হিলারির অসততা এবং বাংলাদেশের দুশ্চিন্তা

বিজন সরকার
Published : 18 Oct 2016, 03:52 AM
Updated : 18 Oct 2016, 03:52 AM

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আগামী ৮ নভেম্বর। বহু প্রেক্ষাপট বিচারেই এই নির্বাচন কেবল আমেরিকার নয়, যেন সারা বিশ্বের নির্বাচন। একবিংশ শতাব্দীতে নতুন নতুন ভূ-রাজনৈতিক মেরুকরণ ঘটছে। দুই দশক আগেও একটি দেশ অন্য একটি দেশের বিশ্বস্ত বন্ধু বলে জ্ঞান করা যেত, সেটি আজকের বিশ্বে প্রায় একেবারেই অসম্ভব। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিশ্বের নানাবিধ সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার পাশাপাশি নিরাপত্তার সমস্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে সামরিক শক্তি বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা। প্রযুক্তির উৎকর্ষ বিশ্বকে যেমন বহু ক্ষেত্রেই সুন্দর করছে, তেমনি অস্থিতিশীলও করে তুলছে পরিস্থিতি। আজকাল পারমাণবিক বোমার হুমকি বাতাসে ভাসে।

এবারের আমেরিকার নির্বাচন নিয়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথাও শোনা যাচ্ছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিশ্বস্ত একজন উগ্র জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ভ্লাদিমির জিরিনোভস্কি সতর্ক করে দিয়েছেন, যদি হিলারি ক্লিনটন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হন আরেকটি নিউক্লিয়ার যুদ্ধের আশঙ্কা বেশি। তাঁর এ বক্তব্য রাশিয়ার প্রায় সব টিভিতে সম্প্রচার করা হয়। রাশিয়ার জনগণও চাইছে, হিলারি নন ট্রাম্পই আমেরিকার ক্ষমতায় আসুক।

ভ্লাদিমির জিরিনোভস্কির যুক্তি, আইএসের উত্থানের পেছনে দায় ডেমোক্র্যাটদের, বিশেষ করে বারাক ওবামা এবং হিলারির। ডেমোক্র্যাটদের নিষ্ক্রিয়তার জন্যই আইএস এখন ৩২টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে হিলারি যদি ক্ষমতায় আসেন, তিনি একই কার্ড খেলবেন। মধ্যপ্রাচ্যের এই অবস্থা চলতে থাকলে রাশিয়া বসে থাকবে না। তবে ভ্লাদিমির জিরিনোভস্কি বিশ্বের কোন অঞ্চলে এই নিউক্লিয়ার বোমা নিক্ষেপের প্রয়োজন, তা নির্দিষ্ট করে বলেননি।

আমেরিকার এই নির্বাচন কেবল সারা বিশ্বের জন্য নয়, আমেরিকার অভ্যন্তরীণ সামাজিক অনুষঙ্গের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। প্রেক্ষাপট ও ইস্যুভিত্তিক বিচারে আমেরিকার বিগত যে কোনো নির্বাচনের চেয়ে একেবারেই আলাদা এবারের নির্বাচন। কারণ, একে ঘিরে এমন কিছু ইস্যু চারপাশে ঘুরছে, যা অতীতে দেখা যায়নি। উদাহরণ: শরণার্থী, আইএস, মেক্সিকো-আমেরিকার সীমান্ত এবং আমেরিকার নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের অভিযোগ অন্যতম। তবে অর্থনীতি ও নিরাপত্তা ইস্যু এখন গৌণ হয়ে পড়েছে। নারী ও যৌনতার জ্বরে আমেরিকার নির্বাচন আক্রান্ত।

এমতাবস্থায় বলা যায়, আমেরিকার এবারের নির্বাচন স্মরণকালের যে কোনো নির্বাচনের তুলনায় বিশ্বব্যাপী জনগণের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।

