শেখ হাসিনা কি এখনও টার্গেটে?

বিজন সরকার
Published : 17 Sept 2016, 01:10 PM
Updated : 17 Sept 2016, 01:10 PM

দেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক চেতনার মানুষ আদর্শিক ক্ষেত্রে কিছুটা বিচ্যুতিতে রয়েছে। তবে একটি ক্ষেত্রে মোটা দাগের একটি মিল পাওয়া যায়। বিশ্বের নানান প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে প্রগতিশীল চিন্তার অগণিত বাঙালি প্রতিনিধি। তাদেরও রাজনৈতিক ভাবনা মোটা দাগের মধ্যেই পড়ে, বিশেষ করে যখন দেশের প্রগতিশীল রাজনীতির ভবিষ্যতের প্রশ্নটি সামনে আসে।

প্রশ্নটি হল দেশের প্রগতিশীল রাজনীতির ঐক্যের প্রতীক বঙ্গবন্ধু-তনয়া শেখ হাসিনা, যাঁকে ঘিরে দেশের প্রগতিশীল আদর্শ ক্রমে শক্তিশালী হচ্ছে, সেই মানুষটি কি এখনও অপশক্তির টার্গেটে রয়েছেন? যদি তিনি এখনও টার্গেটে থেকেই থাকেন, তবে কাদের টার্গেটে রয়েছেন?

প্রশ্নটির যথার্থ উত্তর দেওয়ার জন্য দুই ধরনের অপশক্তি বিবেচনায় নেওয়া যায়– এক. দেশীয় অপশক্তি এবং দুই. বিদেশি অপশক্তি। তবে ভূ-রাজনৈতিক নতুন বাস্তবতার কারণে নতুন নতুন মেরুকরণ হচ্ছে। ফলে শেখ হাসিনাকে যে সব বিদেশি অপশক্তি টার্গেটে নিয়েছিল, নতুন মেরুকরণের ফলে তাদের মধ্যে পরিবর্তন এসেছে।

কয়েক দশক ধরে চলা প্রচলিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত বহু ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণ স্রেফ ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যাচ্ছে এখন। সোজাভাবে বলা যায়, বেশ কিছু নতুন ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ইতোমধ্যে জন্ম নিয়েছে। আরও কিছু নতুন প্রেক্ষাপট আসন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পরপরই স্পষ্ট হবে।

পরিবর্তিত ভূ-রাজনীতির কারণে শেখ হাসিনাকে উৎখাত-প্রত্যাশীদের মধ্যেও নতুন সমীকরণ যোগ হয়েছে। অধিকন্তু বিশ্বব্যাপী জঙ্গিবাদ, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিতিশীল অবস্থাও শেখ হাসিনা উৎখাত-প্রত্যাশীদের ওপর তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে। পরিবর্তিত ভূ-রাজনীতি ও মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গিবাদ-প্রসববান্ধব সামাজিক আদর্শের জন্য পশ্চিমা বিশ্ব উদ্বিগ্ন। এমতাবস্থায় তারাও এই সমস্যার লাগাম টানতে চাইছে। এসব পরিবর্তন বাংলাদেশের মতো দেশগুলির প্রগতিশীল শাসনব্যবস্থাকে আগের চেয়ে নিরাপদ করছে। তবে পুরোপুরি ঝুঁকিমুক্ত নয়। সোজাভাবে বললে, পরিবর্তনশীল নতুন বিশ্বে শেখ হাসিনার মতো প্রগতিশীল নেতৃত্ব বহুলাংশে কম হুমকির মুখে রয়েছেন।

শেখ হাসিনাকে নিকাশ করার বহু চেষ্টাই হয়েছে। এতে জড়িত দেশীয় ও আন্তজাতিক গোষ্ঠী। তবে শেখ হাসিনাকে উৎখাতে দেশীয় গোষ্ঠীর ভূমিকা যদি বিশ্লেষণ করি, একটি উপসংহার টানা যায়। সেটি হল, শেখ হাসিনাকে উৎখাতে বিশ্বাসী দেশীয় অংশটি আজীবন চেষ্টা চালিয়ে যাবে; বিদেশি কোনো চক্রান্তকারীর সমর্থন থাকুক বা না-ই থাকুক।

শেখ হাসিনা সরকার উৎখাতের চেষ্টা ২০১০ সাল থেকে বেশি গতি পেয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হওয়ার পর থেকেই দেশি-বিদেশি জঙ্গিবান্ধব রাষ্ট্র ও গোষ্ঠীগুলি বহুমাত্রিক পদ্ধতিতে শেখ হাসিনা সরকার উৎখাত প্রকল্পে অনুপ্রেরণা দিয়ে যায়। এই অপচেষ্টা চলে ২০১৪ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত। এরপর থেকে পুরো বিষয়টি রিভার্স হয়ে যায়।

