ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ: হুমকিতে বাংলাদেশ

এম এম খালেকুজ্জামানএম এম খালেকুজ্জামান
Published : 26 Sept 2016, 04:50 AM
Updated : 26 Sept 2016, 04:50 AM

"The river is everywhere."

― Hermann Hesse, Siddhartha

নদনদী মানচিত্রে রেখে অবিভক্ত বঙ্গদেশের একটি ভৌগোলিক মানচিত্র তৈরি করেন মেজর জেমস রেনেল ১৭৬৩ থেকে ১৭৭৩ সালের মধ্যবর্তী সময়ে। মেজর সাহেবের ১৭৮১ সালে প্রকাশিত ওই নদী-মানচিত্রের সঙ্গে বর্তমান মানচিত্রের খুব একটা মিল অবশ্য খুঁজে পাওয়া যায় না।

দেখা যাচ্ছে, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি পার্থক্য। রেনেলের ম্যাপ অনুযায়ী মেঘনা, যমুনা ব্রহ্মপুত্রের উপনদী। ময়মনসিংহের উপর দিয়ে ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহ তখন চাঁদপুরে গিয়ে মিলিত হত। ১৭৮৪ সালের ভূমিকম্পের ফলে ব্রহ্মপুত্র তার গতিপথ পরিবর্তন করে। এটি প্রাকৃতিকভাবে ঘটে যাওয়ায় আশঙ্কার কিছু নেই। কিন্তু বড় আশঙ্কার কথা হল, নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে ভারতে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের আয়োজন শুরু করেছে।

১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা লাভের পরপরই ভারতের বিশিষ্ট প্রকৌশলী ও তৎকালীন নেহেরু মন্ত্রিসভার পানিসম্পদমন্ত্রী ড. কে এল রাও ভারতের সব নদী এবং জলাশয় সংযুক্ত করার এক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার কথা তাঁর 'ওয়াটার রিসোর্সেস অব ইন্ডিয়া'তে ব্যক্ত করেন। ১৯৮০ সালের দিকে পরিকল্পনাটি পুনর্জীবিত করা হয়। ২০০৩ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী পরিকল্পনাটির ব্যাপারে একটি টাস্কফোর্স গঠন করে ভারতকে বন্যা ও খরামুক্ত করার ঘোষণা দেন।

বাজপেয়ীর আমলে ভারত প্রথম যে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের অবতারণা করেছিল, নরেন্দ্র মোদী সরকার আবার নবউদ্যমে সে কাজে হাত দিয়েছেন। যদিও এতদিন সেগুলো মোটা দাগে পশ্চিম ও মধ্য ভারতেই সীমাবদ্ধ ছিল; তার আওতায় ছিল কেন, বেতওয়া, তাপী, নর্মদা বা দমনগঙ্গার মতো দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে এমন সব নদী।

প্রকল্প বাস্তবায়নে দেশের বিভিন্ন রাজ্যের সেচমন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকের পর ভারতের জলসম্পদ প্রতিমন্ত্রী সানওয়ার লাল জাট ঘোষণা করেছেন, সরকারের পাঁচ নং প্রকল্পটা হবে মানস-সঙ্কোশ-তিস্তা-গঙ্গার মধ্যে সংযোগ ঘটানো; এ সবগুলোই আন্তর্জাতিক নদী। আন্তর্জাতিক নদী হওয়ায় ভারতের এই মহাপ্রকল্প প্রভাবিত করবে আশপাশের দেশ, সমাজ তথা সমগ্র জীবনব্যবস্থা।

আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প যে অবাস্তব ও অগ্রহণযোগ্য, তা স্বীকার করেছেন ভারতের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সদস্য ড. মিহির শাহ। তিনি গৌহাটিতে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে এই প্রকল্পের ব্যাপারে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেন।

(ইকোনমিক টাইমস, ৭ মার্চ ২০১৩)

কারণ, আন্তঃনদী সংযোগ পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য হল ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা, যেখানে জল উদ্বৃত্ত বলে ধরা হয়, সেখান থেকে গঙ্গায় এবং পরে পূর্ব ও দক্ষিণ ভারতে জল নিয়ে যাওয়া। দিল্লিতে 'সাউথ এশিয়া নেটওয়ার্ক অন ড্যাম, রিভার্স অ্যান্ড পিপল'এর কর্ণধার হিমাংশু ঠক্কর বলছেন, দেশে আন্তঃনদী সংযোগ পরিকল্পনার মূল প্রকল্প কিন্তু আসলে এটাই। ঠক্কর আরও বলেন–

