কাশ্মীর সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান প্রয়োজন

রণেশ মৈত্র
Published : 7 Oct 2016, 10:27 AM
Updated : 7 Oct 2016, 10:27 AM

সম্প্রতি উপমহাদেশীয় রাজনীতিতে এক উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। হঠাৎ করেই ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে ভারতের এলাকায় উরি নামক স্থানে ভারতের একটি সেনাঘাঁটিতে অতর্কিতে হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ হামলায় প্রায় ৩০ জন ভারতীয় সেনা নিহত হয়েছে। ভারত স্বভাবতই এতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে এবং ভারতীয়দের মধ্যে এ ঘটনা ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।

এর আগে দুদেশের মধ্যে বিস্তর বাকবিতণ্ডা চলছিল কাশ্মীর নিয়ে। কাশ্মীর দুদেশের সরকারের কাছে শক্তি-পরীক্ষার ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে হয়। দীর্ঘ ৭০ বছর ধরে এ ইস্যুতে দুদেশের মধ্যে উত্তেজনা চলছে। ছোট-বড় মিলিয়ে যুদ্ধও হয়েছে কয়েকটি।

এক কাশ্মীর সম্ভবত ভারত ও পাকিস্তানের যত হাজার মানুষের জীবনসম্পদ কেড়ে নিয়েছে, সমগ্র ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামেও অত বিপুল সংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটেনি! ওই সংগ্রাম ছিল বিদেশি শাসক ইংরেজদের বিরুদ্ধে। কিছু সংখ্যক বীর স্বাধীনতা যোদ্ধার ফাঁসি হয়েছে, হাজার হাজার সংগ্রামী নেতা-কর্মীকে বছরের পর বছর কারাগারে নির্যাতন সইতে হয়েছে এবং আরও বহুবিধ অত্যাচার নির্যাতন চালিয়েছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ। অথচ এত বিপুল সংখ্যক মানুষকে জীবন দিতে হয়নি তখন। কিন্তু কাশ্মীর ইস্যুতে দুদেশের বহুসংখ্যক সেনা, অগণিত বেসামরিক নারী-পুরুষ-শিশুর জীবন অকালে ঝরে গেছে। কত জনের শিক্ষাজীবন ধ্বংস হয়েছে, কত নারীকে বৈধব্য যন্ত্রণা সইতে হয়েছে, কত যুবতী ধর্ষিত হয়েছে, কত জনকে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হতে হয়েছে, তার সীমানা-পরিসীমা নেই! যেমন পাকিস্তানে তেমনি ভরতে এই ৭০ বছরে বহুবার বহু সরকার পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু এ সমস্যার সুরাহা হয়নি।

ইতিহাসের দিকে তাকালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলেছিল ১৯১৪ থেকে ১৯১৯ পর্যন্ত, অর্থাৎ পাঁচ বছর। এরপর সমাধান হয়েছে নানা পক্ষের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে। আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলেছে ১৯৩৯ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত, অর্থাৎ ছয় বছরব্যাপী। এতে জাপানসহ পৃথিবীর বহু দেশে বিস্তর মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে, বহু সম্পদের হানি ঘটেছে। কিন্তু কাশ্মীর নিয়ে ৭০ বছর ধরে যুদ্ধ বা যুদ্ধ-পরিস্থিতির, অস্ত্রবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর ও তা লঙ্ঘনের এবং অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষর ও পরবর্তীতে তা লঙ্ঘনের খেলা চলছে– এক বিরতিহীন লড়াই যেন। কিন্তু কেন এমন একটি দুঃসহ পরিস্থিতি চলছে এত দীর্ঘকাল ধরে?

বিদ্যমান এ সমস্যায় দুদেশেরই লাখো সাধারণ মানুষের জীবনে দীর্ঘমেয়াদী সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। তবু এমন পরিস্থিতির সমাধানের কোনো বাস্তব পন্থার উদ্ভাবন কেন হচ্ছে না? এ নিয়ে জাতিসংঘে বহু বক্তৃতা হয়েছে, বহু প্রস্তাব পেশ হয়েছে, অনেক প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে, কিন্তু ওই পর্যন্তই।

কবে থেকে কাশ্মীর সমস্যার সৃষ্টি হল? কে সৃষ্টি করল– ভারত নাকি পাকিস্তান?

না, ভারত নয়, পাকিস্তানও নয়। এ সংকট সৃষ্টি করে গেছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ– যারা এ দেশকে অর্থাৎ ভারতবর্ষকে দুশ বছর ধরে শাসন-শোষণ করেছে।

ব্রিটিশরা ভারত ছাড়তে চায়নি। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাধ্যমে তারা দুর্বল হয়ে পড়ায় ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রাম ভারতবর্ষে তীব্র হয়। এ অবস্থায় সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বের মাধ্যমে ভারত ভেঙে পাকিস্তান নামক একটি তথাকথিত মুসলিম রাষ্ট্রের উৎপত্তি ঘটালেও ইংরেজ-মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের সাম্প্রদায়িক অংশ কাশ্মীরসহ ভারতের কয়েকটি রাজা-বাদশাশাসিত রাজ্যের সমস্যার সমাধান না করে তা জিইয়ে রাখে। স্থির হয়, যে রাজা বা বাদশা ওই রাজ্যগুলো শাসনের দায়িত্বে আছেন, তিনি সিদ্ধান্ত নেবেন তাঁর রাজ্য ভারতের অংশীভূত হবে নাকি পাকিস্তানের।