বিদেশি শক্তির বড় একটি অংশ ভূ-রাজনীতির নব্য মেরুকরণের ফলে শেখ হাসিনা সরকার উৎখাত প্রকল্প থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছে। এমন পরিকল্পনা এখন পশ্চিমাদের নেই বলেই ধারণা করা যায়। তবে দেশীয় কিংবা আঞ্চলিক কোনো গোষ্ঠী যদি শেখ হাসিনাকে সরিয়ে দেয়, সেটিতে তারা অখুশি না-ও হতে পারে। দেশীয় গোষ্ঠীর সঙ্গে আঞ্চলিক জঙ্গিগোষ্ঠীগুলি সরকারবিরোধী কথিত গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তিগুলির প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ মদদে এখনও সেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

আরব বিশ্বের তেল সমৃদ্ধ দেশগুলোর মতো বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদের প্রতি পশ্চিমা বিশ্বের, বিশেষ করে আমেরিকার ততটা আগ্রহ দেখা যায় না। বাংলাদেশকে নিয়ে আমেরিকার মৌলিক উদ্দেশ্য ছিল দেশটিকে কৌশলগতভাবে ব্যবহার করা। চীনের অর্থনৈতিক ও সামরিক উত্থানকে রুখতে বাংলাদেশের দক্ষিণে একটি মার্কিন নৌঘাঁটির প্রয়োজন ছিল। তবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ থাকাতে আমেরিকার ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ বাধাগ্রস্ত হয়েছে।

বাংলাদেশকে নিয়ে আমেরিকার মাথাব্যথা অনেক আগে শুরু হলেও ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পরে সেটি বেড়ে গিয়েছিল, বিশেষ করে শেখ হাসিনার বর্তমান নেতৃত্ব যখন আমেরিকার স্বার্থের বিপরীতে। ১৯৯৬-২০০১ সালের শাসনামলে আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের গ্যাস রপ্তানির প্রস্তাবটি নাকচ করে দেওয়া ছাড়া শেখ হাসিনার তেমন কোনো শক্ত অবস্থান লক্ষ্য করা যায়নি। কিন্তু ২০০৮ সালের পর শেখ হাসিনা অনেকগুলো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যা সরাসরি এই অঞ্চলে আমেরিকার ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের পরিপন্থী। বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিব যেখানে পশ্চিমা দুনিয়া নিয়ে তেমন কিছু বলতেন না, সেখানে শেখ হাসিনা সরাসরি এই পুঁজিবাদীদের স্বার্থের প্রতিকূলে অবস্থান নিয়েছেন।

দক্ষিণ চীন সাগরে বিতর্কিত সামুদ্রিক সীমানায় চীন কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি করছে। তারা ২০১৩ সালে নভেম্বরে পূর্ব চীন সাগরকে 'এয়ার ডিফেন্স আইডেন্টিফিকেশান জোন' (ADIZ) ঘোষণা করে। ফলে এই অঞ্চলে আমেরিকার কর্তৃত্ব প্রশ্নের মুখে পড়ে। কেবল আমেরিকা নয়, চীনের প্রতিবেশী সব রাষ্ট্রই এর বিরোধিতা করছে। চীন বিতর্কিত দ্বীপে সামরিক ঘাঁটি বানাচ্ছে।

ফিলিপাইন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, অস্ট্রেলিয়া ও কম্বোডিয়া চীনের আগ্রাসন নীতির তীব্র প্রতিবাদ করে আসছে। তবে কোনো রাষ্ট্র চীনের বিপক্ষে শক্ত অবস্থান নেয়নি, নেওয়ার সাহসও দেখায়নি। ফলে চীনকে রুখতে আমেরিকাও তেমন ভরসা পাচ্ছিল না।

ভারত এখন সরাসরি চীনের আগ্রাসন নীতির বিরোধিতা করছে। ভারত চীনকে টেক্কা দিয়ে ভিয়েতনামে বড় ধরনের নৌঘাঁটি বানিয়েছে। মরিশাসেও রয়েছে ভারতীয় নৌঘাঁটি। অস্ট্রেলিয়াতে ভারতীয় নৌঘাঁটি বানানোর জোর আলোচনার কথা শোনা যায়। দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের অন্যায় ও আগ্রাসন নীতির বিরোধিতাকারী প্রতিটি রাষ্ট্রের সঙ্গে আরও কীভাবে সামরিক সম্পর্ক জোরদার করা যায় ভারত সে দিকে নজর দিয়েছে। পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের ভেতর দিয়ে চীনের অর্থায়নে চীন-পাকিস্তান ইকোনোমিক করিডোরের (সিপেক) ভারত তীব্র বিরোধিতা করছে। চীন যে পাকিস্তানের জঙ্গিবাদের ইস্যুতে নীরব এবং বহুলাংশে সমর্থন দিচ্ছে– ভারত চীনকে তা সরাসরি জানিয়ে দিয়েছে।

