চিনি চর্বি হার্ভার্ড

শোয়েব সাঈদ
Published : 24 Sept 2016, 05:28 AM
Updated : 24 Sept 2016, 05:28 AM

কোলেস্টেরল, প্রেসার আর সুগার হচ্ছে একই প্যাকেজ প্রোগ্রামের তিনটি 'এপিসোড'। মেটাবলিক সিনড্রোমের চক্করে সাধারণত আগে-পরে এই তিনটিই হাজির হয়ে ষোলকলা পূর্ণ করে। সুগার সমস্যার আগে মিষ্টি নিয়ে ভাবা হয় না, কারণ মিষ্টি ছাড়া তো চলেই না! ডাক্তারের পরামর্শে শুধু কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যে ডিম-মাংস এড়িয়ে চলেও স্বাস্থ্য পরিচর্চায় তেমন সাফল্য নেই। কোলেস্টেরল যতটা চিন্তার কারণ, চিনি নিয়ে ততটাই উদাসীনতা।

চিনি নিয়ে এই উদাসীনতা এখন বিশ্বজুড়ে ডায়েট আর নিউট্রিশন গবেষণায় এক কেলেঙ্কারির নাম! বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় হার্ভার্ডের নামও জড়িয়ে গেছে এই কেলেঙ্কারির সঙ্গে। অভিযোগ, ইচ্ছাকৃতভাবে নির্দিষ্ট গবেষণা উপাত্ত ছোট করে দেখিয়ে সত্য লুকিয়ে রাখা হয়েছে, অনেকটা বাংলায় 'উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে' চাপানোর মতো। চিনি ব্যবসায়ীদের যোগসাজশের প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও চিনিকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে, বেচারা চর্বিই 'যত নষ্টের গোড়া' হিসেবে দেখানো হয়েছে।

খুব সতর্কতার সঙ্গে গবেষক, বিজ্ঞানী, আমলা, রাজনীতিবিদ আর রেগুলেটরি এজেন্সিগুলোকে ফাঁকি দিয়ে বা ভুল বুঝিয়ে বেশ কয়েক দশক ধরে লুকোচুরির এই খেলা চলছিল। তবে গবেষক আর বিজ্ঞানী মহলে সত্যটা নিয়ে কানাঘুষা বরাবরই চলছিল, কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?

যিনি প্রথম ঘণ্টা বাঁধতে গিয়েছিলেন, পুষ্টি গবেষণায় তাঁর যুগান্তকারী অবদান শুধু খাটো করা নয়, বরং তাঁর ক্যরিয়ারও কবর দেওয়া হয়েছিল। নীরবে হারিয়ে যাওয়া ওই বিজ্ঞানীর গবেষণা প্রবন্ধগুলোও গায়েব করা হয়েছিল। দ্বিতীয়বার যিনি ঘণ্টা বাঁধতে গিয়েছিলেন, ভাগ্য ভালো, তাঁকে এত সহজে কাবু করা যায়নি, ফলে সত্য ক্রমশ সামনে চলে আসছে।

ব্রিটিশ পুষ্টিবিদ প্রফেসর জন ইয়াদকিন ১৯৭২ সালে তাঁর 'পিওর, হোয়াইট অ্যান্ড ডেডলি' বইয়ে চিনি সম্পর্কে প্রথম 'লাল পতাকা' ওড়ান। তিনি বলেন, চিনির ক্ষতি করার যে ক্ষমতা তার সামান্য অংশ যদি খাদ্যে ব্যবহৃত অন্য কোনো উপাদানে থাকত, তবে সেই উপাদান নিষিদ্ধ হয়ে যেত। ইয়াদকিনের চিনি-বিষয়ক এই উপাত্তটি আলোর মুখ দেখার সুযোগ পায়নি। চিনি শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ফুড কোম্পানিগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় চিনির পক্ষে সাফাই গাওয়া পুষ্টিবিদদের সহযোগিতায় প্রফেসর ইয়াদকিন আর তাঁর গবেষণাকর্ম হারিয়ে যায় বিস্মৃতির আড়ালে।

