রাঙা হোক রাঙ্গামাটি

অনিকেত সন্ধানী
Published : 8 Oct 2011, 09:00 AM
Updated : 16 Oct 2016, 03:04 PM

চট্টগ্রাম থেকে রাঙ্গামাটি। বিভাগীয় শহর আর উপজেলা শহরগুলো পার হওয়ার পর প্রকৃতি তার অকৃপণ সৌন্দর্য দিয়ে অভিবাদন জানায় যেন। এই সুন্দরের আড়ালেই লুকিয়ে ছিল কত না অসুন্দর একসময়! হানাহানি কম হয়নি। শান্তিচুক্তি অশান্তির পুরোটা না পারুক বেশির ভাগটাই দূর করেছে ইতোমধ্যে। রাঙ্গামাটিতে আছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় কৃত্রিম হ্রদ। কিন্তু একে ঘিরে আকাশ আর পাহাড় মিলে যে সুন্দর রচনা করেছে, সেটা অকৃত্রিম।

আমি সব শেষ রাঙ্গামাটি গিয়েছিলাম ২০১৫ সালে। রাতে হোটেলের বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। তখন রাত সাড়ে চারটা। কোনো কিছু করার নেই দেখে বারান্দায় গিয়ে বসলাম। রাঙ্গামাটি লেকের পাশেই পর্যটনের হোটেল। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। চারদিকে নিকষ অন্ধকার, কিন্ত বৃষ্টির সুমধুর আওয়াজ। আমি আর বৃষ্টি মুখোমুখি, "জগতে কেহ যেন নাহি আর"। এমন সুন্দর রাত, এমন সুন্দর বৃষ্টি আর এমন সুন্দর সকাল রাঙ্গামাটি ছাড়া আর কোথাও আসে না! নাগরিক জীবনে যা যন্ত্রণা নিয়ে আসে, রাঙ্গামাটি সেটাকেও রঙিন করে দিতে পারে।

এ জন্যই যাবেন রাঙ্গামাটি। বার বার যাবেন। অনেক কড়ি গচ্চা দিয়ে আর কুয়ালালামপুর এয়ারপোর্টে সম্ভাব্য অপমানকে মেনে নিয়ে লংকাভি যেতে হবে না। নানান বাহানায় বার বার যাবেন রাঙ্গামাটিতে। শহরের নৌঘাট কিংবা পর্যটন হোটেল পেরিয়ে ঝুলন্ত ব্রিজের কিনার থেকে স্পিডবোট নিয়ে হ্রদ ঘুরতে যাবেন। লাইফ জ্যাকেট পরে নেবেন। তাহলে মনটা নিরাপত্তাবোধে প্রসন্ন থাকবে। নির্ভার মন নিয়ে তখন জল আর পাহাড়ের কোলাকুলি দেখবেন।

এ হবে অন্য রকম অভিজ্ঞতা। লেকের মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পাহাড়ের চূড়া এবং তার বিচ্ছিন্ন জনজীবন আপনাকে বিস্মিত করবে। চারদিকে পানি-ঘেরা একটি ছোট ভূখণ্ডে তাদের বিচরণ এতই সীমিত যে তাদের জীবনের সঙ্গে হয়তো আপনি কয়েদির জীবনের কোনো তফাৎ খুঁজে পাবেন না! আপনার কবি মন হয়তো খুব জানতে চাইবে– মাথার উপরে বিশাল আকাশের ডাক শুনে ওদের কি কোনোদিন পানিতে ঝাপ দিয়ে আত্মাহুতি দিতে ইচ্ছে করে কি না!