চীনও ভারতকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলার সব চেষ্টাই করছে। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল এবং এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে দেশটির নৌ-সেনারা নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে সচেষ্ট। একই সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে অর্থনৈতিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল এবং এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল চীনের সামরিক উত্থানবিরোধী শ্লোগানকে নীরব করতে চাইছে। উদাহরণ: চীন কম্বোডিয়াতে ছয় বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। ফলে কম্বোডিয়া অত্র অঞ্চলে চীনের উত্থান নিয়ে আগের মতো সোচ্চার নয়। অস্ট্রেলিয়াতে চীন ১১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। ফলে অস্ট্রেলিয়াও স্পষ্ট কোনো অবস্থান নিচ্ছে না বলে আমেরিকার অভিযোগ রয়েছে। আমেরিকা অস্ট্রেলিয়াকে নানাভাবে চাপও দিচ্ছে।

চীন আন্তর্জাতিক ফোরামে ভারতকে সুযোগ না দেওয়ার নীতি গ্রহণ করছে। কিছুদিন আগেই চীনের বিরোধিতার কারণে পরমাণু সরবরাহকারী (এনএসজি) দেশগুলির তালিকায় ঠাঁই পায়নি ভারত। এমনকি ভারতের মাথাব্যথার কারণ জঙ্গি সংগঠন জইশ-ই-মুহাম্মদের প্রধান মাসুদ আজহারকে চীনের ভেটোর কারণে জাতিসঙ্ঘ জঙ্গি হিসেবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে পারেনি। তবে দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের নব্বই শতাংশের দাবি আন্তর্জাতিক আদালতে বাতিল হয়ে যাওয়ায় চীন সমস্যা পড়ে যায়। অনেকটা নরম সুরে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য চীন ইচ্ছা প্রকাশ করে।

চীনের বিপক্ষে ভারতকে পেতে আমেরিকার প্রায় দেড় দশক অপেক্ষা করতে হয়। ভারত ও আমেরিকার মধ্যকার সম্পর্ক বছর দুয়েক আগেও কৌশলগত ছিল। ভারতের কূটনৈতিক দেবযানীকে গ্রেপ্তার এবং বাংলাদেশের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে উভয় দেশের প্রতিক্রিয়ায় তা ভালোভাবেই প্রতিফলিত হয়েছে।

তবে ভারত-আমেরিকার বর্তমান সম্পর্ক অন্য একধরনের উচ্চতায় বিরাজ করছে। চীনের বিপক্ষে ভারতকে পাওয়ার জন্য আমেরিকা পাকিস্তান ও বাংলাদেশকেও কৌশলে ব্যবহার করেছে। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় বাংলাদেশকে আমেরিকা নিজের অনুকূলে ব্যবহারের সুযোগ পেয়ে যায়। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। পশ্চিম ফ্রন্টের ন্যায় পূর্ব ফ্রন্টের সীমান্ত নিয়েও ভারতের ঘুম হারাম হয়ে যায়। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের নেতৃত্বে আমেরিকা ভারতের কৌশলগত অংশীদার হয়। তখনই ভারত ও আমেরিকার মধ্যে বেসামরিক পারমাণবিক চুক্তি হয়।

পরাশক্তি রাশিয়ার ক্ষয়িষ্ণু অবস্থা, প্রতিবেশী চীনের সামরিক ও অর্থনৈতিক উত্থান এবং জঙ্গিবাদের আঁতুড় ঘর পাকিস্তানের 'প্রক্সি ওয়ার' ভারতকে আমেরিকার দিকে ঝুঁকতে অনুপ্রেরণা দেয়। জামায়াত-বিএনপি সরকারকেও জঙ্গিবাদের কারণে চাপে ফেলে আমেরিকা তাইওয়ানকে বাংলাদেশে মিশন খুলতে পুরো সহযোগিতা দেয়। খুব সম্ভবত ঘটনাটি ২০০৪ সালে ঘটে। তাইওয়ান বাংলা মটর এলাকায় তাদের অফিস খুলেছিল। পরে চীনের প্রবল চাপে চীনমুখী জামায়াত-বিএনপি সরকার মিশনটি বন্ধ করতে বাধ্য হয়।

