গুডবাই গুড কিং

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 15 Oct 2016, 01:00 PM
Updated : 15 Oct 2016, 01:00 PM

উত্তর কোরিয়ার কিম জিং ইল মারা যাওয়ার পর কোরিয়ানদের শোক দেখেছিলাম। বুঝতে সময় লাগেনি মিডিয়া প্রভাবিত চাপে-ভয়ে জড়ো হওয়া মানুষের শোক ছিল লোক দেখানো। খেয়াল করবেন, সবাই কাঁদছিল, বুক চাপড়াচ্ছিল এক সুরে, এক কায়দায়। যেন রিহার্সেল করে এসেছিল তারা! থাইল্যান্ডের শোক তেমন না। রাজা ভূমিবলে মৃত্যুতে দেশবাসী সত্যিই শোকার্ত।

যত বার দেশটিতে গেছি রাজা ভূমিবলের জনপ্রিয়তায় বিস্মিত হয়েছি। দেশবাসী তাদের রাজাকে দেবতূল্য মনে করে। দেশের ভেতরে থাকা মানুষ অনেক সময় তা করতে হয়তো বাধ্য হন। কিন্তু যারা দেশের বাইরে, যেমন সিডনিতে বসবাসকারী থাইল্যান্ডের মানুষ রাজার নাম শুনলে আগে মাথা নমিত করে, তারপর কথা বলে। রাজা ভূমিবল তাঁর দেশের অনেক উন্নতি করেছেন। রাজনীতি ও সেনাশাসনের দ্বন্দ্বে বারবার তিনিই ছিলেন ত্রাণকর্তা। ভূমিবলের স্বাভাবিক মৃত্যু মনে করিয়ে দিল, অনেক দেশেই জনপ্রিয় রাজাও মারা যান অস্বাভাবিকভাবে। নেপালের বীরেন্দ্র শাহ এর বড় উদাহরণ।

রাজ বীরেন্দ্রও তাঁর জনগণের কাছে ছিলেন ভীষণ জনপ্রিয়। এখনও নেপালের মানুষ মনে করে, তিনিই পারতেন দেশকে সামনে এগিয়ে নিতে। সে দেশের গায়ে এখনও উন্নয়নের হাওয়া তেমন লাগেনি। যতটা এগোনোর কথা ততটা পারছে না নেপাল। ইতোমধ্যে তারা হিন্দু দেশের তকমা ঝেড়ে ফেলেছে। মাওবাদীরাও এসেছিল গদিতে, লাভ হয়নি। দুর্নীতি, অন্যায় আর অপশাসনে নেপাল রাজত্বের শোক কাটাতে পারেনি আজও।

রাজা বীরেন্দ্রর আমল 'স্বর্ণযুগ' কিছু ছিল না। কিন্তু মানুষের মনে তাঁর ইমেজ এখনও অম্লান। কেন? কারণ, তাঁর মৃত্যূ মানতে পারেনি নেপালিরা। পুরো পরিবারকে হত্যা করে আত্মঘাতী পুত্রের জীবন দেওয়ার কারণ এখনও কুয়াশাচ্ছন্ন। এরপর যিনি রাজা হয়েছিলেন সেই রাজার আমলে রাজতন্ত্র তো গেছেই, সম্মান, বিশ্বাস এমনকি রাজমহলও গেছে। রাজা জ্ঞানেন্দ্র এখন একরকম আত্মগোপনে থাকেন। খবরে দেখলাম, গত দশ বছর বিদ্যুৎ বিল দেননি এই রাজা। বীরেন্দ্রের সঙ্গে এই তাঁর তফাৎ।