রবার্ট লাস্টিগ ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বাচ্চাদের মুটিয়ে যাওয়া বা ওবেসিটি নিয়ে কাজ করছেন। চিনির ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়ে সরব আছেন বেশ কয়েক বছর ধরে। ইতোমধ্যে কর্পোরেট সংস্কৃতি আর বৈজ্ঞানিক গবেষণার ভুবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে; চিনি নিয়ে পুষ্টিবিদরা মুখ খুলতে শুরু করেছেন। ফলে আশঙ্কা থাকলেও রবার্ট লাস্টিগকে প্রফেসর ইয়াদকিনের মতো একা করা ফেলা সম্ভব ছিল না।

তথ্য-উপাত্ত প্রচারের এক পর্যায়ে রবার্ট লাস্টিগ জানতে পারেন প্রফেসর ইয়াদকিন সম্পর্কে। বহু চেষ্টার পর তিনি সংগ্রহ করেন চিনি-বিষয়ক ইয়াদকিনের হারিয়ে যাওয়া বইখানি। লাস্টিগ দেখতে পান, চিনির ক্ষতিকর দিক নিয়ে নিজে যা জেনেছেন, ৩৫ বছর আগে প্রফেসর ইয়াদকিন তা জানিয়ে গেছেন বিশ্ববাসীকে।

ষাটের দশকে বিশ্বজুড়ে লো-ফ্যাট ডায়েট হছে স্বাস্থ্যসম্মত ডায়েট– এই হুজুগে হারিয়ে যায় প্রফেসর ইয়াদকিনের চিনি-বিষয়ক গবেষণা। তখন চিনি শিল্পের হর্তাকর্তারা চিনির ক্ষতিকর দিক নিয়ে প্রকাশিত গবেষণা কার্যক্রমে নজর রাখতে শুরু করেন এবং ফ্যাটকে দায়ী করে গবেষণা ফলাফল প্রকাশে অনৈতিক উৎসাহ দিতে থাকেন।

সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে সুগার এসোসিয়েশন প্রোজেক্ট ২২৬এর আওতায় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের ৫০ হাজার ডলার দেন চিনি বাঁচিয়ে শুধু ফ্যাটকে দায়ী করে গবেষণার ফলাফল প্রকাশের জন্য। ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত হার্ভার্ডের গবেষণা প্রবন্ধে হৃদরোগের জন্য একতরফাভাবে কোলেস্টেরল এবং স্যাচুরেটেড ফ্যাটকে দায়ী করা হয় এবং ইচ্ছাকৃতভাবে চিনির ক্ষতিকর দিকগুলো উপেক্ষা করা হয়।

সাধারণভাবে বলতে গেলে স্যাচুরেটেড ফ্যাট বা সম্পৃক্ত চর্বি ঘরের সাধারণ তাপমাত্রায় জমে থাকে, যেমন গরুর চর্বি ইত্যাদি। আর আন-স্যাচুরেটেড ফ্যাট বা অসম্পৃক্ত চর্বি ঘরের সাধারণ তাপমাত্রায় তরল থাকে, যেমন সয়াবিন তেল ইত্যাদি। ডিমের কোলেস্টেরল বা প্রাণিজ চর্বি নিয়ে ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মীদের যে সতর্কতা, চিনি নিয়ে সতর্কতা মোটেও কম হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু প্রভাবশালী বিশ্ববিদ্যালয় বা নামকরা গবেষকদের অসততা বা অসহযোগিতা ভোক্তাদের ধারণাই পাল্টে দেয়। ফলে বিশ্বব্যাপী সফট-ড্রিংকস আর সাম্প্রতিককালের তথাকথিত এনার্জি ড্রিংকসের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের রমরমা বাণিজ্য ব্যবসায়ীদের পকেট ভারী করলেও, বিশ্বব্যাপী ব্যাপক স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি করে।