বাকি রাজ্যগুলোর ক্ষেত্রে ওই ফর্মুলামাফিক সমাধান ঘটলেও কাশ্মীরের ক্ষেত্রে তা কার্যকর করা গেল না। সেখানে তখন ক্ষমতায় ছিলেন একজন রাজা। তিনি হিন্দু। আর ওই রাজ্যের জনসংখ্যার বিপুল অংশ হল মুসলিম। রাজা ভারতভুক্তির পক্ষে সিদ্ধান্ত নিলেও কাশ্মীরের মুসলিম বাসিন্দাদের একটি অংশ এবং পাকিস্তান তা মেনে নিতে নারাজ হয়। ফলে সৃষ্টি হয় সংকটের।

এবং এ সংকট এমনই যে ভারত বলছে, "কাশ্মীর ভরতের অবিচ্ছেদ্য অংশ" আর পাকিস্তান বলছে, "কাশ্মীর তাদের চাই-ই।" পরিণতিতে কাশ্মিরের একাংশ পাকিস্তানের দখলে এবং বৃহত্তর অংশ ভারতের দখলে। ভারত তার অংশের কাশ্মীরিদের জন্য অনেক বেশি সুযোগসুবিধা দিয়ে আসছে। লক্ষ্য, বিদ্রোহ যেন না হয়।

আর পাকিস্তান? তাদের অধিকৃত কাশ্মীরে বিন্দুমাত্র ভিন্নমত প্রকাশ করলেই প্রাণে বাঁচার সুযোগ নেই কারও!

ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে কোনোদিন পাকিস্তান জেতেনি, আমেরিকার ব্যাপক সমর্থন থাকা সত্ত্বেও। আমেরিকা দীর্ঘকাল ধরে পাকিস্তানকে নানাভাবে মদদ ও অস্ত্রভাণ্ডার দিতে দিতে দেশটাকে একটা জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিণত করে ছেড়েছে। ফলে পৃথিবীতে জনমত পাকিস্তানের অনুকূলে নেই। এমন একটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্রের পক্ষে জনমত থাকার কথাও নয়। তবে আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের শাসক গোষ্ঠী গোপনে হলেও পাকিস্তানকে যে সমর্থন-সহযোগিতা দিচ্ছে না বা দেবে না– জোর দিয়ে এ কথা বলা মুশকিল।

অপরদিকে, সমস্যাটির সমাধানে যত বিলম্ব ঘটছে উভয় দেশে কাশ্মীর কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িকতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিণতিতে পাকিস্তান আজ প্রায় হিন্দুশূন্য। ভারতেও সাম্প্রদায়িকতা কম নেই, কিন্তু তারপরও সে দেশে গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা এবং অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যের কারণে এবং পার্শ্ববর্তী মুসলিম দেশগুলোর অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তার দুর্বলতা-অনিশ্চয়তার কারণে সে দেশের মুসলিমরা নিকটবর্তী কোনো মুসলিম দেশে চলে যাওয়ার কথা ভাবে না। কিন্তু পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে দেশত্যাগ অব্যাহত রয়েছে।

যা-ই হোক, ভারত-পাকিস্তানের বর্তমান সংঘাত শেষ পর্য্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকবে সেটাই হল আলোচ্য। সাময়িক সমাধানের চিন্তা না করে ভারত ও পাকিস্তান এগোবে কি না তা দেখতে হবে। এ সংকট জিইয়ে রাখার ফলে উভয় রাষ্ট্রের যেসব ক্ষতি হচ্ছে তা এরকম–

এক. বিপুল সংখ্যক সেনা ও অন্যান্য বাহিনীর সদস্য মোতায়েন রাখতে হচ্ছে দুদেশের সীমান্তে এবং উভয় দেশের অধীনস্থ কাশ্মীরে।

দুই. বাহিনীগুলোর জন্য বিদেশি অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র আমদানি করতে হচ্ছে।

তিন. ভারতকে তার অধীনস্থ কাশ্মীরের অধিবাসীদের বাড়তি সুযোগ-সুবিধা বাবদ বিপুল পরিমাণ বাড়তি অর্থ খরচ করতে হচ্ছে।

চার. পাকিস্তান ও কাশ্মীর থেকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ক্রমাগত দেশত্যাগ করে ভারত চলে যাবার ফলেও স্থায়ীভাবে বাড়তি দায়িত্ব ও ব্যয়ভার বহন করতে হচ্ছে তাদের।

পাঁচ. কাশ্মীরবাসী ৭০ বছর ধরে চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। সীমান্তবর্তী এলাকায় এ সমস্যা আরও প্রকট।