হয়তো বা না। কিন্ত ওদের জীবন বাঁধা শক্ত অর্থনৈতিক বেড়ি দিয়ে। অর্থনৈতিক কয়েদির জীবন ওদের। সেই বেড়ি ব্যক্তির শক্তি দিয়ে এড়ানো সম্ভব নয়। রাষ্ট্রের সহায়তা দরকার। কিন্ত সেই সহায়তা এখনও পুর্ণ মাত্রায় মেলেনি। অর্থনৈতিক জীবনের প্রাণভোমরা হচ্ছে বিনিময়, সোজা কথায়– হাট-বাজার। একজনের যা কিছু উদ্বৃত্ত তা হাটে বিকিয়ে তার যা নেই সেটা কিনবে। এটা একধরনের অনিবার্যতা। কেবল কল্পিত দ্বীপের একমাত্র বাসিন্দা রবিনসন ক্রুশোর জীবনেই বিনিময়হীন অর্থনীতির অস্তিত্ব পাওয়া যায়। আর কোথাও নয়। জলবেষ্টিত এসব দুর্গম পাহাড়ের ঢালেও না।

রাঙ্গামাটির উর্বরা ভূমিতে ফসল হয় রাশি রাশি। কিন্তু সেগুলি বিপণনের ব্যবস্থা নেই। তাই তার বেশির ভাগ পচে যায়। এশিয়াতে উৎপাদিত পণ্যের প্রায় ৩০ শতাংশ বিপণন এবং সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে যায়। দুর্গম এলাকার কিছু লোকের অনুমানের ভিত্তিতে দেখা যায় রাঙ্গামাটির প্রায় ৬০ থেকে ৭০ ভাগ পচনশীল ফসল পচে যায় বিপণনের অভাবে। কারো পেটেই যায় না। তবে এ বিষয়ে একটি জরিপ চালিয়ে দেখা দরকার এর প্রকৃত পরিমাণ কত। আর উৎপাদিত পণ্য মাঠ থেকে উপজেলা সদরে নিয়ে যেতে সারা দিন লেগে যায়। পার হতে হয় পাহাড়, বন, জলাভূমি, জঙ্গল। আর সেখানে যেহেতু বাইরের পাইকার আসে মুষ্টিমেয়, পণ্যের দামও মেলে না তেমন।

যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটালেই কেবল বাজার তার সুফল মেলে ধরতে পারবে। তখন পণ্যপরিবহন সহজ হবে। পরিবহন ব্যয় কমে যাবে। স্থানীয়-অস্থানীয় পাইকাররা আসবে। তখন আদিবাসী কৃষক তার কলা, আম, কমলা, পেপে কিংবা আনারসের ন্যায্য দাম পাবে। কিন্ত রাষ্ট্র এখনও পার্বত্য অঞ্চলের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ উন্নয়নে মনোযোগী হয়নি। হয়তো বন-জঙ্গলের মানুষগুলোর প্রয়োজন এখনও তার কাছে গুরুত্ব পায়নি। কিন্ত এখানকার রাস্তাঘাট উন্নত হলে সারা দেশের, বিশেষ করে ঢাকার মানুষেরও লাভ হবে। তখন ঢাকায় ফল-ফলাদির সরবরাহ বেড়ে যাবে। কাপ্তাই হ্রদের মাছ রাত না পোহাতেই ট্রাকে ট্রাকে কারওয়ান বাজার পৌঁছে যায় বলেই কিন্তু ঢাকার বাজারে মাছের সংকট বড় হয়ে দেখা দেয় না।

'শিল্পের স্থানীয়করণ' বলে অর্থনীতিতে একটি কথা আছে। কোনো অঞ্চলে উৎপাদিত কাঁচামালের উপর ভিত্তি করে সেই অঞ্চলেই কলকারখানা গড়ে উঠে। রাঙ্গামাটিতে যে পরিমান ফল-ফলাদি উৎপন্ন হয়, সেখানে কৃষি ভিত্তিক কলকারখানা গড়ে ওঠার কথা। সেটা হলে এই অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক জীবন পাল্টে যেত। কিন্ত সেটা হয়নি। না হওয়ার কারণ জমি সংক্রান্ত জটিলতা। রাঙ্গামাটিতে জমি ক্রয়-বিক্রয়ের পথ রুদ্ধ না হলেও সীমিত। সেখানে কেউ নতুন করে বাইর থেকে গিয়ে জমি কিনতে পারবে না। আদিবাসীদের জমি হাতছাড়া রোধ করার জন্যই নাকি এই ব্যবস্থা।

