বিমস্টেক: আঞ্চলিক সহযোগিতায় কতটা সফল হবে?

ধীরাজ কুমার নাথ
Published : 17 Oct 2016, 04:09 AM
Updated : 17 Oct 2016, 04:09 AM

ভারতের পর্যটন নগরী গোয়ায় 'বিমস্টেক'-এর একটি আউটরিচ সন্মেলনে যোগদান করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সন্মেলন শুরু হয়েছে ১৬ অক্টোবর, চলবে দুদিন। বিমস্টেককে গতিশীল করতে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহযোগিতামূলক উদ্যাগ হিসেবে কিছু সমঝোতা স্মারক সম্পাদন করাই হচ্ছে এ আউটরিচ সন্মেলনের প্রধান উদ্দেশ্য। প্রায় ১৯ বছর অতিক্রান্ত হতে চলল এই সংগঠন দর্শনীয়ভাবে কর্মকাণ্ড শুরু করতে পারেনি। তাই ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী এবার একটি ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগ নিলেন, কিভাবে সংগঠনটিকে অধিকতর অর্থবহ করা যায়। গোয়ায় অক্টোবরের ১৪ ও ১৫ তারিখে অনুষ্ঠিত হয়েছে 'ব্রিকস'-এর অষ্টম সামিট।

ব্রিকস হচ্ছে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার একটি সহযোগিতামূলক সংস্থা। দেশগুলোর ইংরেজি বানানের আদ্যাক্ষর নিয়ে এটির নামকরণ হয়েছে BRICS বা ব্রিকস।

ব্রিকসের বড় ধরনের সামিটের পরপরই বিমস্টেকের আউটরিচ সন্মেলন, যেখানে সুযোগ থাকবে উভয় সংস্থার প্রতিনিধিদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ এবং সাইড লাইনে মতামত বিনিময়ের।

'বিমস্টেক' হচ্ছে বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক বহুমুখী উদ্যোগী আঞ্চলিক সংগঠন– Bay of Bengal Initiatives for Multi-Sectoral Technical and Economic Cooperation (বা সংক্ষেপে BIMSTEC)। একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করলেও মূলত এটি হচ্ছে একটি আঞ্চলিক সহযোগিতার অঙ্গন।

১৯৯৭ সালের ৬ জুন শুরু হওয়া এ সংস্থার একজন উদ্যোক্তা বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রথম অধিবেশন হয় থাইল্যান্ডের ব্যাংকক শহরে।

বিমস্টেকের সদস্য দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, মিয়ানমার, নেপাল, থাইল্যান্ড এবং শ্রীলঙ্কা– এ সাত দেশ। এবারও গোয়ায় এসব দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানগণ সমবেত হয়েছেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়াও ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং তোবগে, নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কমল দাহল, থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী প্রায়স চান ওচা, মিয়ানমারের অং সান সু চি, আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি এবং মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিন এতে যোগদান করেছেন।

অনেকেই মনে করেন, সার্ক সম্মেলন স্থগিত হওয়ার প্রেক্ষাপটে বিমস্টেকের এই আউটরিচ সন্মেলন পাকিস্তানকে একঘরে করার বিকল্প উদ্যোগ।

২০১৪ সালের ৪ মার্চ মাসে বিমস্টেকের তৃতীয় সম্মেলন হয়েছিল মিয়ানমারের নতুন রাজধানীতে। সেখানেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যোগদান দেন এবং বিমস্টেকের ভবিষ্যৎ কর্মসূচি নিয়ে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য রাখেন।

উল্লেখ্য, ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসের ২২ তারিখে মিয়ানমারে অনুষ্ঠিত বিমস্টেকের ১৩তম মন্ত্রীপর্যায়ের সভায় স্থির হয়, বিমস্টেকের প্রধান কার্যালয় হবে বাংলাদেশের ঢাকায়। প্রধান কার্যালয়ের স্থান নির্বাচনের ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের মধ্যে ব্যাপক প্রতিযোগিতার পর ঢাকাকে ভালো যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং শ্রীলঙ্কা থেকে একজন মহাসচিবের মনোনয়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরই প্রেক্ষিতে ২০১৪ সালে এ সংস্থার মহাসচিব পদে আসীন হন শ্রীলঙ্কার সাবেক কূটনৈতিক ব্যক্তিত্ব সুমিত নাকানডালা। লক্ষ্যণীয় যে, এ সংস্থার গতিপ্রবাহ অত্যন্ত ধীর। কারণ, এটিও হচ্ছে সার্কের অনুরূপ একটি আন্তঃসরকারি সংগঠন, যেখানে সিদ্ধান্ত নিতে অনেক সময়ের প্রয়োজন হয় প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে।

বিমস্টেকের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে 'কানেকটিভিটি' জোরদার করা। সড়ক পরিবহন থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির অংশীদারিত্ব, শিল্প ও প্রযুক্তি বিনিময়, মুক্ত বাণিজ্য এলাকা গঠন, বিনিয়োগ এবং পর্যটনসহ মোট ৯৪টি সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রাথমিকভাবে নির্ধারিত হয়।

