লেখক-শিল্পীর দৃষ্টিভঙ্গি ও গণমুখী ভূমিকা

গোলাম কিবরিয়া পিনুগোলাম কিবরিয়া পিনু
Published : 18 Sept 2016, 12:57 PM
Updated : 18 Sept 2016, 12:57 PM

বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর তৎপরতার সাযুজ্যে গড়ে উঠছে ভিন্ন মার্কার শিল্প-সাহিত্য। এর ফলে বাংলাদেশের ধারাবাহিক চেতনানির্ভর শিল্প-সাহিত্যের সজীব ও অগ্রসরমান ধারা অনেক ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীনই শুধু হচ্ছে না, সেই ধারাকে চোরাস্রোতে নিয়ে যাওয়ার জন্য একধরনের শ্বাপদনির্ভর উন্মাদনা তৈরি করা হচ্ছে। এই শিবিরের উগ্রতা ও সংগঠিত হওয়ার বাস্তবতা কি প্রগতিশীল কবি-লেখক-শিল্পীদের মধ্যে কোনো রকম প্রণোদনা সৃষ্টি করছে না?

অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদীদের লোলুপতা আর তৃষ্ণা– এর কবলে পড়ে সারা বিশ্ব আজ নয়া-ঔপনিবেশিক বাস্তবতার মধ্যে পড়ে গিয়ে সেই পুরনো অর্থনৈতিক শোষণ ও লুণ্ঠনের দিকটি উন্মোচন করছে। সাম্রাজ্যবাদ আজ প্রযুক্তি আয়ত্তে নিয়ে, মিডিয়া দখল করে, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে সারা বিশ্বে নেটওয়ার্ক তৈরি করে, সমরশক্তিতে বলিয়ান হয়ে তাণ্ডব-সন্ত্রাস চালাচ্ছে। ইরাক-লিবিয়াতে যে দখলী-ভণ্ডামি চলল, তা আমেরিকাসহ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মুখোশ উন্মোচন করেছে। এমন পরিস্থিতিতে কি বাংলাদেশের কবি-লেখক-শিল্পীরা মূক ও বধির হয়ে থাকতে পারে?

আমরা জানি, শিল্প ও সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিভিন্নমুখী মতামত আছে। ভাবুক ও লেখক-সমালোচকের মধ্যে বোঝাপড়ার পার্থক্যও আছে। কোনটা ভালো সাহিত্য বা শিল্প, তা নিয়েও তর্ক আছে। কিন্তু তারপরও বলি, দেশ ও মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কি কবি, লেখক ও শিল্পীদের কোনো ভূমিকা থাকবে না? তাঁরা কি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ও অগ্রগতি চাইবেন না? নিশ্চয় চাইবেন। পূর্বেও তাঁরা নিজেদের বিবেকতাড়িত ভূমিকা রেখেছেন, বর্তমানেও তাঁরা সেই ভূমিকা শাণিত রাখবেন, সেটাই সবার আকাঙ্ক্ষা।

লেখক-শিল্পী কোনো সংগঠন সক্রিয়ভাবে করতে পারেন, আবার না-ও করতে পারেন। তবে শিল্প-সাহিত্যের মাধ্যমে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি ও ভাবাদর্শের লড়াইটা কখনও মোটা দাগে বা কখনও সুক্ষ্মভাবে চলতে থাকে। এ পরিস্থিতি থেকে শিল্পী ও লেখকরা কখনও সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকতে পারেন না। যে শিল্পী-লেখকরা এই লড়াই থেকে দূরে থাকতে চান, তাঁরা অজান্তে কোনো পক্ষের উঠানে গিয়ে উপস্থিত হন অথবা কোনো পক্ষের 'সেবাদাস' হয়ে পড়েন। আর এই ধরনের যাঁরা শিল্প-সাহিত্যকে রাজনীতিবর্জিত করে রাখতে চান, তাঁরা হয়তো জানেন না– রাজনীতি মানে শুধু মিছিল-সভা-শ্লোগান নয়; রাজনীতি একটি দৃষ্টিভঙ্গি; বলা ভালো– বিশ্ব-দৃষ্টিভঙ্গি।

শিল্প-সাহিত্যে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা আছে। অর্থনৈতিক-সামাজিক পরিবর্তনের বাঁকে নতুন নতুন শিল্প-সাহিত্য যেমন সৃষ্টি হয়, তেমনি সমাজের পরিবর্তনের ধারাকে উন্মুখ বা বিকশিত করতে শিল্প-সাহিত্যের একধরনের ভূমিকাও থেকে যায়। এইভাবে মিথস্ক্রিয়ায় শিল্প-সাহিত্য ও সমাজ উভয়ই পরিবর্তিত হয়।

