমুক্ত করার দল। সে কর্মীবাহিনী আওয়ামী লীগের থাকলেও আমরা এবার তাদের কোনো ভূমিকা দেখিনি।

যে কথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বারবার বলেন– শুধু প্রশাসন আর গোয়েন্দাবাহিনী দিয়ে হবে না– সেটাই রাজনীতির মূল কথা। এবারের সম্মেলনে যে আবেগ-আনন্দ আর ঐক্যের আবহ দেখলাম তার কিয়দংশ থাকলেও আওয়ামী লীগ রুখে দাঁড়াতে পারবে।

কাউন্সিলে মানুষের আকাঙ্ক্ষার জায়গাটা ছিল সাধারণ সম্পাদক পদ নিয়ে। বিগত বছরগুলোতে সৈয়দ আশরাফের ইজমহীন নেতৃত্ব, দলে ভাঙনহীনতা আর উপদলীয় কোন্দল ছাড়া পথচলা তাঁকে অনন্য এক বিশিষ্টতায় দাঁড় করিয়ে রেখেছে। সত্যি কথা বলতে, বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন, সৈয়দ নজরুল, কামরুজ্জামান বা মনসুর আলীদের পর এতটা অবিতর্কিত নেতৃত্ব দেখা যায়নি। কথায় পরিমিত, আচরণে শালীন, চলনে পরিপাটি চিত্তজয়ী এই সম্পাদক না ছিলেন খুব সোচ্চার, না নীরব।

যেটাকে আমরা ভদ্রলোকের রাজনীতি বলি, যেটা মেঠো নয়, নাগরিক অথচ সবার কাছে যেতে পারে– এমন এক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ আশরাফ। তাঁর চরম বিরোধীরাও তাঁর বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারে না। খেয়াল করবেন, যেসব তুচ্ছ ও ব্যক্তিগত দোষের কথা বলা হয় সেগুলো আসলে ধোপে টেকে না। কারণ, সেগুলো কারো কাছে দোষের হলেও অনেকের কাছে আধুনিকতার 'সিম্বল'। তাঁর আধুনিক মন-মানসিকতা আর উদারতার কারণে নারীমহলে ব্যাপক জনপ্রিয় ভদ্রলোক সৈয়দ আশরাফের চলে যাওয়া তাই একধরনের শূন্যতাই বটে।

এই সেদিনও রাজনীতিতে নারীরা ছিল খালেদা জিয়ার দলে। ভোটের হিসেবে নারী ভোটে এগিয়ে থাকা বিএনপির এখন সব দিক 'ডাউন'। অাওয়ামী লীগের বিদায়ী সম্পাদক সৈয়দ অাশরাফ যে কোনো সময়ের চেয়ে অধিক রমনী-চিত্তজয়ী নেতা। অথচ এ নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো নোংরামির অভিযোগ নেই। স্রেফ ভদ্রতা আর শালীনতার জোরে ও পরিমিত কথাবার্তা এবং নিজেকে সময়মতো অাড়াল রাখার কারণে তিনি তা করতে পেরেছেন। রাজনীতি মানে যেখানে মুখরতা, বাচালতা সেখানে কঠিন সময়েও তিনি ছিলেন যথাযথ।

কে অাসবেন কে যাবেন তার বিচারক সময়। দল বা দলের লোকেরা ভালো জানে তারা কী করছে। নবাগত সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে বলাটাও অনৈতিক। হয়তো তাঁর হাতেই নতুন কোনো পথ খুঁজে পাবে দল।

কিন্তু 'ইমেজ' বলে যে বিষয়টা আছে সেখানে ওবায়দুল কাদের পিছিয়ে। অামরা যখন ছাত্র তখন তিনি ছাত্রনেতা। মুজিববাদের পতাকার তলে থেকেও কোনো নির্বাচনে জিততে পারেননি। মনে অাছে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকশানে অতিথি হয়ে এলে তাঁকে অালাওল হলের একটি রুমে তালাবন্দি করে রেখে জাসদের উগ্র ছেলেরা সারা রাত স্লোগান দিয়েছিল। সে নির্বাচনেও তাঁর ক্যারিশমায় জিততে পারেনি ছাত্রলীগ। মনে হয় না সে কথা তিনি ভুলে গেছেন। অাজ দলকে ঘিরে অাছে জাসদের নেতারা; তারা মন্ত্রী, তারা সরব, তারাই বঙ্গবন্ধুপ্রেমী। তাদের ব্যাপারে দলছুট বা হাইব্রিডদের বেলায় কী করবেন নতুন নেতা?

মুখ বদল অার চরিত্র বদল এক নয়। এমনিতেই অাওয়ামী লীগে গণতন্ত্রের ঘাটতি। এখনও চলছে মেধা ও রক্তের উত্তরাধিকারের লড়াই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী থাকায় ঐক্য এখনও অটুট। কিন্তু উপমহাদেশের রাজনীতি কী বলে?

ভারত বা পাকিস্তানে নেহেরু ও ভুট্টো ডাইনেস্টি দুই পুরুষের পর অার কাজ করছে না। ইন্দিরা ও বেনজিরের পর ইমেজ-সংকট কাটেনি দলগুলোর। অাওয়ামী লীগের তাই সাবধান হতে হবে। যাকেই তারা সামনে অানতে চায় না কেন এখনই সময়। প্রজ্ঞাবতী শেখ হাসিনা সেটা বুঝতে পেরেই হয়তো বারবার নেতা বদলানোর কথা বলছেন।

এবার অাওয়ামী লীগের অর্জন তাদের ঐক্য। তারা এখন বলতে গেলে একক দৃশ্যমান দল। তবে চোরাগোপ্তা দুশমন বা বিরোধীরা হয় ভয়ংকর। বাংলাদেশের রাজনীতির সংকটও সেখানে। যাবতীয় অাপদ অার প্রতিক্রিয়াশীল দলগুলোর শত্রু হল অাওয়ামী লীগ। অার লীগের শত্রু তার ভেতরে মোশতাকের দল।

এটা মানতেই হবে অাওয়ামী লীগের বিকল্প নেই এখনও। শেখ হাসিনা দল ও দেশকে যে উচ্চতায় নিয়ে গেছেন সেখানে তাঁর সাধারণ সম্পাদককেও পৌঁছুতে হবে। সময় অর্থনৈতিকভাবে সঠিক হলেও রাজনৈতিকভাবে প্রতিকূল। আওয়ামী লীগ না জিতলে বা দুর্বল হলে কারো শান্তি থাকবে না; সৈয়দ অাশরাফের সময় যে কোনোভাবে হোক তা ছিল। এখন হাসিনা-কাদেরের দলটি তা বজায় রেখে কত দূর যায়– সেটাই দেখব অামরা।