ছয়. কাশ্মীরের তরুণ-তরুণীদের শিক্ষাজীবন মারাত্মকভাবে ব্যহৃত হচ্ছে। ফলে তাদের ভাবিষ্যত জীবনে নেমে আসছে ভয়াবহ অন্ধকার।

সাত. কাশ্মীর একটি অত্যধিক সম্পদশালী রাজ্য। পর্যটকদের গভীর আকর্ষণের স্থান। কাশ্মিরী সিল্ক বিশ্বের আকর্ষণ। তা সত্ত্বেও পর্যটকদের দেখা পাওয়া যায় না এখন। হোটেল ব্যবসায় ধস নামছে।

আট. ভারত এখন অর্থনৈতিকভাবে অনেক উন্নত রাষ্ট্র হলেও সে উন্নয়নের ছোঁয়া থেকে বহু রাজ্য বঞ্চিত। আরও ব্যাপক উন্নয়ন, শিল্পায়ন, কৃষির অগ্রগতি, দারিদ্র্য-বেকারত্ব দূরীকররণ, সমাজের বিস্তর আধুনিকীকরণ প্রয়োজন। কিন্তু ৭০ বছর ধরে এক কাশ্মীর বাবদ যে বাড়তি সামরিক ব্যয় ভারতকে বহন করতে হচ্ছে, তাতে এসব খাতে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি হচ্ছে না। যদি কাশ্মীর সমস্যা সৃষ্টি না হত তবে হয়তো ভারতের ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হত;

নয়. পাকিস্তান তুলনামূলকভাবে অনুন্নত রাষ্ট্র। দারিদ্র্য অন্যতম কারণ যার জন্য দেশটি মারাত্মকভাবে জঙ্গি উৎপাদনের ঊর্বর ভূমিতে পরিণত হয়েছে। আমেরিকা যুগের পর যুগ ধরে পাকিস্তানকে অস্ত্রসজ্জিত করেছে, সেনাবাহিনীকে উচ্চতর প্রশিক্ষণ দিয়েছে, কিন্তু দেশটির শিল্পায়ন, কৃষির অগ্রগতি সাধন বা দারিদ্র্য দূরীকরণে নয়। ফলে পাকিস্তানকে আজও আমেরিকার একটি 'উপনিবেশ' বললে অত্যুক্তি হবে না। যদিও এবার ভারত-পাকিস্তানি নতুন সংকটে আমেরিকা তাদের পক্ষে থাকবে না বলে জানিয়েছে।

দরিদ্র রাষ্ট্র পাকিস্তানের পক্ষে বাস্তবে কাশ্মীর প্রশ্নে বিপুল ব্যয় বহনের কোনো সাধ্য-শক্তি নেই। তাই এই দ্বন্দ্বের ফলে ক্ষতি পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর না হোক, সেখানকার কোটি কোটি মানুষকে ভুগতে হচ্ছে। সুতরাং এ সংকটের আশু সমাধান পাকিস্তানের জনগণের স্বার্থেও অত্যন্ত জরুরি।

নীতিগতভাবে অবশ্য সবাই সমস্যাটির সমাধানের কথাই বলছেন, কিন্তু কাজে সেদিকে এগোচ্ছেন কমই। ফলে দীর্ঘায়িত হচ্ছে বিরোধ। আসলে মূল কথাটি মেনে নিতেই হবে যে, কাশ্মীর কাশ্মীরিদের। তাই যদি হয় সামরিক পন্থায় তো সেদিকে এগোনো যাবে না– সমাধানের পথে আন্তরিকতা নিয়ে এগোতে হলে শান্তিপূর্ণ আলাপ-আলোচনা ছাড়া বিকল্প নেই। পাকিস্তানকে বিশেষ করে এটি বুঝতে হবে যে, আমেরিকা ও চীন তার পাশে নেই। সার্ক শীর্ষ সম্মেলন তারা করতেও পারল না তাদের সন্ত্রাসী নীতির ফলে।

বস্তুত শাসক গোষ্ঠীর পরিচালিত নীতির কারণে পাকিস্তান আজ উপমহাদেশে একঘরে। দাবি উঠতে শুরু করেছে সার্কের সদস্যপদ থেকে পাকিস্তানকে খারিজ করে দেওয়ার। সর্বোপরি, পাকিস্তানের বিশাল প্রদেশ বেলুচিস্তানও আজ রুখে দাঁড়িয়েছে। অল্পকালের মধ্যেই হয়তো সেটি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে।

আবার পাকিস্তানের এই একঘরে হওয়ার পরিস্থিতি কাশ্মীর সমাধানের ক্ষেত্রে ভারতের ইচ্ছামাফিক বা তার স্বার্থে কৌশল হিসেবে না নিয়ে কাশ্মীরবাসীর স্বার্থে শান্তি পুনরুদ্ধারে অগ্রসর হলে ভারত, পাকিস্তান ও কাশ্মীর সবাই জিততে পারে।

কেউ কাউকে পরাজিত করার লক্ষ্যে আর না এগিয়ে সবাই Win-Win Position এ এলে সবারই মঙ্গল। শান্তিপূর্ণ পথেই তা সম্ভব।