ভারত-আমেরিকা এখন বড় ধরনের সামরিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। চীনের উত্থান, বিশেষ করে সামরিক উত্থান এখনও কেবল আমেরিকার নয়, ভারত ও চীনের প্রতিবেশী প্রতিটি রাষ্ট্রের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারত-আমেরিকা গত আগস্ট মাসে বড় ধরনের সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। চুক্তি অনুয়ায়ী দেশ দুটি পরস্পরের সামরিক ঘাঁটি ব্যবহার করতে পারবে। এই চুক্তি দুটি দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে মাইলফলক।

ফলে আমেরিকা দক্ষিণ এশিয়াতে এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চাইবে না, যা ভারতের স্বার্থের পরিপন্থী। বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচন নিয়ে ২০১৪ সাল অবধি ওবামা প্রশাসনের মধ্যম সারির কিছু প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তির আগ্রহ ছিল। অধিকন্তু, হিলারিপন্থী ড. মুহাম্মদ ইউনূস নানাভাবে শেখ হাসিনা সরকারের প্রতি মার্কিন প্রশাসনকে বিরাগভাজন করে তুলতে ভূমিকা রাখেন।

এমনকি যদি কোনো গোষ্ঠী শেখ হাসিনাকে সরিয়েও দিত, সেটি সেই সময়ের মার্কিন প্রশাসনের আকাঙ্ক্ষার সমান্তরালেই থাকত। একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে। তুরস্কের অতি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সামরিক ক্যু ব্যর্থ হওয়ার পর আমেরিকা নিন্দা জানিয়ে গণতন্ত্রের প্রতি সমর্থন দিয়েছে।

তবে ভূ-রাজনীতির নতুন মেরুকরণে বাংলাদেশের প্রতি আমেরিকার অবস্থান পুরো ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যাওয়ার কথা। মার্কিন প্রশাসন বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় দক্ষিণ এশিয়ার এমন কোনো অপচেষ্টা সমর্থন করবে না, সেটি আমেরিকা সামরিক-সঙ্গী ভারতের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে। আমেরিকা এই অঞ্চলে ভারতের সঙ্গে আরও নিবিড় হতে চাইছে। আফগানিস্তানে ভারতের ভূমিকা ছাড়া শান্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। আফগানিস্তানের অস্থিতিশীল অবস্থা আমেরিকা ও ভারতকে একে অন্যের কাছে আসতে বড় ভূমিকা রাখছে।

পাকিস্তানকে ৩০০ মিলিয়ন ডলার আমেরিকার সামরিক সহযোগিতা বাতিল এবং মার্কিন কংগ্রেসে পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করার মতো সিদ্ধান্তগুলি ভারতের পরিকল্পনার প্রতিচ্ছবি। এমতাবস্থায় বলা যায়, কথিত গণতন্ত্রের শ্লোগান তুলে শেখ হাসিনা সরকার উৎখাত করতে গাঁটছড়া বেঁধে আমেরিকাকে মাঠে নামতে আর দেখা যাবে না। এমনকি শেখ হাসিনাকে উৎখাত করার কোনো প্রকল্পে মার্কিনিদের কোনো ভূমিকাও থাকবে না।

এখানে একটি প্রশ্ন হয়তো অনেকেই তুলতে পারেন। যদি হিলারি ক্লিনটন ক্ষমতায় যান, ড. ইউনূসরা কি বসে থাকবেন? প্রথমত, হিলারির হোয়াইট হাউসে যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। দ্বিতীয়ত, হিলারি যদি প্রেসিডেন্ট হন, ড. ইউনূসরা হয়তো একটি চেষ্টা চালাবেন। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, দক্ষিণ এশিয়ায় আমেরিকা ও ভারতের ভূ-রাজনীতির স্বার্থে, বিশেষ করে নিরাপত্তার প্রশ্নে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার মতো একজন বলিষ্ঠ নেতার বড় প্রয়োজন। এই প্যারামিটারের কাছে ড. ইউনূসদের ক্ষমতার খায়েশ মিটানো খুবই গৌণ হয়ে উঠবে।