২০০৫ সালের রেকর্ডকৃত একটি ভিডিও টেপে ট্রাম্পের সগর্বে এক বিবাহিত নারীর সঙ্গে যৌনসম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টার বর্ণনা ফাঁস হওয়ায় ট্রাম্পের নির্বাচনী ক্যাম্পেইনে বড় ধাক্কা লাগে। ট্রাম্প ও হিলারির মনোনয়ন নিশ্চিত হওয়ার পরপরই বিভিন্ন জরিপে দেখা যায়, হিলারি ট্রাম্পের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। পরবর্তীতে ট্রাম্প হিলারির কাছাকাছি চলে আসেন।

ভিডিওটি প্রকাশ হয় দ্বিতীয় প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্কের দুই দিন আগে। বিতর্কের পরে হিলারিপন্থী বিভিন্ন মিডিয়ার জরিপে দেখা যায়, হিলারি ট্রাম্পের চেয়ে সাত থেকে নয় পয়েন্ট ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছেন। এমনকি ফক্স নিউজের সর্বশেষ জরিপে হিলারি ট্রাম্পের চেয়ে সাত পয়েন্ট ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছে বলে জানা যায়।

ভিডিও প্রকাশের পর ট্রাম্প নিজ দলের রিপাবলিকানদের সমর্থনও হারাতে থাকেন। কংগ্রেসের স্পিকার পল রায়ানসহ দলীয় বহু সিনেট সদস্য ও কংগ্রেসম্যান ট্রাম্পের ওপর থেকে সমর্থন তুলে নেন। বলা যায়, রিপাবলিকান দলের ভেতর একধরনের গৃহযুদ্ধ বিরাজ করছে। এমতাবস্থায়, ডেমোক্রেটের মনোনীত প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের হোয়াইট হাউসে যাওয়ার পথটি সুগম হয়। নির্বাচনের বাকি আর মাত্র দুই-তিন সপ্তাহ। ট্রাম্পের জন্য অলৌকিক কিছু না ঘটলে হিলারি ক্লিনটনই আমেরিকার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট।

আমেরিকার জনগণ ট্রাম্পকে বেছে না নেওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ হল, ট্রাম্পের ইমেজ সংকট। ট্রাম্পের লাগামহীন কথাবার্তাই ট্রাম্পকে ডুবিয়েছে। ট্রাম্পের অন্যতম শত্রুই হচ্ছে তাঁর জিহ্বা। তাছাড়া বিশ্বব্যাপী মূলধারার গণমাধ্যম ও নারীরাও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। ট্রাম্প কারো সমালোচনা করতে বাদ রাখেননি। নিজ দল ও প্রতিপক্ষ দলের প্রভাবশালী নেতাদের লাগামহীনভাবে সমালোচনা করছেন।

অধিকন্তু, ট্রাম্প প্রাইমারি ভোটের সময় থেকেই আমেরিকার মূলধারার গণমাধ্যমকে অসৎ ও পক্ষপাতদুষ্ট বলে আসছেন। আমেরিকার প্রায় ৮০ শতাংশ গণমাধ্যম ট্রাম্পের বিরোধিতা করছে। মূলধারার গণমাধ্যমগুলো হিলারির অসততা, সহজাত মিথ্যাচার, দুর্নীতি ও অযোগ্যতা নিয়ে কথা বলছে না।

উইকিলিকসের হিলারি সম্পর্কিত হাজার হাজার সংবেদনশীল দলিল-দস্তাবেজ প্রকাশ করছে; সেসব মূলধারার গণমাধ্যমগুলো কৌশলে এড়িয়ে যাচ্ছে। গণমাধ্যমগুলো ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে নারীদের সঙ্গে অশালীন আচরণের অভিযোগ নিয়ে প্রতিবেদন, ফলোআপ ও বিশ্লেষণ নিয়ে ব্যস্ত। হিলারিপন্থী বাম ঘরানার মূলধারার গণমাধ্যমগুলো অনেক ক্ষেত্রেই ট্রাম্পের তুচ্ছ ঘটনা হাইপ করে প্রচার করছে। গণমাধ্যমগুলো এমন সময় প্রচার করছে যখন নির্বাচনের আর মাত্র সপ্তাহ তিনেক বাকি।