"পরিবেশগত ও অন্য নানা কারণে এর বাস্তবায়ন সম্ভব নয় বলেই আমার ধারণা। তাছাড়া ব্রহ্মপুত্রে বর্ষাকালে যখন জল উদ্বৃত্ত থাকে তখন গঙ্গাতেও তো বন্যা, ফলে বাড়তি জল তখন কীভাবে আপনি গঙ্গায় নিয়ে আসবেন?"

আরেক নদী-বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র, যিনি তিস্তার জলের পরিমাণ নিয়ে সমীক্ষার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হয়ে দায়িত্ব পালন করেছিলেন, সেই তিনিও কিন্তু এই মানস-সঙ্কোশ-তিস্তা-গঙ্গা প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব আশাবাদী হওয়ার কারণ দেখেন না বাস্তবিক কারণেই।

অন্তত গোটা পঞ্চাশেক নদী অতিক্রম করে এই প্রকল্পের জন্য পূর্ব থেকে পশ্চিমমুখী খাল কাটতে হবে। এলাকাটা যাবে ডুয়ার্সের ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এবং বর্ষায় এই নদীগুলো ভয়ঙ্কর চেহারা নেয়, তার জন্য ভায়াডাক্টও বানাতে হবে। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, প্রযুক্তিগতভাবে বেশ কঠিন কাজ সেটা। আর পরিবেশের ওপর প্রভাবটাও দেখতে হবে। এ আশঙ্কা জানান পশ্চিমবঙ্গ সরকারও। রুদ্র বলেন–

"এ ধরনের কোনো প্রকল্পে সরকার সম্মতি দেবে না বলেই আমার ধারণা।"

আন্তঃনদী সংযোগ মহাপ্রকল্পের অংশ হিসেবে যেসব নদীর অববাহিকায় উদ্বৃত্ত পানি থেকে তা অন্য অববাহিকায় যেখানে ঘাটতি রয়েছে সেখানে স্থানান্তর করা। এর মধ্যে ১৮টি নদী হিমালয় অঞ্চলের ও ২০টি উপদ্বীপ অঞ্চলের। এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ভারত সরকার সারা দেশে ৭৪টি জলাধার ও বেশকিছু বাঁধ নির্মাণ করবে। এর মাধ্যমে দেশটিতে তারা আড়াই কোটি হেক্টর জমি সেচের আওতায় এনে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করবে। এরই মধ্যে তারা ১১টি সংযোগ খালের সমীক্ষা সম্পন্ন করে ফেলেছে।

ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পগুলো হল: তিস্তা-গঙ্গা-মানস-সঙ্কোশ, কোশি-মেচি, কোশি-ঘাঘড়া, গন্ধক-গঙ্গা, গঙ্গা-যমুনা, সারদা-যমুনা, যমুনা-পশ্চিম যমুনা খাল থেকে শবরমতি সংযোগ পর্যন্ত রাজস্থান খালের সম্প্রসারণ, চুনার-শোন বাধ সংযোগ, শোন বাধ-গঙ্গা সংযোগের দক্ষিণাঞ্চলীয় উপনদী, গঙ্গা-দামোদর সংযোগ, ফারাক্কা-সুন্দরবন সংযোগ ও ব্রহ্মপুত্র-গঙ্গা (জেটিএফ) সংযোগ।

আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের অংশ হিসেবে আসাম, পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারের 'তিস্তা-গঙ্গা-মানস- সঙ্কোশ' নদী সংযোগ প্রকল্পের কাজ শুরু হবে বলে ১৩ জুলাই ভারতের প্রভাবশালী প্রায় সব পত্রপত্রিকায় রিপোর্ট ছাপা হয়েছে। এ সংবাদ সমর্থন করে পানিসম্পদমন্ত্রী সানোয়ার লাল জাট জানান, তাঁর মন্ত্রণালয় আসাম, পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নদীসংযোগ প্রকল্প 'তিস্তা-গঙ্গা-মানস-সঙ্কোশ'এর কাজ শুরু করবে।