দেশে দেশে কত রাজা। সবার খবর কি রাখি আমরা? যাঁরা দেশ ও জাতির মাথার উপর ছাতা হয়ে থাকেন তাঁদেরই মনে রাখে মানুষ। ভূমিবলের অসামান্য জনপ্রিয়তার কিছু নমুনা দেওয়া যেতে পারে। প্রথম যে বার ব্যাংকক যাই দর্শনীয় জায়গা হিসেবে রাজপ্রাসাদ দেখতে যাওয়া ছিল ভ্রমনের অংশ। যেমন ভেবেছিলেম তেমন হলেও চমক ছিল অনেক। রাজপ্রাসাদের আশেপাশে অনেক মানুষকে দেখলাম দুহাত জোড় করে প্রণাম জানাচ্ছে। এরা সবাই সে দেশের মানুষ। কেউ কাজে যাচ্ছে, কেউবা ব্যবসা করতে, কারো হাতে রোগীর পথ্য, কারো চোখেমুখে আনন্দের ঝলক।

আনন্দ-বেদনা প্রাত্যহিক কাজে মন্দিরের মতো ছিল ভূমিবলের রাজপ্রাসাদ। দেশবাসীর অনেকে রাজাকে হয়তো সামনাসামনি দেখেনি কখনও। দেখার কথাও না। কিন্তু রাজা তাদের কাছে ছিলেন সম্ভাবনা ও সৌভাগ্যের প্রতীক। দেশটিতে সবচেয়ে বিস্ময়ের বিষয় তাদের এয়ারপোর্ট। দিনেরাতে কত বিমান নামছে আর উঠছে হিসাব রাখা মুশকিল। সে বিমানবন্দরে রাজা ভূমিবলের ছবি চারদিকে। ব্যাংকে, পোস্টাপিসে, বাজারে সবজায়গায় ছিলেন রাজা।

একরাতে হোটেলে ফেরার পথে দেখি সারা দিনের কাজ শেষে ফেরা থাইরা রাস্তার পাশে আসন করে রাখা রাজার ছবিতে প্রণাম জানাচ্ছে। এমন এক উচ্চতায় পৌঁছে যাওয়া একধরনের বিতর্কও তৈরি করে বটে। মানুষ তো আর দেবতা নয়। দেবতা জ্ঞান করার বিপদ আমাদের চেয়ে বেশি আর কে জানে!

যিনি দেবতায় পরিণত হন তাঁর হিতাহিত জ্ঞান লোপ পেতে থাকে। উঠতে উঠতে একসময় তিনি যেমন অদৃশ্য হয়ে যান, তেমনি উপর থেকে মানুষকে মনে হতে থাকে বিন্দুর মতো। এসব অপদেবতারা মানুষহীন হয়ে পড়ার পর যখন 'ভূপ্রপাত ধরণীতল' হন তখন তাদের শেষযাত্রায় যাওয়ার মানুষ পাওয়া যায় না।

থাইল্যান্ডের রাজনীতি সরল কিছু না। থাকসিনের পর সে দেশে নানা ধরনের ঝামেলা লেগেই আছে। দিনের পর দিন রাস্তাঘাট অবরোধ করে মিছিল-মিটিং হয়েছে। পর্যটনে ধস নামায় কোটি কোটি ডলার লোকসান দিয়েছে দেশ। সেনাবাহিনীর নাক গলানোও সে দেশে নিয়মিত ব্যাপার।

থাইল্যান্ডের যাবতীয় সমস্যায় ভূমিবল ছিলেন ঐক্য আর সমঝোতার প্রতীক। একজন মানুষ তাঁর ইমেজ-ক্যারিশমায় পুরো জাতিকে এক ছাতার তলায় রাখতে পারেন– এটা কম বড় কথা না।

ইংল্যান্ডের রানি আরও শক্তিশালী। ইউরোপের শক্তিধর দেশ দুনিয়ার অন্যতম মাতবর ইংল্যান্ড। তাদের রানিও ঐক্যের প্রতীক। কিন্তু টনি ব্লেয়ার যে মধ্যপ্রাচ্যের লড়াইয়ে সামিল হলেন রানি জেনেছিলেন পরে। জেনে অখুশী হলেও তত দিনে যা হওয়ার হয়ে গিয়েছিল। সে যুদ্ধের পর দুনিয়ার চেহারা পাল্টে গেছে। এত মারামারি এত হানাহানি এত জঙ্গি আগে দেখিনি আমরা। অথচ রানি তা জানতেন না। শাসনতান্ত্রিকতার পরিবর্তে অালঙ্কারিক রাজতন্ত্রের এটাই দুর্বলতা। থাইল্যান্ডে রাজতন্ত্র নিস্ক্রিয় হলেও রাজা ছিলেন সব ভরসার কেন্দ্রবিন্দু।