সমান্তরালভাবে, ট্রাম্প নারীদের আক্রমণ করে আসছেন। দেশটির অর্ধেক যে নারী ভোটার সেটি ট্রাম্প ভুলেই গিয়েছেন। কেবল ২০০৫ সালের ভিডিও নয়, দ্বিতীয় প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্কের পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় দশজন বিভিন্ন বয়সী নারী ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অশালীন আচরণের অভিযোগ আনেন। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মনে হয় সে তালিকা বেড়েই চলবে। যদিও সেসব অভিযোগ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে এবং ইতোমধ্যে অনেকগুলো ধোপে টিকছে না।

বলা যায়, ট্রাম্পের সঙ্গে গণমাধ্যমের বিরাগভাজনপূর্ণ সম্পর্ক হিলারি ক্লিনটনকে সম্ভাব্য ভোটারদের ভোট পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করছে। যেখানে আমেরিকার নির্বাচনে বিশ্বরাজনীতির নব্য মেরুকরণ, আইএসের পতন, চীনের মতো নাগরিক অধিকারহীন শাসনব্যবস্থার দ্রুত উত্থান ও অভ্যন্তরীণ অবকাঠামোসহ অর্থনীতি মূল ইস্যু হওয়ার কথা, সেখানে এখন নারীর প্রতি অশালীন আচরণই এবারের মার্কিন নির্বাচনের মূল ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের জনগণও গণমাধ্যমের কারণে মূল ইস্যুগুলোর বিষয়ে অন্ধকারে রয়েছে।

একটি বিষয় অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ডোনাল্ড ট্রাম্প যেভাবে তাঁর নির্বাচনী প্রচার শুরু করেন এবং এখন পর্যন্ত চালিয়ে যাচ্ছেন, বহু ক্ষেত্রেই তাঁর নন-প্রেসিডেন্সিয়াল অযোগ্যতা প্রকাশ পেয়েছে। বিশেষ করে 'মুসলিম ব্যান' ও 'ইমিগ্র্যান্টরা ধর্ষক' জাতীয় ট্যাগগুলো আমেরিকার মতো একটি পরাশক্তি দেশের প্রেসিডেন্টের রাজনৈতিক ডিসকোর্স হতে পারে না।

তবে হিলারি ক্লিনটন ট্রাম্পের ঋনাত্মক রাজনৈতিক ডিসকোর্সগুলো পুঁজি করে নিজের সীমাহীন দুর্নীতি, অসততা, মিথ্যাচার, ভণ্ডামি, রাজনৈতিক অবস্থানের দ্বিমুখিতা ও দুর্বলতা আড়াল করছেন। এটি খুবই ভয়ানক বিষয়। হোয়াইট হাউসে যাওয়ার পর হিলারির রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের এসব দুর্বল ও অগ্রহণযোগ্য বৈশিষ্ট্য কেবল আমেরিকার সমাজব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করবে, বিষয়টি তা নয়; তাঁর নেতৃত্বের এই বৈশিষ্ট্য মধ্যপ্রাচ্যের জ্বলন্ত কড়াইয়ে 'ঘি'-এর মতো কাজ করবে। আমরা যারা হিলারির মুখস্থ সুন্দর সুন্দর বুলি শুনে হিলারিকে সমর্থন দিচ্ছি তাদেরও মোহ ভাঙতে খুব সময় লাগবে না।

হিলারি ক্লিনটন যখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন, সৌদি আরব বহু চেষ্টা করেও আমেরিকার সঙ্গে অস্ত্র ক্রয়ের চুক্তি করতে ব্যর্থ হয়। মূলত সৌদি আরবের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্কের শীতল আবহটি আসে হিলারির হাত ধরেই। পরে সৌদি আরব যখন হিলারির স্বামী বিল ক্লিনটনের 'ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ ফাউন্ডেশন'-এ কয়েক মিলিয়ন ডলার অনুদান দেয়, এর কয়েক মাস পরেই আমেরিকা সৌদি আরবের সঙ্গে বড় ধরনের অস্ত্র চুক্তিতে আবদ্ধ হয়।