সানোয়ার লাল জাট আরও নিশ্চিত করেন, এ প্রকল্প এ অঞ্চলের কৃষি ও পানির প্রাপ্যতা আগের চেয়ে অনেক সহজ করে তুলবে; একই সঙ্গে তা দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে বিপুল পানি সরবরাহ নিশ্চিত করবে। ভারতের 'ন্যাশনাল ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি' প্রায় দুদশকের পর্যবেক্ষণে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ৩৮টি নদীসহ বিভিন্ন নদীর মধ্যে ৩০টি সংযোগ খাল স্থাপনের পরিকল্পনা করে।

নদীকেন্দ্রিক বৃহত্তম এই প্রকল্পের পক্ষের আগে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট একটি রায় দিলে, তা বিতর্কের ঝড় তোলে। ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১২ তারিখে দেওয়া এই রায়ে বিচারিক প্যানেলের প্রধান বিচারপতি এস. এইচ. কাপাডিয়া বলেন–

"প্রকল্পটি জাতির উপকারের জন্য। কিন্তু এটি করতে ১০ বছরেরও বেশি সময় লাগছে। এ জন্য এটি শিগগিরই বাস্তবায়ন করতে হবে।"

বলা হয়, এটি বিহারের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হবে। যেহেতু বেশিরভাগ নদীর পানি বিহারের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয় এবং এর মাধ্যমে নদীর অতিরিক্ত পানি সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হলে বিহারে বন্যার প্রকোপ কমবে।

বিচারিক বেঞ্চের অন্য বিচারপতি ছিলেন বিচারপতি সাওয়াটানটার কুমার ও এ কে পাটানিক। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বিচারিক বেঞ্চ সরকারের বিভিন্ন বিভাগ, মন্ত্রণালয়, বিশেষজ্ঞ ও সমাজকর্মীদের নিয়ে একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কমিটি গঠন করেন। পানিসম্পদমন্ত্রী, সচিব, বন ও পরিবেশ সচিব এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা কমিশন এবং বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের চারজন বিশেষজ্ঞ নিয়ে এই কমিটি গঠিত হবে। এটি ছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ীর একটি স্বপ্নের প্রকল্প। তিনি ২০০২ সালের অক্টোবরে একটি টাস্ক ফোর্স গঠন করেছিলেন খরা থেকে ওই এলাকা বাঁচাতে।

আদালত আরও বলেন–

"আমরা সরকারকে এই প্রজেক্ট বাস্তবায়নের জন্য নির্দেশনা দিচ্ছি। কমিটি এই প্রজেক্ট বাস্তবায়নের জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন করবে।"

তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, ভারত এই রায়ের আগেই এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন শুরু করে দেয়। ভারতের ১২ হাজার কোটি মার্কিন ডলার ব্যয়ে এই প্রকল্পের পরিকল্পনা তৈরির কাজ ২০১৬ সালের মধ্যে সম্পন্ন হবে বলে জানা গেছে। প্রকল্পের আওতায় ১৭ হাজার ৩০০ কোটি ঘনমিটার পানি গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র থেকে প্রত্যাহার করে ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ অঞ্চলের শুকনো এলাকায় নিয়ে যাওয়া হবে।

প্রকল্পটির লক্ষ্য হল, দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তর এই পানি-প্রবাহ ব্যবহার করে ১২ হাজার ৫০০ কিলোমিটার খাল খনন, তিন কোটি ৫০ লাখ হেক্টর জমিতে সেচ প্রদান এবং ৩৪ হাজার মেগাওয়াট পানিবিদ্যুৎ উৎপাদন। এছাড়া নৌ-চলাচল ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং খরা পরিস্থিতিও এভাবে মোকাবিলা করা হবে।

ভারত সরকার তার নিজ দেশের কৃষি, সেচ ও জলবিদ্যুতের প্রয়োজন মেটানোর তাগিদে যে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে তাতে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল, উত্তর-মধ্যাঞ্চল, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও দক্ষিণ-মধ্যাঞ্চলের শাখা নদীগুলোর পানি-প্রবাহ আশঙ্কাজনক হারে কমে যাবে। ভারতজুড়ে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের প্রভাব বিবেচনায় বাংলাদেশের পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব সংযোগ খালের মাধ্যমে পানি প্রত্যাহার করা হলে বাংলাদেশের বিশাল অংশ কার্যত মরুভূমিতে পরিণত হবে।