জমি বাজারে বিক্রয় করার একটা পণ্য বটে। তফাৎ এই, জমি বাজারে আসে না। ক্রেতা জমির কাছে যায়। নিয়ম করে ক্রেতা আসা বন্ধ করা মানে, জমির বাজার তুলে দেওয়া। এতে কার ক্ষতি বেশি হচ্ছে? আশির দশকের শেষের দিকে বাংলাদেশের অনেক এলাকায় ২০ শতক জমি বিক্রি করে একটা রিক্সাও কেনা যেত না। আর এখন সেসব এলাকাতেই একই পরিমান জমি বিক্রয় করে একটা গাড়িও কেনা যায়। জমির সরবরাহ বাড়ে না, কিন্ত চাহিদা বাড়ে। সঙ্গে বাড়ে তার বাজার দাম। তাতে সম্ভাব্য ক্রেতার অসুবিধা হয় বটে। কিন্ত ক্রেতা এবং ক্রেতার ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে বলেই এই দাম বৃদ্ধি। তাই এই নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা না করলেও চলবে।

সারা বাংলাদেশেই জমির দাম বেড়েছে এবং বাড়ছে। আর এই দাম বাড়া কিন্তু মানুষের হাতে পুঁজির সরবরাহ বাড়াচ্ছে। প্রয়োজন মতো একটু জমি বিক্রি করে কেউ ব্যবসার পুঁজি যোগাচ্ছে, কেউ ভাঙাচোরা ঘরটার জায়গায় একটা ভালো ঘর বানাচ্ছে। আবার এমন অনেকেও আছে, একটু জমি বিক্রি করে ব্যাংকে টাকাটা রেখে দিয়ে সেটির আয় দিয়ে সন্তানদের পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। এ সবই জমির তারল্যকরণের মাধ্যমে ব্যবহারযোগ্য পুঁজির যোগান বাড়ানোর উদাহরণ।

জমির দাম না বাড়লে এ কাজগুলো সহজ হত না। প্রশ্ন হল, পার্বত্য অঞ্চলে জমির কেনা-বেচা শুধু স্থানীয়দের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দেওয়ার কাজটা অর্থনৈতিক বিবেচনায় গ্রহণযোগ্য কি না। সমতলের বাসিন্দারা যেভাবে জমির বর্ধিত দামের সুবিধা কাজে লাগিয়ে পুঁজি জোগাড় করছে, আদিবাসীরা কি সেটা পারছে? জমি একটা সম্পদ। অন্য সব সম্পদের মতো জমি তখনই সম্পদ হয় যখন সেটা অর্থনৈতিক সুফল নিয়ে আসে। আর মানুষ সিদ্ধান্ত গ্রহণে সার্বভৌম। জমির বাজার উন্মুক্ত করলেই আদিবাসী জমি খোয়াবে– কথাটা ঠিক না। অর্থনৈতিক বিবেচনায় জমি বিক্রয় প্রয়োজন এবং প্রাপ্ত দামের ভিত্তিতে যৌক্তিক মনে হলে বাজার ব্যক্তিকে সেই সুযোগটি দেবে মাত্র। সেই সুযোগ গ্রহণ করা বা না করার বিষয়টি ব্যক্তির সার্বভোম সিদ্ধান্ত। জমি কেনা-বেচার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে সেই সুযোগটিকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আদিবাসীদের জমি তারল্যকরণের মাধ্যমে পুঁজি যোগানের পথ রুদ্ধ করা হয়েছে।