আজকের মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতার দায় হিলারি ক্লিনটন কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না। অতিসম্প্রতি হিলারি ও তাঁর নির্বাচনী ক্যাম্পেইনের যেসব ইমেইল উইকিলিকস প্রকাশ করেছে, তাতে হিলারির রাজনৈতিক দ্বিচারিতার অবস্থানটি স্পষ্ট। হিলারি তাঁর নির্বাচনী ক্যাম্পেইনের চেয়ারম্যান জন পডেস্টাকে এক ইমেইল জানিয়েছেন, 'সৌদি আরব ও কাতার' হল আইএসের মূল অর্থায়নকারী। অথচ হিলারি তাঁর নির্বাচনী ফান্ডের প্রায় ৫০ মিলিয়ন ডলার নিয়েছেন সৌদি আরবসহ গালফের অন্যান্য দেশ থেকে।

হিলারি ক্লিনটন নিজেই আইএসের সমস্যার অংশ। আমরা যদি আইএসের উত্থানের পেছনে হিলারির পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালীন ভূমিকা বিবেচনা না-ও নেই, তাও দেখা যায়, বর্তমান হিলারির ভূমিকাও আইএসবান্ধব। প্রথম প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্কে হিলারিকে বলতে শোনা যায়, শিয়া-সুন্নি ও কুর্দিয়ের মধ্যে বিভাজনকে পুঁজি করে আইএসের বিপক্ষে যুদ্ধ করার কথা।

হিলারি যখন নারীর প্রতি অসম্মানের বিষয়টি সামনে এনে ট্র্যাম্পকে ধরাশায়ী করেন, হিলারি তাঁর নিজের রেকর্ডের কথা ভুলে যান। হিলারি যদি নারীর প্রতি এতই সম্মান বজায় রেখে চলেন, কেন তিনি নারী নির্যাতনের শীর্ষে থাকা সৌদি আরবের মতো দেশ থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার অনুদান নেন? ক্লিনটন পরিবারের আজকের যে অর্থনৈতিক অবস্থান, তার পেছনে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর ভূমিকা খুব তাৎপর্যপূর্ণ। অথচ সেসব দেশে নারীর অধিকার নিয়ে হাজারো প্রশ্ন রয়েছে।

সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি হল, হিলারি ক্লিনটন যখন নিজের ঘরেই 'ধর্ষক' রেখে ডোলান্ড ট্রাম্পের নারীর প্রতি অশালীন আচরণ নিয়ে কথা বলেন। হিলারির এই অবস্থানটি মূলত গলাবাজি হয়ে যায়। বিল ক্লিনটনের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরও নারী ধর্ষণ করেন বলে অভিযোগ ছিল। ধর্ষণের অভিযোগের জেরে নিজের আইনজীবীর সনদ হারান এবং হাজার হাজার ডলার জরিমানা দেন তিনি।

প্রথম প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্কে হিলারি স্বপ্রণোদিত হয়ে নারী ইস্যুটি বিতর্কের শেষ মিনিটে নিয়ে আসেন। হিলারি বলেন, হিলারি যখন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সামাজিক উন্নয়নের জন্য কাজ করেছিলেন, ট্রাম্প তখন সুন্দরী নারীদের নিয়ে ডেটিংয়ে ব্যস্ত। তবে ট্রাম্প কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি। হিলারির এই মন্তব্য নারী সমাজের প্রতি অবমাননাকর। অধিকন্তু, হিলারি আইনজীবী হিসেবে ক্যারিয়ারের শুরুতেই ১২ বছরের এক মেয়ের ধর্ষকের পক্ষে আইনি লড়াই করেন। ফলে নারীর প্রতি হিলারির সম্মানের বিষয়টি কেবল রাজনৈতিক শ্লোগান ছাড়া আর কিছু নয়।