এখন দেখার বিষয় সে দেশের অর্থনীতি কোনদিকে মোড় নেয়। রাজার জীবনাবসানের সঙ্গে সঙ্গে ৩০ দিনের জন্য সবকিছু বন্ধ হয়ে গেছে। এটা কিঞ্চিৎ অস্বাভাবিকও বটে। কারণ, এই শোক আমাদের দেশের মতো লোক দেখানো কাঙ্গালি ভোজ বা বিরিয়ানির প্যাকেটে সীমাবদ্ধ কিছু না। মাইক লাগিয়ে পাড়া-মহল্লায় হল্লা করার শোকও না। এটা তাদের ভেতরের শোক। দোকানপাট ব্যবসা বাণিজ্যে এর প্রভাব পড়বেই। ইতোমধ্যে ডলারের দাম বেড়ে গেছে। এর ওপর আছে মানুষের আস্হা বা বিশ্বাসের বিষয়।

দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তিধর থাইল্যান্ডের সামনে তাই অনিশ্চয়তার হাতছানি। সেটা তারা কিভাবে কাটিবে ওঠে, সেটাই এখন দেখার বিষয়। রাজতন্ত্রে অনেক বিষয় জানানো হয় না। মানুষ বলে রানি নাকি আগেই মারা গেছেন। বলা হয়নি বা রাজার কারণে চেপে রাখা হয়েছিল। এখন তা জানানো হবে আর উভয়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াও নাকি হবে একসঙ্গে। জানি না, সত্য না মিথ্যা। তবে এটাও হবে দেখার বিষয়।

গণতন্ত্রের যা নমুনা তাতে মাথার উপর এমন একজন রাজা থাকাটা মন্দ কিছু না। অন্তত জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে রাখতে পারেন তাঁরা। আমি দেখেছি, মানুষের অন্তরে জাগ্রত এক রাজার নাম ভূমিবল। আমাদের তো নানা অনুশাসনের জন্যও এমন কেউ থাকতে পারেন না। থাকলেও আমরা তাঁকে মাথা নত করে শ্রদ্ধা জানাতে পারব না। যারা জানাবে তাদের 'শিরক' করার অপরাধে কখন কে মেরে ফেলবে, কে জানে! আমাদের শোকও এখন সীমাবদ্ধ। নিয়ন্ত্রিত।

রাজা এখন অতীত। তবে ইতিহাসে তাঁর একটা জায়গা ছিল এবং থাকবে। নতুন রাজাকে সে দেশের মানুষ কখনও পিতার মতো সম্মান জানাবে না। তিন মেয়ের এক মেয়ে ছিল পিতার ছায়া। কৃষিবিদ। থাইরা তাঁকেই রানি হিসেবে চেয়েছিল। কিন্তু পুরুষতন্ত্র আর নিয়ম তাঁকে তা হতে দেবে না। আর একটি মেয়ে সম্ভবত প্রতিবন্ধীদের দেখাশোনা করে জীবন কাটায়। আর একজন ডিভোর্স হওয়ার পর নিভৃতে থাকেন। ছেলেটি একের পর এক বিয়ের করার পর আজ সিংহাসনে।

রাজা ভূমিবলকে থাইল্যান্ডবাসী পয়মন্ত মানুষ বলে মানেন। তেজ ও বিক্রমে ৭০ বছর দেশ কাঁপানো রাজার বিদায়ে থইল্যান্ডের মানুষের সঙ্গে আমরাও শোকার্ত।

গুডবাই কিং।