২০০৬ সালের আগস্ট মাসে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় স্থির হয় যে প্রত্যেক দেশ কিছু কাজের জন্য 'লিড কান্ট্রি ' হিসেবে চিহ্নিত থাকবে। যেমন শিল্প ও বাণিজ্যে বাংলাদেশ হবে লিড কান্ট্রি; পরিবহন, পর্যটন, পরিবেশের ক্ষেত্রে ভারত; মৎস্য, কৃষি, জনস্বাস্থ্য গণযোগাযোগের ক্ষেত্রে থাইল্যান্ড ইত্যাদি। এভাবে প্রত্যেক দেশকে নিদিষ্ট ক্ষেত্রে উদ্যোগ গ্রহণের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

এবারের ব্রিকসের সঙ্গে আউটরিচ হিসেবে গোয়ায় বিমস্টেকের সন্মেলনের একটি প্রধান কারণ হচ্ছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ব্রিকসের সঙ্গে বিমস্টেকের একটি যোগসূত্র স্থাপনে আগ্রহী। ব্রিকসভুক্ত দেশগুলো অনেক বেশি আর্থিকভাবে এবং প্রভাব বলয়ে শক্তিশালী, যেখানে আছে চীন এবং রাশিয়ার মতো দেশ। একই সঙ্গে বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে প্রায় ২৪.৪৫ বিলিয়ন ডলারের কৌশলগত অংশীদারিত্বের চুক্তি করেছে এবং মিয়ানমারের সঙ্গে রাশিয়ার আছে অনেক সহযোগিতার ক্ষেত্র।

সম্ভবত ভারত এই আউটরিচ সন্মেলনের মাধ্যমে বিমস্টেককে গতিশীল করতে আগ্রহী। ভবিষ্যতে সার্ককে গুরুত্ব দিতে ভারত আগ্রহী নয়। কারণ, পাকিস্তানি সামরিক জান্তা সন্ত্রাসবাদকে প্রকাশ্যে লালন করছে। এ ছাড়াও ব্রিকস এবং বিমস্টেকের মিলিত যে স্বল্প সময়ের সন্মেলন হবে তাতে উঠে আসবে কিভাবে ব্রিকস ব্যাংক থেকে বিমস্টেককে বিভিন্ন খাতে বিশেষ করে, আনুষঙ্গিক অর্থ ব্যয়ের সুযোগ করে দেওয়া যায়।

ব্রিকস এবং বিমস্টেকের সন্মেলন শুধু দুটি পৃথক সন্মেলন হলেও একটি ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের সূচনা করেছে সংগঠন দুটির মধ্যে। যে কয়েকটি ক্ষেত্রে এ দুই সংস্থার সহযোগিতা প্রয়োজন হবে, তা হচ্ছে মূলত জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যমত প্রতিষ্ঠা, জনগণের মধ্যে অধিক যোগাযোগ বা চলাচলের সুবিধাদান, পর্যটন শিল্পের বিকাশ, পরিবেশ সংরক্ষণের সহযোগিতা এবং সর্বোপরি দারিদ্র্য বিমোচন।

তবে একটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে যে, বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত এবং নেপাল একটি গ্রুপ করেছে (BBIN), যারা কানেকটিভিটি নিয়ে অধিক আলোচনা ও সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রসারিত করতে আগ্রহী। অপরদিকে বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমার (BCIM) গ্রুপ অনেক বেশি শক্ত অবস্থানে আছে। চীনের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফরকালে 'এক অঞ্চল, এক পথ' এবং 'সিল্ক রুট'-এর ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি মূলত BCIM-কে অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন।

এ ছাড়া দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশের সংগঠনও (SASEC) ইতোমধ্যে সহযোগিতা পাচ্ছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক থেকে। এ ছাড়া আছে এশীয় কো-অপারেশন ডায়লগ, মেকং গঙ্গা কো-অপারেশন এবং সিরডাপ নামক সংস্থা, যেখানে প্রায় এসব দেশ কোনো না কোনোভাবে সম্পৃক্ত। তাই ভবিষ্যতে বিমস্টেকের গতিপ্রকৃতি কেমন হবে এবং বিমস্টেকভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতার ক্ষেত্র কেমন রূপ নেবে– এ নিয়ে অনেক সংশয় আছে।

এ কথা সত্য যে, ভারত এ যাবৎ বিমস্টেকের প্রতি খুব একটা মনোযোগ দেয়নি। কিন্তু এবার সার্ক সন্মেলন বন্ধ হওয়ার পর ভারত বোধ হয় বিমস্টেককে অধিকতর শক্তিশালী করার প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছে।

বাংলাদেশও বিমস্টেকের প্রধান কার্যালয় স্থাপনের প্রেক্ষাপটে এই সংস্থার প্রতি অধিক মনোযোগ দিতে বাধ্য হবে। উল্লেখ্য, বর্তমানে সিরডাপ (Centre for Integrated Rural Development for Asia and Pacific), Partners in Population and Development (PPD), International Centre for Diarrhoeal Disease Research, Bangladesh (icddr,b)-এর সদর দপ্তর বাংলাদেশে অবস্থিত। বাংলাদেশ জমিদান, গৃহনির্মাণসহ ব্যাপকভাবে এসব আন্তর্জাতিক সংস্থাকে সহযোগিতা করছে। অত্রএব ভবিষ্যতে বিমস্টেকের সদর দপ্তর কিভাবে অধিকতর অর্থবহ করা যায়, এ ব্যাপারে অবশ্যই বাংলাদেশ মনোযোগী হবে– এমন আশা করা যায়।