তাতে কার লাভ? প্রথমত, লাভ সেখানকার অপেক্ষাকৃত ধনী আদিবাসীদের। কারণ, তারা এখন কম দামে জমি কিনতে পারছে। ফলাফল দাঁড়াল এই যে, গরীব আদিবাসীরা জমি খোয়াবে ঠিকই, তবে তা ধনী আদিবাসীদের কাছে। যার খোয়া যায়, সেটা খোয়াই যায়। বাইরের কারো কাছে খোয়া গেল নাকি স্বজাতি জ্ঞাতীর কাছে গেল, তা দিয়ে কিছু যায় আসে কি? তারা জমি খোয়াবে ঠিকই কিন্তু প্রয়োজন মতো পুঁজির যোগান হবে না। দাম কম বলে একই প্রয়োজনে ১০ শতকের জায়গায় তাদের ২৫ শতক বিক্রি করতে হয়। ফলে জমি খোয়ানোর পরিমানটা বরং বেড়ে যাচ্ছে। সমতলের গল্পটা কিন্তু একটু ভিন্ন।

জমি না পাওয়ায় সমতলের বিনিয়োগকারীরা পার্বত্য জেলায় বিনিয়োগ করতে পারছে না। কৃষিভিত্তিক কলকারখানা একটি উদাহরণ। কিন্তু বিনিয়োগের আরও সুযোগ আছে এসব জেলায়। তার একটা বড় উদাহরণ পর্যটন। রাঙ্গামাটিকে মালয়েশিয়ার লংকাভি কিংবা বান্দরবানকে নেপালের নাগরকোট বানিয়ে লাখ লাখ দেশি-বিদেশি পর্যটককে আকৃষ্ট করার জন্য দরকার বিনিয়োগ। কিন্তু সেই বিনিয়োগের সুযোগ কাজে লাগাতে পারছে না ব্যক্তি খাত। ব্যক্তি খাতের প্রবেশাধিকার রহিত করার সু্যোগ কারা নিচ্ছে? নিচ্ছে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান, ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠান। উদাহরণ টেনে বরং বৈরিতা তৈরি না করি। কিন্তু তাকিয়ে দেখুন কারা বিনিয়োগ করছে সেখানে। এসব বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পরিবেশ, জনবসতি, এবং যাদের জমি নেওয়া হচ্ছে তাদের অর্থনৈতিক জীবনের উপর কি প্রভাব পড়ছে তার সঠিক মূল্যায়ন এবং সে জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না, সেটা দেখভাল করেছে কি কেউ? এসব প্রশ্ন অপ্রিয়। উত্তরও জানা। এসব ইস্যু বাদ দিয়ে যারা পার্বত্য সীমান্তে বিজিএফ ফাঁড়ি নির্মার্ণের জন্য জমি অধিগ্রহণ নিয়ে ঢাকার শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত রুমে বসে সোচ্চার হন, তাদের মেরুদণ্ডের জোর নিয়ে করুণা করা ছাড়া উপায় থাকে কি? তারা হয় ভীত, না হয় মতলববাজ।

অনেকদিনের অনেক বঞ্চনার ইতিহাস হয়তো আদিবাসীদের মনে তাদের জমি খোয়ানোর ব্যাপারে একধরনের শঙ্কা তৈরি করেছে। তাদের এই শঙ্কা যৌক্তিক হলেও তা রোধের জন্য গৃহীত ব্যবস্থা ভুল। অজান্তে সেই ভুল ব্যবস্থার শিকার হচ্ছে প্রান্তিক আদিবাসীরা। প্রয়োজন দরিদ্র আদিবাসী রাজেশ তইঞ্চাও যেন সমতলের আলী মিয়ার মতো একটু জমি বিক্রি করে তার ছেলেটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে সমর্থ হন। বর্তমানে অনুসৃত ব্যবস্থা এ কাজের পথে অন্তরায়। সরিয়ে নেওয়া হোক এই বাধা। তাহলেই রাঙা হবে রাঙ্গামাটির মানুষের অর্থনৈতিক জীবন।