অভিবাসন নিয়েও হিলারির দ্বিমুখী অবস্থান রয়েছে। আমেরিকার মোট জনসংখ্যা প্রায় ৩৩ কোটি। অথচ দেশটিতে অবৈধ অভিবাসীর সংখ্যা এক কোটি দশ লাখের মতো। আধুনিক সভ্যতা ও প্রযুক্তির সর্বোচ্চ স্তরে থাকার পরেও মনে হয় অবৈধ অভিবাসীর সংখ্যা আমেরিকাতেই বেশি।

হিলারি নির্বাচনী সভায় এবং প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্কে 'মুক্ত-সীমান্ত'-এর বিরুদ্ধে কথা বললেও বিদেশি একটি ব্যাংকের এক কর্মকর্তাকে মুক্ত সীমান্তের কথা বলেন। এমনকি হিলারি তাঁর সীমান্তবিহীন বিশ্বের স্বপ্নের কথাও উল্লেখ করেন। সিরীয় শরণার্থীদের ভালো করে 'ভেটিং'-এর পর আমেরিকার গ্রহণ করা উচিত বলে জনসমক্ষে মন্তব্য করলেও উইকিলিকসে প্রকাশিত হিলারির ইমেইল থেকে জানা যায়, ভালো করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে শরণার্থী গ্রহণ করা অসম্ভব বলে হিলারি মনে করেন।

ডেমোক্রেটদের মূল উদ্দেশ্য হল, আমেরিকাতে অভিবাসীদের সংখ্যা বাড়িয়ে রিপাবলিকানদের ক্ষমতার বাইরে রাখা। এমনিতেই আমেরিকাতে রেকর্ডকৃত রিপাবলিকানদের চেয়ে ডেমোক্রেটদের সংখ্যা অনেক বেশি। হিলারির এই অবস্থান বেশ কট্টর। এতে করে আমেরিকার সমাজ বামপন্থার দিকে বেশি ঝুঁকে পড়তে পারে। ডোলান্ড ট্রাম্পের প্রতি নারীর প্রতি অশালীনতার ইস্যুর পাশাপাশি হিলারির নির্বাচনী ইস্যুতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনও বড় ইস্যু।

হিলারির শিবির থেকে অভিযোগ করা হয় যে, ট্রাম্প পুতিনপন্থী। উইকিলিকস রাশিয়ার গোয়েন্দাদের সহযোগিতায় হিলারির ব্যক্তিগত ইমেইল ও হিলারির নির্বাচনী ক্যাম্পেইনের ইমেইল হ্যাক করছে। অথচ উইকিলিকস প্রকাশিত হিলারির ব্যক্তিগত ইমেইল থেকে জানা যায়, হিলারি নিজেই পুতিনের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। আর এখন পুতিনবিরোধী শ্লোগান দিচ্ছেন এবং ট্রাম্পকে পুতিনপন্থী বলছেন।

হিলারির ইমেইল বিতর্ক এখানেই শেষ নয়। উইকিলিকসের হ্যাককৃত হিলারির নির্বাচনী ইমেইল থাকা জানা যায়, ডেমোক্র্যাটদের প্রাইমারি বিতর্কে হিলারিকে কী কী প্রশ্ন করা হবে, তাও আগে থেকেই হিলারিকে জানিয়ে দেওয়া হত। সে অনুযায়ী হিলারি প্রাইমারি স্কুলের ছাত্রের মতো মুখস্থ করে বিতর্কে অংশ নিতেন।

হিলারি ক্লিনটন প্রায় ৫০ হাজার ইমেইল একটি ব্যয়বহুল প্রক্রিয়ায় ধ্বংস করেছেন। যখন হিলারি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন তখন তিনি অফিসিয়াল সার্ভার ব্যবহার না করে ব্যক্তিগত সার্ভার ব্যবহার করেছেন। এই নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টার কংগ্রেসে শুনানি হয়েছে। শুনানিতে হিলারির বহু মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়েছেন।