অন্যদিকে আরব বিশ্ব, বিশেষ করে যে উপসাগরীয় দেশগুলি দশকের পর দশক ধরে মুসলিম বিশ্বব্যাপী উগ্র রাজনৈতিক আদর্শ 'ওহাবিজম' প্রচারে বিলিয়ন বিলিয়ন পেট্রো-ডলার ব্যয় করেছে। তাদের প্রচারিত সেই আদর্শ এখন তাদের জন্যই 'ব্যাকলাশ' হয়ে দেখা দিয়েছে। সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি হচ্ছে, ধনী রাষ্ট্র সৌদি আরবের প্রয়োজনে দেশটির মিত্র কাউকে পাশে পাচ্ছে না। ইয়েমেনের উপর অন্যায় যুদ্ধ চালিয়ে সৌদি আরব বড় ধরনের সমস্যায় রয়েছে। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে সরাতে গিয়ে আইএসের অন্যতম নির্মাতা সৌদি আরব নিজেই আইএসের বড় হুমকিতে রয়েছে। বাশার আল আসাদকে সিরিয়ার ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে, তা আর উঁচু গলায় এখন সৌদি আরব বলে না।

সৌদি আরবের বিশ্বস্ত বন্ধু বলতে কেউ নেই। দেশটি দশকের পর দশক পেট্রো-ডলার ব্যয় করে পশ্চিমা দেশগুলির সঙ্গে বন্ধুত্ব টিকিয়ে রেখেছিল। এখন আর সেই অবস্থানটি নেই। দক্ষিণ কোরিয়াকে রক্ষার জন্য যেভাবে গুয়াম বিমানঘাঁটি থেকে মার্কিন পারমাণবিক বোমা বহনকারী যুদ্ধবিমানগুলি উত্তর কোরিয়ার আকাশে টহল দিয়েছে, সৌদি আরবের ক্ষেত্রে বর্তমান বাস্তবতায় সেটির সম্ভাবনা কম। এমনকি পাকিস্তানও সৌদি আরবের পাশে দাঁড়াতে আগ্রহী নয়; অথচ সৌদি আরব থেকে সবচেয়ে সুবিধা গ্রহণকারী একক দেশ হিসেবে পাকিস্তানের নাম সবার উপরে।

সৌদি আরব নিজের নিরাপত্তা ও অর্থনীতি নিয়েই শঙ্কিত। আইএসের উত্থান প্রাথমিক ধাপে সৌদি আরব কাজে লাগিয়ে সিরিয়ার বাশার আল আসাদ সরকারকে সরাতে চেয়েছিল। আইএস আর হাতে থাকেনি। এখন আইএস সৌদি আরবের জন্যই বড় হুমকি। সৌদি আরবের সরকার বাধ্য হয়েই মসজিদের খুতবা নিয়ন্ত্রণ করছে। যে আন্তঃধর্মীয় বিদ্বেষ পুঁজি করে বিলিয়ন বিলিয়ন পেট্রো-ডলার ওহাবিজম সৌদি আরব সারা বিশ্বব্যাপী মার্কেটিং করেছে, সেই ওহাবিজম কীভাবে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখা যায়, সৌদি আরব সেই চেষ্টায় লিপ্ত। যেখানে খোদ সৌদি আরব ধর্মীয় উগ্রবাদবান্ধব কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করতে শুরু করেছে, মধ্যপ্রাচ্যের বাকি দেশগুলির কথা আর না-ই বা বললাম।

এমতাবস্থায়, সৌদি আরব অন্যান্য সুন্নিপ্রধান দেশগুলিতে আর ধর্মীয় উগ্রবাদ প্রসারে রাষ্ট্রীয়ভাবে সহযোগিতা দেবে না বলেই ধারণা করা যায়। কারণ, সৌদি আরব অনেকটা জ্বলন্ত কড়াইয়ের ওপর রয়েছে। আইএসের বিদেশি যোদ্ধাদের এক-পঞ্চমাংশ সৌদি নাগরিক। ফলে বাংলাদেশের ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠী ও জঙ্গিবাদ প্রসারে যে অর্থনৈতিক ও আদর্শিক সমর্থন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি থেকে আসত, সেটি ক্রমে কমে যাবে। তাই বলা যায়, যে উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলো দশকের পর দশক শেখ হাসিনাকে নিকাশের জন্য হন্যে হয়ে সুযোগ খুঁজছে, তাদেরও এখন নতুন করে হিসাব মেলাতে হচ্ছে।

শেখ হাসিনা সরকার উৎখাত কনসোর্টিয়ামের আকার ছোট হয়ে আসছে। তবু এখনও দেশি-বিদেশি ধর্মীয় জঙ্গিগোষ্ঠী ও জঙ্গিবান্ধব রাজনৈতিক দল, সুবিধাবাদী বিএনপি, পাকিস্তানি আইএসআইসহ সমমনা শক্তিগুলো একসঙ্গে কাজ করে যাবে।