এই মরুময়তার থাবায় মানুষের জীবনযাত্রা, প্রকৃতি ও কৃষিতে বিপর্যয় নেমে আসবে। আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা ও গঙ্গা নদীর পানি-প্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর শুকিয়ে যাবে জলাভূমিগুলোও, যার লক্ষণ এখনই দেখা যাচ্ছে। লবণাক্ততা দেশের মধ্যাঞ্চল পর্যন্ত উঠে আসতে পারে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি কমে গেলে। ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে ইতোমধ্যেই দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে আশঙ্কাজনকভাবে।

ব্রহ্মপুত্রের ওপর নির্ভরশীল বাংলাদেশ অংশ যেখানে ধান ও গমের মোট উৎপাদনের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ হয়ে থাকে সে অঞ্চল পানির অভাবে নিষ্ফলা ধূসর মরু হয়ে যেতে পারে। গঙ্গার ওপর নির্ভরশীল দেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটবে। নদীর সঙ্গে সম্পৃক্ত কৃষি, মৎস্য, পশুসম্পদ, শিল্প-কারখানা বিপর্যস্ত হবে। পাশাপাশি আর্সেনিক দূষণ তীব্র হবে, নদীর নাব্যতা কমে গিয়ে নৌ-চলাচল ব্যাহত হবে, ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাবে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন।

ভাটির দেশ হিসেবে এই প্রকল্পে বাংলাদেশের ক্ষতি হবে কি না, তা সমীক্ষা না চালিয়েই তারা এটা বাস্তবায়ন করতে গেলে আমাদের পরিবেশ ও প্রতিবেশ সমূহ হুমকির মুখে পড়বে।

"We never know the worth of water till the well is dry."

— Thomas Fuller, Gnomologia

একচেটিয়া কর্তৃত্বের চূড়ান্ত প্রকাশের অংশ এই উচ্চাভিলাষী প্রকল্প, যা নিয়ে খোদ ভারতের পরিবেশবিদরাই আশঙ্কা ব্যক্ত করছেন। ভারতীয় পরিবেশবাদী বন্দনা শিভা এর বিরোধিতা করে বলেন–

"এতে ভাটির অঞ্চলে মরুপ্রবণতা আমন্ত্রণ জানানোর আয়োজন ছাড়া কিছু না।"

এশিয়ার পানি সংকটবিষয়ক ওয়েবসাইট thethirdpole.net সম্প্রতি এক নিবন্ধে ভারতীয় পরিবেশবাদীদের উদ্ধৃত করে বলেছে–


"এ ধরনের প্রকল্পে নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহ বদলে যাবে। সৃষ্টি হবে জলাবদ্ধতা। অসংখ্য মানুষ বাস্তুহারা হবে। নদীর পলিপ্রবাহ ব্যাহত ও মৎস্যসম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ডুবে যাবে অসংখ্য বন আর খোলা মাঠ। এর কারণে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হবে।"

ভারতীয় বেসরকারি সংস্থা 'ইয়ামুনা জিয়ে আভ্যিয়ান'এর কর্মকর্তা মনোজ মিশ্র বলেছেন–

"এটি আসলে একটি পরস্পরবিরোধী নীতি। নদী কোনো পাইপলাইন নয় যে তাকে সংযুক্ত করা যাবে।"

এই প্রকল্পে বাংলাদেশের ক্ষতি হবে কি না তা সমীক্ষা না চালিয়েই ভারত এটা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক আইন ও গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি অনুযায়ী ভারত একতরফাভাবে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারে না, যা দুই দেশের বিদ্যমান চুক্তি অনুযায়ী আইনের লঙ্ঘন। বাংলাদেশে প্রবাহিত হয় এমন বেশ কিছু নদীতেই সংযোগ খাল স্থাপন করে পানি প্রত্যাহার করার পরিকল্পনা রয়েছে এ প্রকল্পে।