এফবিআই যখন হিলারিকে ইমেইল ধ্বংসের বিষয়ে প্রশ্ন করে, উত্তরে হিলারি জানান যে বিশেষ দলিল দস্তাবেজের উপর 'C' অক্ষর দিয়ে কী বুঝায় তা তিনি জানেন না। অথচ প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্কে হিলারি আবার নিজেই বলছেন যে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকা অবস্থায় তিনি ক্লাসিফায়েড ডকুমেন্টগুলো ভালোভাবেই ব্যবস্থাপনা করেছেন। (ক্লাসিফায়েড ডকুমেন্ট 'C' দিয়ে চিহ্নিত করা হয়।)

এফবিআইয়ের জিজ্ঞাসাবাদের সময় ৩৯ বার "মনে করতে পারছি না" বলে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যান হিলারি। উইকিলিস থেকে এ-ও জানা যায়, এফবিআইয়ের জিজ্ঞাসাবাদ চলার সময় বারাক ওবামার প্রশাসন জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেন। জিজ্ঞাসাবাদের ঠিক আগে রাষ্ট্রের আইন কর্মকর্তার সঙ্গে হিলারির স্বামী বিল ক্লিনটন এক গোপন মিটিংয়ে অংশ নেন।

হিলারির এই অসততা, দুনীতিপরায়ণ মনোভাব, মিথ্যাচার ও রাজনৈতিক দ্বিচারিতা আমাদের জন্যও হুমকি। হিলারি যদি হোয়াইট হাউসে যান, আমাদের ড. মুহাম্মদ ইউনূসরা যে আরেক বার বেপরোয়া হয়ে উঠবেন– এতে কোনো সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের প্রতি নানা দিক থেকে চাপ আসতে থাকবে। বিশ্বব্যাংক, জাতিসংঘ ও আইএমএফসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও তৎপর হয়ে উঠবে।

দেশের কথিত সুশীল সমাজের গুলশানে আনাগোনা বহুগুণ বেড়ে যাবে। উইকিলিকস থেকে আমরা জেনেছিলাম, ড. ইউনূস হিলারির নির্বাচনী ফান্ডে কয়েক লাখ ডলার পাঠিয়েছেন। ধারণা করা যায়, কেবল ইউনূস নন, বাংলাদেশের কোনো কোনো রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে জামায়াত ও বিএনপিও কোনো না কোনোভাবে হিলারি ক্লিনটনের নির্বাচনে আর্থিক সাহায্য দিয়েছে। বাংলাদেশের জনগণকে মনে রাখতে হবে, জামায়াত পশ্চিমবঙ্গের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্বাচনে বিশাল অংকের টাকা বিনিয়োগ করেছিল। এমতাবস্থায় সন্দেহ করা অমূলক নয় যে, হিলারির নির্বাচনী ফান্ডে জামায়াতের টাকা কোনো না কোনোভাবে গেছে।

হিলারির বিজয় হলে বাংলাদেশে আরেকটি দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা চলতে পারে। আবারও পেট্রোল বোমা দিয়ে মানুষ মারার রাজনীতি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলতে পারে। 'জাতীয় সরকার', 'মধ্যবর্তী নির্বাচন'– এ ধরনের শব্দগুচ্ছের ফ্রিকোয়েন্সি রাজনৈতিক ডিসকোর্সে বেড়ে যেতে পারে। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা ঘন ঘন বাংলাদেশ সফর করবেন।

হিলারি ক্লিনটনের নির্বাচনী ক্যাম্পেইনে বহু লবিস্ট গ্রুপ জড়িত। বিশেষ করে হিলারির নির্বাচনী ক্যাম্পেইন চেয়ারম্যান জন পডেস্টার ভাই টনি পডেস্টারের লবিস্ট অফিস 'পডেস্টা গ্রুপ' বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রবলভাবে জড়িয়ে পড়তে পারে।

এমতাবস্থায় এটি বলাই যৌক্তিক যে, হিলারির ব্যক্তিগত অসততা, মিথ্যাচার ও দুর্নীতিবান্ধব রাজনৈতিক দর্শন কেবল আমেরিকার জনগণের জন্য নয়, বাংলাদেশের জন্যও দুশ্চিন্তার বিষয়।