উদ্দেশ্যমূলক বৈজ্ঞানিক উপসংহারে যখন নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষকদল জড়িত থাকে তার প্রভাব হয় ব্যাপক। দুনিয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী খাদ্য এবং ওষুধ রেগুলেটরি সংস্থা ইউএস এফডিএ, আমলা, রাজনীতিবিদ চিনি-চর্বির এই ব্লেইম-গেইম লবিংয়ে যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছিল। ১৯৮০ সালে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ডায়েটারি গাইডলাইনে যত দোষ বেচারা চর্বির উপরেই চাপানো হয়েছিল।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ মূলত এই গাইডলাইনই অনুসরণ করে। অথচ এই নির্দেশনার আগে যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৫০ সালে অতিমাত্রায় মোটা (ওবেস) লোকের সংখ্যা ছিল ১২ শতাংশ বা ১৯৮০ সালে ১৫ শতাংশ, গাইডলাইনের পরে ২০০০ সালে এসে তা দাঁড়ায় ৩৫ শতাংশে। বলা হয়ে থাকে, চিনিকে দায়মুক্তি দেওয়া বা এর ক্ষতিকর দিক উপেক্ষা করার অসৎ উপসংহার এই বিপর্যয়ের কারণ।

লো-ফ্যাট ডায়েটের সাফল্য নিয়ে সংশয়ের মধ্যে ১৯৭৪ সালে নামকরা ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল 'ল্যানসেট' ব্যাপক হারে খাদ্যে ডায়েটারি ফ্যাট কমানোর ক্ষতির ব্যাপারে সতর্ক করেছিল। তাদের বৈজ্ঞানিক বক্তব্য ছিল, ডায়েটারি ফ্যাট কমিয়ে যে চিকিৎসা তা রোগটির চেয়েও ভয়াবহ। ১৯৫৫ সালে প্রেসিডেন্ট আইসেনআওয়ার যখন হৃদরোগে আক্রান্ত হন, পুষ্টিবিজ্ঞানী ও চিকিৎসকের বরাত দিয়ে এর জন্য দায়ী করা হল ফ্যাটকে।

হৃদরোগ-ফ্যাট হাইপোথেসিসের এই চক্রে পুষ্টিবিজ্ঞান গত ৫০ বছর যাবৎ একটি অসম্পূর্ণ মিথের উপর চলেছে। রুশ প্রফেসর ইয়াদকিন এই অসম্পূর্ণ মিথের একজন ভিকটিম। প্রফেসর ইয়াদকিন প্রাণি আর মানুষের উপর করা গবেষণায় দেখিয়েছেন ফ্যাট নয়, চিনিই হৃদরোগের সঙ্গে বেশি সম্পর্কিত। মানুষ তো আসলে মাংসাশী প্রাণি, ফ্যাট মানুষের বিবর্তনের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অন্যদিকে শর্করা বা কার্বোহাইড্রেটের প্রতি মানুষের সম্পর্কের ইতিহাস মাত্র ১০ হাজার বছরের। চিনি হচ্ছে বিশুদ্ধ শর্করা যার মধ্যে নেই কোনো ফাইবার, মিনারাল ও ভিটামিন। আর পশ্চিমাদের খাবারে এর আগমনের ইতিহাস মাত্র ৩০০ বছরের।

'সুগার' শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শর্করা থেকে। ইতালীয় ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে তা পৌঁছে ইংল্যান্ডে। চিনি লিভারে প্রক্রিয়াজাত হয়ে ফ্যাট হয়। চিনি আর ফ্যাট মেটাবলিজিমের অতি টেকনিক্যাল বিষয়ে না গিয়ে সহজভাবে বলা যায়, প্রফেসর ইয়াদকিন হৃদরোগ আর মুটিয়ে যাওয়ার জন্য তথ্য-উপাত্তসহ সরাসরি দায়ী করেন চিনিকে। তবে তিনি অহেতুক ফ্যাটকেও উৎসাহিত করেননি।

এ বিষয়ে পরে আরেকজন মুখ খোলেন, তিনি কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কার্ডিওলজিস্ট এটকিন। চিনির বিপক্ষে কথা বলতে গিয়ে এটকিন অবাঞ্ছিত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ বনে যান। ইয়াদকিন আর এটকিনকে মাংস ব্যবসায়ীদের ভাড়াটে বানাতেও দ্বিধা করেননি তাদেরই সহকর্মীরা। এ দুজন স্রোতের বিরুদ্ধে লড়তে চেয়েছেন প্রাণপণে। আটকিন শুধু চিনিকে চ্যালেঞ্জ নয়, ফ্যাটের পক্ষেও দাঁড়িয়ে গেলেন এবং বলেই বসলেন, ওজন কমবে শুধু হাই-ফ্যাট, লো কার্বোহাইড্রেট ডায়েটে; লো-ফ্যাট ডায়েটে নয়।