শিল্প ও সাহিত্য বিচারের ক্ষেত্রে বহু তাত্ত্বিক সমাজতান্ত্রিক দর্শন ও বিবেচনা-বোধে নতুন নতুন সমস্যা চিহিৃত করেছেন, পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দিক-নির্দেশনাও দিয়েছেন। তবে নন্দনতত্ত্বের স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য কয়েকটি সূত্রে সাবেক সোভিয়েতের নন্দনতাত্ত্বিক আনাতোলি ইয়েগেরোভ উল্লেখ করেছেন এভাবে–

১. নন্দনতত্ত্ব জগৎকে অতীন্দ্রিয়তা ও ভাববাদ থেকে মুক্ত করে বিজ্ঞানসম্মত এক অখণ্ড তাৎপর্য দান করেছে;
২. নন্দনতত্ত্ব শিল্প-সাহিত্যকে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ তত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে মানবমনে ও জীবনে শিল্প-সাহিত্যের ব্যাপক ও সক্রিয় প্রভাব অন্বেষণ করেছে এবং
৩. সামাজিক অবস্থার গতি-প্রকৃতির সঙ্গে সাহিত্যের গতি-প্রকৃতিকে অভিন্ন সূত্রে পর্যালোচনা করাই নন্দনতত্ত্বের প্রধান বৈশিষ্ট্য।

ইয়েগেরোভের এই সূত্রের ভিত্তিমূল হচ্ছে, দ্বন্দ্বমূলক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। এই সূত্রের তাৎপর্য এখনও শিল্প-সাহিত্য বিচারের ক্ষেত্রে জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ। তবুও এর বিপরীতে নন্দনতত্ত্বের আরও ব্যাখ্যা রয়েছে, তবে নন্দনতত্ত্বের নামে শিল্প-সাহিত্যে যথেচ্ছাচার কাঙ্ক্ষিত নয়।

বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি এবং অন্যদিকে একচক্ষুবিশিষ্ট দানবের মতো সাম্রাজ্যবাদের সর্বগ্রাসী উন্মাতাল পদচ্ছাপে যখন পৃথিবী রক্তাক্ত ও লণ্ডভণ্ড, তখন প্রগতিশীল শিল্পী-কবি-সাহিত্যিকদের যূথবদ্ধতা জরুরি হয়ে পড়ছে। দেশ, পৃথিবী ও মানুষের কল্যাণে কমিউনিস্ট-অকমিউনিস্ট, মার্কসবাদী-অমার্কসবাদী, জাতীয়বাদী, মানবতাবাদী ও প্রগতিশীল লেখক-শিল্পীদের এক কাতারে দাঁড়াতে হবে। বাংলাদেশে প্রগতিশীল শিল্পী-লেখকদের অবস্থান অনেক শক্তিশালী, এই অবস্থানকে আরও সংহত করা প্রয়োজন। যদিও কেউ কেউ দলবৃত্তের সংকীর্ণতায় (দল করা অসমীচীন বলছি না) ও স্বার্থপরতার চোরাস্রোতে নিমজ্জমান, যা মানুষের মধ্যে আস্থাহীনতার জন্ম দিচ্ছে। এর ফলে লেখক-শিল্পীদের সম্পর্কে ভিন্ন ধারণার উৎপত্তি হচ্ছে। এই ক্ষতিকর প্রবণতা থেকে লেখক-শিল্পীদের গণমুখী ও ঐতিহ্যবাহী ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রাখতে হবে। নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া ও মৈত্রীর সম্পর্ক সুদৃঢ় করাও জরুরি।

জার্মান লেখক ব্রের্টোল্ট বেখটের রচনা থেকে লেখক-শিল্পীদের জন্য প্রাসঙ্গিক একটা অংশ উল্লেখ করি–

"রচনা সৃষ্টির মাধ্যমে সংগ্রামে অবতীর্ণ হও। তুমি প্রমাণ করো যে সংগ্রামে নেমেছ! সেটাই হল সবল বাস্তববাদ। বাস্তবতা রয়েছে তোমার দিকে, তুমি বাস্তবতার দিকেই থাকবে। সমগ্র জীবন কথা বলে উঠুক– এর ব্যত্যয় না ঘটে।

"বুর্জোয়ারা চায় না সামগ্রিক জীবনের মুখর প্রকাশ। তবু তোমার সাধ্য রয়েছে; সাধ্যেও প্রকাশ ঘটুক। বাস্তবতাকে যেখানে নির্বাসনে দেওয়া হয়েছে, চকচকে প্রলেপে ঢেকে রাখা হয়েছে, সেখানে প্রলেপের আবরণ ছিঁড়ে ফেল! স্বগতোক্তি না করে মুখর প্রতিবাদ জানাও। আরও প্রতিবাদ তুলে ধর। তুমি স্বয়ং প্রাণবন্ত যুক্তির অধিকারী; বস্তুসম্মত যুক্তির চর্চাতেই জীবন সক্রিয়। নির্ভয় হও, যা সত্য তা বলবে।"