কন্যাশিশু দিবস এবং বাল্যবিবাহ

মাসুমা বিল্লাহ
Published : 4 Oct 2011, 11:41 AM
Updated : 1 Oct 2016, 03:31 AM

৩০ সেপ্টেম্বর কন্যাশিশু দিবস। এ দিবস ঘিরে উৎযাপনের সব পর্যায়ে কন্যাশিশুর কৈশোরে বিয়ের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত। 'বাল্যবিবাহ' নিঃসন্দেহে একটি অভিশাপ। বলা বাহুল্য, জাতীয় পর্যায়ে অনেকদিন থেকেই আমরা এ আলোচনা এগিয়ে নিচ্ছি। কিন্তু প্রশ্ন হল, বাস্তবে কতটা সাফল্য পেয়েছি?

বাংলাদেশ যেখানে অন্যান্য সামাজিক ও উন্নয়ন সূচকে এগিয়ে যাচ্ছে তখন কেবল বাল্যবিবাহ কেন অভিশাপের মতো চেপে আছে দিনে পর দিন, বছরের পর বছর, তা গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে না দেখলে অন্যান্য সূচকও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হবে।

গবেষণা বলে, বাল্যবিবাহ আর নারীর সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়ন একসঙ্গে সম্ভব নয়। গবেষণা আরও দাবি করে, বাল্যবিবাহ নারীর যৌনস্বাস্থ্য দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকিতে ফেলে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় বাল্যবিবাহের শিকার সাধারণত কন্যাশিশু। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশের ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী ৫৯% নারী ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই বিয়ের পিঁড়িতে বসে। ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সীদের ২৫% সন্তানের মা হয়েছে।

কেন এই বাল্যবিবাহ? কেন পরিবার শিশু বয়স পার হওয়ার আগেই তার আদরের কন্যাশিশুটিকে অন্যের বাড়ি পাঠাতে চায়? এসব প্রশ্ন এখন গবেষণার বিষয়; এসব প্রশ্ন এখন সরকারী নীতি নির্ধারকদের মাথাব্যাথার কারণ।

আমরা সবাই জানি, বাংলাদেশে নারীর বিয়ের বয়স আইনত ১৮ বছর। এখন থেকে প্রায় ৮০ বছর আগে প্রণীত একটি আইনের ধারাবাহিকতায় এটা নির্ধারিত। যদিও কোনো এক অজানা কারণে অথবা ধরে নিতে পারি কোনো না কোনো ভুল ব্যাখ্যার কারণে এ আইন পিছিয়ে দেওয়ার আলোচনা উঠেছিল, যদিও তা আলোর মুখ দেখেনি। তবে কেন আইন না মেনে এত এত বাল্যবিবাহ হয়েই চলছে?

গবেষণার তথ্যউপাত্ত বলে, নারীকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে হবে। বাংলাদেশের সরকার এগিয়ে এসেছে বলিষ্ঠভাবে, মেয়েশিশুর লেখাপড়ার খরচ এখন সরকারের। গবেষণায় দেখা গেছে, যে সব মা শিক্ষিত, তারা কিছুটা দেরিতে নিজের মেয়েশিশুকে বিয়ে দিতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু কোথাও একটা অদৃশ্য বাধা থেকে গেছে, সাফল্য এখনও আশানুরূপ নয়।

গবেষণা আরও বলছে, দারিদ্র্য একটা বড় কারণ; মেয়েকে বেশি দিন পড়ালেখাসহ বাড়িতে রাখার সামর্থ্য গরিব মা-বাবার থাকে না। অবশ্য এখানে হিসাব মেলে না! সামগ্রিক দারিদ্র্য যেখানে কমেছে, মানুয়ের আয় পূর্বের যে কোনো সময়ের তুলনায় যখন বেশি, তা সত্ত্বেও বাল্যবিবাহ সে গতিতে কমছে না কেন? ধর্ম বলছে 'উপযুক্ত' কন্যাসন্তানকে সুপাত্রে পাত্রস্থ করতে; এই 'উপযুক্ত' শব্দটিকে খণ্ডিতভাবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে।

এবার যদি বলি, ৮০ বছরের পুরনো সেই আইনের ভূমিকা কী এ ক্ষেত্রে? বলতে হবে সেখানেও ফাঁকফোকর তৈরি করা হয়েছে, রাষ্ট্র যেহেতু এখন পর্যন্ত জন্মনিবন্ধন সর্বজনীন করতে পারেনি, এই সুযোগে কন্যাশিশুর বয়সের কমবেশি করে আইনের চোখে ধূলা দেওয়া খুব সহজ বইকি।

দেশ এগিয়েছে, অর্থনীতি আগুয়ান, জীবনযাত্রার মানে এসেছে অনেক উন্নতি, প্রধানমন্ত্রী বলছেন, বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে। আর এই মহাসড়কের আগুয়ান যাত্রী কিন্তু নারীই। নারীকে নিয়ে ভাবনার জায়গা কেন তবে অনেক বেশি আগুয়ান না, বরং কোনো কোনো জায়গাতে পিছিয়েছে আগের চেয়ে। নারীকে সমাজে কোথায় স্থান দেওয়ার কথা– সে শিক্ষা দেবে পরিবার। আপনার কন্যাশিশুটিকে যেমন শেখাতে হবে আত্মমর্যাদাবোধ তেমনি পুত্রশিশুটিও যেন পায় নারীকে সম্মান করার শিক্ষা।

অনেক আলোচনায়, গবেষণায়, ইনফরমাল (অনানুষ্ঠানিক) কথাবার্তায় যে কথাটি বাল্যবিবাহের অন্তর্নিহিত কারণ হিসেবে বার বার উঠে এসেছে তা হল, কন্যাশিশুর নিরাপত্তা। কন্যাশিশুর নিরাপত্তা দিতে রাষ্ট্র বদ্ধপরিকর, পরিবার তো চেষ্টা করেই যায় শেষ পর্যন্ত, কিন্তু সমাজ এ ক্ষেত্রে কেন বার বার ব্যর্থ– সেটা অনেক সতর্কতার সঙ্গে খতিয়ে দেখতে না পারলে বাল্যবিবাহের করাল গ্রাস থেকে মুক্তি নেই।

সমাজ এখানে কাঠগড়ায়, ক্ষত সারতে সমাজবিদগণসহ সংশ্লিষ্ট সবাই যদি এগিয়ে না আসেন, তবে মহামারি লাগবে। এই মহামারি আঘাত করবে সমাজের প্রতিটি রন্ধ্রে; স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অর্থনীতি, জীবিকা সবকিছু প্রাণহীন হয়ে পড়বে।

নিরাপদ সমাজ, নির্ভয়ে বিদ্যালয়ে যাওয়ার নিশ্চয়তা, আপন সৌরভে বেড়ে ওঠার স্বাধীনতা, স্বপ্ন দেখতে পারার অপার একাগ্রতা যদি নিশ্চিত করা যায় প্রতিটি কন্যাশিশুর জন্য দেশের প্রতিটি জনপদে, দেখুন না ওরা আপনার জন্য কত কিছু এনে দেয়! অন্যথায় 'এখন সময় বাংলাদেশের'– এই দাবি কমজোরি হতে বাধ্য।