পরিবর্তিত বিশ্বে অবস্থাদৃষ্টে এখন মনে হচ্ছে, বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া এই গবেষকদের গবেষণাকর্মের সুদিন ফিরে এল বুঝি। ২০১৪ সালে কার্ডিওলজিস্ট এটকিনের হাই-ফ্যাট, লো কার্বোহাইড্রেট ডায়েটের উপর ভিত্তি করে স্বাস্থ্য-বিষয়ক বিশ্বসেরা গবেষণা প্রতিষ্ঠান এনআইএইচ (ইউএস ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব হেলথ) ১৫০ জনের উপর গবেষণা চালিয়ে দেখেছেন, এটকিনের হাই-ফ্যাট, লো কার্বোহাইড্রেট ডায়েট গ্রুপে ওজন কমেছে লো-ফ্যাট গ্রুপের চেয়ে অনেক বেশি।

লক্ষ্য করলে দেখবেন, এখন ডিমেরও সুদিন ফিরে আসছে। মহানিষিদ্ধের জায়গা থেকে আপনার কার্ডিওলজিস্ট বা ডাক্তার এখন বলছেন, প্রতিদিন একটা ডিম খেলে সমস্যা নেই। আরও বলছেন শুধু সাদা অংশ নয়, কুসুমও খেতে পারেন।

আমাদের দেহের সব কোষে কোলেস্টেরল আছে এবং লিভার এটি তৈরি করে। প্রাণ-রসায়নবিদরা এটা জানেন যে, খাবারের মাধ্যমে (ডায়েটারি) যত কোলেস্টেরল গ্রহণ করবেন লিভার তত কম তৈরি করবে। এ রকম অসংখ্য গবেষণাকর্ম আছে যাতে দেখা গেছে, ডায়েটারি কোলেস্টেরল রক্তের কোলেস্টেরল বাড়ায় না। অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রে প্রতিদিন ২-৩টি ডিম রক্তের কোলেস্টেরল বাড়ানোয় ভূমিকা রাখে না। কারও কারও ক্ষেত্রে ২৫টি ডিমও রক্তের কোলেস্টেরল তেমন বাড়ায় না।

২০০৮ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায়, এমনকি বিশ্ব খাদ্য সংস্থার অনুসন্ধানে হৃদরোগের সঙ্গে হাই-ফ্যাট ডায়েটের বিশ্বাসযোগ্য যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি। সাম্প্রতিক প্রায় অধিকাংশ গবেষণায় হৃদরোগ আর মোটা হওয়ার পেছনের কারণ হিসেবে চিনির দিকে আঙুল তোলা হচ্ছে। লিভারে চিনি ফ্যাটে পরিণত হয়, চিনি রক্তে চর্বি-প্রবাহ ত্বরান্বিত করে, ফ্যাটি লিভারসহ নানা রকম অসুখ-বিসুখে চিনির যোগসূত্রের তথ্য ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে।

'সাদা চিনি' যাকে আমরা 'টেবিল সুগার' বলি, কার্বোহাইড্রেট পরিবারে এটি 'সুক্রোজ' নামে পরিচিত। সুক্রোজের গাঠনিক উপাদান হচ্ছে গ্লুকোজ ও ফ্রুকটোজ। সুস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা এবং পুষ্টি নির্দেশনায় এই টেবিল সুগারের পরিমিত ব্যবহার ভীষণ জরুরি হয়ে উঠছে।

স্বাস্থ্যরক্ষায় পরিমিত খাদ্যের বিকল্প নেই। তাই বলে ডিম বাদ দিয়ে নয়, পারলে চিনির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করুন। তাতে ভালো থাকবেন।

তথ্যসুত্র:

১.

২.

৩.

সিবিসি টিভি ডকুমেন্টারি:

৪.

ড. এটকিনের বই 'নিউ ডায়েট রেভোলুশন'