আন্তর্জাতিক নদীগুলোর পানি-প্রবাহ নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য উভয় দেশের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ১৯৭২ সালের ২৪ নভেম্বরে উভয় দেশের মধ্যে সম্পাদিত মোট ৯টি ধারা সংবলিত একটি সনদ চুক্তি সম্পাদিত হয়। এতে দুটি বন্ধুরাষ্ট্র তাদের অভিন্ন নদীগুলোকে উভয় রাষ্ট্রের জনগণের জন্য কল্যাণকর ব্যবহারের উদ্দেশ্যের কথা ঘোষণা করেছে। সনদের দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৫ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে:

"কোনো দেশ আন্তর্জাতিক পানি-প্রবাহের যে অংশ তার ভূখণ্ডের মধ্যে পড়েছে সে অংশের ব্যবহারের ক্ষেত্রে 'ন্যায়ানুগ ও যুক্তিযুক্ততার নীতি' মেনে চলবে।"

সহজ করে বললে বলা যায়, একটি আন্তর্জাতিক পানি-প্রবাহ এমনভাবে ব্যবহার করতে হবে, যাতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো সর্বোচ্চ সুবিধা পায়; একই সঙ্গে পানি-প্রবাহটি যাতে সুরক্ষা পায়।

অনুচ্ছেদ ৬ নংয়ে বলা হয়েছে–

"পানি-প্রবাহের ব্যবহারে ৫ নং অনুচ্ছেদে ঘোষিত 'ন্যায়ানুগ ও যুক্তিযুক্ততার নীতি' মানা হচ্ছে কি না, তা বিবেচনায় নিতে হবে এবং তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমেই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হবে।"

৭ নং ধারায় বলা হয়েছে–

"আন্তর্জাতিক পানি-প্রবাহ ব্যবহারকারী কোনো একটি দেশ তার নিজের এলাকায় বহমান অংশটি যখন ব্যবহার করবে, তখন অপর দেশটির যাতে 'উল্লেখযোগ্য' ক্ষতি না হয় তার জন্য প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। যে ক্ষেত্রে এ রকম ক্ষতি সংঘটিত হয়েছে সে ক্ষেত্রে ৫ ও ৬ নং ধারার উল্লিখিত নীতিমালার আলোকে তা দূর করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। উপযুক্ত ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের আলোচনা করতে হবে।"

১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ গঙ্গার পানি ভাগাভাগি নিয়ে ভারতের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির প্রস্তাবনার ৩ নং অনুচ্ছেদে বলা রয়েছে–

"আন্তর্জাতিক নদীগুলোর পানি ভাগাভাগি ও এসব নদীতে প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে দুই দেশের জনগণের সুবিধা বিবেচনা করে দেখা হবে।"

চুক্তির ৯ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে:

"দুই দেশের সরকার ন্যায়বিচার, ন্যায্যতা ও কারো ক্ষতি করা নয়– এসব নীতিমালার আলোকে যৌথ নদীর পানি ভাগাভাগি করতে সম্মত আছে।"

সুতরাং এই চুক্তির আওতায় ভারত কোনোভাবেই একতরফাভাবে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারে না। আসলে এই প্রকল্প নিয়ে ভারতের ভেতরে ঐকমত্য তৈরি করা যেমন জরুরি, তেমনি ভুটান ও বাংলাদেশেরও কিন্তু এখানে সম্মতি প্রয়োজন।

"A river seems a magic thing. A magic, moving, living part of the very earth itself."

-― Laura Gilpin

নদীবিজ্ঞানী প্যাট্রিক ম্যাককুলি তাঁর 'দ্য সাইলেন্সড রিভারস' বইয়ে বলছেন–

"নদী আর বড় বাঁধ দুটি পরস্পরবিরোধী অস্তিত্ব, এরা একসঙ্গে টিকে থাকতে পারে না। একটি আরেকটির সংহার নিশ্চিত করে।"

ভারতের বিহারের সাম্প্রতিক বন্যা এই মতের অনুমোদন দেয়। জাতীয় বা আন্তর্জাতিক যে কোনো সমস্যা বা বিরোধের ইতিবাচক সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জনসচেতনতা ও সমর্থন কূটনৈতিক আলোচনায় সরকার ও রাষ্ট্রের অবস্থান প্রভাবিত করতে শক্তিশালী বুদ্ধিবৃত্তিক ক্যাম্পেইন দরকার। এ বিষয়ে দুদেশের সচেতন জনসমষ্টির সম্মিলিত সক্রিয়তা প্রকৃতি-সংহারী কাজের রক্ষাকবচ হতে পারে।